| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

পাঠ প্রতিক্রিয়া: নিসর্গের শোকগাথা নিয়ে । বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

সম্প্রতি আমাদের দেশে, বাংলায় ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। চার-পাঁচ বছর ধরে প্রায় নিয়মিত। আমাদের ভাবনায় এখন জায়গা করে নিয়েছে ভূমিকম্প। তার আগে ভূমিকম্প নিয়ে আমরা এতটা ভাবিনি। আমাদের এই বাংলা, বিশেষত উত্তরবঙ্গকে এখন অনায়াসে ভূকম্প-প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। গত কয়েক বছর ধরে উত্তরবঙ্গের বহু মানুষ ভূমিকম্প জনিত ট্রমায় আক্রান্ত। রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারেন না। সন্ধের পর যতটা সম্ভব বহুতলের বাইরে কাটাতে পারলে স্বস্তি পান। এখনও কোনও কারণে মাথা ঘুরলে ভূমিকম্প হচ্ছে বলে ভ্রম হয় অনেকের। ভূমিকম্প— একটি পরিবেশ-কেন্দ্রিক সমস্যা। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে বাংলার কোনও সাহিত্য রচিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এই রকম একটা প্রেক্ষাপটে আমাদের বাংলা সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাচ্ছি বাংলার ভূমিকম্প না হলেও ভূমিকম্পকে বিষয় করে একটি উপন্যাস রচিত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের ভূমিকম্প নিয়ে বাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস লেখা হয়েছে বিশ শতকের শেষ দশকে।   

আমাদের দেশে যে কয়েকটি ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাতুরের ভূমিকম্প। মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলায় ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ৩-৫৬ মিনিটে হয়েছিল এই ভূমিকম্প। বাহান্নটি গ্রামের দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তিরিশ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সাধারণভাবে ভূমিকম্প-সাইক্লোন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়া, না-হওয়ার উপর মানুষের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু লাতুরের এই ভূমিকম্পের মূলে মানুষের ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। চাষের সুবিধার্থে মহারাষ্ট্র সরকার লাতুরে একটার পর একটা ড্যাম তৈরি করে গেছে। যেমন গার্নি ড্যাম (১৯৬৯), তিরু ড্যাম (১৯৭৬), তাওয়ারজা ড্যাম (১৯৮২), সাকোল ড্যাম ১৯৯২), দেভার্গন ড্যাম (১৯৯৩) ইত্যাদি অনেক ড্যামের কথা বলা যেতে পারে। প্রায় সব ড্যাম-ই আর্থফিল ধরনের (Earth fill Type)।মানুষের সুবিধের জন্য এই ড্যামগুলি তৈরি করা হলেও প্রকৃতির উপর তার অনিবার্য প্রভাব নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করেনি। তার ফলে এই বিধ্বংসী ভূমিকম্প, এত এত মানুষের মৃত্যু! আর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মূলে মানুষের লোভ। ফলে আর পাঁচটা ভূমিকম্পের থেকে লাতুরের ভূমিকম্প সম্পূর্ণ আলাদা। একে অনায়াসেই ম্যান-মেড ভূমিকম্প বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। 

    বাংলার বাইরে ঘটে যাওয়া এই ভূমিকম্প এবং ভূমিকম্প-পরবর্তী ঘটনা বাংলা উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠে। অমর মিত্র ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘প্রতিক্ষণ’-এর শারদ সংখ্যায় লিখলেন ‘নিসর্গের শোকগাথা’। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিক্ষণ থেকে বই হয়ে বেরোয়। পরে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘অমল ও এলিজাবেথ’ নামক আর একটি উপন্যাসের সঙ্গে একত্রে ‘নিসর্গের শোকগাথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সোপান প্রকাশনী থেকে। 

শুধু বাংলার পরিবেশ-কেন্দ্রিক সমস্যা নয়, বাংলার বাইরের পরিবেশ-কেন্দ্রিক সমস্যাও জায়গা করে নিল বাংলা সাহিত্যে। অমর মিত্রের হাত ধরে বাংলা পরিবেশবাদী সাহিত্যের বিষয়ের পরিধিও ব্যাপ্ত হল। লাতুরের ঘটনা ঘটার এক বছরের মধ্যে অমর উপন্যাস লিখলেন। প্রায় সমসাময়িক একটি ঘটনা নিয়ে সাহিত্য রচনা সহজ নয়। কিন্তু অমর যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে কাজটি করেছেন। লাতুরের ভূমিকম্প-পরবর্তী মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ; ত্রাণের নামে রাজনৈতিক বিতণ্ডা সব— সবই নিবিড়ভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। 

কাহিনি শুরু হয়েছে ভূমিকম্পের ছ-মাস পর। ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ রাত্রে, গনেশ চতুর্থীর রাত্রে ভূকম্পনে শেষ হয়েছে, পচেছে, গলেছে, দাহ হয়েছে, কবর হয়েছে গণচিতার গণকবরে, ঘরে উঠোনে, যেখানে মাটি সেখানে। তারপর থেকে প্রলম্বিত শূন্যতা ব্যাপ্ত হয়ে আছে চারদিকে। ছ-মাস আগে তারা বেঁচে ছিল দেহ নিয়ে, ছায়া নিয়ে, রাত্রি আর দিন নিয়ে, প্রেম-ভালোবাসা আনন্দ-বিষাদ নিয়ে। আর এখন দেহ গেছে, ছায়া আছে শুধু। আর আছে দীর্ঘ কালরাত্রি। কালরাত্রি নিয়ে শোকগাথা গাইছে মারাঠাওয়াড়া। ছ-মাসে কোনও কথা বলেনি। এখানকার চাষিরা সূর্যমুখীর বীজ ফেলেনি। ফলন্ত সূর্যমুখী কেটে ঘরে তোলেনি। আখ কাটেনি, জোয়ার কাটেনি। তারা শুধু ছায়া নিয়ে ঘুরেছে। ছ-মাসে কারো বিবাহ হয়নি। কেউ কুটুমঘর যায়নি। নতুন বস্ত্র পরেনি। নবরাত্রি দেওয়ালি পালন করেনি, রমজানের রোজা ধরেনি, মসজিদে যায়নি, নীলকণ্ঠদেও ভগবানের মুখ দেখেনি, মহাশিবরাত্রির ব্রত পালন করেনি। “গত আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে তারা কেউ বাতাস হয়ে উড়েছে, আকাশের নীল হয়ে ভেসেছে, শীতের কুয়াশা হয়ে ছড়িয়ে গেছে খেতে প্রান্তরে।” 

১৯৯৩-এর আগেও তো ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে এখানে ভূমি কেঁপে ছিল। বয়স্করা জানে। শাঁখ বাজিয়ে, খুব হল্লা করে, সবাই বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। নীলকণ্ঠদেওর মন্দিরে গিয়ে মাথা ঠুকেছিল। পরে তারা জেনেছিল তা আসলে কোয়না নদীর কম্পন। অমর স্পষ্ট করে বলেছেন—“নদীতে বাঁধ হয়েছে, তাই মাটি দুলল। … নদী বাঁধল সরকার তাই মিট্টি দুলে গেল কোয়না ধরে।” মারাঠওয়াড়ার এই ভৌগোলিক সত্যকে সাহিত্যের সত্যে রূপান্তরিত করেছেন লেখক।  

ভূমিকম্প-পরবর্তী বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাস লেখা হলেও অমর এই বিধ্বংসী ঘটনার প্রকৃত কারণও আলোকিত করতে চেয়েছেন। সরকার ভূমিকম্পের কথা জানত। গত দু-তিন সাল ধরে অল্প অল্প মিট্টি দুলছিল। মানুষ ভাবত কত আর কাঁপবে। কাঁপতে কাঁপতে থেমেও তো যাচ্ছে। তবুও কিল্লারির মানুষ কালেক্টারের কাছে বারবার পত্র দিয়ে বলেছিল— পুরা এক সাল ধরে মিট্টি দুলছে। সরপঞ্চ নিজে জানায়। কিন্তু সরকার বিশ্বাস করে না। কারণ সরকারি আদমি যখন আসে তখন তো মিট্টি থেমে গেছে। শান্ত। তাই বিশ্বাস করে না। লাভ হল না কিছুই। তারও একসাল আগে ভূকম্প হয়েছিল। ঘর বাড়ি দুলতে দুলতে থেমে গিয়েছিল। তখন হাওয়াই জাহাজে উড়ে বিদর হয়ে মুখ্যমন্ত্রী আর এক বড় বিজেপি লিডার এসেছিলেন। দেখে গিয়েছিলেন। কিছুই হয়নি তারপর। সরকারের অবহেলায় এত মানুষের প্রাণহানি— একথা লেখক স্পষ্ট করে দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে বিশ বছর আগে নাকি কোনও বিজ্ঞানী বলেছিল যে বড়ো ভূমিকম্পে এই অঞ্চল ভেঙেচুরে যাবে। শহরের কেউ কেউ শুনেছিল সে কথা। গ্রামের মানুষ শোনেনি।    

চারি দিকে থেঁৎলে যাওয়া শরীর। ধ্বংসস্তূপ। মরা মানুষের জীবিত মানুষের চিৎকার। কান্নার রোল। মাংস আর মরা মানুষের হাড়ের লোভে কিল্লারি, গুলাবগাঁও চলে গেছে বহু কুকুর। মানুষের একটা হাত বা পা মুখে নিয়ে কুকুরদের দৌড়োতে দেখা গেছে। মৃত্যু ভয়ে আর্ত চিৎকার করে দৌড়োচ্ছে সব। আশপাশের মানুষজন, জওয়ান আদমিরা উদ্ধারে নেমে পড়েছে। 

ভূমিকম্পের পরদিন থেকে সরকারওয়ালা, রিলিফওয়ালা, পার্টিওয়ালাদের ভিড় লেগে যায় কিল্লারিতে। সুযোগ বুঝে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকেরা নিজেদের বিজ্ঞাপিত করার জন্য কীভাবে প্রাণপাত করে তার স্বরূপ তুলে ধরেছেন লেখক। সারাদিন ধরে কত কত পার্টির লোক আসছে। ক্ষয়ক্ষতির আলাদা আলাদা করে তালিকা করছে প্রত্যেকে। প্রত্যেকের দাবি তাদের তালিকায় কাজ হবে। যেন ভোট লেগে গেছে। গণচিতার কাঠ নামছে। তখনও বেরোচ্ছে ডেড বডি। ফটো উঠছে সব। কান্নার ফটো, পড়া মাংসের গন্ধের ফটো। 

স্বয়ং প্রধান মন্ত্রীও এসেছিলেন তখন। কিল্লারি হাই রোড থেকে গাঁও কিল্লারির শিবাজীচক পর্যন্ত পুলিশের দখলে। যত মানুষ কাঁদছিল তার থেকে পুলিশের সংখ্যা বেশি। তখন এখানকার মানুষের থেকে পি এম-এর সিকিউরিটির দাম যে অনেক বেশি। পুলিশের শৃঙ্খল ভেদ করে গুলাবচন্দ্র সূর্যবংশী পৌঁছোতে পেরেছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে— “সরকার ঘর হবে কবে?” প্রধানমন্ত্রী স্মিত হেসে বলেছিলেন দশেরার পর হয়ে যাবে। “প্রকৃতির মার, নিসর্গের অভশাপ। এহল সমগ্র দেশের দুর্গতি, সবাই তোমাদের পাশে আছে, তুমলোগ আকেলা নেহি।” ভিডিও ক্যামেরার দল, কাগুজে ফটোগ্রাফারের দল লেন্সের মুখ ঘুরিয়েছিল গুলাবচন্দ্রের দিকে। 

সম্মোহিত হয়ে গেছিল সে। পি এম, সি এম-কে সে বলতে পারেনি— রিলিফওয়ালা ফালতু ঘুরাচ্ছে, কম দিচ্ছে, এক-এক আদমিকে ছয় রোটির বদলে দো রোটি দিয়ে বলছে পরে আস্তে। লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে পোলিশ ভি লুটপাট চালাচ্ছে। গয়না, সোনা, রুপা লিয়ে লিচ্ছে।   

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চেনা ঘর গেরস্থালী অচেনা লাগে। গাছ-তলায়, রাস্তায় রাত কাটায় সবাই। আঁখ জুড়লেই তো মনে হয় মিট্টি দুলছে। আন্ধার হয়ে গেলে তাই মনে হয়। ঘুমোতে পারে না। ঘুম আসে না। কান্না থামে না।  কথা বলতে একটাই— ভূকম্প, রিলিফ, রিহ্যাব গাঁও কবে কোথায় হবে। ছ-মাস ধরে কথাই শুনেছে তারা। কিছুই পায়নি। সরকার কোথাও কোথাও লোহার ঘর তৈরি করে দিচ্ছে। এই গরমের দেশে লোহার ঘরে থাকা যায় না। 

এই ধরনের ভূমিকম্প-রোধক ঘর কিল্লারির গ্রামীণ গৃহভাবনার সঙ্গে যায় না। অমর বিষয়টির অবতারণা করেছেন চমৎকার ভাবে। সবিতা বাঈয়ের মতো কেউ কেউ প্রস্তাবিত এই ঘরকে ঘর বলেই মানতে চায় না। ঘরের সঙ্গে গোয়াল থাকবে, বাগান থাকবে, রাস্তা থাকবে, জিনিসপত্র রাখার জন্য চালি লাগবে, নিম্বু-মিরচি-আচার শুকাবার জন্য খোলা ছাদ লাগবে— এই না হলে ঘর! 

লেখক মারাঠাওয়াড়ার মানুষদের যাপনের খুঁটিনাটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন বাংলার পাঠকের কাছে। সংলাপে, বর্ণনায় কিছু আঞ্চলিক শব্দের চমৎকার প্রয়োগ করে একটা গ্রামীণ মহারাষ্ট্রীয় ফ্লেবার আনার চেষ্টা করেছেন।

অদ্ভুত এক ট্রমায় আক্রান্ত মানুষেরা। একদিন দুপুরে হাইরোড বাজারে বুড়ো বনোয়ারির মাথা ঘুরে গেল। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করল—ভূকম্প হচ্ছে। নিজের শরীরের কাঁপুনিকে মাটির কাঁপুনি বলে ভ্রম হচ্ছে অনেকের। পশু পাখিরা আগে ধরতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা। তাই রতুয়ার মতো কেউ কেউ সারাদিন কুত্তা, গাই, বিল্লি, পিপিড়া দেখে। গত বছর চৌষট্টি বার ভূমিকম্প হয়েছিল। সবকটা বুঝতে পারেনি সকলে। তাই কেউ ভ্রম থেকে যদি বলে ভূমিকম্প হয়েছিল—তা সকলে বিশ্বাস করে বসে। 

এসব ক্ষেত্রে শহুরে মানুষজন পুরনো ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে মহান সাজতে চায়। কারা ব্যবহার করবে সেদিকে খেয়াল থাকে না। ভাল কাজের সুবাদে বাড়ির আবর্জনা সরাতে ফেরে সকলে খুশি। অমর এই ত্রাণের বিষয়টি চমৎকার তুলে ধরেছেন। দিল্লি থেকে মুম্বাই থেকে লাতুরে পুরনো পোশাক এসেছে প্রচুর। লরি থেকে, জিপ থেকে ছেঁড়া কাপড় নামছে, কোট প্যান্ট ঢোলা গেঞ্জি ম্যাক্সি, মিডি মিনি, ফ্রক স্কার্ট, নাইটি চোলি, হট বারমুডা প্যান্ট। কিন্তু কিল্লারির মা-বহিন লেড়কিরা শাড়ি ছেড়ে মিডি-ম্যাক্সি পরবে না। রামজি হাসতে হাসতে বলে এগুলো নিয়ে বরং পুরুষেরা রাতে ঘুমাতে পারে। এগুলো নিয়ে ঘুমোলে বোম্বাইওয়ালা হিরোয়িন আর বড়োঘরের লেড়কির গায়ের গন্ধ পেয়ে যাবে। লাভ ইউ, কিস ইউ লেখা বাহারি গেঞ্জি নেয় না কেউ। কোনও কোনও ব্যবসায়ী ত্রাণের এই পোশাক রেখে দেয় দোকানে। তারা ঠিকই জানে বিনে পয়সায় এগুলো না নিলেও পরে মানুষের হাতে টাকা এলে এগুলোই সব দাম দিয়ে কিনবে। 

লাতুরের ভূমিকম্পের পর অমর মিত্র নিজে গিয়েছিলেন কিল্লারিসহ বিভিন্ন গ্রামে। নিজের চোখে দেখেছিলেন মানুষগুলির মর্মন্তুদ যাপন। বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত লাতুর-সংক্রান্ত রিপোর্টগুলি লক্ষ করতেন। লেখকের অভিজ্ঞতার জোর উপন্যাসটিকে পৃথক মাত্রা দিয়েছে। বিধ্বস্ত কিল্লারির ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠেছে। বাঙালি পাঠক অমরের এই উপন্যাস পড়ে মারাঠাওয়াড়ার ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত গ্রামগুলির প্রকৃত স্বরূপটিকে অবলোকন করতে পারে। কিন্তু শুধু তথ্য বা ডকুমেন্টেশনে আটকে থাকেনি এই লেখা। প্রকৃত অর্থেই একটি সার্থক উপন্যাস হয়ে উঠেছে।    

উপন্যাসের শুরু হয়েছে একটি নববিবাহিত বধূর প্রসঙ্গে—“বউটি টের পেত ধরণী এখানে চঞ্চল। বিয়ের পর সে তার পায়েল খুলে রেখেছিল। স্বামী আর শাশুড়িকে বলেছিল, এখানে ভূমি দোলে, ভূমির কম্পন টের পায় সে, পায়েল বেজে ওঠে কম্পনে।” কেউ বিশ্বাস করত না তার কথা। স্বামীর দেশে এসে সে একাই অনুভব করত এই দুলুনি। ছ-মাস ধরে সে আর নেই। স্বামী ধরম পটেলের মনে পড়ে সে কথা। 

লাতুরের ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসে লেখক যেভাবে সেখানকার ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত মানুষদের কথা তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প, উত্তরবঙ্গের ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতার বিস্তর মিল পাওয়া যায়। প্রায় পঁচিশ বছর আগে লেখা এই উপন্যাস পাঠে উত্তরবঙ্গের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনও একাত্মবোধ করতে পারেন সহজে। উপন্যাসটির বিশিষ্টতা এখানেই। একটি ছোট্ট অঞ্চলকে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যও আঞ্চলিকতায় আটকে থাকছে না। লেখকের বীক্ষার স্বাতন্ত্র্যে স্বমহীম হয়ে উঠছে। আজকের পরিবেশবাদী প্রেক্ষাপটে একটি আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই উপন্যাসের আন্তর্জাতিক গুরুত্বকেও স্বীকার করে নিতে হয়।      

যে গুলাবচন্দ্র প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিল সেই গুলাবচন্দ্র ছ-মাস পরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চলেছে। সেই জার্নির সূত্রে এগিয়েছে কাহিনি। শহরে সি-এম আসছেন ভূকম্প-পীড়িত মানুষদের জন্য রি-হ্যাব প্রোজেক্ট উদ্বোধন করতে। খবর পাওয়া মাত্র গুলাবচন্দ্র প্রস্তুত করে নিজেকে। ফিতা কাটা হবে, বক্তৃতা হবে, হাততালি হবে তারপর মুখ্যমন্ত্রী চলেও যাবেন। এই সুযোগ না-হলে পরের ছ-মাসও এভাবে কেটে যাবে। গুলাবচন্দ্র কাউকে জানাতে পারবে না—ছ-মাস আগে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কোনও কাজই হয়নি। তাই এই সুযোগ কাজে লাগাবে সে। সকলকে সে বলে বেড়াই যাওয়ার কথা। প্রত্যেকের কাছে গুলাবচন্দ্র অভিযোগ শোনে। কাগজে লিখেও ফেলে তার বক্তব্য। মনে মনে আওড়ায় দেখা করে কী কী বলবে সে। গুলাবচন্দ্রের অবচেতনের প্রবহমানতার প্রতিফলন উপন্যাসের পরতে পরতে। গত ছ-মাস ধরে শোকগাথা লিখেছে গুলাবচন্দ্র। অভিযোগ পত্র নিয়ে সাদা ধোতি কুর্তা, টোপি মাথায়, ঝোলা কাঁধে করে চলে সে।    

“আমার নাম গুলাবচন্দ্র সূর্যবংশী সাকিন কিল্লারি, আমি কিছু বলতে চাই, বলব এবং স্মারকপত্র আপনার হাতে তুলে দেব। আপনি মোটরেও যাবেন বোম্বাই না হেলিকপ্টারে যাবেন জানি না সরকার, যেতে যেতে মারাঠাওয়াড়ার এইসব কথা পড়ে নেবেন। ভূকম্প পীড়িত মানুষের কথা পড়ে নেবেন জি। আমি ভূকম্প পীড়িত মানুষের হয়ে বলতে এসেছি সরকার, আমাকে সবিতা বাঈ পাঠাল ধরম পটেল পাঠাল, পাঠাল রামজি ভোঁসলে, বালক মুরারি, বুড়া ভাগ্যধর বুড়ি রাধিয়া। আমাকে সব ভূকম্প পীড়িত মানুষ পাঠাল, জিন্দা আদমিরা পাঠাল। জিন্দা আদমিরা সব মরে গেছে সরকার, ভূকম্পের পর কেউ জিন্দা নেই মারাঠাওয়াড়ায়। এ কথা বলছে রামজি ভোঁসলে। বলছে বরং মরা মানুষ বেশি জিন্দা আছে। আমাকে মরা মানুষরাও পাঠাল। রামজি বলছে তাদের কথাও জানাতে। আমাকে ধরম পটেলের পোয়াতি বিবি পাঠাল, সবিতা বাঈয়ের বেট।।আর স্বামী পাঠাল। কালরাত্রিতে যত মানুষ মরেছে সবাই আমাকে পাঠাল সরকার। আমাকে বীর মারাঠারা পাঠাল জি। … আমার বাপ্পা বলেছে, আই বলেছে পোবাডা গেয় গেয়ে। তখন তারা বীরের মতো বেঁচেছে, জমিনের ফসল তুলে ভূমিয়া মোগল সেনার বিরুদ্ধে লড়েছে। এখন আর বাঁচছে না, লড়ছে না। ছ-মাহিনায় সব ভিখিরি বনে গেল সরকার। সবাই কংগ্রেস বিজেপি শিবসেনা বহুজন পার্টি জনতা পার্টিতে নাম লিখাল রিলিফের জন্য। তারা কেউ দিল কেউ দিল না। তারা একে ওকে দুষল, এখানে এসে বলল, কংগ্রেস মেরে দিচ্ছে। এখানে এসে বলল, ভূকম্প নিয়ে রাজনীতি করছে ওসব পার্টি। তারপর সব দল এক হয়ে এটা ছুঁড়ল ওটা ছুঁড়ল, বিবির জন্য ফ্রক আনল স্কার্ট আনল নাইটি আনল। মরদের জন্য পুরানা ছেঁড়া কোট আনল, প্যান্ট আনল, কিস মি লাভ মি গেঞ্জি আনল, একপাতি জুতা এনে বলল আর এক পার্টি পাবে, কংগ্রেস না দিলে বিজেপি দেবে, শিবসেনা দেবে, কেউ না দিলে জাপান দেবে আমেরিকা দেবে। এক পাটি জুতা নিয়ে মানুষ সব ভিখিরি বলে গেল জি। সরকার মানুষ এখনো রাতে ঘুমায় না ভয়ে। ঘুমায় না, জেগে জেগে ভাবে কবে রূপয়া আসবে মকান হবে। মুখ্যমন্ত্রীজি এবার খরা লাগবে। ভূকম্পে মরা মানুষ পিয়াসি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আশমানে, মেঘ খেয়ে নিচ্ছে তাই বারিষ হবে না। জেনে রাখুন সরকার ধরম পটেলের বিবি রাজলক্ষ্মী পেটে ষোলো মাসের বাচ্চা নিয়ে কেঁদে বেড়াচ্ছে অন্ধকারে, দিনের আলোয় কেউ জাগতে পারে না, শরীর পায় না, পেলে আপনার কাছে সবাই আসত সরকার। কারোর গতি হয়নি, রামজি বলে জিন্দা মানুষ ভালো না থাকলে মরা মানুষের গতি হয় না।” 

এখানে এসে উপন্যাসটি আর শুধু ডকুনেটেশনে আটকে থাকে না। প্রকৃত ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক তথ্য থেকে না সরেও অদ্ভুত এক দার্শনিকতায় উত্তীর্ণ হয় ‘নিসর্গের শোকগাথা’। শেষপর্যন্ত গুলাবচন্দ্র দেখা করতে পারেনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। সমাবেশে পৌঁছতে পারলেও পোলিশওয়ালা মিছিলওয়ালা তাকে সরিয়ে দিয়েছে। বহুত কথা জমেছিল। বহুতকথা বলার ছিল তার। সেসব নিয়ে ফেরে সে। কথা চলতে থাকে তার। গ্রামের মানুষেরা নিসর্গ প্রকৃতির অধীন। শহর টাউনে নিসর্গ হেরে যাচ্ছে। বড় আদমিদের ঘর ভূকম্পে নড়ছে না। “শুনিয়ে সরকার, আমাদের তিরিশে সেপ্টেম্বর ফেরত দিয়ে দিন, গনেশ চতুর্থীর রাত ফেরত দিয়ে দিন, সরকার তো এটা করতে পারে, সরকারের কাছে এটা কোনও কাজই নয়। আমরা সব ঘরে ঢুকে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ি। মরে যাই। মরে গেলে কেউ জিন্দা থাকে না…”

বলতে বলতে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঢুকে পড়ে সে। গলায় ছন্দ চলে আসে। বর্ণনা করে পোবাডার ঢঙে। পাঠকের মনেও অলৌকিক বিভ্রম ঘটে শোকগাথা চলতে থাকে। মারাঠাওয়াড়া থেকে সেই গাথা বাংলার আকাশ বাতাসেও ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক এবং ভৌগোলিক থেকে ভিন্ন মেরুতে অবস্থিত বাংলার পাঠকও গুলাবচন্দ্রের সঙ্গে একাত্মবোধ করে। আমাদের প্রত্যেকের অবচেতনে জমা রাশি রাশি অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা গুলাবচন্দ্রের ঝোলায় গিয়ে জমতে থাকে। উপন্যাসটি শেষ হচ্ছে এভাবে—

“আকাশের দিকে তাকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বীর পূর্বপুরুষদের ডাক দেয়। অবাক হয়ে তার ডাক শোনে ভূকম্প পীড়িত মারাঠাওয়াড়ার মানুষজন। কখনও যেন তারা দেখতে পায় সত্যি দিগন্তে ধুলো উড়িয়ে বিধ্বস্ত গ্রামে ফিরছে পূর্বপুরুষ বীরেরা। কখনো তাদের মিনে হয় গুলাবচন্দ্রটা কেমন হয়ে গেল, হায়। দিগন্তে তাকিয়ে তারা বেদনায় ঝুঁকে পড়ে। গুলাবচন্দ্র দ্যাখে শুধু মানুষ। জীবিত মৃত সকলে এসে ভিড় করছে তার চারিদিকে। মানুষ দেখে তার কণ্ঠস্বর বদলে যায় বারবার, কখনো তা শোকগাথা হয়। কখনো শোকগাথা ক্রমে বীরগাথা হয়ে যায়। আবার বীরগাথা শোকে পরিণত হয়। নিসর্গ মিশে যায় গুলাবচন্দ্রের উচ্চারণগুলি ক্রমান্বয়ে।”   

ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-নিরাপত্তাহীন-হেরে যাওয়া মানুষগুলো তাদের ঐতিহ্যকে, আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে। শিকড়ে ফিরে বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুঁজতে চাইছে। স্মৃতি হাতড়ে পৌঁছোতে চাইছে স্বপ্নের ভুবনে। কাহিনির প্রধান বিষয় ভূমিকম্প হওয়া সত্ত্বেও ভূমিকম্পের আবর্তে ঘুরপাক খায়নি। কাহিনির উত্তরণ ঘটেছে এভাবে। বাংলা সাহিত্যের সীমানাকে সম্প্রসারিত করা উপন্যাস ‘নিসর্গের শোকগাথা’ পড়তে পড়তে আমাদের গহনে নিঃশব্দ ভাঙচুর চলে। ভিন্নধর্মী এই উপন্যাস আমাদের আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে।         

একই বিষয় ঘুরে ফিরে আসে বিভিন্ন লেখকের রচনায়— এমন অভিযোগ শোনা যায়। বাংলা সাহিত্যের সমালোচক-লেখকদের অনেক সময়ই বিষয়ের ক্রাইসিসের কথা বলতে শুনি। এরকম একটি সময়ে বাংলায় ভূমিকম্পের প্রভাবকে বিষয় করে সাহিত্য রচিত হতে পারে। বন্যা, খরা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলা সাহিত্যে স্বমহিমায় জায়গা করে নিয়েছে। বাংলার সাহিত্যিকেরা পরিবেশ-কেন্দ্রিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। গত দু-দশকে অনেক পরিবেশবাদী সাহিত্য রচিত হয়েছে বাংলায়। ধীরে ধীরে ভূমিকম্পও বিষয় হয়ে উঠবে বাংলায়।  

                                                                                                                                                                                                            

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত