“মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ;
সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ!”

কাঁথা বা কেন্থা বা শুজনি প্রধানত গ্রামবাংলার মহিলাদের হাতে তৈরি সেলাইয়ের কাজ করা আচ্ছাদন বস্ত্র। এটি কম্বলের তুলনায় পাতলা, সাধারনত একাধিক পুরোনো শাড়ীর পরত দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়ে থাকে। কাঁথা মূলত লোকশিল্প হিসেবে পরিগণিত। অত্যন্ত দক্ষ ও কুশলী হাতে, নৈপুণ্যের সাথে নকশা যুক্ত তৈরি কাঁথাকে নকশি কাঁথা বলে। নকশার উপর নির্ভর করে কাঁথার মূলত তিন প্রকার রূপ রয়েছে- নকশি কাঁথা, পাড়তোলা কাঁথা ও লহরী কাঁথা। ব্যবহারভেদেও কাঁথার বিভিন্ন প্রকার হয়- লেপ কাঁথা, শুজনি কাঁথা, রুমাল কাঁথা, আসন কাঁথা, আর্শিলতা প্রভৃতি।
কাঁথার উৎপত্তি ও তার ইতিহাস আনুমানিক হাজার বছরের প্রাচীন। অবিভক্ত বাংলায় ব্যাপকভাবে প্রচলন ছিল এই কাঁথা শিল্পের ঐতিহ্য। হিন্দুধর্মের পরবর্তী প্রভাব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা, বিয়ের ও জন্মের জন্য কাঁথা তৈরিতে এই প্রাচীন লোকশিল্প ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অর্থ বহনকারী এই কাঁথা শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান বীরভূম জেলার নানুর।


স্থিরচিত্র : সম্রাট ঘোষ


নানুর এর কাঁথা শিল্প আজ দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের দরবারে সমানভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই এলাকার ৩০০০ হাজার মহিলা শিল্পীর জীবন অতিবাহিত হয়ে থাকে এই শিল্পকে আঁকড়ে ধরে। সুচ আর রঙিন সুতো দিয়ে কাপড়ের পরতে পরতে হারানো দিনের ফুল-পাতা, জীবজন্তু, আলপনার নকশা ফুটিয়ে তোলাতেই দিন কাটে এখানকার তাজকিরা বেগাম, আমিনা বেগাম, লাভ্লি বেগাম দের। কদম, আঙ্গুর থোকা, রকেট, আংটি ফাঁস, গোলকধাঁধা এই রকম বিভিন্ন মোটিফ অনায়াসে কাপড়ে ফুটিয়ে তোলেন এই শিল্পীরা।


স্থিরচিত্র : সম্রাট ঘোষ


কিছু পুরোনো কাপড়ের টুকরো কে বিভিন্ন স্তরে সাজিয়ে কাপড়ের প্রান্তগুলি পর পর সেলাই করে তার উপর রঙিন সুতো দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলাই ছিল প্রাচীন কাঁথা তৈরির রীতি। একটি সাধারণ কাঁথাতেও শুধুমাত্র ফোঁড় দেয়ার নৈপুণ্যের গুণে বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। প্রাথমিক ভাবে একটি ট্রেসিং পেপারে নকশা আঁকা হয়, তারপর সুচ দিয়ে সেই নকশার উপর ছিদ্র করা হয়। পরবর্তী সময়ে রংযুক্ত পাউডার এর সাথে কেরোসিন মিশিয়ে পেপারের উপরে ছড়ানো হয় যার ফলে পেপারের নকশা কাপড়ের উপর ফুটে ওঠে। তারপর নির্ধারিত হয় রঙের প্যালেট। এরপর নকশার ধার অথবা প্রান্তগুলি রান সেলাই করা হয়ে থাকে। প্রান্তগুলি সেলাই এর পর শিল্পী তাঁর নির্বাচিত বিভিন্ন রঙ এর সুতো দিয়ে এবং সেলাই এর বিভিন্ন ধরণের মধ্য দিয়ে নকশা ভরিয়ে তোলেন।

তবে বর্তমানে সনাতনী কাঁথা শিল্পের বাইরেও শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশন কভার, ব্যাগ, গহনা প্রভৃতিতে সুতো দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে।

 

নানুরের কাঁথা শিল্পীরা বছরে একবার গ্রামে “কাঁথা মেলা” র আয়োজন করে থাকেন। দেশ- বিদেশ থেকে বহু পর্যটক সেই সময় মেলা দেখতে গ্রামে ভিড় করেন। বহু প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও আজও কাঁথা শিল্পকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন নানুরের কাঁথা শিল্পীরা, বরং পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং সরকারি উদ্যোগে কাঁথা শিল্প বর্তমানে বেশ প্রসার লাভ করেছে। বাংলার এই প্রাচীন লোকশিল্প তাঁর ঐতিহ্যগত আবেদনের জন্য আজও অনন্য ও অদ্বিতীয়। বেঁচে থাকুক কাঁথা শিল্প, বেঁচে থাকুন কাঁথা শিল্পীরা, তাঁদের জীবনেরও প্রতি মুহূর্ত রঙিন সুতোর নকশায় ভরে উঠুক।


স্থিরচিত্র : সম্রাট ঘোষ