| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

নীল প্রজাপতি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

টিভি’র রিমোট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ঘাত আব্বু সরিয়েছে। রোজ সন্ধ্যায় এই হয়েছে নকশা। এস,এস,সি পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার পর থেকে এই কাণ্ড শুরু হয়েছে। সকালে আব্বুর গলা খাঁকারি দিয়ে ড্রইং রুমে আসার পর রিমোট জায়গা মত পাওয়া যায়। তখন স্কুলে স্পেশাল কোচিং-এ যাওয়ার সময়। আর  সন্ধ্যায় দুনিয়া উল্টে গেলেও টিভি দেখা যাবে না। রিমোটের কথা জিজ্ঞাস করলে আম্মু অন্যমনস্ক স্বরে বলে, “কি জানি?” আব্বু পেপার মেলে ধরে। অথচ টেস্ট পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হয়েছি। নিয়ম মেনেই পড়াশোনা করি, তাও…। এই চালাকি না করে ধমক দিলেও পারে। সেটা তারা কখনই দেয় না। কি যে বাবা মা হয়েছে! সব সময় শাক দিয়ে মাছ ঢেকে বোঝায়। অসহ্য! এই তো সেবার তুনি খালা এলো বাগেরহাট থেকে। আম্মুর দূরসম্পর্কের কাজিন। আমার চেয়ে বছর দুয়েক বড় কিন্তু দুনিয়ার চালু। মোবাইল আছে দুইটা। বিয়ে ঠিক হয়েছে আবার এক্স বয়ফ্রেন্ডও আছে। দুইজনের সাথেই গুজগুজ করে আলাপ চলে রাতে। আমার সাথে খালা অনেক গল্প করত। একদিন ফট করে আম্মু বলে, “ জিয়ানা, তোর তুনি খালা তোর ঘরে ঘুমাক, আজ থেকে তুই আমার ঘরে ঘুমাবি।“ আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, “কেন?” আম্মু বলল, “ তুনি তো ওদের বাড়ীতে একা থাকে, কটা দিন ই বা থাকবে, ওকে ওর মত থাকতে দে।“ আমি সব বুঝেও কিছু বললাম না। আহারে মাতাজান! তুনি খালার মত পাকনার সাথে তোমার মেয়েরে থাকতে দিতে চাও না। মেয়ে যদি পেকে ঝানু হয়ে যায়!

আমি পেকেছি। তুনি খালা কোন ছাড়! আমাদের ক্লাসে যে কয়টা ফাজিল আছে ওদের অ্যাডাল্ট জোকসের ভাণ্ডার বিশাল। সেগুলো যখন মাঝেমধ্যে উগড়ে দেয় তখন মাথা কান দিয়ে ধোঁয়া ছোটে। আমি সিগারেটও টেস্ট করেছি। ভালো লাগেনি। তিথি একদিন ব্যাগে করে হুইস্কি এনেছিল। রেশমি এক ঢোঁক খেয়ে বমি করে ভাসাল । তাই আর খেতে ইচ্ছে হয়নি। মানসূরার তো গতবছর বিয়ে হয়েছে। কেউ অবশ্য এখনো জানেনা। ও ওর জামাইয়ের সাথে কি করে সব বলে। গল্প গুলো অবশ্য রুচিকর কিছু না। ঘেণ্ণা লাগে, আবার শুনতেও ইচ্ছা করে।

সে যাই হোক, ঘটনা হচ্ছে, আজ আমার টিভি দেখা জরুরী। কারণটা লজ্জার। এবং এজন্য হৈ চৈ করে টিভির রিমোট খোঁজা আরও লজ্জার। আজ জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখাবে বা দেখাচ্ছে। এই জাতীয় অনুষ্ঠান আমার দেখা হয় না। আমার বাবা মার জন্য এটাও একটা সন্দেহজনক বিষয় হবে। আরেকটা যেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবে সেটা অন্তত আমি কাউকে বুঝতে দিতে চাই না। বিতর্কের এক দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানে দলনেতা হিসেবে যিনি থাকবেন তার নাম রাহাত। মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্সের ছাত্র। রাহাত আহমেদ রূপম নামে তার ফেসবুক আই,ডি।  আমাদের ঠিক উপরের ফ্লোরে থাকেন। আর মাঝে সাঝে ছাদে গেলে দেখা হয়। ঢং মং নায়ক অপূর্বর মত। আশেপাশে অনেক মেয়েরা নানা ভুwভাw করে তার অ্যাটেনশন পেতে। আমি ঘুরি আর রং তামাশা দেখি। পাশের বিল্ডিংএ কয়েকটা মেয়ে উঠে খালি আমাদের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছাদে তো অনেকেই ওঠে। যেই রাহাত ওঠে ওমনি ওদের চুল ঝটকানি, ওড়না ঠিক করা, সিনেমার সখীদের মত হাসাহাসি বেড়ে যায়। আর এদিকে রাহাত সাহেব উদাস চোখে এদিক ওদিক ঘুরে, সেল ফোন টিপতে টিপতে কোথাও বসে থাকেন, মাঝে মাঝে যদি ওদের দিকে চেয়ে চোরা হাসি দিয়েছেন, হায় খোদা! ওদের হাসির হুল্লোড়ে আমি ছাদ ছাড়ি।

ঘটনা হচ্ছে, আমার সন্দেহ হচ্ছে আমি রাহাত আহমেদ রূপম সাহেবের প্রেমে পড়েছি, যেটাকে বলে ক্রাশ খাওয়া। নইলে যে আমি ডিসকভারি চ্যানেল দেখি সে এই ভর সন্ধ্যায় বিটিভি দেখার জন্য মরিয়া হতাম না।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আমি জানলাম কি করে যে সে আজ টিভিতে দর্শন দেবে। ওয়েল, আমি তার সাথে ফেসবুকে কাণেক্টেড, অবশ্যই বেনামী অ্যাক্যাউণ্ট থেকে। তার স্ট্যাটাস ছবি সব ই আমি দেখি, কিন্তু চ্যাট করার সাহস হয় না। বুকটা কাঁপে। যদি জেনে যায়! তুনি খালা বলত, “কাউরে ভাল্লাগলে বেনামে ম্যাসেজ দিবি, দিতে দিতে একসময় পাবলিক তোর হাতের মুঠায়।“ আমি সেটাও পারিনা। বুকটা ঢিপ ঢিপ করে।

কিন্তু, সেদিন টিভি দেখতে না পারলেও বিতর্কের ফুটেজ ফেসবুকে পেয়ে গেলাম রাতে। দেখে ধাপ করে রাহাত সাহেব কে ইনবক্স করলাম, “হাই”। কোন উত্তর নেই।

তারপর লিখলাম, “ আজকের বিতর্ক দেখলাম। জিতে আসার জন্য অভিনন্দন।“

একটু পর দেখলাম লিখেছে, “ নীল লাবণ্য, আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন?”

‘নীল লাবণ্য’ আমার ফেসবুক আইডি।  আমি ঢোঁক গিললাম। তারপর লিখলাম, “ আপনাকে চেনা কি খুব কঠিন?”

রাহাত লিখল,” পরিচয়ের সূত্র জানলে ভাল হত।“

আমি লিখলাম, “ একদিন হয়তো জানাবো, আজ যাই।“ লিখেই আমি লগ আউট করে ফেললাম। বুকটা কাঁপছে। বায়োলজির কাশেম স্যারের নোট ঘাটতে ঘাটতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম জানিনা।

পরদিন কোচিং ক্লাস শেষে যখন বাসায় আসছি সিঁড়ীতে হঠাৎ দেখা। কালো রঙের একটা টি শার্ট আর ছাই রঙের মোবাইল ট্রাউজার পরে ধূপধাপ করে পাশ দিয়ে নেমে গেল। নোটিস পর্যন্ত করল না আমাকে। আমি জানি আমি কোন ‘বোম্বশেল’ নই।  কিন্তু অ্যাট লিস্ট এক নজর তো তাকাতেই পারত। মনটা ডাউন খেয়ে গেল।

মন খারাপ হলে আমি গোসল করি। গোসল করে দুধ দিয়ে কফি বানিয়ে খাই। আম্মু বুঝে যায়। সন্ধ্যায় পছন্দের কোন নাশতা বানিয়ে বলে, “আজ বানাতে ইচ্ছা করল।“ আজ বানিয়েছে কলিজি সিঙ্গারা। আমি হূমহাম খাই। তারপর মন খারাপটা রাগ আর জেদে ডাইভার্ট করে পড়তে বসি। ঘুমানোর সময় ফেসবুকে নক দেই মিস্টার রাহাতকে। আজ ভালই কথার ব্যাডমিণ্টন চলতে থাকে। কিন্তু বিপদে পড়ি যখন ছবি চায়। কিছুক্ষণ ভাবি। তারপর বলি, “ কাল ঠিক পাঁচটায় তার বাসার ছাদে থাকতে, আমি চলে আসব।“ কেন বললাম, নিজেও জানিনা। বলেই ভাবলাম, “ এখন কি হবে?”

সকালে স্কুলে গিয়ে দেখি মানসুরা চুপচাপ বসে আছে। ওর পাশে অন্য ফাজিলগুলা ভনভন করছে। কিন্তু ওর কোন সাড়া নেই। আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম। “ কি রে , আজ কি জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে আসছিস?”

মানসুরা চুপ। আমি একটু অবাক হলাম। বেটি বিরাট বাচাল, তার উপর নিজের জামাইয়ের  ব্যাপারে হেভি সেনসিটিভ। কিছু বলছে না কেন? আমি থুতনি ধরে মুখ উঁচু করলাম। দেখি চোখে ভয় আর জল টলটল। দু একবার জিজ্ঞাস করার পরও যখন বলছে না, তখন আমি বললাম, “এক্ষণ বলবি, নাকি আমি হেড মিসকে তোর সব কথা বলে দিব।“  মানসুরা কেঁপে উঠল। আমাকে ধরে বলল, “না…না…পায়ে পড়ি দোস্ত…আল্লাহর দোহাই লাগে…”। ওকে শান্ত করতে করতে টিচার এসে পড়ল। আমি মানসুরাকে ইশারা করলাম। ও আর আমি ওয়াশ রুমে যাওয়ার নামে বেরোলাম।

মানসুরা যা বলল তা বেশ ভয়াবহ। মানসুরার জামাই থাকে আদাবর। ঐ বাসায় আমাদের বায়োলজির টিচার কাশেম স্যার প্রাইভেট পড়ায়। সামহাউ জানলা দিয়ে সেই মহান শিক্ষক মানসুরা আর ওর জামাইয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ ধারণ করেছে। করে কাল রাতে মানসুরার ফেসবুকে ইনবক্স করেছে। তারপর প্রথমে বলেছে সবাইকে বলে দিবে। পরে মানসুরা ফোন করে বলে সে বিয়ে করেছে এবং এই মুহূর্তে কাউকে জানালে তার আর পড়াশোনা করা হবে না। আধবুড়া কাশেম স্যার মানসুরার হালত দেখে ‘ক্ষমা’ দিবেন বলে জানিয়েছেন তবে একটা শর্ত সাপেক্ষে। আজ বিকেলে যদি মানসুরা তার বাসায় এসে তাকে স্বামীর মত আদর ভালোবাসা দেয় তবে…।        

   

ঘটনা প্রতিকারের সমস্যা কয়েকটা। এক, মানসুরা বিবির পড়াশোনায় মন কম, ক্লাস সেভেনে একবার গাড্ডা খেয়েছে, আর অনেকটা দয়া করে টেস্ট পরীক্ষায় পাশ করানো হয়েছে। এখন যদি সকুল কর্তৃপক্ষ জানে সে বিয়ে করেছে, সোজা বের করে দিবে, পরীক্ষায় বসতে দিবে না। দুই, কাশেম স্যার সিনিয়র শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে কিছু করলে, তিনি  মানসুরাকে গোপনে টাইট দিতে পারেন। বোর্ডে ওনার পরিচিত লোক আছে। যদি কোন সাবজেক্টে ফেল করিয়ে দেয়! সকুল বা স্যার কেউ যাতে কিছু টের না পায় আবার মোবাইলের ভিডিও নষ্ট হয়ে যায় সেটাই করতে হবে। কিন্তু বাই চান্স যদি ঐ ভিডিওর কপি অন্য কোথাও সেভ থাকে? মানসুরাকে বললাম, “ভাবিস না, একটা ব্যবস্থা করে ফেলব।“ ক্লাসে ফিরে ভাবতে থাকলাম। প্রথমত ফোনটা চুরি করে ভিডিও ডিলিট করতে হবে। আর তারপর সদিব কে দেখাতে হবে।

প্রথম কাজটা কঠিন। কাজটা হওয়ার পর স্যার টের পেলে সন্দেহের কাঁটা মানসুরার দিকে আসবে, আর খুব সহজেই ভেজাল করতে পারে। অন্তত এক ঘণ্টার জন্য স্যার যাতে টের না পায়। আমাদের ক্লাসের মধ্যে ম্যাজিক জানে মিঠু। ভাল হাত সাফাই জানে। অনেকে ডাকে চুন্নি। কিন্তু দেখতে একদম গোবেচারা। ওর পাশে বসে ওকে বললাম যে কাশেম স্যারের ফোন চুরি করতে হবে। কাশেম স্যারের ক্লাস সামনে। ও তো ভয়ে শেষ। বলল, পারবেই না। তখন চোখ পাকিয়ে বললাম, “ তুই অঙ্কিতার ভাইকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখছিলি অঙ্কিতাকে বলে দেই…?” মিঠুর মুখ সাদা। ক্লাসের টপ ফাজিল গুলাকে এর পর সেট করলাম। কাশেম বদমাইশটা আসলে যাতে এনগেজ রাখে নানা কোয়েরিতে। মিঠু চুরি করতে পারবে, কিন্তু সাদিব কে আসতে বলতে হবে। কাশেম স্যারের  পিরিয়ডেই কাজ শেষ করতে হবে। যেভাবে হোক।

মিঠু হাঁপাচ্ছে। ওর হাতে কাশেম স্যারের স্যামসাং গ্যালাক্সি জে থ্রি। ফিসফিস করে বলল, “ এখন কি করবি?” আমি চোখ টিপে আস্তে করে ফোন কোমরে গুঁজে  সকুলের বাইরে চলে এলাম। গেটে একটু ঝামেলা করছিল। বলছি ওষুধের দোকানে যাব। দারোয়ান কি বুঝল কে জানে, মিচকা একটা হাসি দিয়ে গেট খুলে দিল।

সাদিবকে পেয়ে গেলাম পাশের দোকানেই। এখন সবার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই সাদিব টা কে। সাদিব কোন সুদর্শন যুবক নয়। আমার ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ফুপাতো ভাই। পড়াশোনায় যা তা, কিন্তু দুর্দান্ত হ্যাকার, আর টেকনো ফ্রিক। নিমিষেই একটা ফোন বা ল্যাপটপের চৌদ্দগুষ্ঠি বলে দিতে পারে। কাশেম স্যারের ফোন থেকে খুঁজে হয়তো আমি ভিডিও ডিলিট করে দিতে পারতাম কিন্তু, সেটার অন্য কোন কপি আছে কিনা সেটা সাদিব আমাকে বলতে পারবে।

সাদিব কথা বলে কম। আমার দিকে একবার চেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, “ পিজা হাট…”

আমি সম্মত হলাম। বাবাজিকে ওখানে খাওয়াতে হবে। ফোন ঘেঁটে পাওয়া গেল ভিডিওটা। সাদিব দেখে শীষ দিয়ে উঠল। আমি বললাম, জলদি ডিলিট কর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিরক্ত মুখ আমার দিকে তাকিয়ে ডিলিট করল। আমি বললাম, “আর কপি আছে কিনা জানা যাবে?“ সাদিব চুপচাপ কি কি সব করল, তারপর বলল, চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু কপি প্রসেস শেষ করতে পারেনাই। মানে কপি হয় নাই। আর এই ফোন দিয়েই ভিডিও হইছিল। কোয়ালিটি আর ফাইল নেম তাই বলে। “

আমি হাঁপ ছাড়লাম। সাদিব ফোন ঘাঁটছে তখনও। আমি বললাম, “ফোন দে, আবার রেখে আসতে হবে। টাইম নাই।“

সাদিব হেসে বলল, “ লোকটার ফোনে কিন্তু হেভি জিনিস আছে। অনেক…। তুমি এক কাজ করলে পার, এটা তোমাদের স্কুল অথরিটিকে দাও। ওরা দেখে ব্যবস্থা নিবে।

বুকটা ধক করে উঠল। আজ খুব বেশী দুঃসাহসী কাজ হয়ে গেছে। আর সম্ভব না। কেউ বোঝার আগে ফোন ঐ শয়তানকে ব্যাক করতে হবে। কিন্তু স্কুলে ফিরতে ফিরতে মারাত্মক একটা ঘটনা ঘটালাম। তারপর একদম ভাল মানুষের মত ক্লাসে চলে এলাম। পিছনের দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে পেছনের বেঞ্চে বসে মিঠুকে আবার ইশারা করলাম। ও ওর কাজ সারল। কিভাবে করল তার বিষদ বিবরণ না জানলেও চলবে। মানসুরা ভয়ার্ত মুখে চেয়ে আছে। আমি ইশারা করলাম, সব কাজ শেষ, ও নিশ্চিন্ত হতে পারে। স্যার ক্লাস শেষে বেরুবে তখন পিওন এলো তাকে ডাকতে। হেডমিস তাকে ডাকছে। টিচার্স রুমে দারুণ হৈচৈ হচ্ছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস বেরিয়ে বললেন, “ এই তোমরা বাড়ি যাও। আজ আর ক্লাস হবে না। “ আমরা বেরিয়ে এলাম। মানসুরা আমার কানের কাছে এসে বলল, “ কি হয়েছে রে?” আমি ওকে বললাম, “ স্যারের ফোন থেকে বিভিন্ন মিসদের নম্বরে আর ফেসবুকে বাজে ভিডিও পাঠিয়েছি।“ ওর চোখ ছানাবড়া। আমি ওকে ধরে হাসি দিয়ে বললাম, “তোর টা ডিলিটেড। ব্যাটা এখন ক্লিন বোল্ট হবে।“ তারপর আবার ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “ শালী, তোর জন্য আমার একটা দিন নষ্ট হ’ল, তোর বিয়ের খবর পরীক্ষার পর আর লুকিয়ে রাখিস না। নইলে আরও সমস্যা হবে।“

 

বাসায় এলাম সাড়ে তিনটায়। খেয়ে দেয়ে এমন ঘুম এলো যে ৬ টায় উঠে আবিষ্কার করলাম আজ রাহাতের সাথে দেখা হওয়ার কথা ছিল। ইশ! কিন্তু কি আর করব এখন। বেশ হয়েছে দেখা হয়নি। আমি পড়তে বসি।  ৬ টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত পড়ে খাওয়া সেরে যখন বিছানায় যাই তখন ফোনটা হাতে নেই। দেখি ফেসবুক ইনবক্সে রাহাতের অ্যাঙ্গরি ইমো। আমি লিখি, “ আই অ্যাম সরি।” সিন হয় কিন্তু কোন উত্তর নেই। আমি ফোন বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাই।

 

তারপর, এস, এস, সি পরীক্ষাও একসময় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু রাহাত আর কথা বলে না। আমিও আর আগ বাড়িয়ে নক করি না। হ্যাঁ, দেখা হয় মাঝে মাঝে। আমি তার সামনে অদেখা হয়েই থাকি। যেদিন রেজাল্ট হয় আর জানতে পারি আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি, আব্বু গাদাগাদা মিষ্টি আনায়। ভাবি, রাহাতদের বাসায় যাব। আম্মু আর আমি যাই  সন্ধ্যার দিকে। রাহাত বাসাতেই ছিল। ওর মা খুশী হয়ে বসতে বলেন, আম্মু ওর মায়ের সাথে কথা বলতে থাকে। রাহাত টেলিভিশন দেখছিল। ওর মা পরিচয় করিয়ে দেয়। ভদ্রতাসুলভ একটা হাসি দেয় সে। আমি হেসে বলি, আমার আরেকটা নাম আছে, হয়তো আপনি চিনবেন। রাহাত মুখে ভদ্রতাসূচক হাসি আরেকটু বাড়িয়ে বলে, “তাই? কি নাম?”

আমি বলি, “নীল লাবণ্য। আচ্ছা আসি।“

রাহাত নাম টা মনে করে মেলাতে মেলাতে আমি আম্মুর সাথে চলে আসি। সে রাতে রাহাতের ম্যাসেজ আসে, “কনগ্রাচুলেশনস!”

একটা খুশীর দোলা ছুঁয়ে যায় আমায়, আমি ধন্যবাদ জানিয়ে রিপ্লাই দেই।

“আরেকটু বড় ভেবেছিলাম।“

“ তাতে কি খুব অসুবিধা?”

“আসলে তুমি এতো ছোট…”

“তাতে…?”

“কিছু না…ওকে! পরে কথা হবে।“

আমি একটু দমে যাই। কাউকে ভালোলাগার প্রথম শর্ত কি ? বয়সের ব্যবধান মাপ মত হতে হবে? নিজেকে কেমন হাস্যকর লাগতে থাকে। না জানালেই হত।

এরপরও রাহাতের সাথে কথা হয়, নিতান্তই হাই হ্যালো টাইপ। আমি তার কাছে আকর্ষণীয় কেউ নই।

কলেজে ভর্তির পর একদিন হঠাৎ রাহাত কে দেখি ছাদে। খুব উদাস। আমাকে দেখে যেন সাত রাজার ধন পেয়েছে এমন ভাবে তার চোখ মুখ জ্বলে ওঠে। আমি তাকে দেখেও আমার মত থাকি। ভালোবাসা ভালোলাগা একতরফা থাকতে নেই। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, “ নীল!” আমি বলি আমার নাম “ জিয়ানা।“ সে বলে, “আমি তোমাকে নীল বলেই জানি, তাই ঐ নামেই ডাকছি। কেমন আছ?”

আমি একটু অবাক হলাম। বললাম, “ভাল, আপনি?”

রাহাত মুখ নামিয়ে বলল, “ মনটা ভাল না। চল না কোথাও ঘুরতে যাই।“

আমি টাশকী খেলাম, বলে কি! আমি বললাম, “ ঘুরতে যাবো মানে? কোথায়?

রাহাত ফট করে আমার হাত ধরে ফেলল, “ সাভার যাবে, ওখানে আমার ফ্রেন্ডের রিসোর্ট আছে।“

আমি  ভ্যাবলার মত চোখ গোল করে বললাম, “ আমি কেন?”

রাহাত আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “ তুমি তো আমাকে লাইক কর, তাই না?”

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ আর আপনি?”

রাহাত কি একটু হোঁচট খেল? তাড়াতাড়ি বলল, “ হ্যাঁ, আমিও করি, তো…কাল যাবে আমার সাথে?”

আমি হিসেব মেলাতে পারছিলাম না। একটা ছেলে যাকে আমার ভালো লাগে, হয়তো ভালও বাসি। সে প্রথমে আমাকে পাত্তা দেয় না। এখন আমার সাথে ঘোরার জন্য পাগল। আমার বুকের মধ্যে আবেগের ঢেউয়ের ধাক্কা গুলো ভেসে যেতে বলে কিন্তু কোন একটা বিষয় কেন যেন গোলমেলে।

আমি যন্ত্রের মত ঘরে ফিরি। আট বছর আগে আমার বড় বোন ঠিক আমার বয়সে একটা ভুল করেছিল। সেই ভুলের ভুল মাশুল হিসেবে সে বেছে নিয়েছিল এক গাদা ঘুমের ওষুধ। সেই একই ভুলের সূচনা কি আমিও করতে যাচ্ছি?  বেডসাইড টেবিলে আম্মু আব্বু আপু আর আমার পিচ্চী কালের ছবি। ছবিটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরি আমি। ফোন আসে রাহাতের। আমি তাকিয়ে থাকি।

    

 

 

               

      

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত