‘চাঁদের আলোয় যাযাবর গান’ মানুষ ও প্রকৃতির নিগূঢ় সম্মোহন
‘এটা সত্য নয় যে আমার বাড়ি নেই
আমার বাড়ি তো উদীয়মান সূর্যে
মরুভূমির সাজানো বাঁকে
কিন্তু এখন দেখতে শীতল চাঁদের মতো লাগছে।’
(পৃঃ ১৯, আমার বাড়ি নেই এটা সত্য না)
যাযাবর কণ্ঠস্বরের আড়ালে তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন- তার অবস্থান মহাবৈশ্বয়িক। তিনি পৃথিবীর নাগরিক।
কবি হাদা সেন্দো মঙ্গোলিয়ান সাহিত্যে অন্যতম শক্তিমান কবি। তার কবিতায় শব্দের ধারায় প্রবহমান তীক্ষ্ণ সুর। শব্দের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে অস্থির সময় ও প্রকৃতির ঘনিষ্টতা। তিনি কবিতা নির্মাণ করেছেন নিবিষ্ট মাটি সংলগ্ন উৎস হতে। উন্মত্ত সময়ে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের উচ্চারণ-
‘ভোরবেলার অনুজ্জ্বল রঙ আলোর সঙ্গে
মিশে আছে রক্তমাখা জ্বলন্ত জমি,
গজলা হরিণের মতো’
(পৃঃ ৪১,পৃথিবীর কোনা)
আবার এ কবিতাতেই কিছুক্ষণ পর শীতল হয়ে গেছেন তিনি। প্রকৃতির আলিঙ্গনে খুঁজেছেন শান্তি।
‘বাতাস ফিরে আসছে
সকালের শিশির,
ঝরে পড়ে-
আর আমি বসে আছি ঘাসের উপর
শেকড়ের সঙ্গে।’
(পৃঃ ৪১,পৃথিবীর কোনা)
হ্যাঁ, কবি আজন্ম শেকড় সন্ধানে ছিলেন। নিমগ্ন ছিলেন শৈশবের বেড়ে উঠা পাহাড় ও বিস্তীর্ণ মাঠের ভূমিতে।
কবি হাদা সেন্দোর জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ অক্টোবর মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে। বাবা-মার নাট্যাভিনয় শৈশবেই তার মনে প্রভাব বিস্তার করেছে। সিলিগোল শহর দালানহার পর্বতমালায় কাটে তার বাল্যকাল। সেখানকার স্থানীয় স্কুল থেকে পুরাতন মঙ্গোলীয় ভাষা ও চাইনিজ ভাষায় শিক্ষা গ্রহণকে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি চলে যান তৃণভূমি অঞ্চলে। বেছে নেন যাযাবর জীবন। তাঁর কবি জীবনে ‘যাযাবর জীবনধারা’ স্পষ্ট-
‘আমি অনেক দূরদেশ ভ্রমণ করব
আমার ভয় নেই কোনো কিছু হারানোর
এমনকি দলছুট হরিণের মতো
আমি যদি আটকা পড়ি ভয়ংকর তুষার ঝড়ে’
(পৃঃ ৪২,তীর্থযাত্রী)
মঙ্গোলিয়ানদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন-প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা ও পরিবেশ বিপর্যয়ে কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠে, তিনি লিখেন-
‘ঘোড়া আমার অস্তিত্ব-
তবু নীরব কান্না আশ্রয়হীনের চোখে
আদি-অন্তহীন নীল আকাশের নীচে’
(পৃঃ ৪৭, তামির নদী)
১৯৮৪ সালে হাদা সেন্দোর যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে। তিনি যোগ দেন আর্ট ইনস্টিটিউটে। সেসময়ে ব্যাপকভাবে পড়াশোনা করেন বিশ্বসাহিত্য। পাঠ করেন মঙ্গোলিয়ান মহাকাব্য, লোকগান ও ধ্রুপদী সাহিত্য। সাহিত্য সমালোচকরা মনে করেন,- তার প্রথম দিকের কবিতা মঙ্গোলিয়ান মহাকাব্য দ্বারা প্রভাবিত। পরবর্তীসময়ে সেন্দো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। হাদা সেন্দোর কবিতা এক স্বচ্ছ প্রগাঢ় সম্মোহন তৈরি করে। যে সম্মোহনের সবটা জুড়ে আছে রহস্যময় জীবনের ছাপ। আদিগন্ত চিন্তার অমিয় বাণী। মানুষ ও প্রকৃতির সুরময় গীতলীলা। বিরূপ প্রতিবেশে সংগ্রামী মানুষকেই তিনি দেখেছেন বারবার। যেমন-
‘ওহ মানুষ, তুমি ফিরে এসেছ
বাল্যকালের মতো
দাঁড়িয়ে আছ রাতের মধ্যে’
(পৃঃ ৩৯,তুষার)
‘চাঁদের আলোয় যাযাবর গান’ কবিতার স্বরূপে এক অন্যবদ্য স্তুতি। বইটি ভাষান্তর করেছেন কবি অনন্ত উজ্জ্বল। বইটির ভাষান্তরে গঠনশৈলীর বৈকারণিক ব্যবচ্ছেদে হয়তো বিজ্ঞজনের নানা প্রশ্ন থাকতেই পারে। বইটির ভাষান্তরে সরল ভাষার প্রয়োগ দ্যুতিময় উপমায় প্রতিটি কবিতার পঙতি আমাদের নিজস্ব হয়ে উঠে। যা বিশ্ব কবিতার সার্বজনীনতাকে স্বীকার করে। মঙ্গোলিয়ান প্রাচুর্যময় ঐতিহ্যে ঘোড়ার খুড়ে খুড়ে আমরা স্পষ্টই শুনতে পাই আদি প্রকৃতি ও মানুষের বেঁচে থাকার চিরায়ত কণ্ঠস্বর। অনন্ত উজ্জ্বলকে অভিনন্দন, যিনি কবিতাপ্রেমীদের কাছে হাদা সেন্দো’র কবিতা মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বইটি প্রকাশ করেছে স্বদেশ শৈলী, প্রকাশকাল একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০, অনুবাদক-অনন্ত উজ্জ্বল, মূল্য-২০০ টাকা।
কবি