Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

লেখার লক্ষ্য : নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী 

Reading Time: 4 minutes

মানুষের উদ্দেশ্য অন্তহীন, উপায়েরও অন্ত নেই। উপায়টার যে ব্যবহাররূপ, তাকে বলি কাজ। সাহিত্যও একটা কাজ। তার কোন উদ্দেশ্য? 
প্রশ্নটা কিছু নতুন নয়। বস্তুত এতই পুরোনো যে, পুনশ্চ এ নিয়ে আর খোঁচাখুঁচি করা ঈষৎ ক্লান্তিকর। নানান সময়ে, নানানতর পরিস্থিতিতে, এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, সাহিত্যিকরা তার উত্তর দিয়েছেন। সে-উত্তর কিছু দিনের জন্য মানুষকে শান্ত রেখেছে, চিরদিনের জন্য রাখেনি। তা যদি রাখত, নতুন করে এই প্রশ্ন তবে আর উত্থাপিত হত না। প্রশ্নাবলী উত্থাপিত হয়েছে নানানতর ভাবে ; কখনও নিছক অনুসন্ধিৎসার থেকে, কখনও উত্তর আদায়ের ভঙ্গিতে।
আগে-আগে সাহিত্যিকরাই এ-সব প্রশ্নের জবাব দিতেন, ভঙ্গিটা পাল্টাবার পর থেকে আর দেন না। ইদানীং রাজনৈতিক নেতারা দিচ্ছেন। 
উত্তরমালা আমাদের মুখস্থ নয়। শুধু জানি, মূল উত্তর দুটো। এক দল বলেছেন, সাহিত্যের জন্যই সাহিত্য ; অন্য দল বলেছেন, জীবনের জন্য। এবং জীবন বলতেই যেহেত এরা সমাজজীবন বোঝেন, তাই এদের দাবি, সমাজসেবাতেই সাহিত্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করুক। সেটাই তার পরম উদ্দেশ্য হোক, সেইখানেই তার চরম সার্থকতা। দৃশ্যত, বিরোধের এইখানেই সূত্রপাত। কার্যত, এইখানেই এ-বিরোধের সমাপ্তি ঘটা উচিত ছিল। কেন, সেই কথাই বলছি।। 
মানুষ যে সমাজবদ্ধ জীব, এবং সমাজের উন্নতিতে যে তারও উন্নতি, তা নিয়ে, আশা করি, আর আপত্তি উঠবে না। যদি ওঠে এই প্রবন্ধ তা হলে অবান্তর। গোড়ার থেকেই তা হলে আলোচনা শুরু করতে হয়। সে-আলোচনা, বলাই বাহুল্য, সাহিত্য নিয়ে হবে না ; মানুষের সঙ্গে তার পরিবেশের সম্পর্ক-নির্ণয়াত্মক একখানা নৃতাত্ত্বিক প্রবন্ধে গিয়ে ঠেকবে। তর্কের খাতিরেই ধরে নিচ্ছি, সমাজ আমাদের প্রাণধারণের জলবায়ু, আমাদের অস্তিত্বের প্রধানতম শর্ত। জলবায়ুটা যাতে বিশুদ্ধ করে তোলা যায়, তার দায়িত্বটাও তাই আমাদেরই। 
প্রশ্ন হল, কী করে তা করা যায়? উত্তর হল, বিশেষ কোনও একটা ছক-কাটা পথে তা করা যায় না। এটা নেতিবাচক উত্তর, এতে কেউ খুশি হবেন না। তাই প্রত্যয়বাচক ভঙ্গিতে বলি, বহুধা পথেই সমাজকল্যাণ সম্ভব। অর্থাৎ? যে যার নিজের পথেই অগ্রসর হতে পারেন, সমাজকে তার সেবা দিয়ে পরিপুষ্ট করে তুলতে পারেন। বৈজ্ঞানিক তাঁর বিজ্ঞানসাধনার পথে, শ্রমিক তার শ্রমের পথে, কৃষক তার কর্ষণের পথে। এ যা বলা হল, এর সবই কোনও না-কোনও একটা কাজ। আগেই বলে নিয়েছি, সাহিত্যও একটা কাজ। তা যদি হয়, সাহিত্যিকের কাছেই বা সমাজ তার সেবা পাবে না কেন? 
সাহিত্যিকের কাছেও পাবে। তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবে। 
শুধু সাহিত্যিকদেরই বা এ-ব্যাপারে একটা আলাদা কোঠা নির্দিষ্ট করে দিয়ে লাভ কী, প্রত্যেকেই বস্তুত সমাজকে এই পরোক্ষ সেবাই দিয়ে থাকেন। ‘সমাজকল্যাণ করছি’– অষ্টপ্রহর এই চিন্তা মনে রেখে কি কেউ কাজ করেন? প্রত্যেকেই তার নিজস্ব প্রয়োজনে কাজ করে যান। বৈজ্ঞানিক, শ্রমিক এবং কৃষকও তার ব্যতিক্রম নন। প্রয়োজনটা নিজস্ব হলেও পরোক্ষভাবে সমাজ তাতে উপকৃত হয়। 
বিবৃতি প্রদানের সময় কি আমরা এত কথা মনে রাখি? রাখি না। সমাজকেই তখন সামনে এগিয়ে দিই। তাতে করে আমাদের কাজের ওপর বেশ একটা মহত্ত্বের প্রলেপ পড়ে। তখন বলি, যা কিছু আমরা লিখি, সমাজের জন্যেই লিখি। এইটুকু বলেই থামি না। আরও এক ধাপ এগিয়ে বলি, সমাজের জন্যে লিখলে তবেই সে-লেখা ভালো হয়। সমাজবোধটা সেখানে সাহিত্যের ভালো-হয়ে-ওঠার একটা শর্ত। 
সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমাজ-চেতনার উপর যদি কেউ অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন, তবে সে সমাজবাদী লেখকগোষ্ঠী। সম্প্রতি একখানা ‘সমাজবাদী’ গল্প-সংকলন পড়বার সৌভাগ্য হয়েছিল। গল্পগুলির মধ্যে সমাজচেতনা, সমাজের সর্বপ্রকার কল্যাণসাধনের আকাঙ্ক্ষা, খুব প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত। সুতরাং পূর্বোক্ত নিয়ম অনুযায়ী সাহিত্য হিসেবেও এগুলির সার্থক হয়ে ওঠা উচিত ছিল। তা কিন্তু হয়নি। অনেকগুলি আবার গল্পই হয়ে ওঠেনি। অথচ এঁরা সমাজবোধসম্পন্ন লেখক, সমাজের হিতসাধনই এঁদের শিল্পকর্মের একমাত্র আদর্শ। সে-আদর্শ আমাদের হৃদয়কেও প্রবলভাবে নাড়া দেয়, তাকে আমরা শ্রদ্ধাও করি। সেই সঙ্গে এ-কথাও বলি, অন্য কোনও উপায়ে তা সফল করতে গেলেই যেন ভালো হত। দুর্বল কতকগুলি গল্প লেখার কী এমন দরকার ছিল? সমাজের এতে উপকার হবে না। 
সমাজকে যারা প্রত্যক্ষ গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সকলেরই শিল্পসৃষ্টি দ্বারা সমাজ যেমন কিছু উপকৃত হয়নি, তেমনি সমাজকে যারা পরোক্ষ গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদেরও সকলের দ্বারা সমাজ এখানে কিছু অপকৃতও হয়নি। আধুনিক সমাজবাদী লেখকগোষ্ঠীর সকলের দ্বারাই কি সমাজ কিছু উপকৃত হচ্ছে? শেলি, কিটস, ব্রাউনিঙ, রবীন্দ্রনাথ–এঁদের দ্বারাই কি সমাজ কিছু অপকৃত হয়েছে? এ-প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য দু’বার করে ভাবতে হয় না। 
ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াল? সমাজকল্যাণের জন্যে লিখলে তবেই সে-লেখা ভালো হবে, এটা এমন কিছু ধ্রুব সত্য নয়। হতে পারে, না-ও হতে পারে। অপরপক্ষে যিনি বলেন, সাহিত্যের জন্যেই সাহিত্য, তার দ্বারাও সমাজের উপকার হওয়া সম্ভব। সাহিত্যিকের শক্তির উপরেই সেটা নির্ভর করছে। লেখাটা যদি ভালো হয়, তবেই সমাজের মঙ্গল। 
কিন্তু সে-কথা থাক। সাহিত্যের দ্বারা কী কী জনকল্যাণকর কার্য সাধিত হতে পারে, তা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। তার দ্বারা কী হয় সেটা পরে ভাবা যাবে, আপাতত দেখা যাক, সে কী চায়। সাহিত্যের উদ্দেশ্য কী, আমরা লিখি কেন? এর উত্তর, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমরা লিখি। জীবনকে জানবার জন্যে। আমাদের অভিজ্ঞতা, আমাদের অনুভূতিকে সম্পূর্ণ করবার জন্যে। 
কথাটার একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। সকলেই স্বীকার করবেন, অভিজ্ঞতাই সাহিত্যকর্মের উৎস। অথচ সাহিত্যিকরা নিজ মুখেই ইতস্তত স্বীকার করেছেন, যে-বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ, সে-বিষয়ে কোনও কিছু লিখতে তারা আদৌ উৎসাহ বোধ করেন না। কেন করেন না? আসলে তারা ভয় পান। অভিজ্ঞতার সেই সম্পূর্ণতাকে সাহিত্যে রূপ দেওয়া যাবে না, সে-ভয় নয়। সাহিত্যে তাকে রূপ দিতে গেলে, পুনশ্চ – চিন্তার ক্ষেত্রে হলেও—যে সেই অভিজ্ঞতার স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, সেই ভয়। জীবনে আমরা দৈহিক অর্থে সুখ অথবা দুঃখ সঞ্চয় করি, লিখবার সময় চিন্তার ক্ষেত্রে তার স্মৃতিকে পুনরাবাহন করতে হয়। যে-সুখ অথবা যে-দুঃখ সম্পূর্ণ নয়, তাকে পুনর্জীবন দেওয়া সোজা। যে-সুখ অথবা যে-দুঃখের অনুভূতি সম্পূর্ণ, তাকে পুনর্জীবন দেওয়া কি এতই সোজা? 
দুঃখের কথাটা বুঝলুম, সুখের কথাটা বুঝলুম না। দুঃখের স্মৃতিকে সাহিত্যিক না হয় না-ই জাগিয়ে তুললেন, সুখের স্মৃতির স্বাদ গ্রহণে তার দ্বিধা কেন? দ্বিধা এইজন্যে যে, যে-সুখ সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ-দুঃখের সঙ্গে তার তিলমাত্রও পার্থক্য নেই। সুখের সম্পূর্ণতা আনন্দে, দুঃখের সম্পূর্ণতা বিষাদে। যা কিনা আনন্দেরই নামান্তর। সুখের সঙ্গে দুঃখের তফাত রয়েছে, আনন্দের সঙ্গে বিষাদের নেই। এর দুয়ের ভারই সমান দুঃসহ। 
সম্পূর্ণ অনুভূতি নিয়ে যে সাহিত্যসৃষ্টি হয় না, তার আরও একটা কারণ আছে। অনুভূতি যাঁর সম্পূর্ণ, তার সকল চাওয়াই মিটেছে, তার সকল পাওয়াই তিনি পেয়ে গেছেন। তিনি আবার লিখতে যাবেন কোন দুঃখে? এ-অনুভূতি সাহিত্যিকের কিছু একচেটিয়া সম্পত্তিও নয়। এই সম্পূর্ণতাকে সকলেই স্পর্শ করেন, জীবনের কোনও-না-কোনও ক্ষেত্রে করেন। শ্রমিক তার শ্রমের মধ্যে একে পান, কৃষক তার কর্ষণের মধ্যে। 
আমরা পাইনি। পাইনি বলেই আমরা লিখি। যে-কারণে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে সাহিত্য লেখা হয় না, ঠিক সেই কারণেই আবার অর্ধ-অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা সাহিত্য-সৃষ্টির তাড়না বোধ করি। জীবনের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা অর্ধেক, সৃষ্টির মাধ্যমে—চিন্তার ক্ষেত্রে হলেও –বাকি অর্ধেক আমাদের অর্জন করতে হয়। জীবনের ভাণ্ডারকে এই পথেই আমরা সম্পূর্ণ করে তুলি। না-লিখেই যদি সেই সম্পূর্ণতাকে অর্জন করা যেত, আমরা লিখতুম না।
——————-
রচনা : ১৯২৪

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>