| 25 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৪) । নিরুপমা বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Nirupama Borgohainঅভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।


 

 

যাই হোক, শইকীয়ানী যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলে নানা ধরনের আবেগপূর্ণ কথা বলেন, শ্রীমতী গোস্বামী চুপ করে বসে থাকেন এবং মনটা জানুয়ারি মাসে পিছিয়ে যেতে চায়। কীযে এক অশান্তির দিন গেল তার– পাঁচ জানুয়ারি থেকে উত্তর কামরূপে কাটাকাটি মারামারির খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল– তারই একটি জায়গার বাসিন্দা হলধর এবং রজব আলী নয়! এই রুণী যে কবেই তার মনের মধ্যে আশঙ্কার একটা ভাব ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাহলে কি তা সত্যে পরিণত হবে নাকি? হলধর এবং রজব আলী পরিস্থিতির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সত্যিই পরস্পরের বুকে ছুরি বসাবে নাকি? না কি ইতিমধ্যে সেরকম একটি সর্বনাশ ঘটে গেছে? খবরের কাগজে পড়ে তো কিছু বোঝা যায় না– মারামারি কাটাকাটি চলছে, বহু মানুষের বাড়িতে আগুন জ্বলছে,গৃহহীন হয়ে অনেক মানুষ আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই পেয়েছে, খবরের কাগজে অবশ্য অসমিয়া মানুষদের ছবি ছাপা হয়েছে,তাঁরা নিজ রাজ‍্যে গৃহহীন হওয়ার ক্রোধ, ক্ষোভ এবং বেদনা ভরা খবর ছাপা হয়েছে, বাংলাদেশিরা নাকি অসমিয়া স্থানীয় লোকের উপরে এই ধরনের অমানুষিক অত্যাচার চালাচ্ছে । হে প্রভু দেখতে দেখতে চোখের সামনেই যে কীসব ঘটনাগুলি ঘটতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে অসমিয়া মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বাঙালি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সামনে এক একটি সম্ভাবনাপূর্ণ রঙ্গিন সুদীর্ঘ ভবিষ্যৎ থাকা কোমল বয়সের ছেলে মায়ের বুক শূন্য করে অকাল মৃত্যুবরণ করেছে।ওদের প্রাণ বা কি আশা আকাঙ্খায় ভরপুর হয়েছিল, কে কী ধরনের কল্পনার মধুর স্বপ্ন রচনা করেছিল– এক মুহূর্তে, মৃত্যুর এক অতর্কিত আক্রমণে সেই সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত আকাঙ্ক্ষা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।


আরো পড়ুন: অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৩) । নিরুপমা বরগোহাঞি


কিন্তু আগের একটি-দুটি মৃত্যুর গুরুত্ব এবং শোক যেন অনেকখানি হ্রাস হয়ে গেল এই সমস্ত পাইকারি হারে মৃত্যুর সামনে। মৃত্যু এত সহজ, মানুষকে স্পর্শ না করা ধরনের, এত মূল্যহীন হয়ে গেল কি? তবে না, নিশ্চয় না, শুনে শুনে দেখে দেখে অন্যের জন্য অন্যের মৃত্যু সহজ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুভূতিতে মৃত্যুর ছাপ পড়ে  একইভাবে, সে থেকে যায় সেই চির অনাদি অনন্ত রহস্যময়’ বিচ্ছেদের দস্যু ভয়ংকর’ মৃত্যু হিসেবেই যে প্রিয়জনের বুকের একটুকরো বৃহৎ অংশ কুড়ে কুড়ে খুঁড়ে বের করে নিয়ে সেই বুকে এক গভীর শূন‍্য গহ্বরের সৃষ্টি করে রেখে যায়…

উত্তর কামরুপে কত নিরীহ জনের জীবন ধ্বংসযজ্ঞে আহুতি দেওয়া হল আর সেই অকাল, অভাবনীয় এবং নৃশংস মৃত্যু কতশত হৃদয় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে গেল সে কথা রুণী উত্তেজিতভাবে বাবা এবং মাকে বলেছিল,রুণীর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাকি সম্পূর্ণ অঞ্চলটা ঘুরেফিরে দেখে এসেছে। নিজের চোখে দেখা সেই ঘটনা গুলির বিবরণ দিয়ে রুণীর বন্ধু নাকি বলেছে যে দেশ বিভাজনের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সেই হিন্দু বাঙালি মানুষগুলি অসমের মাটিতে আশ্রয় নিতে এসে এখানেই চিরস্থায়ী হয়ে বসতি স্থাপন করে। তাদের এখন অসমই একমাত্র আশ্রয়স্থল, অসমই ঘর, পূর্ববঙ্গে ফিরে যাবার পথ তাদের কাছে এখন সম্পূর্ণ রুদ্ধ; এখন আর পূর্ববঙ্গ বলে কোনো জায়গা নেই। দেশ বিভাজনের সময় প্রথমে পাকিস্তান এবং এখন বাংলাদেশ হওয়া জায়গাটিতে তাদের জন্য এক তিলও ঠাঁই নেই। এরা সেই তখন থেকে অসমে বসবাস করে অসমের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে, অসমিয়া মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছে– অন্তত উত্তর কামরুপে একথা একেবারে সত্যি যেখানে বিদেশি বিতাড়নের নামে এই ন– অসমিয়াদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে । কিন্তু কি দুঃখ এবং পরিতাপের কথা যে এদের উপরে হওয়া এই নারকীয় অত্যাচারের জন্য আমাদের কোনো একজন দেশপ্রেমিক খবরের কাগজে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলল না, সহানুভূতি জানিয়ে কিছু লিখল না । তাদের খবরের কাগজের পাতা ভর্তি হয়ে রইল কেবল উত্তর কামরূপের জনগণের উপরে সিআরপি এবং মিলিটারি করা বর্বর এবং নিষ্ঠুর আক্রমণের বর্ণনায় । এই ধরনের পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন জনগণকে আসল সত‍্যের থেকে অনেক দূরে রাখল। এখন গ্রামের মানুষের কাছে চোখের জল ফেলা শহরের খবরের কাগজ এবং মানুষের কতটা দূরত্ব গত ৩২ বছরের অভিজ্ঞতায় তাদের আর বুঝতে বাকি নেই। কুম্ভীরাশ্রু আর আসল চোখের জলের মধ্যে পার্থক্য গ্রামের জনগন নিজের রক্ত এবং ঘামের দামে ভালো করে বুঝতে পারে । চড়া দাম এবং অন্যান্য দাবিতে শহরে যখন শ্রমিক-কৃষক শোভাযাত্রা বের করে তখন আমরা কোন দিন কয়জন শহরবাসী সহানুভূতির সঙ্গে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে গিয়েছিলাম বাবা?… 

গোস্বামী এবং শ্রীমতী গোস্বামীর মুখে ধীরে ধীরে এক অজানা আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। যারা মরার তারা তো মরেছেই,এখন সাংঘাতিক মেয়েটি এই ভীষণ কথাগুলি বলে দেখছি তাদের ও বিপদ ডেকে আনবে–। 

যেন দেওয়ালেরও কান আছে, তেমনই এক আতঙ্কিত ভঙ্গিতে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে গোস্বামী প্রায় চাপা কণ্ঠে বললেন–’এই রুণী, এত চিৎকার করে করে এই কথাগুলি বলিস না, দিনকাল খুব খারাপ, যতটা সম্ভব আমাদের না দেখা, না শোনার ভান করে মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে , বোবার শত্রু নেই ,সত্যি, খুবই খারাপ দিনকাল পড়েছে অনবরত এক ধরনের ভয়ের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে –’

বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রুণী তিক্ত বিদ্রূপের কন্ঠে বলে উঠেছিল–’ তোমাদের মতো ক্ষুদ্রপ্রাণ মানুষগুলির জন্যই তো আজ অসমের দেশপ্রেমিক, দেশদ্রোহী সমস্ত দুষ্কৃতিকারীরা এত প্রশ্রয় পেয়েছে, তোমরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিবেকের কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছ বলেইতো অসমে আজ নরহত্যাও সহজ-সাধারণ কথা হতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথের মতোই আমারও আজ প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করছে–’ এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময় / দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়/ লোক ভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর / দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার… আর বাবা তোমার দেশ প্রেমিক ছেলেকে জিজ্ঞেস কর তো পৃথিবীতে না হওয়া এত শান্তিপূর্ণ অহিংস এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনটি তোমাদের মতো নিরীহ নির্বিরোধী মানুষের মনেও কেন ভয়ের জন্ম দিয়েছে ?’

উত্তর কামরূপের নৃশংস হত্যাকাণ্ড গুলির সমস্ত খবর বন্ধুর কাছ থেকে শুনে আসার পরে রুণী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিল–’It is too deep for tears! আমরা নিরীহ শান্ত বলে পরিচিত অসমিয়া মানুষ গুলি কীভাবে এরকম দানবে পরিণত হলাম? অস্তিত্বের সংকটে এরকম বুক কাঁপানো ভয়কে আমাদের মনে কে এরকম গভীরভাবে ঢুকিয়ে দিল যার ফলে আমরা নররাক্ষসে পরিণত হয়ে উত্তর কামরূপের নিরীহ ন- অসমিয়াদের সঙ্গে ভাতৃঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হলাম? প্রাণজিৎ যে ভয়ঙ্কর বর্ণনা দিল তা শুনলে দেখছি আমাদের নাজী অত‍্যাচারের কথা মনে পড়ে । সে নাকি মুকালমুয়া ক্যাম্পে আধপোড়া একটি শিশুও দেখে এসেছে । দুর্বৃত্তরা নাকি মা-বাবাকে আগুনে ফেলে দিয়ে তাকেও আগুনে ছুড়ে ফেলার পরে কেউ একজন উদ্ধার করে এনেছে তবে তার যে অবস্থা কোনোমতেই নাকি বাঁচানো যাবে না। গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে সন্তান বের করে সন্তান এবং মা দুজনকেই নাকি হত্যা করেছে। আজ এক উগ্ৰ জাতীয়তাবোধের উন্মাদনায় যারা নিজের হাত এভাবে নির্দোষ মানুষের রক্তে রঞ্জিত করছে বাকি জীবনটা তারা আত্মধিক্কারের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরবে না কি ? লেডি ম্যাকবেথের মতোই তাদের বাকি সমস্ত জীবনটা মনে মনে আর্তনাদ করে থাকতে হবে–’Here is the smell of the blood still;all the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand ,oh,oh,oh !’

হায় ইতিহাসের ষড়যন্ত্র, রাজনীতির ষড়যন্ত্র! একদিন সবাই আমরা একই ভারতীয় ছিলাম, কিন্তু তারপরে নেতার অদূরদর্শী রাজনীতি তারই একদল মানুষকে বিদেশি বানিয়ে দিল, অশিক্ষিত, দরিদ্র নিরীহ জনসাধারণকে ভাগ হয়ে যাওয়া একটি দেশ থেকে অন্য একটি দেশে ফুটবলের মতোই লাথালাথি করা হল, তারপর একদিন আমরা যাকে দয়া এবং মমতায় আশ্রয় দিলাম আজ পুনরায় সেই শরণার্থীদের আমাদের করুণার মুখোশ খুলে বুকে ছুরি বসিয়ে দিলাম। আমাদের আর কবে শুভবুদ্ধির উদয় হবে, কখনও হয়তো আমরাও আমেরিকা স্ট্যাচু অফ লিবার্টিতে খোদিত থাকা কথাগুলি শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে অসীম মমতা ভরা কন্ঠে বলতে পারব –

‘Give me your tired ,your poor

Your huddled masses yearning to breathe free,

The wretched refuge of your teeming shore,

Send these,these homeless,tempest tossed to me.

I lit my lamp beside my golden door.’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত