ট্যাক্সি চালকের উপখ্যান : নির্মাল্য বিশ্বাস

Reading Time: 4 minutes

আজ ২৪ সেপ্টেম্বর কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক নির্মাল্য বিশ্বাসের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


ইনস্যুরেন্স অফিসের কাজ মিটতে রাত হয়ে গেল। ট্যাক্সিতে শরীর এলিয়ে শহরটাকে দেখছি। কলকাতায় আসার আগে ঠিক করেই নিয়েছিলাম যাচ্ছি যখন এই রহস্যের কিনারা করেই ফিরব। 
ভীড়ের রাস্তা ছেড়ে ট্যাক্সি বাইপাস ধরতেই স্পিডের কাঁটা এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেল।খোলা জানালা দিয়ে দুপাশের দোকানপাট, মানুষজনগুলোকে দেখতে দেখতে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম এই শহরের বদল কতটা হয়েছে। বারো বছর খুব একটা কম সময় নয়। এত বছর পর ওই মানুষটার সাথে যদি হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায় তাহলে চিনতে পারবে তো?
শিবুর মধ্যে যে কী দেখেছিলাম নিজেই জানি না। আমার সাথে চোখাচোখি হলেই মুচকি হাসত। আমি না দেখার ভান করে হনহন করে এগিয়ে যেতাম। 
সেদিন নোয়াপাড়ার সাথে ক্রিকেট ম্যাচ ছিল আমাদের। ক্রিকেট ম্যাচ থাকলেই বই-খাতা ফেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। ক্রিকেটের প্রতি যত না আগ্রহ তার থেকে অনেক বেশি আগ্রহ শিবুকে দেখার। বল হাতে বিদ্যুৎ গতিতে পপিং ক্রিজের দিকে ধেয়ে আসছে এটা দেখার মধ্যে এক ধরণের রোমাঞ্চ ছিল। মায়ের ডাকাডাকি কানেই ঢুকত না তখন।
– কী রে ঝুমা, বেলা দুটো বাজতে চলল। খাওয়াদাওয়া কি আজ আর করবি না? 
– যাচ্ছি যাচ্ছি। আর পাঁচটা মিনিট।
বিপক্ষের একটাই উইকেট অক্ষত আছে। তবে ম্যাচের তিন ওভার বাকি এখনও। জিততে হলে ওদের করতে হবে মাত্র দুটো রান। শিবুর কোটার আর মাত্র এক ওভার বাকি। দলের অধিনায়ক শিবুর হাতে বল তুলে দিয়েছে। সব আশা- ভরসার কেন্দ্রবিন্দু এখন ওই-ই। 
শিবু জানে যা করার এই ওভারের মধ্যেই করতে হবে। না হলে শেষ দু’ ওভারে ঠিক দুটো রান তুলে নেবে ওরা। প্রথম চারটে বল দেখেশুনে ছেড়ে দিল ওরা। আগের চার ওভারে চার উইকেট তুলে নিয়েছে শিবু। তাই দেখেশুনে ওর ওভারটা খেলে দিতে পারলেই ম্যাচটা বার করে নেবে ওরা। 
বল হাতে নিয়ে আমাদের বারান্দার দিকে একবার তাকাল শিবু। দৌড় শুরু। উত্তেজনায় চোখের পাতা পড়ছে না। 
গুড লেন্থ স্পটের বেশ কিছু আগে বলটা লাফিয়ে উঠল অনেকটা। ব্যাটসম্যান ব্যাটটা সরাতে গিয়েও পারল না।ব্যাটের কানায় লেগে বল উঁচু হয়ে ফার্স্ট স্লিপের কাছে। ওই ক্যাচটা ধরতে পারলেই ম্যাচের নিষ্পত্তি। উত্তেজনায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। গগনভেদী চিৎকারে যখন চোখ খুললাম তখন শিবুকে কোলে তুলে নিয়েছে সবাই। 
ওর সামনে যতই ডোন্ট কেয়ার অ্যাটিটিউড দেখাই, আমার ভেতরে বরফ গলতে শুরু করেছিল অনেক আগে থেকেই। তবে এই বাউণ্ডুলে ছেলের সাথে নিজেকে জড়ালে ভবিষ্যতে যে কী দুর্গতি অপেক্ষা করে আছে সেটা ভাবলেই আঁতকে উঠতে হয়। ওর সাথে কথা বলতে দেখলেই মায়ের ভুরুজোড়া কাছাকাছি চলে আসত। মেয়েকে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে দিতে না পারলে পরিবারের মান থাকবে না। যদি আগেভাগে কিছু করে বসি, তাই আগাম সতর্কতা মায়ের। 
একদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। শিবুকে ডাকলাম।বললাম, 
– একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে লন্ডনের ডাক্তার। মা এই সম্বন্ধ কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। 
শিবু ছেলেমানুষের মতো কাঁদল। 
-তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। 
– থাকতে হবেও না। সেইজন্যই বিয়েতে রাজি হয়ে যাচ্ছি। 
শিবু কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওর কথাগুলো আমার ঠোঁটের মধ্যে হারিয়ে গেল। 
কলিংবেল বাজছে। বাবা-মা সময়ের আগেই চলে এসেছে। দুজনকে দেখে একটা কথাও বলল না। পরের মাসেই ফ্ল্যাট কিনল বাবা। শহরের অন্য প্রান্তে চলে গেলাম আমরা। বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারিনি আমি। শিবু পড়াশোনা জানে না।গাড়ি চালাতে জানে। সেই নিয়েই আমার স্বপ্ন দেখা শুরু। 
আমার বিয়ের আর পনেরো দিন বাকি । নতুন কেনা গয়নার মধ্যে থেকে একটা নেকলেস বেপাত্তা হয়ে গেল। বাবা থানা- পুলিশ করতে যাচ্ছিল। বাধা দিয়ে বললাম, বিয়ের আগে এইসব ঝামেলা করতে না যাওয়াই ভালো। তাতে অকারণে সমস্যা বাড়বে। তার চেয়ে বরং নেকলেস ছাড়াই বিয়ে করব। 
নিজে তো জানি সেই নেকলেস কোথায় আছে। বড়বাজারে নেকলেস বেচে যা টাকা পেলাম সেটা শিবুর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, 
– এটা দিয়ে একটা ট্যাক্সি কেনো। পারবে তো আমার দায়িত্ব নিতে? 
শিবুর চোখে রাজ্যের বিস্ময়! 
সেই ডাক্তার ছেলের সাথে তিনদিন পর বিয়ে। অমত করিনি বিয়েতে। শুধু মনে মনে ছক কষে চলেছি। শিবুকে বলাই ছিল আগে। পরদিন বারোটার সময় ইউনিভার্সিটির সামনে ট্যাক্সি নিয়ে আসবে। সেই ট্যাক্সি চেপে আমরা হারিয়ে যাব। ঘর বাঁধব দুজনে। 
পরদিন পার্লারে যাব বলে বের হলাম। ঘড়ির কাঁটাগুলো একটু একটু করে সরছে আর উৎকন্ঠার পারদটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দেখতে দেখতে এক ঘন্টা কাটল। শাড়ির খুঁটটা ধরে অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। দু’টো বাজল। শিবু এল না। কোনোরকমে শরীরটাকে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদলাম কিছুক্ষণ।
শিবু যদি একবার চাইত তাহলে ট্যাক্সি কেনার পুরো টাকাটা এমনিই দিয়ে দিতাম। কোনোদিন ফেরতও চাইতাম না।কিন্তু এটা কী করল শিবু? এতদিনের সব ভালোবাসা, সব বিশ্বাস এক লহমায় শেষ হয়ে গেল। এইভাবে প্রতারণা করতে পারল শিবু? এরপর মন বাঁধলাম। ভবিতব্য স্থির। বাপ-মার সম্বন্ধ করা ছেলেকেই বিয়ে করব। এ ছাড়া কোনও পথ আমার সামনে খোলা নেই। 
বিয়ের পর লন্ডন চলে গেলাম। স্বামী প্রবাসী ডাক্তার। স্বামীর সাথে মোটামুটি সুখী দাম্পত্য জীবন কাটানোর পরও একটা প্রশ্ন প্রতিদিন কুরে কুরে খেয়েছে আমাকে। দীর্ঘ বারো বছর পর এই কলকাতায় আসা। অনেক কিছু বোঝাপড়া করার বাকি আছে। অনেক কিছু জানারও আছে।
সম্বিৎ ফিরল হঠাৎ। ড্রাইভারের পিছনের সীটে ট্যাক্সির নম্বরটা দেখে চমকে উঠলাম। দীর্ঘ বারো বছরেও যা ভুলতে পারিনি। সামনের শপিং মলে ট্যাক্সিটা পার্ক করালাম। ট্যাক্সি থেকে যে নামল সে শিবু নয়, শিবুর ছোটভাই বাদল। আমার মতো বাদলও আমাকে এতক্ষণ খেয়াল করেনি। 
চিনতে পেরে বলল, 
– ঝুমাদি না? 
– চিনতে পেরেছিস তাহলে। দাদা কোথায়? 
– বলছি, চলো। 
শপিং মলের ফুড কোর্টে দুজনে বসলাম।বাদল আমাদের সমস্ত ব্যাপারটাই জানত। এমনকি আমার আর শিবুর মধ্যে চিঠিপত্তর আদান-প্রদানের মাধ্যমও ছিল বাদল।
কফিতে চুমুক দিয়ে বাদল বলল, 
– যেদিন তোমার ইউনিভার্সিটির সামনে দাঁড়ানোর কথা, দাদা তখন হাসপাতালের বেডে। 
– কেন? কী হয়েছিল দাদার? 
অন্যমনস্কের মতো বাদল বলে চলল, 
– রাতে দুটো মেয়ে দাদার ট্যাক্সিতে ওঠে। মেয়ে দুটো সম্ভবত বার সিঙ্গার ছিল। দাদা ট্যাক্সি গ্যারেজই করছিল, কিন্তু অত রাতে মেয়ে দুটোর অসহায়তার কথা ভেবে গাড়ি ঘোরাল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর একদল বাইক আরোহী দাদার ট্যাক্সি আটকায়। তিনটে ছেলে ট্যাক্সিতে উঠে দাদার পিঠে ছুরি ঠেকিয়ে গাড়ি অন্যদিকে ঘোরাতে বলে। মেয়ে দুটির সাথেও অশালীন আচরণ করা শুরু করে। কিছুটা যাওয়ার পর ছেলেরা বুঝতে পারে গাড়ি তাদের নির্দেশিত রাস্তায় না গিয়ে অন্য রাস্তায় চলেছে ; তখন ছুরিটা সমূলে বিঁধিয়ে দেয় দাদার পিঠে। 
আমার মুখ দিয়ে অস্ফুটে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। সেই আওয়াজ বাদলের কানে পৌঁছল কি? 
ও বলেই চলেছে, 
– সেই অবস্থাতেও স্টিয়ারিং ছাড়েনি দাদা।থানার সামনে এসে চিৎকার করলে ছেলেগুলো পালায়। 
একটানা কথাগুলো বলে থামল বাদল। মনে হয় আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে না পেরে বললাম, 
– তারপর? 
– তারপর দু’দিন যমে-মানুষে টানাটানি চললেও বাঁচানো গেল না দাদাকে। 
কথাটা শোনার পর মনে হল যেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। বাদলের দিকে তাকালাম। অনেক পুরনো দিনের এক দুঃসহ যন্ত্রণার স্মৃতিকে ও যেন মাটি খুঁড়ে ওপরে তোলার চেষ্টা করছে। 
– দাদার মৃত্যুসংবাদটা তোমাকে দিতেও এসেছিলাম।এসে দেখলাম তোমার সেদিন বিয়ে। তাই বিরক্ত করা ঠিক হবে না ভেবে ফিরে গেছি। 
আমার দু’চোখে রাজ্যের অন্ধকার নেমে এল। সেদিকে তাকিয়ে বাদল বলল,
– তুমি একবার বাড়ি চলো ঝুমাদি। দাদাকে দেওয়া তোমার ট্যাক্সি কেনার টাকাটা আমি জমিয়ে রেখেছি। দাদা বলেছিল, যদি কোনোদিন পারি টাকাটা যেন তোমার হাতে দিয়ে আসি। 
কী যেন একটা অনুভূতি দলা পাকিয়ে আছে গলার কাছে। সেটাকে ভেতরে ঠেলে বললাম, 
– টাকা নিতে আমি এত বছর পর কলকাতা আসিনি ভাই। টাকাটা তোরই থাক। আমি শুধু যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম এতগুলো বছর ধরে, আজ পেয়ে গেলাম। 
ট্যাক্সিতে উঠলাম। দরজায় ঢোকার মুখে মাথাটা এমনিতেই নীচু করতে হয়। দেখলাম ট্যাক্সিতে শিবুর ছবি রেখে দিয়েছে বাদল। সেদিকে তাকাতেই মাথাটা আরো নীচু হয়ে গেল। 
[নির্মাল্য বিশ্বাসের এই গল্পটি শব্দের মিছিলে প্রকাশিত। লেখকের জন্মতিথিতে তা পুনঃপ্রকাশ করা হলো।]

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>