ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিডিং ক্লাবের ১১৬ তম পাবলিক লেকচার। প্রবক্তা: সাবিদিন ইব্রাহিম ইরাবতীর পাঠকদের জন্য পাঁচ বছর আগের সেই বক্তব্যটি প্রকাশ করা হলো।
যাকে নিয়ে অনেক নিন্দা, যাকে নিয়ে অনেক গালাগালি, যাকে নিয়ে অনেক সমালোচনার গল্প শুনি তাকে নিয়ে আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। আমি দেখেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঙালি যাকে একবাক্যে একমত হয়ে গাল দেয়, সমালোচনা করে তার মধ্যে অসাধারণ কিছু থাকে। তাছাড়া প্রশংসা করা কম শিখলেও (বা প্রশংসাকে কেবল চাটুকারিতায় পরিণত করার সক্ষমতা অর্জন করলেও যদিও তা নিজের স্বার্থ সিদ্ধি ও দাশ মনোবৃত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য) কিন্তু সমালোচনা ও গালমন্দ বাঙালি বেশ ভালো শিখেছে। অবশ্য এ কাজ করতে কোন পয়সা বা পরিশ্রম লাগেনা তাই বলে হয়তো!
নীরদ সবচেয়ে বেশি গালি খাওয়া বাঙালিদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন। এজন্যই তাকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে বলে মনে করি।
নীরদকে পড়ে যদি মনে হয় তাকে সমালোচনা করার যথেষ্ঠ জায়গা আছে তাহলে সেটা করতে দ্বিধা করবোনা। শুধু শোনা কথায় কান দিয়ে, ক্ষেপে গিয়ে গালবাজির সিলসিলা ধরে রাখতে আমি আগ্রহী নই, অভ্যস্তও নই।
কারণ বাঙালি চরিত্রের এ দিকটি নিয়ে আমার বেশ পরিচয় আছে যে তারা শোনা কথায় প্রশংসা কমই করে কিন্তু কুৎসা প্রচারে সবার চেয়ে এগিয়ে।
নীরদের প্রথম প্রকাশিত বই ‘The Autobiography of an Unknown Indian’ ভারতীয় প্রকাশনী JAICO থেকে প্রকাশিত ভারতীয় সংস্করণটির মলাটের পেছনের অংশে লেখা রয়েছে, “Nirad C. Chaudhury, India’s most controversial writer…”
তার এই পরিচিতির কারণেই তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
নীরদ সি চৌধুরী বা শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী
নীরদ যখন ইংরেজিতে লেখেন তখন Nirad C. Chaudhury/ নীরদ সি চৌধুরী লেখেন। আবার বাংলায় লেখার ক্ষেত্রে শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী লেখেন।
নীরদ সি চৌধুরী বা শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী নামটা কানে ও মনে আসলে ধারণা হয় মানুষটা হয়ত অনেক বড় আকৃতির, মোটাসোটা জাদরেল ধরণের। এই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে যে কজন হাতেগুণা বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক মানুষ তৈরি হয়েছে নীরদ তাদের মধ্যে অন্যতম।
নীরদ একটি বিতর্কের নাম, সমালোচনার নাম, আলোচনার নাম, পছন্দের নাম এবং একই সাথে ঘৃণার নাম। তিনি আবার এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে You may not like him, but you cannot ignore him.
এই আলোচিত-সমালোচিত নীরদ সি চৌধুরী নামের এই বিশাল ব্যক্তিটি আসলে একজন এভারেজ বাঙালির চেয়ে খাটো। নীরদ তার “আমার দেবোত্তর সম্পত্তি”র দ্বিতীয় অধ্যায়ে নিজের শারীরিক অবয়বের পরিচয় দিয়েছেন। উনার মুখ থেকেই শুনি:
“সংক্ষেপে দৈহিক অক্ষমতার হিসাব দিই। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট আধ ইঞ্চি; ওজন একমনের অতি সামান্য ঊর্ধ্বে সারাজীবন ধরিয়া; দেহ হাড়-জিরজিরে কৃকলাশের মত; রঙ আধ-ময়লা; মুখের বিশেষ শ্রী নাই।“
কার সাথে আমাদের আগামী দুই ঘন্টার যুদ্ধ তার শারীরিক পরিচয়টা আগে মেপে নিলাম। এবার না হয় তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়টা মাপবো!
আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিডিং ক্লাবের ১১৬ তম লেকচারের শিরোনাম হচ্ছে-
‘নীরদ সি চৌধুরী স্মৃতি বক্তৃতা’ (২৩ নভেম্বর,১৮৯৭-১ আগস্ট, ১৯৯৯)
‘বাঙালির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন সব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবদান
(“All That Was Good And Living Within Us Was Made, Shaped, And Quickened By The Same British Rule”)
টাইটেলটার ইংরেজি অংশটি নেয়া হয়েছে তার ‘‘The Autobiography of an Unknown Indian’ থেকে। বইটির উৎসর্গে তিনি এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করেন। উৎসর্গবাণীর এ অংশটি নিয়ে প্রকাশের পর থেকেই খিস্তি,আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আমরাও আজ খানিকটা করবো।
শুধু Dedication এর এই অংশটি পড়েই রাজনৈতিক কর্মী, সমাজপতি, পণ্ডিতজন নীরদের উপর ক্ষেপে যান। ভারত সরকার ক্ষেপে গিয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করেন ‘All India Radio’ থেকে। নীরদের বন্ধু খুশবন্ত সিং এ নিয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। নীরদ চৌধুরী তার এই dedication এর জবাব দিয়েছিলেন যে “The dedication was really a condemnation of the British rulers for not treating us as equals.”
আজকের এই লেকচারে নীরদ স্মৃতি বক্তৃতায় নীরদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে লেখা থেকে তার পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আমরা যদি নীরদের পুরো জীবন ও কর্মকাণ্ড স্টাডি করি তাহলে শিরোনামের এ বাক্যটির সত্যতা আমাদের সামনে ধরা পড়বে। সে অর্থে নীরদের পুরো জীবনটাই আমাদের আলোচনার ক্যানভাস। তবে কিছু অংশে তুলি একটু বেশি পড়বে আর কিছু অংশে কম পড়বে এই আরকি!
এখন পাঁচ ফুট আধ ইঞ্চি ও এক মণের মত ওজনদার মানুষটির দীর্ঘ জীবন, বিশাল কর্মযজ্ঞ ও ওজনদার লেখা থেকে যে বিষয়গুলো আজকে আলোচনা করবো সেগুলো হচ্ছে:
• আমি সাম্রাজ্যবাদী কেন
• আমি একাধারে বাঙালী ও ইংরেজ
• বাঙালীদের নিয়ে তার কথা
• বাঙালীর অর্থপ্রীতি
• মধ্যবিত্ত চরিত্র বিশ্লেষণ
• আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ
• পূর্ববঙ্গ নিয়ে কথা
• নৃতাত্ত্বিক নীরদ, হিন্দু-মুসলমান ও বাংলা ভাষা প্রসঙ্গ
• বিভিন্ন টিকা-টিপ্পনী
• সমন্বয়বাদিতা: ভারতীয় চিন্তার ভুল
• ইউরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব
• শেষ টানা
আমি সাম্রাজ্যবাদী কেন
উনি কেন সাম্রাজ্যবাদী ‘জ্যামিতিক রীতি’ মেনে এর জবাব লিখছেন ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’র দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘আমি সাম্রাজ্যবাদী কেন’ অংশে তিনি বলেন:
১.আমি সাম্রাজ্যবাদী, প্রথমত, মানুষ বলিয়া; কেঁচো নই বলিয়া
২. আমি সাম্রাজ্যবাদী, দ্বিতীয়ত, সভ্য মানুষ বলিয়া; অসভ্য, পদদলিত, দাসজাতীয় মানুষ নই বলিয়া
৩. আমি সাম্রাজ্যবাদী, তৃতীয়ত, সত্যকার হিন্দু বলিয়া, মলিন প্যান্ট-পরিহিত, আধা-ট্যাসফিরিঙ্গি, অথচ গনৎকারের উপাসক হিন্দু নই বলিয়া।
তারপর তিনি একে এক বিভিন্ন ছোট ছোট অংশে দেখানোর চেষ্টা করেন সাম্রাজ্যবাদ কেন জরুরী। তার প্রবন্ধগুলোর শিরোনামগুলো শুধু বলি-‘আদিম সাম্রাজ্য-পশু-পক্ষী ও উদ্ভিদের উপর’, ‘গ্রীক, রোমান ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ’, ‘হিন্দুর সাম্রাজ্যবাদ’, ‘প্রাচীন ভারতে সাম্রাজ্য’, ‘সাম্রাজ্যের অবসান হইলে কি ঘটে’, ‘বাঙালীর সাম্রাজ্যবিদ্বেষের মূলে কি’।
এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের একটি উক্তি ব্যবহার করেছেন নীরদ যেটা মনে রাখার মতো! এক ফরাসী বৈজ্ঞানিক যুবক ভিক্টর জাকমঁর সাথে আলাপচারিতায় বলেছিলেন- “Conquest is very rarely an evil when the conquering people are more civilized than the conquered, because the former bring to the latter the benefits of civilization.”
১৮২৯ সালের ২১ জুন কলকাতার বাগান বাড়িতে রাজা রামমোহন রায় এ কথা বলেছিলেন। নীরদ এর রেফারেন্স দিয়েছেন তার ‘বাঙালীর সাম্রাজ্য-বিদ্বেষের মূলে কি’ প্রবন্ধে।
আমি একাধারে বাঙালী ও ইংরেজ
নীরদ এই অধ্যায়ে এসে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুড়েন, ‘আমার ব্যক্তিত্ব আসলে কি?
উনি নিজেই এর উত্তর দেন:
“উহা একদিক হইতে যেমন দ্বিধাবিভক্ত, আর একদিকেও তেমনই দ্বিধাসংযুক্ত। আমি যে ইংরেজের প্রশংসা করি ও ইংরেজের জীবন ও সভ্যতা সম্বন্ধে গৌরব অনুভব করি, তাহা ইংরেজের অধীন বাঙালী হিসাবে নয়, করি নিজেকে ইংরেজ মনে করি বলিয়া; অর্থাৎ জন্মে না হইলেও মানসিক ধর্মে এবং আংশিকভাবে জাতীয়তাবোধেও আমি ইংরেজ, ইহা মনে করিয়া।” (আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, পৃষ্ঠা: ১১৫)
“আমি যে বর্তমানে ইংরেজের সমালোচনা করি উহা প্রকৃতপ্রস্তাবে দেশের দোষ সম্বন্ধে দেশপ্রেমিকের অসহিষ্ণুতার ফল।
এইবার আমার দ্বিত্বের বাঙালী দিকটার কথা বলি। ইংরেজি শিক্ষার ফলে আমার জীবনে ও আচার ব্যবহারে যে ইংরেজী ভাব দেখা দিয়াছিল তাহার বশে আমি ইংরেজ সম্বন্ধে যেমন অভিমত প্রকাশ করিয়াছি, জন্মে ও কুলে শীলে বাঙালী হইয়া বাঙালী সম্বন্ধেও ঠিক তাহাই করিয়াছি। আরও স্পষ্ট করিয়া বলি যে, একদিকে যেমন বাঙালীর কীর্তি সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করি, অন্যদিকে বাঙালীর অধোগতি ও ধর্মভ্রষ্টতা দেখিয়া ক্রুদ্ধ হই। আমার মনোভাব ইংরেজ সম্বন্ধে যাহা বাঙালীর সম্বন্ধেও তাহাই। ইংরেজ সম্বন্ধে আমার বিচারহীন পক্ষপাতিত্ব নাই, বাঙালী সম্বন্ধেও বিচারহীন অনুরাগ নাই।
আমি এইভাবে দ্বিধাবিভক্ত হইয়াও ঐক্য লাভ করিয়াছি। উহার কারণ আমি বাঙালী হিসাবেও খাঁটি, ইংরেজ হিসাবেও খাঁটি। ” (আমার দেবোত্তর সম্পত্তি,পৃষ্ঠা ১১৫-১১৬)
নীরদ তার পরিচয় অত্যন্ত পরিস্কার করেছেন। তার অবস্থান বোঝা আমাদের এখন সহজ হওয়া উচিত। নীরদ কেন এমন ‘দ্বিধাবিভক্ত’ ও দ্বিধাসংযুক্ত’ বাঙালী ও ইংরেজ তার পরিচ্ছন্ন ছবি আঁকতে গেলে আমরা তার আত্মজীবনীর দুই খণ্ড দেখতে পারি।
“The Autobiography of an Unknown Indian” নামে প্রথম অংশটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে, ম্যাকমিলান থেকে। “Thy Hand, Great Anarch! শিরোনামে সিক্যুয়েলটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে।
তার আত্মজীবনীতে তার ছোটবেলার জীবন, গড়ে উঠা, পঠন-পাঠন, অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন, লেখালেখি এ সব কিছুই তার ভবিষ্যতের নীরদ হওয়ার মসলা যে একই সাথে ইংরেজ ও বাঙালী হওয়ার দু:সাহস দেখাবে!
তার আত্মজীবনী থেকে আমি শুধু একটি অংশ নিয়ে কিছু কথা বলবো:
তার ‘The Autobiography of an Unknown Indian’ থেকে চতুর্থ অধ্যায় নিয়ে কথা বলবো যে অধ্যায়টির শিরোনাম ‘ENGLAND’।
‘ইংল্যান্ড’ শিরোনামে এ অধ্যায়টিতে নীরদ তার গড়ে উঠা এবং কিছু চরিত্রের সাথে পরিচয়ের কথা বলেছেন। ওখানে দেখা গেছে যে রাণী ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স আলবার্ট, নেপোলিয়ন, শেক্সপীয়র, রাফায়েল, মিল্টন, বার্ক, হেস্টিং, ওয়েলিংটনের সাথে কখন পরিচিত হয়েছেন এটা নিশ্চিত বলতে পারেননা। তবে এটা নিশ্চিত বুঝ-জ্ঞান হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জনের সাথে সাথেই তাদের নাম-পরিচিতি তার কানে ও মনে গেঁথেছিল অন্যসব Advanced English ছেলে মেয়েদের মত। এ সূত্রে তার ছোটবেলাকে অনেকটা ইংরেজিয়ানা শৈশব বললে দোষের কিছু দেখিনা।
আবার সাহিত্যের সাথে যখন তার পরিচয় ঘটছিল তখন অন্যসব ভারতীয় হিন্দু শিশুর মত রামায়ণ, মহাভারতের সাথে পরিচয় ঘটেছিল, এবং একই সাথে হোমার ও মিল্টনের সাথেও পরিচয় ঘটছিল-অনেকটা যুগপৎভাবেই।
আরো কয়েকটা পয়েন্ট যদি বলা হয় তাহলে বলতে হয়:
• তিনি কবিতার জনক হিসেবে হোমার ও বাল্মিকীকে সমান শ্রদ্ধাই করতেন।
• রাফায়েলের ‘ম্যাডোনা’ চিত্রটি তার বাসার সামনের দরজায় টাঙানো ছিল।
• নিজেদেরকে ‘বোনাপার্টিস্ট ইন বেঙ্গল’ বলে অভিহিত করেন। অর্থাৎ চৌধুরী পরিবার ছিল নেপোলিয়ন ভক্ত এবং নীরদ ছিল নেপোলিয়নের একনিষ্ঠ ভক্ত।
• ‘ব্যুওর ওয়ার’ নিয়ে বিস্তর জানাশুনা ছিল এবং এ নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা লেখা থেকেই এটা আরও পরিস্কার হয়ে যায়। এ যুদ্ধে ইংরেজের বিজয় নিয়ে তিনি যে ব্যাপক উৎসাহ দেখান তা কেবল একজন ইংরেজের সাথেই মানানসই। নীরদ এ যুদ্ধে নিজেকেই জয়ী মনে করেছেন। অবশ্য আবার বিরোধিদের প্রতিও সহমর্মিতা দেখলাম।
• তিনি ইংল্যান্ডে না গিয়েই ইংল্যান্ড নিয়ে কল্পনার ছবি এঁকে ফেলেছেন। মনে রাখতে হবে তিনি প্রথম বিলেত যান ৫৫ বছরের পরেই কেবল!
কিছু বাঙালি নিয়ে তার কথাবার্তা:
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়ে তার ব্যাপক ভালোবাসা ছিল। তিনি তাকে অনেক উচ্চে স্থান দেন। নীরদের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘মহাপুরুষ বঙ্কিম’। পাশ্চাত্য জগতে ‘গ্রেট ম্যান’ বলতে যা বুঝায় তিনি তাই।
এ নিয়ে নীরদের মত হচ্ছে, “বাঙালির ভারতব্যাপী প্রতিষ্ঠা প্রথম চৈতন্যদেবের দ্বারা হয়। উহার চেয়েও বড় প্রতিষ্ঠা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাঁহাদের দ্বারা হইয়াছিল সেই বাঙালিদের মধ্যে বঙ্কিমকে প্রধান বলা যাইতে পারে।” (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৯৯)
শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?
১৯৮৮ সনের ৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় বঙ্কিমকে নিয়ে লিখতে গিয়ে নীরদ লিখেন:
“বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে বাঙালি হিসাবে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি রবীন্দ্রনাথ, তাঁহার অপেক্ষা বড় বাঙালি জন্মে নাই, জন্মিবেও না।. তাঁহার পরেই বঙ্কিমচন্দ্র, কেশবচন্দ্র সেন, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষচন্দ্র বসু।
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ‘বড় বাঙালি জন্মে নাই, জন্মিবেও না’- এ কথাটি বলে নীরদ ভবিষ্যতের প্রতি অন্যায় করেছেন! রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই জন্মাবেনা, কেউই পুনর্জন্ম লাভ করেনা বা তার দরকারই নেই কিন্তু তার মানের বা তার চেয়ে বড় কেউ জন্মাবেনা এটা একজন ভক্তের পত্রিকা কলাম হিসাবেই নিলাম, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক নীরদ থেকে নিলাম না।
৬ শ্রেষ্ঠ বাঙালি
চারটি ক্যাটাগরিতে ৬ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা করেছেন নীরদ সি চৌধুরী।
১. রবীন্দ্রনাথ, মহাকবি, শ্রেষ্ঠ কবি। শুধু বাংলা ভাষায় নয় বিশ্বের যেকোন ভাষার শ্রেষ্ঠ কবির যোগ্যতা আছে রবীন্দ্রনাথের। তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বকবি।
২. শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তারা বিশ্বমানের, সেরা ঔপন্যাসিক।
৩. শক্তিমান ধর্মপ্রচারক: কেশবচন্দ্র সেন ও বিবেকানন্দ
৪. আত্মবলিদানকারি নেতা: সুভাষচন্দ্র বসু
তার এই ৬ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ঈশ্বরচন্দ্রের অনুপস্থিতি অনেকেরই সমালোচনার কারণ হয়েছিল। তিনি এর জবাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে অনেক লিখেছেনও। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে তার মনোভাব হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র মহাপুরুষ নি:সন্দেহে কিন্তু তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি নন।
শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী
তাকে একটু বেশি গালি দিবেন বলেই হয়তো তার প্রবন্ধের শিরোনামটি এমন রেখেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন নীরদ চৌধুরী। ওখানে প্রমথের প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার ভার অনেক বেশি। প্রমথভক্ত ও সুধীমহলে ওগুলো বেশ সমালোচনার কারণ হয়। শুধু একটু অংশ তুলে ধরি:
“…তবুও প্রমথবাবুর জীবন একটা ট্র্যাজেডি। প্রমথবাবু ‘পলিটিকস্, ইকনমিকস্, শিক্ষা, সমাজ, হিন্দুধর্ম্ম, ইসলামধর্ম্ম ইত্যাদি যেকোন একটা অথবা সবকটা নিয়ে অতি গম্ভীর ও অতি রাগতভাবে নানারূপ প্রভু-সম্মত বাণী ঘোষণা করিতে পারেন না, ইহাই তাঁহার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নয়। তাঁহার জীবনের ট্র্যাজেডি ইহাই- যে এই বৈদগ্ধ্যবর্জিত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার ফলে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে তাঁহার অতি তুচ্ছ রসিকতাকেও লোক একটা গুরুগম্ভীর দার্শনিক তত্ত্ব বলিয়া ভুল করিয়া বসে।”
আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রচর্চার বর্তমান হালহাকিকত বলতে গিয়ে নীরদ তার ভূমিকায় বলেন , “বর্তমানে অবশ্য অবস্থাটা উল্টা হইয়াছে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনিন্দকেরা লোপ না পাইলেও রবীন্দ্রভক্তেরাই প্রবল হইয়াছে। কিন্তু না ভক্তি না নিন্দা, কোনটাই উচ্চস্তরে উঠে নাই। এখনও রবীন্দ্রনাথের সত্য রূপ আত্মপ্রকাশ করিতে পারিতেছে না।
আমি সারাজীবন সেই রূপটি ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি, মনে হয় অবশেষে হয়ত ধরিতেও পারিয়াছি। তবে আমার ধারণায় তাঁহার যে রূপ আসিয়াছে উহা এক নয়, দ্বিধাবিভক্ত। উহার একদিক আত্মসমাহিত রবীন্দ্রনাথের, অন্যদিক আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথের। এই দুই রূপের অবিচ্ছিন্নতাই তাঁহার জীবনের বৈশিষ্ট্য।” (আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, পৃষ্ঠা ৩, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স)
নীরদের এই আত্মবিশ্বাস ও দু:সাহসকে সাধুবাদ না জানানোর উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার অনন্য মতামত ঈর্ষা, হিংসা বা বিদ্বেষপ্রসূত নয়। এটা রবীন্দ্রনাথকে explore করে আসল রূপটি ধরার ইংরেজ বা ইউরোপীয় সুলভ বৈশিষ্ট্য।
নীরদ “রবীন্দ্রনাথ” সম্পর্কে আরও ক্ষুধিত পঙ্কে রবীন্দ্রনাথ
“… যাঁহাদের প্রতিভা সম্বন্ধে সন্দেহ করা চলেনা-তাঁহারাও এই পঙ্কে ডুবিয়াছেন। কয়েকজনের উল্লেখ করিব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্র বসু, পাণ্ডিত্যে হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী ও দেবপ্রসাদ ঘোষ, সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রেমেন্দ্র, শৈলজানন্দ ও হুমায়ুন কবীর। ইহাদের কেহই প্রভাতে উদিত হইয়া মধ্যাহ্নের আকাশ পর্যন্ত যান নাই। বুদ্ধদেব বসু সম্বন্ধেও তাহাই বলিব, তাহাকে শুধু বাঙালী জীবনের মানসিক ক্ষুধিত পঙ্কই গ্রাস করে নাই, যাদবপুরের বাধাও তাঁহাকে কবিপদ হইতে অধ্যাপকপদে নামাইয়াছিল। মরণং যাদবপুরে, অপরং বা কিং ভবিষ্যতি।
আরও অনেকের কথা বলিতে পারিতাম, তবে তালিকা বৃদ্ধি না করিয়া, যিনি আমার তালিকার শীর্ষে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, তাঁহার দশাই দেখিব। তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাবে ক্ষুধিত পঙ্ক গ্রাস করিতে নিশ্চয়ই পারে নাই; কিন্তু তাঁহার জীবনকে, গ্রাস করিতে না পারিলেও দু:খের বিষে জর্জরিত করিয়াছিল। উহার আকর্ষণ হইতে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য তিনি যে সংগ্রাম করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি যেন পাগল হইয়া গিয়াছিলেন। স্বজাতির আচরণ সম্বন্ধে তিনি যৌবন হতে বার্ধক্য পর্যন্ত যেসব উক্তি করিয়াছিলেন তাহা যেন পাগল মেহের আলির ‘তফাৎ যাও, তফাৎ যাও’ চিৎকারের মত। শেষ পর্যন্ত ক্ষুধিত পঙ্ক তাঁহার জীবনকে ক্লান্তিতে অবসন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল, কিন্তু উহার অন্তর্নিহিত মহত্ত্ব ও সেই মহত্ত্বের সাহিত্যিক প্রকাশকে নষ্ট করিতে পারে নাই- তবু উহাকে জীবনব্যাপী দু:খের সহিত জড়িত করিয়া রাখিয়াছিল। সেজন্য এককালে আমি তাঁহার সাহিত্যসৃষ্টিকে ‘les fleurs du mal’ বলিতাম। এত মহান ও এত বহুমুখীন প্রতিভাবান ব্যক্তির এমন দু:খময় জীবনের কথা আমি কোনো দেশের সাহিত্যিক ইতিহাসে পড়ি নাই।”
(আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা:৫)
অর্থপাগল বাঙালী ও বিবাহ
“…বাঙালি সমাজে সম্পন্ন বা ধনীর সহিত সাধারণ অবস্থার বাঙালিরই বিরোধ ও মনোমালিন্য যে দেখা দিয়েছে তাহাই নয়, নূতন অর্থপরায়ণতার জন্য মধ্যবিত্ত সমাজেও একটা অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ দেখা যাইতেছে। উহা বিবাহের ব্যাপারেই বেশি প্রকাশ পাইতেছে। বর্তমানে বিবাহ অনেক ক্ষেত্রেই শুধু সম্পত্তি বা টাকা পাওয়ার মতো বৈষয়িক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমি প্রায়ই শুনিতে পাই, অমুক ভদ্রলোক মেয়ের খুব ভাল বিবাহ দিয়াছেন। জিজ্ঞাসা করিলে জামাতার কিংবা জামাতার পিতার মাহিনার খবর পাই। তখন বলি, ‘ও! মাইনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন?’
ইহাতে মধ্যবিত্ত সমাজের গুণবান যুবকদের খুব দু:খ ও রাগ হইবারই কথা। বয়সী ও গুণবতী মেয়েরা প্রায়ই তাহাদের অনায়ত্ব হইয়া পড়িতেছে।
অপরপক্ষে মধ্যবিত্ত সমাজের মেয়েদেরও ক্ষোভ কম নয়। এই সমাজের যুবকেরা যদি বিদ্যা, বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার জন্য বড় চাকরি পায় তখনই উচ্চপদস্থ বা ধনী ব্যক্তিদের ব্র্যাঘ্রীতুল্যা গৃহিণীরা উহাদের ঘাড় ভাঙিয়া উহাদের মাংস কণ্যাদের পরিবেশন করেন। গুণবতী মেয়েরা ঘরে অনূঢ়া জীবন যাপন করে।
(নির্বাচিত প্রবন্ধ, শ্রীনীরদ চন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা:৪৭)
ভদ্রসমাজে অর্থগত বিরোধ
এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সাথে বাঙালির মধ্যে আদর্শনিষ্ঠার অভাবের কথা বলছিলেন নীরদ। তখনই এক বাঙালি যুবক এম.এ বা এম.এস.সি ক্লাসের ছাত্র তাদের কাছে আসিয়া ইংরেজিতে বলিল-
‘I don’t care for faith or ideals. I shall be satisfied if I get highly paid job.’
“কিছুদিন হইলো একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে বলতেছিলাম যে টাকার পিছনে ছুটিয়া আমার অতিপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যেই অন্তত পঁচিশ জন নিজেদের প্রতিভাকে বলি দিয়াছেন। তখন লোকটি বলিলেন, “যাই বলুন, মশায়, পয়সা করেছে।”
তিনি যেন ইঙ্গিত করিলেন যে, বিত্তহীন হওয়াতে আমি ঈর্ষাপরায়ণ হইয়া এই ধরণের কথা বলিতেছি। তাই আমি না জিজ্ঞাসা করিয়া পারিলাম না,
নীরদ: কত পয়সা?
ভদ্রলোক: অনেক পয়সা!
নীরদ: এক কোটি টাকা?
ভদ্রলোক: আরে, না না!
নীরদ: ৫০ লক্ষ টাকা?
ভদ্রলোক: আরে, না না!
নীরদ: ১০ লক্ষ টাকা?
ভদ্রলোক: তাও নয়।
নীরদ: ৫ লক্ষ?
ভদ্রলোক: না, বোধ হয়।
তখন আমি না বলিয়া পারিলাম না, “দেখুন এক লাখ বা ৭৫ হাজার টাকা করে শহরতলিতে একটা বাড়ি তুলে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে থাকাকে আমি টাকা করা বলিনে।” (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা:৫৩)
মধ্যবিত্ত বয়ান
মধ্যবিত্তরা একটি দেশের কলসীর নিচের অংশের মত। এটা বিশাল ধারণ ক্ষমতার হতে হবে এবং প্রসস্থ হতে হবে। আমাদের মধ্যবিত্ত অনেকটা চোঙার মত; সংকীর্ণ এবং ভেতরে মাল নেই। তাদের স্বপ্ন ছোট, চিন্তা সীমিত, কল্পনাশক্তি অপ্রতুল। জীবনকে নিয়ে ভাবনার চেয়ে দুর্ভাবনার ভার অনেক বেশি। তারা চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পায় কিন্তু নিজ স্বার্থ উদ্ধারে শত কূটকৌশলের সবচেয়ে জঘন্যটা নিয়ে থাকে। অন্যের উন্নতি এদের চোখের কাঁটা, অন্যের সুখে এরা দুখী হয়। আর নিজের দু:খকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়াতে তাদের পরম সুখ।
পরচর্চা এদের বিনোদন, আত্মপ্রচার এদের লক্ষ্য। নিজেকে মেসাইয়া এবং অন্যকে সকল সমস্যার মূল মনে করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য!
এই মধ্যবিত্তকে নিয়ে নীরদের পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত বিস্তৃত ও পরিস্কার। তার কথা তেতো হলেও কথায় সার আছে। যাদের হাতে একটি দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি নির্ভর করে সে মধ্যবিত্তকে নিয়ে নীরদ মনে করেন, “মধ্যবিত্ত সমাজের বার আনা লোকই কালচারের প্রতি উদাসীন। দেশের সাহিত্য, বিজ্ঞান, সুকুমার কলা, ধর্মচর্চা, শিক্ষা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নতি সম্বন্ধে ইহাদের কোনও দায়িত্ব বা কর্তব্য আছে তাহাই ইহারা স্বীকার করেনা। সংবাদপত্রসেবী হিসাবে একাধিক বাংলা সাময়িক পত্রের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকাতে বাংলা সাহিত্যের পাঠক কত, কি শ্রেণীর লোক পাঠক, এই সকল প্রশ্ন আমার মনে প্রায়ই উঠিয়াছে। সন্ধান লইয়া দেখিয়াছি লব্ধপ্রতিষ্ঠ পত্রিকারও গ্রাহকসংখ্যা আসলে সাত-আট হাজারের বেশি নয়। সাধারণত পত্রিকার গ্রাহক দুই হইতে তিনহাজার, বাংলা উপন্যাস বিশেষ ক্ষেত্রে ভিন্ন তিন-চার বৎসরে এক হাজারের বেশি বিক্রয় হয়না, অন্য পুস্তক পাঠ্যপুস্তক না হইলে ইহার এক-চতুর্থাংশও বিক্রয় হয়না। অথচ বাংলাদেশে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা নিশ্চয়ই দশ হাজারের বেশি এবং সাহিত্যের জন্য মাসে পাঁচ টাকা করিয়া ব্যয় করিতে পারেন এরূপ লোকের সংখ্যাও উহার কম নয়। ইহার অপেক্ষাও আশ্চর্যের বিষয়, বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের মধ্যে স্ত্রীলোক ও কিশোরের সংখ্যাই বেশি।”
(নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ১৮)
পূর্ববঙ্গ নিয়ে নীরদের মতামত
‘পূর্ববঙ্গের সমস্যা’ শিরোনামে এ প্রবন্ধটির শুরুর লাইনটি এমন:
“লক্ষ্য করিবেন, পূর্ব পাকিস্তানের সহিত পশ্চিম পাকিস্তানের যে বিরোধ চলিয়াছে, উহাকে আমি ‘পূর্ববঙ্গের’ সমস্যা বলিতেছি। এই সংজ্ঞা ইচ্ছাকৃত। আমি পূর্ব পাকিস্তানকে আজও পূর্ববঙ্গ বলিয়াই মনে করি, শুধু দেশটা আর এক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে বলিয়াই উহার সত্তা লোপ পাইয়াছে, ইহা আমি স্বীকার করিতে পারিনা।
দিল্লী হইতে পূর্ব পাকিস্তানের শিরে যে আশীর্বাদ বর্ষিত হইতেছে, তাহা দেখিয়া একটি পুরাতন বাংলা প্রবাদ আমার মনে পড়ে-শকুনের শাপে গরু মরেনা। যদি কিছু হইবারই হয়, হইবে পূর্ববঙ্গের মুসলমান জনসাধারণের ইচ্ছায় ও চেষ্টায়। এ বিষয়ে তাহাদের মত কি? কোনও সন্দেহই নাই যে, তাহারা নিজেদেরকে বাঙালি ও দেশকে পূর্ববঙ্গ বলিয়াই মনে করে।” (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৬৮)
এর পরের পৃষ্ঠাতেই নীরদ বলেন, “আমার মতে আজ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি বাঙালী ধর্মী, এবং বাংলাদেশ হিসাবে শক্তিও বেশি রাখে।
আগে শক্তির কথাই বলা যাক। পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে পোলিওগ্রস্ত শিশুর মতো, তাহার ভারত গভর্নমেন্ট প্রদত্ত লোহার শলা ও খোঁড়ার-লাঠি ভিন্ন দাঁড়াইবার ক্ষমতা নাই। স্বাবলম্বী হইবার শক্তি প্রধানত নির্ভর করে আয়তন ও লোকসংখ্যার উপর। এই দুই দিক হইতেই পশ্চিমবঙ্গ পূর্ববঙ্গ অপেক্ষা অনেক দুর্বল। পুরাতন বাংলার পাঁচটি ডিভিশনের মধ্যে অখণ্ডিত অবস্থায় একমাত্র বর্ধমান ডিভিশনই পশ্চিমবঙ্গে আছে। উহার জেলাগুলির মধ্যে হুগলি ও হাওড়াকে এখন বৃহত্তর কলিকাতার অংশই বলা চলে। এই দুইটি জেলার স্বতন্ত্র আর্থিক ভিত্তি বা নিজস্ব জীবন নোই।
অপরপক্ষে বাংলাদেশের দুটি সমৃদ্ধ ও উর্বর ডিভিশন অর্থাৎ ঢাকা ও চট্টগ্রাম, পুরোপুরি পূর্ব পাকিস্তানে, প্রেসিডেন্সি ডিভিশন ও রাজশাহী ডিভিশনের ভাল অংশ ও সেখানে। তাহার উপর শ্রীহট্ট জেলা আসিয়া পাকিস্তানের সহিত যুক্ত হইয়াছে।
মোটের উপর জাতিত্বের হিসাব লইলে খাঁটি বাঙালির বাস এখন যে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গে বেশি, তাহা অস্বীকার করা যায়না। পাল্লার সেদিক অনেক ভারী।”(নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৬৯)
“সুতরাং এক সময়ে যে কলিকাতা বাঙালির নূতন জীবন ও নূতন সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল, সে কলিকাতা আর নাই। বাঙালির জীবনের কেন্দ্র হিসাবে এখনও কলিকাতা যতটুকু বর্তমান, উহা ক্ষয়িষ্ণু বনিয়াদিবংশের জীর্ণ অট্টালিকার মতো। এখানে বাস করিয়া আজিকার বাঙালি শুধু পুরাতন কৃতিত্বের অনুবর্তন ও পুরাতন ধারাকে বাঁচাইয়া রাখাই চরম কৃতিত্ব মনে করে। নতুন সৃষ্টির উৎসাহ তো দেখিই না, এমন কি কেহ যে ভবিষ্যতের খুব ভরসা রাখে, তাহারও লক্ষণ কমই দেখা যায়।
ইহার তুলনায় পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের প্রাণশক্তি বেশি। আজ সে যতই বিক্ষুব্ধ, বঞ্চিত বা নিপীড়িত হউক না কেন, সে সংখ্যার জোরে, মনের জোরে ও ভরসায় বাঙালিই আছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি অস্তমান, তাহারা উদীয়মান।
(নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৭০)
নীরদের নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব
“পূর্ববঙ্গের মানবজীবন ভাত ও বাঁশের উপর প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ আমরা ভাত খাই, এবং বাঁশ-চাটাই-খড়ের ঘরে বাস করি। হিন্দুস্থানের ও পাঞ্জাবের জীবনযাত্রা গমের রুটি ও মাটির অর্থাৎ কাদার উপর প্রতিষ্ঠিত।
পূর্ববঙ্গের কৃষক কষ্ট সহিষ্ণু ও কর্মক্ষম হইলেও সাধারণত পাতলা ও পাকানো হইত। তাহার বস্ত্রসম্ভার কিছুই থাকিত না। মাঠের মধ্যে প্লাবনের মধ্যে কাজ করিবার সময়ে তাহার পরিধানে অনেক সময় নেংটি ভিন্ন কিছুই থাকিত না, মাথায় থাকিত পাগড়ির বদলে বাঁশের টোকা-আমরা বাঙ্গালরা যাহাকে ‘পাৎলা’ বলিতাম। উহারা বসিয়া বসিয়া ক্ষেত্রের কাজ করিত। এই মূর্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলীর বা মঙ্গোলীয় ধরণের কৃষকের মূর্তি।
সঙ্গীতজ্ঞ নীরদ
নীরদ একেবারে প্রথম সাড়ির সঙ্গীতজ্ঞ যেমনটা ছিলেন ইমানুয়েল কান্ট, ফ্রেডরিক নিৎসে, বাট্রান্ড রাসেল, এডওয়ার্ড সাঈদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখ। তবে পার্থক্য হলো তিনি শেষ দুজনার মত না হয়ে প্রথম চারজনার মতো ছিলেন।
তিনি ছিলেন সঙ্গীতের উচু মানের ভোক্তা, ক্রেতা, সমালোচক ও সমঝদার। কিন্তু তিনি কোন সঙ্গীত সৃষ্টি করেননি রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মত। তার আত্মজীবনীর ২য় অংশে ম্যোৎজার্টকে নিয়ে কিছু কথা লিখেছিলেন। ঐ বইটির রিভিয়্যু করার সময় এক ইংরেজ লেখক লিখেন- “What a tribute to Mozart!”
তার সঙ্গীতপ্রিয়তা তার বিবাহের পূর্বে একটু ভয় লাগিয়ে দিয়েছিল। কারণ সে ভয় পাচ্ছিল বিয়ের পর স্ত্রী যদি এতে নারাজ হয় এবং তার পছন্দের সাথে স্ত্রীর পছন্দের মিল না হয়!
তার মুখেই শুনি..
“…তখন আমি ইউরোপীয় সঙ্গীতের এমনই অনুরাগী হইয়া উঠিয়াছিলাম যে তাহা প্রায় ভক্তি ও পূজার মত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। সাধারণ ধার্মিক ব্যক্তি যে-ভাবে প্রতিদিনের পূজা-অর্চনা করে আমিও সেইভাবে গ্রামোফোনে ইউরোপীয় সঙ্গীত শুনিতাম। বিবাহের সময় মনে করিতে হইল বাঙালীর কানে ইউরোপীয় সঙ্গীত প্রায় অসহ্য। আমার দাদা দেশীয় সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন, সঙ্গীতবিদও ছিলেন, তিনি আমার ইউরোপীয় সঙ্গীতের রেকর্ড বাড়িতে ঢুকিতেও দিতেন না। সুতরাং ভাবিতে হইল আমার পত্মীর রুচি ও শ্রুতি যদি এই হয়, তাহা হইলে আমি কি করিব। অনেক চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, পত্নীর উপর এই ধরণের জবরদস্তি করিবার অধিকার আমার নাই। সুতরাং বীরের মত আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইলাম। মনে কষ্ট হইলেও স্থির করিলাম, পত্নীর আপত্তি হইলে ইউরোপীয় সঙ্গীত ছাড়িয়া দিব। বিবাহ যে অর্ধেক আত্মবলিদান, এবং অর্ধেক আত্মতৃপ্তি তাহা ভুলিলাম না। এই বীরত্বের কি ফল হইল পরে বলিব।” (আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, বিবাহপূর্ব শঙ্কা, পৃষ্ঠা:২৩৮)
বিয়ের রাতে নীরদ ও তার নববিবাহিত স্ত্রীর মধ্যে প্রথম আলাপনটি তার সঙ্গীতপ্রিয়তার অনন্য সাক্ষর।
বর-কনের মধ্যে প্রথম মুখ খুলেন কনে। তার প্রথম বাক্যটি ছিল “তুমি বড় রোগা, আমি তোমার খুব যত্ন করবো”। আর আমাদের আহাম্মক বর প্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করেন সেটি ছিল, “তুমি কি ইউরোপীয় সঙ্গীত শুন?” যথারীতি কনের উত্তর ছিল ‘না’।
এবার বোকা বর দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়ে যেটা ছিল এমন, ‘তুমি বেটোফেন বলে কারো নাম শুনেছ?’
‘তুমি বেটোফেন বলে কারো নাম শুনেছ?’
কনে: হ্যা।
নীরদ: তার সঙ্গীত শুনেছো?
কনে: না
নীরদ: তার নামটা বানান করতে পারো?
ভাগ্য ভালো কনে নামটা বানান করতে পেরেছিলেন। বানানটা ছিল এমন BEETHOVEN ।
আচ্ছা কেউ বিয়ের রাতে কনেকে এই প্রশ্ন করে? অনেকেই নীরদকে গালি দিয়েছে আমিও একটা গালি লিখেছি বইটির মার্জিনে। সেটা হলো “শালা ইডিয়ট”।
সমন্বয়বাদিতা: ভারতীয় চিন্তার ভুল ও ইউরোপীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব
নীরদ তার ‘বর্তমান ভারতের সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে বলেন-
“আমরা ইউরোপীয় ও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমপর্যায়ের জিনিস বলিয়া জ্ঞান করিয়া আসিয়াছি। প্রকৃতপ্রস্তাবে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য গুরুতর।” (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ২০)
তিনি এর পরের পৃষ্ঠাতেই বেশ দু:সাহস নিয়ে বলেন-
“এক রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী ভিন্ন এই সমাজে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার বহুমুখী কীর্তির কোনও স্মৃতি ছিলনা। এই কারণে উহার সংস্কৃতিকে ইউরোপীয় সভ্যতার সমপর্যায়ের জিনিস বলিয়া ধরিয়া লইলে অত্যন্ত ভুল হইবে। উহা একটা ‘ফোক সিভিলাইজেশন’ বা গ্রাম্য সংস্কৃতি মাত্র।”
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নীরদ বলেন,
“আমরা উনবিংশ শতাব্দী জুড়িয়া সমন্বয়ের ধারণার উপর আমাদের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। কিন্তু ভাবিয়া দেখি নাই প্রকৃত সমন্বয় একমাত্র তাহাদের মধ্যেই সম্ভব যাহাদের শক্তি ও প্রকৃতির সাম্য আছে। আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে যে সহজ গ্রাম্য সংস্কৃতিকে পাইয়াছিলাম, তাহার তুলনায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সভ্যতার শক্তি ও পরিণতি এত বেশি যে এই দুইয়ের মধ্যে সার্থক মিলনের কোনও প্রশ্নই উঠিতে পারেনা।”(নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ২১)
সমাপনী
নীরদকে যে অল্প বিস্তর পড়েছি তাতে এই মনে হয়েছে তাকে নিয়ে গভীর পাঠের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি যদি সবচেয়ে বেশি সমালোচনার বিষয় হন তাকে নিয়ে আলোচনার দরকার তার চেয়ে কম নয়!
পাঠককে শুধু সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো নয়, খোঁচা মেরে মাঝে মাঝে রক্তাক্ত করাও যদি লেখকের কাজ হয় নীরদ সে তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন। তবে মহান লেখকেরা খোঁচা দিয়ে আবার মলম লাগিয়ে দেন পরম মমতায়। এ দুটো কাজই মহান লেখকের কাজ। নীরদ হয়তো সবচেয়ে বড় খোঁচা মারা লেখকদের একজন। তিনি যদি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার মলম মারা লেখক না হন তাহলে আমরা কি করতে পারি? তার খোঁচায় আমরা রক্তাক্ত হই, কষ্ট পাই-কিন্তু খোঁচার প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করতে পারি?
আমি কোন শেষ টানছিনা। শেষ টানা সবসময়ের কাজ নয়। শুরু করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তারপর এটাকে টেনে নেয়া। নীরদকে ভবিষ্যৎ ভালো করে স্টাডি করবে বা করতে হবে। কারণ নীরদকে শত্রু মনে করে এমন লোকের সংখ্যাই দেশে বেশি। আর বন্ধুর চেয়ে শত্রুকে গভীর অধ্যয়ন করা কত গুরুত্বপূর্ণ এটা বাঙালী এখন না বুঝলেও ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ঠিকই বুঝে নিবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে বন্ধুকে ঠিকমত স্টাডি না করলে সমস্যা নাও হতে পারে। কারণ তার থেকে কোন উপকার না পেলেও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তুকে শত্রুকে যতি ঠিকমত স্টাডি না করি তাহলে ব্যক্তি শুধু ভোগবেনা, ভুগবে সমাজ, দেশ ও জাতি! নীরদ এমন এক ব্যক্তি যার কথায় কানে তুলা দিয়ে থাকা যাবেনা। কারণ কানে তুলা দিলেই তো ঝড় থেমে যায়না। নীরদ একটি ঝড়ের নাম এবং তাকে খুবই মনোযোগ ও যত্ন সহকারে অধ্যয়ন করতে হবে!
লেখককে কতটুকু ধরতে পেরেছি তার কথা না হয় ভবিষ্যতের আলোচ্য বস্তু হউক। লেখক নীরদ মনে করেন তাকে এক বিদেশী ভদ্রলোক ভালো ধরতে পেরেছেন।
‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ তে বাঙালি পণ্ডিতেরা যে তাকে কম ধরতে পেরেছে এর উল্লেখ করে বলেন:
“কিন্তু একজন বিদেশী পণ্ডিত আমার ব্যক্তিত্বের আসল রূপ চিনিতে পারিয়াছেন। তিনি শিকাগো ও কেমব্রিজের অধ্যাপক এডোয়ার্ড শিলস্। তিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি কাল ধরিয়া আমাকে জানেন। কিছুদিন আগে তিনি ‘আমেরিকান স্কলার’ বলিয়া যে একটি পত্রিকা আছে তাহাতে আমার সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত করিয়াছেন। উহার এক জায়গায় তিনি লিখিয়াছেন,-
“Mr Chaudhuri’s being an Indian and a Bengali, and a European and Englishman, all at the same time is unique. He is perhaps the only one of his kind and there is no established name for the likes of him. Perhaps the old designation of “citizen of the world’ is the only one available…Mr. Chaudhury is the real thing.
নোট:
নীরদের বইয়ের ক্রম
নীরদ প্রথমে একজন লেখক আর লেখকের জীবনী হচ্ছে তার লেখা বই। অনেক লেখকই আত্মজীবনী লেখেন আবার অনেকেই লেখেন না। লেখকের প্রত্যেকটি বইয়ে কিন্তু তার জীবন থেকে যায়। সে অর্থে আগে লেখক নীরদের প্রকাশিত বইয়ের নামগুলো ও প্রকাশ সাল উল্লেখ করছি:
ইংরেজিতে লেখা বই
• The Autobiography of an Unknown Indian (1951)
• A Passage to England (1959)
• The Continent of Circe (1965)
• The Intellectual in India (1967)
• To Live or Not to Live (1971)
• Scholar Extraordinary, The Life of Professor the Right Honourable Friedrich Max Muller, P.C. (1974)
• Culture in the Vanity Bag (1976)
• Clive of India (1975)
• Hinduism: A Religion to Live by (1979)
• Thy Hand, Great Anarch! (1987)
• Three Horsemen of the New Apocalypse (1997)
• The East is East and West is West (collection of pre-published essays)
• From the Archives of a Centenarian (collection of pre-published essays)
• Why I Mourn for England (collection of pre-published essays)
বাংলায় লেখা বই
• বাঙালি জীবনে রমণী
• আত্মঘাতী বাঙালি
• আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ
• আমার দেবোত্তর সম্পত্তি
• নির্বাচিত প্রব্ন্ধ
• আজি হতে শতবর্ষ আগে