| 3 অক্টোবর 2024
Categories
চলচ্চিত্র বিনোদন

ফিল্ম রিভিউ: অস্কারে সেরা ছবির অন্যতম দাবিদার ‘নোমাডল্যান্ড’

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
নির্মল ধর
বেশ কিছু বছর আগে সলিল চৌধুরীর লেখা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “পথে এবার নাম সাথী…” গানটির কথা বার বার মনে আসছিল ক্লোই (চিনা নাম টিং) ঝাওয়ের (Chloé Zhao) নতুন ছবি ‘নোমাডল্যান্ড’ (Nomadland) দেখতে বসে। একটাই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে। মানুষের আসল ঘর কোনটা – যেখানে বাস করে, নাকি অনন্ত আকাশের চাঁদোয়ার নিচে কোথাও। যেটা কিছু মানুষ আমৃত্যু খুঁজেই চলে। এই ছবির মধ্যবয়স্কা নায়িকা ফার্ন যেমন।
নেভাদায় জিপসামের খনি বন্ধ হয়ে গেলে পুরো এম্পায়ার শহরটাই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। সময়টা অবশ্য আজকের নয়, গত শতকে ‘গ্রেট’ আর্থিক মন্দার যুগ। স্বামীহারা ফার্ন নিজের গাড়িটাকে চলন্ত বাড়ি বানিয়ে বেরিয়ে পড়ে পথে। খানিকটা ভবঘুরে বা জিপসিদের মতো। কোনও পিছুটান নেই। শুধুই চোখ আর মনের টানে এগিয়ে চলা। ‘রোড মুভিজ’-এর আদলে তৈরি পুরো ছবি। পথই তখন ফার্নের ঘর, বাড়ি তার ভ্যান, আর পরিজন বলতে পথের অজানা মানুষের দল। তাদেরও অনেকেই ফার্নের মতই ভবঘুরে। একবার ফার্ন বলে, “আমি হোমলেস নই, বলতে পারো হাউসলেস!” ঘরতো প্রত্যেক মানুষকে খুঁজে নিতে হয়, মনের মতো ঘর আর ক’জন পায়!! ফার্নও পায়নি, যেমন পায়নি সোয়াঙ্কি, ডেভ। আবার পেয়েছে পথের সাথী। যে চেয়েছিল ফার্ন তার জীবনের শেষ বেলায় সঙ্গী হোক। না, ফার্ন হয়নি। আর কোনও বাঁধনে সে নিজেকে বাঁধবে না। পিছনে ফেলে আসা ‘এম্পায়ার’-এ নিজের ভাঙা বাড়িতে একটিবারের জন্য ফিরে এসেও আবার বেরিয়ে সে পড়েছে পথে। পথের সাথী খুঁজতে নয়, বরং অন্তহীন পথের পথিক হয়ে জীবনের অন্যতর উদ্দেশ্যের খোঁজে। যে খোঁজ চিরন্তন, চিরকালীন, সংবেদনশীল যে কোনও মানুষের কাছে।
 
টিং ঝাও একেবারেই সহজ সরল ভঙ্গিতে, নিপাট ন্যারেটিভে ফার্নের দীর্ঘ যাত্রাকে দর্শকের সামনে এনেছেন। ছোট্ট একটি ফ্ল্যাশব্যাক আছে বটে, কিন্তু সেটাও রয়েছে মসৃণ ভাবে। শুধু সখের ভবঘুরে ফার্নের জীবন নয়, পাশে রয়েছে আরও বেশ কিছু সত্যিকার ‘নোমাড’দের দল। তারা অনেকেই অভিনেতা নন, আসল ভবঘুরে। আর এখানেই ঝাও তথ্যচিত্রের ছোঁয়া লাগিয়ে ছবিকে করে তুলেছেন ডকুফিচারের এক অনবদ্য ঘরানা। ভবঘুরে পথিক হয়ে ফার্নকে কত কাজই না করতে হয়েছে! আমাজন কোম্পানির সাধারণ প্যাকার থেকে টয়লেট পরিষ্কার করা, সক্কলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ কিছুই বাদ যায়নি। আসলে সকলে মিলে থাকা খাওয়া ও বাস করার মধ্যে একধরনের কমিউনিটি ফিলিং আনার চেষ্টা। দারুণভাবে সেটা স্পষ্ট হয়েছে ছবিতে।
 
গতবছর ভেনিস উৎসবে সেরা ছবির গোল্ডেন লায়ন প্রাপ্তির পর থেকেই ঝাওয়ের উপর ভরসা তৈরি হয়েছিল। ওঁর প্রথম ছবি ‘সংস মাই ব্রাদার টট মি’ দেখেই আন্দাজ ছিল প্রবাসী এই চিনা তরুণী অন্য মানসিকতার। চিনা পরিচালকদের সঙ্গে ঠিক মানায় না। ‘নোমাডল্যান্ড’ প্রমাণ করে দিল তিনি একজন নারীর মনের অন্দরে যেভাবে প্রবেশ করতে পারেন, সেটা কোনও পুরুষ পরিচালকের পক্ষে সম্ভব নয়। না, সেজন্য তাঁর গায়ে নারীবাদী তকমা লাগানোর দরকার নেই। ঝাও একজন মুক্তমনা মানুষ, যিনি জীবনকে খুঁজতে শুরু করেছেন নিজস্ব ভাবনায়, মননে। কোনও পুরুষের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে নয়। সেটাই এই ছবির অন্তর্নিহিত শক্তি।
 
কী ভাগ্যি! টিং ঝাও সঙ্গে পেয়েছেন ফ্রান্সিস ম্যাকডর্ম্যান্ডের (Frances McDormand) মতো একজন শক্তিময়ী অভিনেত্রীকে। তাঁর ভাঙাচোরা মুখের ক্লোজআপ জশুয়া জেমসের ক্যামেরার সামনে যে কতরকম অনুভূতির মানচিত্র নিয়ে খেলা করেছে, সেটা দেখা এক অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা। ফ্রান্সিস আবার এই ছবির অন্যতম প্রযোজক। সুতরাং বাড়তি আরেকটা সাবাশি তাঁর প্রাপ্য। জীবন বহতা, তাঁকে বইতে দিতে হয়। আটকালেই জীবন যায় থেমে। আমরা বেশিরভাগ মানুষ সেই থমকে থাকা জীবন নিয়েই বাঁচি। টিং ঝাও জানিয়ে দিলেন, বাঁচার অন্য অর্থ পথে নামা, পথ খোঁজা, পথের সাথীকে চিনে নেওয়া। কিন্তু কোনও বাঁধনে নিজেকে বাঁধা নয়।

One thought on “ফিল্ম রিভিউ: অস্কারে সেরা ছবির অন্যতম দাবিদার ‘নোমাডল্যান্ড’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত