নীলকান্ত শইকীয়া’র একগুচ্ছ অসমিয়া কবিতার বাংলা অনুবাদ
এক সময় অসমের নাম ‘কামরূপ’ ছিল। আরও প্রচীনকালে কামরূপ ছিল ‘প্রাগজ্যোতিষ’ নামে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত। এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা এবং উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় রাজ্য দ্বারা অসম বেষ্টিত এবং অসম সহ প্রতিটি রাজ্যই উত্তরবঙ্গের একটি সংকীর্ণ অংশ দ্বারা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া অসমের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে। চা, রেশম, পেট্রোলিয়াম এবং জীববৈচিত্রের জন্য অসম বিখ্যাত। অসমিয়াদের প্রধান উৎসব হলো বিহু। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অসমিয়ারা বিহু পালন করে। বিহু তিনটি- ব’হাগ (রঙালি) বিহু, মাঘ (ভোগালী) বিহু আর কাতি (কঙালি) বিহু। অসমীয়া সাহিত্য অন্য সমস্ত ভাষার মতো অসংখ্য উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং অন্য অন্য বিষয়ক গ্রন্থে পূর্ণ। অসমীয়া সাহিত্য ভাষাটির বর্তমানের সাহিত্য সম্ভার ছাড়াও এর ক্রমবিবর্তনের সময়ে সৃষ্টি হওয়া পুরানো অসংখ্য সাহিত্যের সম্ভারে পরিপূর্ণ, যে ধারার আরম্ভ ৯ম-১০ম শতকের চর্যাপদ থেকে আরম্ভ হয়েছিল বলে ধরা হয়। অজিৎ বরুয়া, অনন্ত কন্দলী,অনিরুদ্ধ কায়স্থ, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী, আনন্দরাম বরুয়া , ইমরান শাহ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, ভোলানাথ দাস, মফিজুদ্দিন আহমদ হাজারিকা, মহেন্দ্র বরা, মাধবদেব, রবীন্দ্র সরকার, রমাকান্ত চৌধুরী, বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, স্নেহ দেবী, হরিবর বিপ্র, হীরেন ভট্টাচার্য সহ আরো অনেক অসমীয়া ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি আছেন। এই সময়ে অসমীয়াতে কি রকম কবিতা লেখা হচ্ছে কারা লিখছেন, এই সময়ের কবি নীলকান্ত শইকীয়া’র কবিতা নিয়ে আজকের আয়োজন। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন অনুবাদক বাসুদেব দাস।
১৯৬০ সনে যোরহাটের ঢেকীয়াখোঁয়া গ্রামে নীলকান্ত শইকীয়ার জন্ম হয়। কবিতার সমান্তরাল ভাবে গল্প,ব্যঙ্গ গল্প,শিশু সাহিত্য,গীত,নাটকেরও চর্চা করে থাকেন। প্রকাশিত গ্রন্থ সোনালী শইচর ছেঁই,পেংলোয়া বেলি,মাতর উত্তরাধিকারী,ভুল কথোপকথন,গছ ফুল শিপার আরম্ভনি ইত্যাদি।
ফাঁকির নগরীতে
ফাঁকির এই নগরীতে প্রতিটি লোকই মৃত
কোনো জীবিত মানুষের সন্ধানে
মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন ঈশ্বর।
ঈশ্বর হয়তো স্বার্থপর
সবাই যদি জীবন্মৃত
কে তাকে ঈশ্বর বলবে
কে তার দেখাশোনা করবে।
ঈশ্বর তিনজন মানুষ বেছে নিলেন
তিনজনকেই দিলেন সত্য
তিনজন মানুষকেজীবিত করে
ঈশ্বর হলেন নিশ্চিন্ত।
তিনজনকেই ঈশ্বর দিলেন নির্দিষ্ট দায়িত্বঃ
একজন ধন-দৌলত দেখাশোনা করবে
একজন শান্তির দিকটাতে দৃষ্টি রাখবে
একজন খাদ্যের যোগান দিয়ে ঈশ্বরকে পুষ্টি দান করবে।
তিনদিন পরে সত্য চলে গেল
একজন ঈশ্বরের বিত্তে নিজে ধনী হল
অন্যজন শান্তির নামে অশান্তি ছড়াল
তৃতীয়জন ঈশ্বরের নামে নিবেদন করে সমস্ত খাদ্য
নিজেই খেয়ে ফেলল।
স্বয়ং ঈশ্বর বিমর্ষ হলেন
ফাঁকির নগরী ছেড়ে তিনি পুনরায়
মন্দিরে প্রবেশ করলেন
কিন্তু শিখে গেলেন একটি পরম সত্য
মানুষকে চেনার জন্য কেবল তিনটি দিনের প্রয়োজন।
রাজনৈতিক
সভায় যিনি কথা বলছেন
তিনি,তিনি নন
তিনি তাকে রেখে এসেছেন সেই শিলাটার কাছে
যেখানে একদিন বুদ্ধ বসেছিল।
তিনি যে সমস্ত কথা বলছেন
সেসবও তাঁর নয়
তাঁর কথাগুলি সেখানে ফেলে এসেছে
যেখানে একদিন গান্ধী ঢলে পড়েছিল।
তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলিও
তাঁর নয়
তাঁর হয়ে অন্য কেউ কিছু বলছে
তাঁর এই সাজ-পোশাক,মুখের ভঙ্গিমা
হাতের আস্ফালন সমস্ত কিছু অন্যের।
তিনি বেরিয়ে যেতে চান
কিন্তু অনুচরবর্গ দেয় না
তিনি কাঁদেন-যে চোখের জল বের হয়
তার বাজার মূল্য নিরূপণ করে ভোটের মূল্য।
মুখে তিনি বলেন-এখন কাঁড়ী পাইকের দিন
কাজে কিন্তু তিনি মান্যগন্য মানুষদেরই
যা দেখছি তিনি আর ফিরে যাবেন না
বুদ্ধের শিলাটার কাছে।
টীকা-
কাঁড়ী-আহোম যুগে তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করা এক শ্রেণির মানুষ।
চেয়ার
আমার সামনের চেয়ারটায় একজন মানুষ বসে আছে
তিনি আমাকে কিছু কথা বলছেন।
তাঁর কথার পাকে আমি স্তম্ভিত হয়েছি
বিশৃঙ্খলাময় অতীত
জঁট খুলতে না পারা বর্তমান
আমার সামনে তিনি উন্মোচন করছেন।
কথার পেছন পেছন যেতে যেতে আমি
তাঁর দুঃখের দিনে হাজির হলাম
তাঁর সুখের খবরাখবর নিলাম
তাঁর হাসিতে হাসি
তাঁর কান্নায় কাঁদি
তাঁর জীবনধারার খবর নিলাম।
ধীরে ধীরে তিনি আগুন হলেন তারপরে ছাই
শেষে ধোঁয়া হয়ে উড়ে বেড়াল।
ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া
আমার চোখে ধোঁয়া মনে ধোঁয়া
আমার যা ছিল ধন সম্পদ,পাপ পুণ্য
সমস্ত কিছু ধোঁয়ায় ভাসল।
একসময় যখন এই ধোঁয়া কাণ্ড নাই হয়ে গেল
দেখলাম চেয়ারটায় তিনি নন
আমি বসে আছি-ধোঁয়ায় গড়া চেয়ারে।
বাজেট
টাকাটার পঁচিশভাগ ঘৃণা
পঁচিশভাগ অবজ্ঞা।
লালসা আর ক্রোধ চল্লিশভাগ ঘিরে আছে
বাকি সাতভাগ দুঃখ
তিনভাগ ভালোবাসা।
সেই তিনভাগই প্রতিরোধ করে বিচ্ছেদ
ভাঙতে দেয়না সংসার
পাহারা দিয়ে থাকে
প্রেমের চার সীমানা।

অনুবাদক