Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

অন্ধনথ

Reading Time: 4 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comশেষ পর্যন্ত রেণু উঠতে পেরেছে ট্রেনটাতে। যে-বগিটাতে উঠেছে ওটা একটা মালবগি। অন্ধকার এবং অনেকটা ফাঁকা। রেললাইন আর চাকার ঘর্ষণে যে শব্দযজ্ঞ উঠা-নামা করছে এইসব আলো-আঁধারিতে তা অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্যের জন্ম দিচ্ছে তার চোখের ভিতর।

মধু ঘরে বউ এনেছে। তার কোনো উপায় ছিলো না। বোনটাকে বিয়ে দিয়েছিলো মধু। দুই বছরের মাথায় ভাইয়ের কাছে ফিরতে হলো সেতুকে! তখন সে গর্ভবতী। স্বামী গঞ্জে দোকান দেবে, হাজার পঞ্চাশেক টাকার দরকার।
‘দাও না। আমাগো পোলার ভাগ্যে কইলাম ভালাই চলবো।’
‘বউ, খালি ভাগ্যে যে কিচ্ছু অয় না। টেকার দরকার। তাই কইতাছিলাম। মানে ইয়ে…’
‘কী, কও না আমতা আমতা করতাছো ক্যান তুমি?’
‘কইতাছিলাম, তোমার ভাইয়ের কাছে গিয়া যদি…’
কথা শেষ করলো না সে। সেতু হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারছে না।
‘আমার ভাইয়ের কতা তুমি জানো না? কী কষ্ট কইরা আমারে বিয়া দিছে! একখান ক্ষেত আছিলো তাও বেইচ্চা  দিছে। তার কাছে তুমি ক্যামনে যাইতে কও? তোমার দিলে কি…’ সেতুকে কথা শেষ করতে দিলো না সে। চিৎকার করে উঠলো, ‘থাম। বেশি কতা শিখ্যা ফালাইছস; কাইল বিয়ানে তোর ভাইয়ের কাছে যাবি, টেকা দিলে ফিরবি, না দিলে কুনোদিন ফিরনের কাম নাই।’

মধু তিনরাত ঘুমোতে পারলো না। আকাশ-পাতাল ভাবলো। কোনো সমাধানে আসতে পারছে না সে। পরদিন ভোরে মাঠে যাচ্ছে এমন সময় রহিমের সঙ্গে দেখা। রহিম তার বন্ধু মানুষ। রহিমই ডাক দিলো, ‘কী গো দোস্তো, দেইখাও না দেইখা চলি যাও। বিষয়ডা কী? তোমারে তো এমুন মুক আঁধার বেখেয়াইল্লা দেহি না কুনোদিন!’
মধু আর নিজের মধ্যে কথাগুলির ভার বইতে পারছিলো না।
‘লও বই, বইয়া কই।’
সব শুনে রহিম বললো, ‘দোস্তো, তুমি একখান বিয়া করো, বিয়া করলে আইজকাইল তো পঞ্চাইশ-ষাইট হাজার না চাইতেই দ্যায়। আমার হাতে একখান মাইয়া আছে। সোন্দর-মোন্দর কম না, তয় একখান চক্ষে নাকি ইকটু কম দেহে। হুনছি পঞ্চাইশ হাজার টেকা দিবো।’

মধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে রহিমের দিকে। ‘কী করবা না করবা হেইডা তোমার বিষয়। তোমার বইনের তো বাঁচন-মরণের পরশনো। আর কুনো রাস্তাও তো দেহি না।’ মধু দোটানায় পড়ে যায়। রেণুকে সে কথা দিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নেবে। ঘরে ফিরে আরো একটা রাত মধু ঘুমোতে পারে না। বোনের চোখের জল সে সহ্য করতে পারবে না। মুয়াজ্জিনের আযানে সে বিছানা ছাড়ে। ঘর হতে বের হয়ে গোয়াল ঘরের দিকেই পা বাড়ায়। একটু সকাল সকাল মাঠে যেতে হবে, রহিমের আসার কথা।

রেণু মধুকে দেখে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো। কানে সে উত্তাপ টের পেলো। সেদিনের কাশবনের সমস্ত লজ্জা যেনো তাকে আজো জড়িয়ে আছে, আকাশের নীলের মতন। সেইদিনের কথা এই মুহূর্তে বিজলির মতন একঝলক তার মনের জানালয় উকি দিয়ে গেলো। সেদিন মধুর সঙ্গে তার কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেলো নদীর চরে। সে পানি আনতে যাচ্ছিলো, মধু যাচ্ছিল গরু গোসল দিতে। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। রেণু জলের কথা, মধু গরুর কথা ভুলে গেলো। পাশে কাশবন, সহসা নড়ে উঠলো, দুজনেই চমকে তাকালো ওদিকে। একটা শালিক ছটফটাচ্ছে। ওরা এগিয়ে গেলো। রেণু পাখিটা যখন হাতে নিলো তখন টের পেলো সে কাশবনের মধ্যে। তার চারিধার কাশবফুলে ছেয়ে আছে; যেনো আকাশ নেমে এসেছে শরতের মেঘফুল নিয়ে। কেউ বোধহয় ঢিল ছুঁড়ে শালিকটার পা ভেঙে দিয়েছে। রক্ত বের হচ্ছে। রেণু ঘাসপাতা দিয়ে পা-টা বেঁধে দিলো। তারপর তাতে ফুঁ দিলো। এবং মাথার উপর দুহাত তুলে সে পাখিটাকে উড়িয়ে দিলো। উড়ে গেলো সেটা। আকাশ হতে রেণু চোখ নামাতেই বুঝলো মধু তার পাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রেণুও মন্ত্রমুগ্ধের মতন হয়ে গেলো। তার অবাক চোখে আর কম্পমান ওষ্ঠাধরে যেনো জন্মের তৃষ্ণা। মধুও যেনো মরুচারী পথিক অবশেষে এসে থেমেছে মরূদ্যানে। মধু রেণুর কাঁধে হাত রেখে বসালো সমুখে। মুখোমুখি দুজন, নির্জন চারধার আর শুধু কাশবন। রেণু মধুর জন্যে সেই কাশবনে একসময় বিছিয়ে দিলো তার বুকের আঁচল। তারপর রেণু আর ভাবতে পারে না সেদিনের সেইসব কথা…
আনত চোখে তাকিয়ে মধুকে বলে, ‘তোমার মুকখান এমুন আঁধার ক্যান, কী অইছে তোমার? তিনচাইর মাস তোমার দেখা নাই। হগলদিন তোমার পথ চাইয়া থাকি। তুমি আসো না…’
মধু হাঁটু গেড়ে রেণুর পায়ের কাছে বসে পড়ে। পা দুটি জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘আমার কুনো উপায় ছিলো না; তুমি আমারে মাফ দেও, দিছো কও…’
রেণু কিছুই বুঝতে পারে না। মধু তাকে বিয়ের কথা, সে কী কারণে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে সব বলে চলে একে একে। রেণুু যেনো কিছুই শুনতে চায় না। সে মূর্তির মতন বসে আছে। তার ভিতরের আকাশটা আদিগন্ত ভেঙে পড়ছে কাচের মতন। তার দুচোখ দিয়ে বাঁধ ভেঙেছে যেনো পৃথিবীর সকল সমুদ্র। সে যে মা হতে চলেছে তার গর্ভের সন্তানের পিতা যে মধু, সে কথা আর মধুকে বলা হলো না। সে এই আনন্দের কথাটা কিভাবে বলবে মধুকে, কিছুক্ষণ আগেও তা ভেবে পাচ্ছিলো না। মধু বার বার তার হাঁটুতে মাথা ঠুকছে, ‘কও, তুমি আমারে মাফ দিছো…’
রেণুর হাতের আঙুল মধুর চুলে বিলি কাটে। সে যেনো ঘোরের মধ্যেই বলে, ‘সব ঠিক অইয়া যাইবো…’
মধু তখন বেরিয়ে গেছে। অথচ রেণু তখনও বলতে থাকে, ‘সব ঠিক হইয়া যাইবো, সব ঠিক হইয়া…’

রেণু ছুটছে ঝুম বৃষ্টির ভিতর। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ কৃষ্ণমেঘমালার আড়ে শুয়ে ঢালছে অ›ধকার জোছনা। সে ছুটছে। তার পেছনে পড়ে থাকছে বৃদ্ধপিতা, ঘর, ধর্ম, সমাজ, সংস্কার, সময়, কতোস্মৃতি, মাঠ-প্রান্তর…। নদীতে বান ডেকেছে। সে শুনতে পাচ্ছে স্রোতের বানভাসি শব্দ। তার নিশ্বাসের বাতাসে ভাসছে গভীর নদীর উন্মাতাল জলের ঘ্রাণ। ওইতো দেখা যাচ্ছে জল আর জল। আবার পাড় ভাঙলো কোথাও নদীর। পাড়ভাঙার শব্দের সাথে বিজলির আলোতে চমকে গেলো এইসব পরিবেশ। দূরে কোথাও বাজ পড়লো। তার কিছুই খেয়াল নেই। তাকে কেবল টানছে অদূরে নদীর জল। সহসা সে থমকে দাঁড়ালো। অস্ফুট অথচ স্পষ্ট সে শুনতে পেলো যেনো তার গভীর থেকে কেউ ডাকছে, মা-আ-আ-আ-আ…
রেণু আর নড়লো না। দাঁড়িয়েই থাকলো। পিচ্ছিল মাটিতে পায়ের নখ ফুটিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। অদূরে ইস্টিশনে তখন বেজে গেলো শেষ ট্রেনের হুইশেল।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>