ননী ও রবি

Reading Time: 2 minutes

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

তত দিনে শান্তিনিকেতনে বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন দুই ভাই। দু’জনের বাড়ি রাজশাহি জেলার জোয়াড়ি গ্রামে। বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান। দু’জনেরই গায়ের রং ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।’ তবে দুই ভাইয়েরই উজ্জ্বল চোখ নজর কাড়ে আশ্রমিক, সহপাঠী থেকে শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ, সকলেরই। বড় ভাইটি তার মধ্যে ভীষণ আমুদে। তার আমোদ আর হাস্যরসের লক্ষ্য থেকে বাদ যান না স্বয়ং রবিও।

এক বার রবি ঠাকুরের কী খেয়াল চাপল— বাঙালির চরিত্রের ভাববিলাসকে দূর করতে সচেষ্ট হলেন। আর তার দাওয়াই কী! না, আশ্রমের ছাত্র, শিক্ষক সকলকে পড়তে হবে পাণিনির ব্যাকরণ। দিন কয়েক পরে শিক্ষকেরা ছাড় পেলেন। কিন্তু ছাত্রদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তক্কে তক্কে ছিলেন ‘বাঙাল’ ছেলেটি।

এক দিন সুযোগ এল। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজির ক্লাস নিচ্ছেন। কী একটা যেন পড়াতে পড়াতে পেলেন ইংরেজি ‘ডায়িং‌’ শব্দটি। অনুবাদ করলেন, ‘মুমূর্ষ।’ তীব্র আপত্তি জানালেন ছেলেটি, বললেন, ‘‘না ওটা হবে ম্রিয়মাণ।’’ কেন? ব্যাখ্যাটা কী, জানতে চাইলেন শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ। ছাত্রের ব্যাখ্যা, ‘ইচ্ছার্থে সন্ প্রত্যয় হয়; লোকটার তো মরবার ইচ্ছে ছিল না— তাই মুমূর্ষ না হয়ে হবে ম্রিয়মাণ।’’ পাণিনি ব্যাকরণে ছাত্রের এমন অধিকার বিস্মিত করল কবিকে। আঁতকে উঠে তিনি বলেন, ‘‘এ যে দেখছি বাংলাও ভুললি, আবার সংস্কৃতও শিখলি না!’’ ছাত্রের সহাস্য উত্তর, ‘‘যেমন ব্যবস্থা করেছেন। সবে বাংলা ভুলতে আরম্ভ করেছি, এর পরে সংস্কৃত জ্ঞানের বুনিয়াদ পাকা হতে থাকবে।’’ কবি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। বন্ধ হল ছাত্রটির পাণিনি পাঠ।

ছাত্রটির ডাক নাম, ননী। শান্তিনিকেতনে যাঁকে সকলে ডাকে ‘বিশী’ নামে। আর বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রমথনাথ বিশী বা প্র.না.বি.।

বিশীর হাতে রবীন্দ্রনাথের জব্দ হওয়ার আরও একটি বেশ চর্চিত গল্প রয়েছে।

তেমনই এক দিন। বিশীর সামনেই রবীন্দ্রনাথ এক পরিচিতকে ডাকছেন, ‘নিমাই, নিমাই’ বলে। বিশী তো অবাক, ওর নাম নিমাই হবে কেন। রবীন্দ্রনাথকে সে কথা বলতেই কবি বলেন, ‘‘দেখছিস না, ওর হাতে যে নিমের ডাল রয়েছে।’’ এমন ব্যাখ্যা শুনে এ বার বিশীর মোক্ষম প্রশ্ন, ‘‘কারও হাতে জামের ডাল থাকলে গুরুদেব তাকে কী বলে ডাকবেন?’’ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশীর সম্পর্ক ছিল এমনই।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রিয় ছাত্রের সাহস ও মজা করার ক্ষমতা আগেও টের পেয়েছেন। ‘অচলায়তন’ নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করছেন আচার্যের ভূমিকায়। সেখানে একটি দৃশ্যে ছাত্রেরা দড়ি দিয়ে বাঁধবেন আচার্যকে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু ছাত্রদের সকলেরই পা ভারী হয়ে ওঠে, কেই-ই বা আচার্যরূপী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে বাঁধবে! এগিয়ে এলেন সেই বিশী। বললেন, ‘‘দূর ছাই, এ তো অভিনয় বৈ কিছু নয়।’’ সমস্যা মিটল মঞ্চেরও।

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: আনন্দবাজার পত্রিকা 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>