সানজিদা বারী
আবরণহীন হওয়া মানে শুধু বস্ত্রের আবরণ সরিয়ে ফেলা, অপরদিকে নগ্নতা হচ্ছে শিল্পের একটি রূপ! – কেনেথ ক্লার্ক
আমাদের সমাজে অথবা বলা যায় পৃথিবীর প্রতিটা সমাজে, প্রতি দেশে একজন নারীর অবস্থান পুরুষের অবস্থান থেকে প্রকৃতিগতভাবেই ভিণ্ণ৷ পুরুষের সামাজিক অবস্থান নির্ভর করে তার কতটুকু ক্ষমতা আছে সেটার উপর ! ক্ষমতা বেশি হলে সে হবে বেশি আকর্ষণীয় আর ক্ষমতা কম হলে সে হবে কম আর্কষণীয় ৷ একজন পুরুষের উপস্থিতি আসলে ইঙ্গিত দেয় সে আপনার প্রতি কি করতে পারে আর কি করতে পারে না ৷ পুরুষের ক্ষমতা তার আচরন নিয়ন্ত্রন করে অন্যদিকে এর ঠিক ব্যতিক্রম হলো নারীর উপস্থিতি যা সে নিজেকে বা তার নিজের প্রতি তার নিজস্ব মনোভাব কে প্রাধান্য দেয় ৷ একজন নারীর আচরন অনেকখানি নির্ভর করে সে নিজেকে কি মনে করে এবং কেন মনে করে ৷পুরুষের উপস্থিতি পুরোপুরি নির্ভর করে তার ক্ষমতার উপর যা আমি আগেই বলেছি অন্যদিকে পুরুষের ঠিক ব্যতিক্রম হচ্ছে নারীর উপস্থিতি কেননা তার উপস্থিতি সুপ্সষ্ঠভাবে প্রকাশ পায় তার অভিব্যক্তিতে,কণ্ঠে, মতামতে ,প্রকাশ ভঙ্গিমায় , পরিচ্ছেদে তার বাছাই করা পরিবেশে ,রুচিতে এবং আমরা একজন নারীর কাছে একটা নিদিষ্ট আচরন আশা করি এবং সর্বোপরি পুরুষরা নারীদের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট আচরন প্র্যতাশা করে আর নারীরা সেই প্রত্যাশা মোতাবেক আচরন করে ৷
এজন্য সাধারনত একজন নারীর জন্ম হয় প্রধানত দুই বার প্রথমবার যখন পৃথিবীতে আসে আর দ্বিতীয়বার তার সমাজে বসবাসরত পুরুষরদের চোখে ৷ তাই জম্ম নেবার জন্য একজন নারীকে আবার জম্ম নিতে হয় পুরুষের রক্ষনাবেক্ষনে ৷ পুরুষের তৈরি করা সীমাবদ্ধ পরিসরে একজন নারীকে নারী হয়ে উঠতে হলে তার নিজের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয় অবিরাম ৷প্রায় সারাক্ষণই সে তার নিজের অস্তিত্বের সঙ্গী ৷ যখন সে কোন ঘরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিংবা তার পিতার মৃত্যু শোকে ক্রন্দনরত পারতপক্ষে তখনও মনে মনে সেই ভাবনাটি এড়াতে পারে না যে তাকে দেখতে কেমন দেখা যাচ্ছে ! খুব শৈশব থেকেই তাকে শেখানো আর বিশ্বাস করানো হয় যে নিজেকে তার খতিয়ে দেখতে হবে প্রতিনিয়ত সুতরাং নারী তার আপন সত্তায়, যে খতিয়ে দেখছে বা নিরীক্ষক আর যাকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে নিরীক্ষিত উভয়কে বিবেচনা করতে হয় নারীকে এবং নারীর আত্মপরিচয়ে সে নিরীক্ষিত প্রতিনিয়ত তাকে দেখা হচ্ছে এ ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই সে জেনে যায় এবং একজন নারী তার দৈনন্দিন জীবনে এই ব্যাপারটা আয়ত্ত করে ফেলে ৷
সর্বোপরি পুরুষদের সামনে কীভাবে সে উপস্থাপিত হচ্ছে তা উপলব্ধি করা এবং তা বুঝতে পারা খুবই গূরত্বপূর্ন কেননা একজন নারীর সফলতা আসলে নির্ধারিত হয় সে পুরুষদের কাছে কীভাবে বিবেচিত হচ্ছে ৷ তার নিজস্বতায় বেঁচে থাকার অনুভূতি কে সরিয়ে সেই জায়গা দখল করে নেয় অন্যদের দ্বারা সে কীভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে এটা নারীর কাছে মোক্ষ বিষয় এবং একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কারন তার সামাজিক অবস্থান পুরুষের দেওয়া বর্ননা বা ধারনার উপর নির্ভর করছে ৷তাই বলা যায় পুরুষরা কাজ করে এবং নারীরা আবিভূর্ত হয় ৷ পুরুষরা নারীদের দিকে তাকিয়ে দেখে আর নারীরা তাদের নিজেদের দেখে অন্যরা কীভাবে তাদেরকে দেখছে ৷আর এটি শুধু পুরুষ আর নারীর মধ্যকার প্রায় সব সর্স্পক কেই শুধু নিয়ন্ত্রনই করে না, নারীদের নিজেদের মধ্যে পারম্পরিক সর্স্পক গুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করে ৷ নারী তার নিজের সত্তার ভেতরের নারীদের সেই নিরীক্ষক একজন পুরুষ কিন্তু যাকে নিরীক্ষা করা হচ্ছে সে একজন নারী ৷ এভাবে নারী নিজেকে পরিনত করে বস্তুতে এবং আরো সুনির্দিষ্ট করলে বলা যায় নারী নিজেকে পরিনত করে দেখার একটি বস্তুতে, সে নিজেকে রূপান্তরিত করে একটি দৃশ্যে ! আমরা যদি খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে কি দেখতে পাই ? খুব গভীরভাবে ইউরোপীয় চিএগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে ইউরোপীয় তৈলচিত্রের একটি শ্রেনী হচ্ছে ন্যুড বা নগ্মতা ৷ ইউরোপীয় এই নগ্মতার চিএকর্মগুলোতে বেশকিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় আর তার মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রথাগত ধ্যান ধারনার স্বরূপ উদঘাটন করা এবং এর প্রধান লক্ষ্য হলো নারীদের দেখা এবং খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় নারীরা এই এসব চিএকর্মগুলোতে বিবেচিত হয়েছে দৃশ্য হিসেবে !
প্রথম দিকে নগ্নতা কে ধর্মীয় চিএকর্মগুলোতে একটা ধর্মীয় আবহ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং সেখানে দেখা যায় ধর্ম কীভাবে নগ্নতা কে প্রতীয়মন করছে ৷ যেমন আদম আর ইভের ঘটনা টি যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায় যে – নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাদের আরেকটি জ্ঞান হলো যে তারা নগ্ন আর তাদের নগ্নতা তাদের (আদম এবং ইভ ) কে প্রথম ধারনা দিলো তারা আলাদা কারন তাদের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য আলাদা এটা পরিলক্ষিত হলো এবং প্রথমবারের মতো তারা তাদের লজ্জাস্থান ডেকে রাখতে সচেষ্ট হলো ৷ ধীরে ধীরে অবশ্য যখন স্যাকুলাজিরমের ধারনার উৎপত্তি হলো তখন চিএকর্মগুলোতে ধর্মীয় ধারনা কমতে শুরু করলো ৷চিএকর্ম সৃষ্টির প্রথায় ধর্মনিরেপেক্ষতা আসলো কিন্ত চিএের ধর্মে কোন পরির্বতন আসলো না এখনও আপনি যে কোন চিএকলা লক্ষ্য করলেই দেখবেন প্রতিটি চিএকর্মে একটি সচেতন ইঙ্গিত থাকে আর সেটি হলো এর বিষয়বস্তু (একজন নারী ) সেখানে সচেতন কারন কোনো একজন দর্শক তাকে দেখছে ৷
আসলে আপনি যদি কোন নগ্ন নারীর চিএকর্ম পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখতে পাবেন সে ঠিক ততটাই আবরনহীন, যেমনটি কোনো দর্শক তাকে দেখছে প্রায়শই যেমন ‘সুজানা আ্যণ্ড দি এলডার্স একটি জনপ্রিয় চিএকর্ম এখন যদি আপনি এই চিএকর্ম টি যদি পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখতে পাবেন কিছু পৌঢ় সুজানার নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর সুজানা স্লান করছে ৷ এখন গভীরভাবে চিএকর্ম টি দেখুন তাহলে কি দেখতে পান ?দেখতে পাবেন যে সুজানা জানে যে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং সুজানা এই ব্যাপারটা উপভোগ করছে ! সুজানার আরেকটি ছবিতেও দেখা যায় একই অবস্থা সুজানা নিজেকে আয়নায় দেখছে এবং এভাবে সে নিজেও লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা দর্শকদের সাথে অংশগ্রহন করে ৷
চিত্রকর্মগুলোর আরেকটি মূল বিষয় হলো আয়না ৷ আয়নাকে প্রায়শই চিএকলায় ব্যবহার করা হয় নারীর অহংকারের প্রতীক হিসেবে যদিও নৈতিক এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষের ভণ্ডামির পরিচয় ৷আপনি একটি আবরনহীন নারীর চিত্র এঁকেছেন কারন আপনি তাকে সেভাবে দেখে উপভোগ করে থাকেন আর আপনি তার হাতে একটা আয়না ধরিয়ে দিলেন এবং চিত্রকর্মটি কে নাম দিয়েছেন ভ্যানিটি বা দম্ভ আর এভাবে আপনি সেই নারীকে নৈতিক দৃষ্টিতে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করছেন আর তার আবরনহীনতা আপনি এঁকেছেন আপনার নিজের উপভোগের বস্তু হিসেবে ৷ আয়না ব্যবহারের সত্যিকার কারন মূলত ভিন্ন কিছু ৷ এটি ব্যবহৃত হচ্ছে নারীকে প্রথমত এবং প্রধানত তার নারীর কাছ থেকে নারীকে একটি দৃশ্য হিসেবে ব্যবহার করবার প্রচেষ্টায় তার নীরব সস্মতি আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা ৷ নগ্নতার আরেকটি বিখ্যাত ছবি হলো দদ্যা
জাজমেণ্ট অব প্যারিস চিএকর্ম টিতেও আমরা দেখতে পাই একই অবস্থা কোনো পুরুষ বা পুরুষদের একটি দল আবরণহীন নারীদের দিকে তাকিয়ে আছে ৷
দ্যা জাজমেণ্ট অব প্যারিস চিএটি আরেকটি মূলভাবনা প্রকাশ করে আর সেটা এখানে একটি বিচারিক প্রক্রিয়া যুক্ত হয়েছে ৷ প্যারিস তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে আপেলটি নিবেদন করে পুরস্কার হিসেবে ৷ এভাবে আজকের দিনেও আমরা দেখতে পাই সৌন্দর্য বিচার যোগ্য হয়ে ওঠে (আজকের দিনে প্যারিসের সেই বিচারিক প্রক্রিয়া পরিনত হয়েছে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় ৷ যাদের সুন্দর বলে বিচার করা হবে না,তারা সুন্দর নয় আর যারা সুন্দর তাদের পুরস্কৃত করা হয় এটাই তো এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই না ?
নগ্ন হতে হলে সেই আবরনহীনতা টিকে দেখতে হবে অন্য কাউকে অথচ আবরনহীন যে তার নিজের কাছে সেটা ধরা পড়বে না ৷ কোনো একটি আবরনহীন শরীরকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখতে হবে ৷ আবরনহীনতা নিজেকে উন্মোচন করে আর নগ্নতা প্রদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা হয় ৷আবরনহীনতা আর নগ্নতা এক নয়!
আবরনহীন হওয়া মানে সব ধরনের ছদ্মবেশ ত্যাগ করা আর নগ্ন হওয়া মানে নিজের ত্বকের পরিস্থিতি কে কখনোই পরিত্যাগ করা যায় না ৷ নগ্ন চিরকালের জন্য আবরনহীন না হওয়ার অভিশাপে যখন অভিশপ্ত তখন নগ্নতাই হয়ে যায় এক ধরনের পোষাক ৷আমি এতোক্ষন যতগুলো উদাহারন দিয়েছি তার সবগুলো প্রাচীন বিশেষ করে রেনেসা কালীন বা তার আগের চিএকর্মের উদাহারন এখন আপনার মনে হতে পারে সময়ের সাথে সাথে চিএের সে ধারা তো নিশ্চয়ই পরিবর্তিত হয়েছে আর আপনি যদি এটা ভেবে থাকেন যে পরিবর্তন এসেছে তাহলে আপনি ভুল করছেন ৷আজও নারীকে দেখার সে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধগুলো অটুট আছে ৷ যা তথ্যপুষ্ট ঐতিহ্যবাহী সনাতন ধারাগুলো দিয়ে আরো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে এবং নগ্নতা প্রচারের জন্য এখন অন্য একটি মাধ্যম বেছে নেওয়া হয়েছে আর তা হলো প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপন প্রচারনা, সাংবাদিকতা ,টেলিভিশন তাই নারীকে দেখবার মূল ব্যবহারগুলো ,যে চিত্রগুলো উপস্থাপন করা হচ্ছে তার কোন পরির্বতন হয়নি ৷পুরুষের তুলনায় নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিণ্ণরূপে ৷ নারীত্ব আর পৌরুষত্বের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে তা নয় বরং এর কারন একজন আদর্শ দর্শক হিসেবে সবসময়ই ধারনা করে নেয়া হয়েছে পুরুষকে এবং পুরুষকে খুশি করবার জন্য নারীর চিএ পরিকল্পনা মাফিক উপস্থাপন করা হয়েছে ৷
যদি এ বিষয়ে পাঠক আপনাদের কোন সন্দেহ থাকে তাহলে নীচের পরীক্ষাটি করে দেখতে পারেন ৷প্রচলিত প্রথায় আঁকা নগ্ন নারীর যে কোনো একটি চিএকর্ম যে কোন একটি বই থেকে বেছে নিন তারপর চিএকর্মটির সেই নারীকে প্রতিস্থাপন করুন একটি পুরুষের চিএ দিয়ে ৷চিএটি আপনি পুরুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখার মাধ্যমে কিংবা এর কোনো পুনর্মুদ্রিত অনুলিপির উপর রেখাচিত্রের মাধ্যমে নিজে এঁকে দেখতে পারেন এবং এরপর ভালোভাবে লক্ষ্য করুন এবং দেখুন এই রূপান্তরটি কত বেশি ভয়ংকর হিংস্রভাবে আচরন করে শুধু চিএটির প্রতি নয় বরং একজন পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কোনো একজন নারীর প্রতি আর একজন নারী হিসেবে আমাকে তা মনে করিয়ে দেয় একজন পুরুষের দৃষ্টি কি রূপ হতে পারে আমার প্রতি অথবা যে কোন নারীর প্রতি !
সূত্র: জন বার্জারের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনে।