| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৫) । নিরুপমা বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comঅভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।


উত্তর কামরূপের কাটাকাটি, মারামারি,সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারের ঘটনাগুলি কিছুদিন পরেই দুলিয়াজানের তৈল প্রকল্পে পিকেটিংকারীদেরপুলিশের নৃশংস গুলি চালনায় যখন অজিত নেওঁগনগেনডেকা, নৃপেন বরা এবং কুমুদ গগৈর মৃত্যুর খবর এল, শ্রীমতী গোস্বামীর দুগালবেয়ে চোখের জলের ধারা নেমে এল। নগেনডেকার অকালে বিধবা হওয়া স্ত্রী এবং তিনটি শিশু সন্তান,নৃপেন বরার বৃদ্ধা মা বকুলি বরা, কুমুদ গগৈরযুবতি স্ত্রী এবং দেড় বছরের ছেলে এই সবারই কথা পরবর্তীকালে খোঁজখবর নিতে যাওয়া লোকেরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে লিখেছে। কিন্তু শ্রীমতী গোস্বামীর সেই একই সান্ত্বনাহীনমনোভাব – কাগজে হাজার খবর বের হক, মানুষ বরমাল্য দিক , সরকারিভাবে শ্রাদ্ধ করে ফোটোর সঙ্গে খবরের কাগজে ফোটো ছাপাক– কিন্তু যা চলে গেল তা আর কখনও ফিরে আসে না বা যারা রয়েছে তাদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হল তা আর কোনো মতেই পূরণ হওয়ার নয় ।

কিন্তু রুণী মাকে অন্য ধরনে অন্য একটি কথা বলে– ‘দেশের স্বার্থে কিছু মানুষকে আত্ম বলিদান দিতেই হবে মা, এ ছাড়া কোনো পথ নেই। কিন্তু আমাদের কথা হল অপ্রয়োজনে যাতে একটি অমূল্য প্রাণেরও হানি না হয়। আজ অসমের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে হাজার হাজার মানুষ সরল বিশ্বাসে বেরিয়ে এসেছে এবং তার জন্য অনেক অনেক মূল্যবান প্রাণ ধ্বংস হয়ে গেছে। আরও বা কত প্রাণের নাশ হয়। কিন্তু নেতার ভুলের জন্য যদি অসমের কোনো স্বার্থ রক্ষিত না হয়, তাহলে এভাবে অপ্রয়োজনে প্রাণ দেওয়া মানুষের জীবন গুলির প্রায়শ্চিত্ত একদিন তাদের করতেই হবে।’

১৯ এপ্রিলের দিন গুয়াহাটি শহরে রুণীমা এক অভাবনীয় ঘটনা দেখল– অসম সরকার হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই সকালবেলা সমগ্র গুয়াহাটি শহরে সান্ধ্য আইন জারি করল,গুয়াহাটির শান্তি এবং শৃঙ্খলা নাকি বিপন্ন ! অথচ আগের দিন রাত পর্যন্ত মহানগরীর মানুষ সাধারণ জীবনযাত্রাই যাপন করছিল।


আরো পড়ুন: অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৪) । নিরুপমা বরগোহাঞি


কিন্তু আশ্চর্যের কথা যে সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে গুয়াহাটি শহরের লক্ষ লক্ষ আবালবৃদ্ধবনিতা বেরিয়ে এসে সরকারের শাসনযন্ত্রের মুখোমুখি হল, লক্ষ লক্ষ জনতা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে তেল শোধনাগারের দিকে এগিয়ে গেল; সেদিন রুণীদের অঞ্চলের শতাধিক লোকের সঙ্গে সেও এগিয়েগিয়ে সেই জনসমুদ্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।

সেদিন অপুরসেকি বিজয় উল্লাস!’এই রুণী,মানুষ এবার কীভাবে স্বৈরতন্ত্রী সরকারের মুখোমুখি হল দেখলি তো? তুই তো সব সময় বলে থাকিস যে আমরা সরকারের সঙ্গে না লড়াই করে লড়াই করছি বামপন্থী মানুষগুলির বিরুদ্ধে,সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে । এখন দেখলি তো লক্ষ লক্ষ জনতা সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে কীভাবে বুক ফুলিয়েএগিয়ে যাচ্ছে ? এমনকি আজ তুইও গিয়ে যোগ দিতে বাধ্য হলি?’

‘ অসমের জনসাধারণের সাহস এবং দেশপ্রেমে আমার সন্দেহ নেই দাদা, আজকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদও আমার কাছে শ্রদ্ধার স্মৃতি হয়ে থাকবে। কিন্তু তথাপিও এই আন্দোলনের ফলাফল সম্পর্কে আমার সন্দেহ দূর করার কোনো কারণ দেখছি না বা মনের এই দুঃখ দূর হয়নি যে জনসাধারণের এত স্বার্থ ত‍্যাগ এবং জীবন আহুতিঅসমিয়া জাতির লাভের চেয়ে লোকসান করবে বেশি, অসমের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে থাকা সম্প্রীতিতে এটা ফাটল ধরিয়েছে। আজ পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ, এবং অসূয়া বেড়ে চলেছে—’

রুণীর কথার মধ্যে বাধা দিয়েঅপু মুখ বিকৃত করে বলে উঠল–’ তোর মতোতোতাপাখির সঙ্গে কথা বলাই ভুল। কিছু একটা বলতে গেলেই তার উত্তরে মুখস্ত করা কিছু কথা গড় গড় করে বলে যাবি, তিক্ত বিরক্তিধরে যায়।’

রুণী হাসতে হাসতে বলল–’ তবুও শৈশবের তোতাপাখিটিরচেয়ে ভালো দাদা– সেই তোতা পাখিটা যে কেবল–’ অপু দাদা এলে?’ বলে বলে তোকে পাগল করে মারত মনে আছে কি দাদা? আমি অন্তত সেই একটি বাক্যকেই পুনরাবৃত্তি করি না।’

শৈশবের এক মধুর স্মৃতি। শৈশবের সমস্ত স্মৃতিই বোধহয় মধুর–’the smile ,the tears/of boyhood year’s সেই হাসি, সেই কান্না– সবকিছুই মধুর। বাবা একদিন খাঁচা সহ একটি তোতা পাখি কিনে এনেছিল। অপু বাইরে খেলতে গিয়ে ফিরতে একটু দেরি করলেই মায়ের যেমন ছটফটানি, সেই জন্য অপুরবাড়ি ফেরাটা মায়ের কাছে সবসময় এক স্বস্তি এবং আনন্দের কথা ছিল, সেই জন্যই তোতাপাখিটাকে সে এই কথাগুলি শিখিয়েছিল। প্রথম প্রথমঅপুর বড় ফুর্তি, শেষ পর্যন্ত সেই একই কথা শুনে শুনে তার অসহ্য মনে হল। একদিন সে মাকে চিৎকার করে করেজিজ্ঞেস করল–’ এটা অন্য কোনো কিছু বলে না কেন মা?’ মা স্নেহ মাখানো হাসির সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল’ তোতা পাখি নিজে কোনো কথা বলতে জানে না সোনা, অন‍্যেশিখিয়ে মুখস্থ করিয়েদিলেই সেই কথা বলতে পারে।’

এখন কথায়কথায় বোনকে তোতাপাখি আখ্যা দিতে ধাকাছেলেটিরতোতাপাখির মুখস্ত করা কথার পাঠ এভাবেই শৈশবে মায়ের কাছ থেকে নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, একদিন সে অসহ্য হওয়ায় মাকে বলেছিল–’ এটা মরে গেলেই খুশি হই, তখন আর তার এই আপদ কথাগুলি কোনোদিন শুনতে হবে না।’ তারপরেতোতাপাখিটি একদিন তার ছোট আয়ুষ্কালের দিনগুলি যাপন করে স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু তখন অপুর সে কি কান্না!

শৈশবের সেই স্মৃতি স্মরণ করে রুণীমার চোখ যেন ভিজে যেতে চায়, আজকাল অপুরুণীমার ওপরে অনবরত বিরক্ত হয়ে থাকে, অথচ তার প্রতি তার কী অগাধ ভালোবাসা। কতদিন সে বিরক্তিরছদ্মবেশেমায়ের সামনে তার দুশ্চিন্তা যে ব্যক্ত করে নি–’ তোমার সেই দেশদ্রোহী মেয়েটিকে একটু সামলে রেখ মা, নাহলে কোথায় কখনও অঘটন ঘটবে– তখন মজা বুঝবে। আমি তাকে নানা কায়দা করে কত আর আগলে রাখব?…’

সেই শৈশবের কথাই আরও অন্য কত ধরনে বারবার অতীতের বুক ভেদ করে বর্তমানে আসতে থাকে– কিন্তু সেই বর্তমান রুণীরদুঃসহ বর্তমান, সেই বর্তমানে অপুর সঙ্গের অতীতের শৈশবেরকথাকান্ড সর্বদা মধুরতার সঙ্গে প্রবেশ করতে পারে না। রুণী অংকে সব সময় বড় কাঁচা ছিল, অন্যদিকে রুণী মুছে মুছে মেলাতে না পারা যোগ বিয়োগ,গুন ,ভাগ ছোট ছোট অংক গুলি অপু মুখোমুখি করে দেয়, তখন শ্লেট সামনে নিয়ে যুদ্ধ করতে থাকা বোনকে অপু যে কী ভালোবাসা এবং তার সঙ্গে দাদার গর্বের ভাবে যে শিখিয়েদেয়নি, চটপট অংক গুলি করে দিয়ে এবং তারপরে এক উন্নাসিক ভঙ্গিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে–’ দেখলি মেজিক? আমার কাছে এগুলি লজেন্স খাওয়ার মতোই সহজ। তাই যখনই কোনো অংক মেলাতে পারবিনা, আমার কাছে আসবি, চোখের নিমেষে করে দেব…’

সেই শৈশবের স্মৃতি এখন রুণী কীভাবে যে তার কঠিন বর্তমান পর্যন্ত টেনে আনল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত