| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্র সংখ্যা: ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ ও ‘পুনরুত্থান । শমীক ঘোষ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ ও ‘পুনরুত্থান’ :

ক্ষমতার অসীম গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের বৃত্তান্ত


“The path of the Novel emerges as a parallel history of the Modern era.”[1]

ইদানিং আধুনিক শব্দটা ব্যবহার করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কঠিন কারণ আধুনিক শব্দটা ব্যবহার করলেই অনেকে রে রে করে ওঠেন। ‘আধুনিক নয় উত্তরাধুনিক।’ অথচ ইংরাজি ‘Modern’ বা বাংলা ‘আধুনিক’ শব্দের একটা নির্দিষ্ট মানে আছে। আধুনিক অর্থাৎ বর্তমান কালের, সাম্প্রতিক, হালের…[2]। সাম্প্রতিক মূলধারার বাংলা উপন্যাসের বেশীর ভাগেরই কেন্দ্রবিন্দু বাঙালি নব্য ধনী। বেশীরভাগেরই প্রধান চরিত্র শহুরে। যদি বা গ্রামের হন, তাহলেও তাঁর আচার ব্যবহার শহুরে শিক্ষিতের মতই। অর্থাৎ বেশীরভাগ বর্তমান বাঙালি লেখকরাই মূলত বিশ্বায়নের প্রতিভূ বা বিশ্বায়নের ফলে লাভবান শ্রেণীকেই তাঁদের প্রধান চরিত্ররূপে কল্পনা করেন। হয়ত এর মূল কারণ হল যে এই শ্রেণীই আসলে তাঁদের উদিষ্ট ভোক্তা। ফলে কুন্দেরার যে কথাটা দিয়ে এই লেখাটা শুরু হল সেই কথাটা সাম্প্রতিক মূল ধারার বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে খাটে না। এই উপন্যাসগুলো সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসের সমান্তরাল কোন বয়ান হয়ে ওঠে না। বরং ইতিহাসের মূল গতিপথ ধরেই হাঁটতে থাকে এবং ক্ষমতার নিজস্ব বয়ানেই আটকে থাকে। ফলে সেই উপন্যাসগুলিতে রাজনীতিও গৌণ হয়ে ওঠে। সামাজিক-রাজনৈতিক বয়ান পরোক্ষ হয়ে ওঠে।

অমর মিত্রের উপন্যাস এইখানেই আলাদা। তিনি মূলধারার নন এমন বলা যাবে না। কারণ তাঁর লেখালেখি বহুল প্রচারিত বিভিন্ন কাগজে দেখা যায়। আবার তিনি মূলধারার কাহিনী এবং চরিত্রের একরৈখিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে। তাঁর আখ্যানের বয়ান ক্ষমতার নিজস্ব বয়ানের সমান্তরাল। বহু ক্ষেত্রেই তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রান্তিক। এবং সেই প্রান্তিকতা শুধু শ্রেণীর প্রান্তিকতা নয়, ক্ষমতাহীনের প্রান্তিকতা।

এই লেখার বিষয়বস্তু অমর মিত্রের যে দুটি উপন্যাস নিয়ে, তাদের একটি ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ ২০০১ সালে প্রকাশিত।[3] অন্যটি ‘পুনরুত্থান’ খুব সাম্প্রতিক রচনা।[4] দুটি উপন্যাসেরই মূল কাহিনীর মধ্যে মিল আছে। দুটি উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুই দু’জন মানুষ যাঁরা রাষ্ট্র তথা পুলিশের কাস্টডিয়াল কিলিং এর ভুক্তভুগি। দুটি উপন্যাসই আয়তনে ক্ষুদ্র। এবং দুটি উপন্যাসেই এই খুন হওয়া মানুষগুলো উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু মূল চরিত্র নন। সংগত প্রশ্ন উঠতেই পারে পরের উপন্যাসটি আগের উপন্যাসেরই পুনরাবৃত্তি কিনা।

সেই প্রশ্নের মিমাংসা করার আগে আগে উপন্যাসদুটির কাহিনী, আখ্যানের গঠনসৌষ্ঠব এবং মূল প্রতিপাদ্য নিয়ে একটু আলোচনা করে নেওয়া প্রয়োজনীয়।

নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান আখ্যায়িত যেন একটি কাল্পনিক মামলার বয়ানে। আদালতের ভাষায়। লেখক প্রথমেই ঘোষণা করেন ‘যাহা কহিব’। এই উপন্যাসের শুরু হল –‘শ্রীযুক্ত মদনমোহন মণ্ডল, নিবাস ২২ নং বস্তি, ৩০/১/২৮ নং গণেশ মিস্ত্রি লেন, গত ১৫ই সেপ্টেম্ব, ১৯৯৯ তারিখে মহামান্য উচ্চ আদালতে একটি আরজিপত্র নিবেদন করেছেন। আরজিটি ভারতীয় সংবিধানের ২২৬নং ধারায় উপস্থাপিত। এই ধারাটি ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করিয়া থাকে যে তা কে না জানে।

শ্রী মদনমোহন মণ্ডল এবং শ্রীমতি সহচরী মণ্ডল এই আরজিপত্রে ঘোষিত ১নং এবং ২নং বাদী। বাদী দুইজন যথাক্রমে শ্রী বৈরাগ্য মণ্ডলের পিতা এবং স্ত্রী। তাঁরা দুইজন গত ৩১শে আগস্ট ১৯৯৯ তারিখে নিখোঁজ বৈরাগ্য মণ্ডলকে আদালতে বিচারের জন্য হাজির করার প্রার্থনা জানিয়েছেন মহামান্য আদালতের নিকটে। এই কাহিনী সেই আরজি নির্ভর। আর্জি যদি সত্য হয় তবে কাহিনী সত্য হতে পারে। আবার তদন্তে বিবাদীপক্ষ যে সমস্ত কথা বলেছেন সত্যাখান অনুসারে, তা সত্য হলেও কাহিনী সত্য, অন্তত অংশত। যা হোক, কাহিনী আরম্ভে এই কাহিনীর নিবেদকও উচ্চারণ করেছেন, যাহা কহিব সত্য কহিব, সত্য ব্যতিত মিথ্যা কহিব না।’

আদালত কেন? কারণ আদালত ক্ষমতার বা রাষ্ট্রকাঠামোর একটি দরবার যেখানে মানুষ সত্য জানতে যান। বিচার চাইতে যান। কিন্তু সত্য কী? কোনটা সত্য? সত্য আংশিক না সম্পূর্ণ? সত্য কথনই বা কোনটা?

“’Truth’ is to be understood as a system of ordered procedures for the production, regulation, distribution, circulation and operation of statements.

‘Truth’ is linked in a circular relation with systems of power which produce and sustain it, and to effects of power which it induces and which extend it. A ‘regime’ of truth.”[5] 

স্টেটমেন্টস- বিবৃতি। একটি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোয় আবদ্ধ। আবার যা ক্ষমতাতন্ত্রের নিজস্ব শৃংখলায়ও আবদ্ধ।  অমর মিত্রের এই উপন্যাস সেই বিবৃতি আর পালটা বিবৃতির খেলার মধ্যে দিয়ে এগোয়। বন্ধ কাঁচকলের কাজ হারানো প্রাক্তণ শ্রমিক বৈরাগ্য মণ্ডলকে পুলিশ বাড়ি থেকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এটা একটা বিবৃতি। বিবৃতি-মাত্রই। সেই বিবৃতি তাঁর স্ত্রী ও বাবার। পালটা বিবৃতি পুলিশের। এমন কিছুই হয়নি। অভিযুক্ত দু’জন পুলিশকর্মী অন্য জায়গায় ডিউটি করছিলেন। বৈরাগ্য মণ্ডল স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁর পরিবারে নিখোঁজ হওয়ার ইতিহাস আছে।

আসলে সত্য দুটো। আর এই দুটোর মধ্যেই লেখকের বিস্তার। অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। তাই পুলিশ নিজেই তার তদন্ত করতে পারে না। অতএব আদালত নিযুক্ত করে বিশেষ তদন্তকারী অখিল শ্রীবাস্তবকে। আর অখিলক এই সত্যের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে পায় সেই লোকটাকে।

এই লোকটা কে তার কোন পরিচয় লেখক দেননা। শুধু এই লোকটা অখিলকে সাহায্য করে বৈরাগ্যর মূল ঘটনা বুঝতে। এই লোকটা যেন সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

আর এই লোকটার মাধ্যমেই লেখক যেন পৌঁছে দেন ১৯৯৯ সালের পশ্চিমবঙ্গে। লক আউট হওয়া বিভিন্ন কারখানা যখন শুধুই মালিকের মুনাফার জন্য ফ্ল্যাটবাড়িতে পর্যবসিত হচ্ছিল। তাৎক্ষণিক লাভ। রিয়্যাল এস্টেটের। সেই লাভ শ্রমিক রেখে উৎপাদনের কারখানা চালানোর থেকে অনেক বেশী। আর এই ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ির নতুন লোকেরা কারখানার সেই উৎপাদন নির্ভর অর্থনীতি কাঠামোর বাইরের। আর পুরোনো কারখানার শ্রমিক কিংবা তাঁদের পরিবার এই নতুন পরিমন্ডলে অভিযোজিত হন ফ্ল্যাটবাড়ির কাজের শ্রমিক হিসাবে। আবার নতুন ক্ষমতার সমীকরণ। নতুন মালিক বনাম নতুন ঠিকা শ্রমিক। মূল কাহিনীর বয়ান থেকে ক্রমশ সরে যায় উপন্যাস। বৈরাগ্যের ঠিক কী হল সেইখান থেকে মূল কেন্দ্রে চলে আসে অন্য একটি আত্মহত্যা – শ্রমিকবস্তিরই অন্য এক দম্পতির।

ক্রমশ বোঝা যায় এই দম্পতির আত্মহত্যার আসল কারণ। ফ্ল্যাটবাড়ির কাজের লোক এই মহিলা ধর্ষিত হয়েছিলেন তাঁর ‘প্রভু’র কাছে। সেই ধর্ষণের প্রতিবাদের কারণে চোর তকমা দিয়ে কাজ থেকে তাড়ানো হয় তাঁকে। এই গরিব দম্পতির অর্থ ছিল না। কিন্তু আত্মসমম্মান ছিল। আর সেই আত্মসম্মানের কারণেই আত্মহত্যা করেন তাঁরা দুজনেই।

অখিল শ্রীবাস্তবের কাছে এই ঘটনার আসল বয়ান তুলে ধরে সেই লোকটাই। সেই তাকে নিয়ে যায় ফ্ল্যাটবাড়ির নারীধর্ষক ধনী ব্যবসায়ীর কাছে। যেমন নিয়ে যায় পার্টির নেতাদের কাছেও। তার মুখ থেকেই উঠে আসে বৈরাগ্য মণ্ডলের অন্য এক বয়ান। কেন তাঁকে পুলিশ ধরেছিল। অথচ এই সব বয়ানই অধিশ্রয়ের বাইরে। ধোঁয়াশায় ঢাকা। কোন কিছুই খুব স্পষ্ট নয়। আবার সম্পূর্ণ অস্পষ্ট। আমরা জানতে পারি বৈরাগ্য মণ্ডল আর সবার মতই লাইনে দাঁড়িয়েছিল ২০০ টাকা ক্ষতিপূরণের জন্য। কিন্তু লম্বা সেই লাইনে কয়েক ঘন্টা দাঁড়ানোর পর সে টাকাটা নেয়নি। সে শুধুই ‘না’ বলেছিল।

‘পুনরুত্থান’ শুরু হয় সোজাসুজি। লেখক তাঁর পাঠককে নিয়ে যেতে চান ন’পাহাড়িতে। ন’পাহাড়ি কয়লা খাদানের অঞ্চল। যেখানে অবৈধ কয়লা খাদানে কাজ করতে করতে হারিয়ে যায় মানুষ। সেই মানুষ, যাঁদের ডিজিটাল ইন্ডিয়া নেই। কিন্তু ইন্ডিয়ার ডিজিটে তাঁরাও আছেন। যেখানে সুরক্ষার সামান্য প্রকরণ ছাড়াই কাজ করতে করতে নিভে যায় এক একজন মানুষ। ভরত কুইল্যা এঁদের কেউ নন। যদিও তাঁর আর্থসামাজিক বৃত্তে তিনি এঁদের মতই একজন। ভরত কুইল্যা এই অবৈধ খাদান নিয়ে চিঠি লেখেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ ধাপে। আর তাই ভরত কুইল্যাকে তুলে নিয়ে আসা হয় থানায়। অবৈধ অ্যারেস্ট শেষ হয় ভরত কুইল্যার কাস্টডিয়াল ডেথের মধ্যে দিয়ে। আর এই খুনের তত্ত্বাবধান করেন আইপিএস অফিসার অনিন্দ্য তালুকদার। এই অনিন্দ্য তালুকদার শুধু আইপিএস নন। তিনি অভিজাত বংশীয়। তাঁকে বাঁচানোর মত ক্ষমতাবান আত্মীয়স্বজন প্রশাসনের নানা স্তরে।

ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে সুরতহাল করা অফিসার ডিএসপিকে বাঁচাতে মিথ্যা রিপোর্ট দেন। এবং পুরো দোষটাই আসলে ঠেলে দেওয়া হয় থানার নির্দোষ অফিসার গোলকবিহারী কুণ্ডুর উপর। আর গোলকবিহারী নিজের রাষ্ট্রের ক্ষমতাতন্ত্রের প্রতিভূ, অথচ সেই একই রাষ্ট্রের কোপ থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়ান এদিকে ওদিকে। পালাতে পালাতে তিনি পৌঁছে যান রাষ্ট্রবিহীন ছিটমহলে।

রাষ্ট্র হল ক্ষমতার এক নিজস্ব প্রকরণ। আর ক্ষমতা মানেই অসীম এক গোলকধাঁধা। যার ভিতরে একবার ঢুকলে বার হওয়ার কোন পথ নেই। সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। নেই তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা। আসলে যা আছে তা হল ক্ষমতার নিজস্ব আধার। যার ফলে মানুষ নিজেই নিজেকে ভুলে যেতে পারে।

অমর মিত্র এর সাথে কোথাও মিলিয়ে দেন পুরুষতন্ত্রকেও। পুরুষের উত্থিত লিঙ্গ আসলে ক্ষমতার এক অবিচ্ছেদ্য চিহ্ন। ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’-এ তাই উঠে আসে এক ধর্ষণের কথা। ‘পুনরুত্থান’-এ ভরত কুইল্যার অত্যাচারের ঠিক একই সঙ্গে চলে অনিন্দ্যের টিভিতে মেয়েদের বিচ ভলিবল দেখা। কিংবা উপাখ্যানের বয়ানের সাথে মিশে যায় ছোটবেলায় বিএসএফ জওয়ানের গোলকবিহারীকে উলঙ্গ করে দেওয়া। কিংবা ট্রেনিং এর সময় কলিগদের তাঁর প্যান্ট খুলে দেখতে চাওয়া সে প্রকৃতই পুরুষ কিনা। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধর্ষণ।

‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’-এ অধিশ্রয়ের বাইরে ঘটে যাওয়া নিপীড়নের ঘটনা। যেখানে অস্বচ্ছ অস্পষ্টতায় ধীরে উপাখ্যায়িত হতে থাকে প্রোমোটার-পার্ট-পুলিশের যোগসূত্র। আর আদালতের বয়ানের মধ্যেও যেন এই মূল কথাটি থেকে যায় অধিশ্রয়ের বাইরে। বরং তা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে পার্টিতন্ত্রের ঘোরাটোপে।

‘পুনরুত্থান’-এ আবার অধিশ্রয় আমলাতন্ত্রের নিজস্ব প্রকোষ্ঠে। সেইখানে খনি মাফিয়া রাজনৈতিক দল থাকে অনুচ্চারিত। বরং ক্রমশ উঠে আসে আমলাতন্ত্রের নিজস্ব ক্ষমতাতন্ত্র। যেখানে উঁচু আমলাকে বাঁচাতে নিমেষে বলি হয়ে যায় নীচু আমলা। এবং সত্যি বা আসলকে ক্রমশ চেপে দিয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় ফাইলে কী লেখা হয়েছিল। গোলকবিহারী তাঁর নিজের চোখে দেখেন থানায় অনিন্দ্য তালুকদারের উপস্থিতি। অথচ আমলাতন্ত্রের জটিল ধাঁধায় হারিয়ে যায় সেই সত্য। সত্য হয়ে ওঠে এইটাই যে অনিন্দ্য তালুকদার সেইদিন আসেননি থানায়। বরং গোলকবিহারীই গ্রেফতার করেছিল ভরত কুইল্যাকে। সেই পিটিয়ে মারে তাকে। জেলা শাসকের কথায় মিথ্যা সুরতহালের রিপোর্ট দেওয়া নিচু আমলা, যিনি নিজের উঠবার সিঁড়ি তৈরী করতে চেয়েছিলেন, তিনিও জড়িয়ে যান সেই আমলাতন্ত্রের জালেই। শুধু রহস্যাবৃত থেকে যায় কিছু ফোন কল, প্রশাসনের সর্বোচ্চ ধাপ থেকে আসা। কিংবা হয়ত সেইগুলোও মিথ্যে। জালি ফোন কল। শুধু নামের জোরে ধামাচাপা পড়ে যেতে পারে রাষ্ট্রের হেফাজতে করা খুন।

আর এই অসীম গোলকধাঁধায়, রাষ্ট্রের নীচু প্রতিনিধি গোলকবিহারী পালাতে পালাতে পৌঁছে যান রাষ্ট্রহীন ছিটমহলে। যে রাষ্ট্র দাবী করে সে আসলে সমাজের সব ধরণের মানুষের প্রতিভূ, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া যার কাজ, সেই রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত থানার আধিকারিক গোলকবিহারী আইন থেকে বাঁচতে পৌঁছে যান আইনশৃংখলাহীন, রাষ্ট্রহীন ছিটমহলে।

আসলে গোলকবিহারীও না বলেছিলেন। না বলেছিল ভরত কুইল্যাও। না বলেছিল বৈরাগ্য মণ্ডলও। আর না ক্ষমতার একমুখি প্রতিষ্ঠানের কাছে এক মারাত্মক দ্রোহ। ক্ষমতাকৃত সত্যের বয়ানের পালটা সত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। তাই না বলা মানুষেরা হারিয়ে যায় মিলান কুন্দেরার ভাষায় Kafkan[6] বা কাফকা-সদৃশ দুনিয়ায়।

“The hypnotic eye of power, the desperate search for one’s own offence, exclusion and anguish of being excluded, the condemnation to conformism, the phantasmic nature of reality and the magical reality of the file, the perpetual rape of private life”[7]

“The struggle of man against power is the struggle of memory against forgetting.”[8]

‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যানের’ সেই লোকটা। যে কে কিছুতেই বোঝা যায় না। অথচ সে যেন স্মৃতি থেকে তুলে আনে ঘটনার প্রকৃত বয়ান। একসময় মনে হয় সে যেন বৈরাগ্য মণ্ডল নিজে। সে যেন কিছুতেই ভুলতে দেবে না তার স্মৃতি। তার সাথে ঘটা ঘটনার সত্য। আর ঠিক তার পাশাপাশি আসেন তার স্ত্রী ও বাবা, কোর্টের নির্দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হওয়ার পরেও, চাপে ভয়ে আশেপাশের মানুষের বয়ান শুনে যাদের মনে হতে থাকে যেন সত্যিই পুলিশ ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাননি বৈরাগ্যকে। বরং তাঁদের স্মৃতিই যেন ভুল। নিপাট মিথ্যে। ক্ষমতার সত্যের কাছে হেরে গিয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়া। ঠিক যে কথা বলেছিল মিলান কুন্দেরার চরিত্র মিরেক। সেই লোকটা যেন এর পালটা সংগ্রামের প্রতীক হয়ে থাকে। প্রতীকই কারণ পাঠকও হয়ত জানেন যে সে সত্যি নয়। ক্ষমতার সত্যের চাপে মুছে যাওয়া অলীক।

‘পুনরুত্থান’-এর গোলকবিহারীর পিঠ যখন পিছোতে পিছোতে গিয়ে দেওয়ালে গিয়ে আটকায়; তিনি যখন স্পষ্ট বোঝেন যে তাঁর আর কোথাও যাওয়ার নেই, তখন তিনিও যেন এই স্মৃতিভ্রষ্ট না হওয়ার লড়াইতেই নেমে আসেন। গোলকবিহারী নিজেই ভরত কুইল্যা হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেই সেই নাম নিয়ে ফোন করতে থাকেন মূল দোষীদের। ভয় দেখাতে থাকেন তাঁদের। গোলকবিহারীর ভরত কুইল্যা হয়ে ওঠা যেমন তাঁদের দু’জনের নিপীড়নের এক ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা বোঝায়; তেমনি বোঝায় ভরত কুইল্যার এবং তাঁর উপরে অত্যাচারের স্মৃতিভ্রষ্ট না হওয়ার লড়াই। ভরত কুইল্যা যেমন দাঁড়িয়েছিল ক্ষমতার বিরুদ্ধে, গোলকবিহারীও তাই হতে চান। ভরত কুইল্যার স্মৃতি হয়েই।

এই দুই উপন্যাস আসলে একে অপরের পূরক। ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’-এ অমর মিত্র ধরেন ক্ষমতার বাইরে থেকে ক্ষমতার অন্তত গোলকধাঁধা। আর ‘পুনরুত্থান’-এ তিনি একই জিনিস ক্ষমতার ভিতর থেকে। আর একই সাথে বুঝিয়ে দেন গত দেড় দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক বয়ানের বদলের কথাও। ১৯৯৯ এর পটভূমিকায় হারিয়ে যাচ্ছিলেন একজন কারখানার শ্রমিক। নিম্নবিত্ত। আর ২০১৬-তে নিপিড়িতের অবস্থান আরো একটু উপরে। তিনি এখন মধ্যবিত্ত।

১৯৯৯ এর শ্রমিককে স্মৃতিভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করতে আসেন একজন অবাস্তব মানুষ – সেই লোকটা। আর ২০১৬ তে নিম্নবিত্ত প্রতিবাদীর স্মৃতিভ্রষ্টতা রক্ষা করতে আসেন একজন মধ্যবিত্ত, যিনি নিজেও পুলিশ। কারণ এই দেড় দশকে বদলে গিয়েছে ক্ষমতার নিজস্ব প্রকোষ্ঠ। তার বয়ান। তার আক্রমণের সর্বজনীনতা। হয়ত তার প্রক্রিয়া অলীক। কিন্তু পৃথিবী জুড়ে চলা মধ্যবিত্তের বিক্ষোভের মতই, তার মধ্যেই আছে পুনরুত্থানের কুহক।

আর এইখানেই বেঁচে থাকে বাংলা উপন্যাস। ইতিহাসের সমান্তরাল বয়ান হিসাবে। যা মূল ধারার, ক্ষমতার ইতিহাসের পালটা বয়ান হয়ে।

[1] The Depreciated Legacy of Cervantes, Milan Kundera 

[2] সংসদ বাংলা অভিধান

[3] নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান, অমর মিত্র, পিপলস্‌ বুক সোসাইটি, বইমেলা ২০০১

[4] শারদীয়া বর্তমান, ২০১৬

[5] Truth And Power, Michael Foucault Interviewers: Alessandro Fontana, Pasquale Pasquino.

[6]

 Somewhere Behind, Milan Kundera

[7] Somewhere Behind, Milan Kundera

[8] The Book of Laughter and Forgetting, Milan Kundera

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত