| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

নো পবলেম

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

 

।। ১।।

কৃষ্ণপুর স্কুলের সবাই তাকে এক নামে চিনে। আমাদের দলের লিডার। সে হলো চিনু’দা। মা- মাসিরা বলে, এটা কোন নাম হলো? পাড়ার বুড়ো পটলবাবু দাঁত খিঁচিয়ে বলে, বদের হাড্ডি একটা, ইঁচড়েপাকা চিনু।

চিনুদা’র অবশ্য একটা ভালো নাম আছে, তা হলো চিন্ময়। আমাদের ক্ষেপাটে বন্ধুরা বলে- ‘চিনিময়’। গতবার গোপালপুর জাগরণী ক্লাবের সাথে ফুটবল খেলায় হেরে যাবার পর ওরা কোরাস তুলেছিলো ‘চিনিগুড়’ বলে। ক্ষেপে গিয়ে চিনুদা বলেছিলো, বাপ শালা আর নাম পেলো না… রাখলো গিয়ে চিন্ময়। যেন একেবারে ‘ময়’ করে ছাড়বো সব। আমি বলেছিলাম, চিনুদা, বাবা আবার শালা হয় কিভাবে? দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিলো, হয় এ-রকম কম্ম করলে হতে হয়।

চিনুদা’র একটা স্বভাব হচ্ছে, কথা বলার সময় আঞ্চলিক, চলিত ও সাধু ভাষার সংমিশ্রনে কথা বলা। পাড়া জুড়ে সুখ্যাতি-কুখ্যাতি দুটোই আছে তার। আমাদের দলের কোন নাম নেই। পাড়াশুদ্ধু লোক বলে পঞ্চপাণ্ডবের দল। সদস্য সংখ্যা পাঁচ জন। আমি পল্টু, বিলু, চিনু, নিপেশ। আমাদের সবাই চিনু দা’র দারুন রকমের ভক্ত।

 

আজ আমরা বাঞ্ছারামপুর থেকে ফুটবল খেলায় হেরে বাড়ি ফিরছি। আমাদেরকে হায়ার করে এনেছিলো ওরা। এর আগে আর কখনো আসিনি। রাস্তাঘাটও অচেনা। খেলাতে হেরে মনটা খারাপ তার উপর পকেট গড়ের মাঠ! স্টেশনের পথে হাঁটছি। হঠাৎ বিলু বলে উঠলো, পল্টুর জন্যই তো আজ হারলাম আমরা। মোটকু দৌঁড়াতে পারে না। পল্টু বললো, তোরা খেলতে পারিস না, আমাকে দোষ দিবি না; আর মোটকু বলবি না। নাদুস-নুদুস বডিটার দিকে তাকিয়ে আমিও বললাম তুই তো মোটকুই। একটা বিচ্ছিরি ঝগড়া লাগতে যাচ্ছিল মাত্র; তার আগেই চিনু’দা বলে উঠলো বিলু পবলেম হলো দেখছি।

চিনুদা প্রবলেমকে পবলেম বলে।  র-ফলা ব্যবহারে তার একটু এলার্জি আছে। আমি বললাম কী পবলেম? মুখ বেঁকিয়ে চিনু’দা বললো, প্রকৃতির ডাক এসেছে… আতঁকে উঠলাম সর্বনাশ! একে তো বাজার, তার উপর আশে পাশে কোন মাঠঘাটও নেই। তাছাড়া এখানে কাউকে চিনি না। পল্টু বললো, কষ্ট করে ধরে রাখ; চিনু’দা মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো বললেই হলো।

একটু পর চিনু’দা বলে উঠলো, পড়ে গেলো তো; সর্বনাশ! আঁতকে উঠলাম আমরা। আশে-পাশে দেখতে লাগলাম টয়লেট কিংবা গনশৌচাগার আছে কিনা। চোখ লাগিয়ে খুঁজছি পল্টু আর আমি। বিলু আবার ক্ষণে ক্ষণে পিছু চেয়ে চেয়ে হাঁটছিল। রাস্তায় বসে পড়লো না তো চিনু, তাহলে গেছে… কম্ম সারা। কিন্তু খুঁজে পাই না টয়লেট।

 

হাঁটতে হাঁটতে পাঁচতলা একটা বিল্ডিং পার হবার পর হঠাৎ টের পেলাম চিনু’দা নেই। ভাবলাম কোথাও কাজ সারতে চলে গেছে হয়তো। থামলাম পাঁচতলা বিল্ডিংটার পাশের ডাল-পুড়ির দোকানের সামনে। চোখ ঘুরিয়ে দেখলেম নতুন ফ্লাট বাড়ি হচ্ছে। দাঁড়িয়ে আছি, নিপেশ বললো, আমার কাছে পাঁচটি টাকা আছে কিছু খাবি তোরা? আমরা তো অবাক! কিপটে আজ খাওয়াতে চাইছে। নিশ্চয়ই বাপের পকেট থেকে টাকা মেরে দিয়েছে। চিনু’দা না আসলে খাবো না, বলে দাঁড়িয়ে রইলাম।  ততক্ষণে দশ মিনিট পেরিয়ে পনেরতে পড়েছে।

চিনু’দা তো আসছে না। চিন্তার ব্যাপার। পল্টু বললো, চল পিছু দেখি। অগ্যতা আবার হাঁটা লাগালাম। মনে মনে বলি, চিনু কি কারো বাড়ি গিয়ে কাজ সারবার সময় ধরা খেলো। বিলু বললো, সামনে একটা জটলা দেখা যাচ্ছে রে, চল যাই। সাপের খেলা মনে হয়। আমি বলে উঠি, আগে চিনুদা’র খোঁজ করি পরে সাপ দেখবো। কিন্তু কী ভেবে জটলায় দিলাম উঁকি, দেখে তো চক্ষু ছানাবড়া! চিনু’দা এখানে দু’হাতে কান ধরে আছে। নিতেশ বললে চিনু’দা কী ব্যাপার? এখানে কী করে? কানে ধরে আছো কেন?

মোটা মতন দুটো লোক বললো, তোমরাই বুঝি ওর চ্যালাপ্যালা। হু বলার আর অবকাশ নেই, বিলু বললো, ওকে বেঁধেছেন কেন? আমি বললাম, কী হয়েছিলো চিনু দা?

চোখ বড় করে চিনু’দা বললো, আর বলিস নে, তোরা তো হাঁটছিস এদিকে আমার তো প্রাণ যায়! হঠাৎ দোতলার একটা সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা রয়েছে “টয়লেট”। কোনভাবে সিঁড়ি পেরিয়ে উঠলাম। ভাবলাম বন্যার কারণে পাবলিক শৌচাগার বোধহয় আজকাল উপরেই বানানো হচ্ছে।  তখনকার চাপটা ছিলো কঠিণ। উপর তালায় তন্ন-তন্ন করে খুঁজে কমোড জাতীয় কিছু পেলাম না শেষে এক জায়গায় গর্ত মতো একটা জায়গা দেখে বসে গেলাম। ও মা পড়ে দেখি এটা পানি যাবার পাইপ লাইন। তারপর আর কী! কাজ শেষ করে পানি খুঁজলাম পেলাম না। হঠাৎ এক বোতল পানি পেলাম সিড়ির গোড়ায়; কম্ম শেষ করে দেখি ওটা মিনারেল ওয়াটরের বোতল। নো পবলেম পানি তো। নামতে গেছি এমন সময় ওরা হাজির। এই বলে থামলো চিনু’দা। আমি বললাম তারপর?

তারপর ওরা আমায় ধরে নিয়ে এলো। পল্টু বললো কেন? আরে বুদ্ধু ওখানে তো ফ্ল্যাট তৈরির কাজ চলছে আসলে ওটা টয়লেট না। লেখা ছিলো টু-লেট! আমি টয়লেট ভেবে ভুল করেছি। বিলু বললো, লে-ঠ্যালা। চাপ সহ্য করিতে না পারিয়া ছাড়িয়া দিয়াই আজি এই অবস্থা আমার। মোটা মতন লোকটা বললো ফ্লোর, পানির পাইপ নষ্ট করে দিয়েছে, তাই একঘণ্টা কানে ধরে বসে থাকতে হবে।

।। ০২।।

সেই টু-লেটের পর কদ্দিন ঝিমিয়ে ছিলাম আমরা, তার উপর সামনে পরীক্ষা। সেদিন সকালে আমি পড়ছিলাম। এমন সময় চিনু’দা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বললো, এই ফকরা বাইরে আয় তো। হাবু কাকার চা-স্টলে নিয়ে এলো আমাকে। দেখি বিলু, নিপেশ, পল্টু সবক’টি আছে। চিনুদা বললো, এই পূজোয় বাবা আর মাসির কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা আমি পেয়েছি। এগুলো সৎকাজে ব্যায় করা হইবেক, তোরা কি বলিস? আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম ঠিক আছে কিন্তু ব্যায় পূর্বক কিছু খাওয়াতে হবে আমাদের। চিনু’দা বললো, আগে সৎ কর্মটা করে নিই তারপর খাওয়াবো।

চিনুদা বলতে শুরু করলো, ভেবে দেখলাম প্রতি সপ্তাহেই তো মোবাইল কল করতে হয় দাদা’র কাছে। যেতে হয় বিপ্রদা’র বাড়ি। বসে থাকো রে, লাইন পাইনা রে, শব্দ হয় রে, কত কী পবলেম দেখায় ওরা। তাই ঝক্কি ঝামেলা আর না পোহাবার তরে একটা মোবাইল কেনার পদক্ষেপ। তোরা কি বলিস? আমি বললাম, বুঝলাম কিন্তু নেটওয়ার্ক পাবে কোথায়? (আমাদের কৃষ্ণপুরে এখনও মোবাইলের টাওয়ার হয়নি, জেলা শহরে আছে। নেটওয়ার্ক পেতে হলে বাঁশ দাঁড় করিয়ে এন্টেনা ঝুলাতে হয়)। মাথায় চাটি মেরে চিনুদা বললো কানা, দেখিসনি রিন্টুদা’র ছাদে যে টাওয়ার ঝুলছে!

আমি ক্ষেপে গিয়ে বললাম, আরে ওটা টাওয়ার কিসের। একটা বাঁশের মাথায় এন্টেনা লাগানো।  এন্টেনায় নেটওয়ার্ক থাকবে কিন্তু লাইন থাকবে পিছে পিছে। একটুক্ষণ ভেবে চিনুদা বললো, নো পবলেম। বিলু বললো, তুমি যখন মোবাইল পকেটে নিয়ে ঘুরবে তখন তো তোমার পিছু পিছু একজন লোক লাগবে বাঁশ সমেত এন্টেনা নিয়ে ঘুরার জন্য। তখন কি করবে? চিনুদা চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, নো পবলেম তোরা আছিস না। আমরা জানি ওর ঘাড়ের রগ একটা ত্যাড়া! কিনবেই মোবাইল।

 

তিনদিন পর…

আমি স্কুল মাঠে গিয়ে দেখি চিনু’দা আর বিলু বসে আছে, হাতে মোবাইল। জিনিসটা টিভিতে দেখেছি হাতে ধরা হয়নি তাই ধরে নেড়েচেড়ে দেখলাম। নেটওয়ার্ক নেই। আস্তে-আস্তে সবাই চলে এলো। দেখলো চিড়িয়াটাকে। গড়ের মাঠে যাবার সময় হয়ে এলো আমার। আমি উঠে যাবো, এমন সময় চিনুদা বলে উঠলো, ফকরা বাঁশটা নে? বাঁশ! বলে কী! পনের হাত লম্বা এন্টেনা লাগানো এক বাঁশ এনে দিলো হাতে। লে-ঠেলা । বিলু এমন সময় বলে উঠলো ও তো পারবে না, পল্টুকে দে? পল্টু বললো পারবে না। মাথায় গাট্টা মেরে বললো, না নিলে তোর প্যান্ট খুলে নদীতে ফেলে দেব ন্যাংটা হয়ে বাসায় যাবি। শেষে কাচুমাচু হয়ে রাজী হলো। কিন্তু এভাবে কতোক্ষণ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যায় হাত লাল হয়ে উঠলো। চোখে পানি আসে আসে ভাব।

মাঠে এসে নিপেশ বললো, এভাবে হবে না, মাথায় হুডওয়ালা টুপি পড়ে এন্টেনা সেটিং করতে হবে। তাহলে ঝামেলা বিহীন। দেখিস না গাড়ীর সাইডে যেমন থাকে। চিনু দা বললে আরে তাই তো।

না চিনুদা’র সেটা আর করা হয়নি আমি তো আশায় ছিলেম আহা না জানি কেমন সে দৃশ্য হবে। পিটুনি খেয়েছে বাপের হুড ওলা টুপি চুরি করতে গিয়ে তার উপর বাবা তাকে আহাম্মক বলেছে।

 

।। ০৩।।

এর কিছুদিন পর গড়ের মাঠে আমরা ঘুড়ি উড়াচ্ছি, চিনু দা এসে বললো, ফকরা গাছটা কেটে দেব? আমি বললাম কোন গাছটা। চিনু’দা বললো, তালগাছটা। নিপেশ বললো, কেন ঘুড়ি বার বার আটকে যায় তাই। চিনু’দা বললো হ্যা; দেখিস না আমার সবকটা ঘুড়ি ওখানে গিয়ে আটকায়। এবার বিলু বলে উঠলো, সরকারী গাছ কাটা যাবে না। পেছন থেকে নিপেশ বলে উঠলো, কাটাবার আগে মেয়র বরাবর একটা দরখাস্ত করতে হবে তাহলে কোন সমস্য হবে না। চিনুদা’র এক কথা অত ঝামেলা করতে পারবো না দরক্ষেস্ত করার টাইম কম আমার। এই সকালে আবার যখন চিনুদা’র ঘুড়িটা গেল তাল গাছে আটকে চোখমুখ লাল করে বললো, এই পল্টু তুই দরখাস্ত লেখবি?

পল্টু বললো না। আমি তো আগেই না; বানান ভুলের কারিগর কিনা। নিপেশ বলে সরি বাবা। বিলু বলে আমার সমস্যা আছে, বাবা জানলে আচ্ছা পিটুনি নিশ্চিত। দাতঁ খিচিয়ে চিনু’দা বললো শালারা হাঁদারাম সবকটা ভীতুর ডিম্ব; আমিই লিখবে বলে চলে গেল সে। পরদিন সকালে চিঠি বাক্সে ফেলে এসে চিনুদা হাজির।

-কি লিখলে চিনুদা?

চিনুদা বললে লিখলাম-

মহাশয়,

গড়ের মাঠে যে তালগাছ নামক একটা বিদঘুটে প্রানী আছে সেটার জন্য আমাদের ঘুড়ি উড়াতে পবলেম হয়। বৃথায় ইহাকে কাটুন, নয়তো আমরা আইন হাতে তুলিয়া নিব এবং এরপর ঘুড়ি ওখানে গিয়া আটকালে কেটে দেব।

নিবেদান্তে- চিনু ,বিলু, পল্টু,ফকরা, নিপেশ।

 

আমি বললাম এই রে আমাদের ভালো নামগুলো দাও নি কেন? মাথায় গাট্টা মেরে চিনু’দা বললো, তাহলে তো পরে আমাদের খুঁজে পাবে সহজেই। ওরা গাছ আজকের মধ্যে না কাটলে কাল আমরা কেটে দেব। আমরা সবক’টা নিশ্চিন্ত মনে ঘুড়ি উড়াতে লাগলাম। এই চিঠি পেলে মেয়র মশাই বোধকরি সেপাইদের পাঠিয়ে খবর নেবে।

পরদিন সন্ধ্যেয়। না কেউ আসেনি, উল্টো নিপেশের ঘুড়ি আটকে যাওয়াতে ওর মাথা হট! এবার কাটতে হবেই কুড়োল নিয়ে পল্টু হাজির। বিলু বললো, পরে যদি কোন সমস্য হয়?  আমি বললাম, হবে না, চিনুদা তো দরখাস্ত দিয়েছেই অগত্যা কাটা স্টার্ট।

চিনু’দা হাতে কুড়োল নিয়ে শুরু করলো। গাছ কাটার শব্দে আশে পাশের সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা ভেদ হওয়াতে ক’জন অবশ্যি ইতিমধ্যে উকিঁ দিয়েছে; কিন্তু আমরা থামছি না। চিনুদা’র পরে বিলু তারপর আমি কাটছি। অর্ধেক হয়ে গেছে। আবার যখন চিনু’দা কাটা শুরু  করেছে এমন সময় হঠাৎ কর্পোরেশনের গাড়ীর আওয়াজ! এ মাঠের দিকেই আসছে। চিনু’দা বললে, নো পবলেম আসুক। আমরা তো আইন হাতে নিয়েছি দরখাস্ত দিয়ে।

হেডলাইট নিভিয়ে ওরা থামলো। আস্তে-আস্তে লোক জড়ো হচ্ছে, আগে কেউ জানতো না এখন সবাই জানবে ইশ্ ভৎসর্নার একশেষ। পাড়াসুদ্ধ লোকের সামনে। পাড়ার কমিশনার বললেন, আচ্ছা কেটে যখন ফেলেছো তখন ওটা কেটে ফেলা হবে তবে তার আগে শাস্তি স্বরুপ তোমাদের কে নীলডাউন কানে-ধরা প্রক্রিয়ায় দেয়া হবে।

সবক’টা কান ধরে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি তবে নীল-লাল ডাউনটি আর হতে হয় নি। হিহি করে হাসছে ছোট বড় সব! কি যে লজ্জা! এমন সময় চিনু’দা বলে উঠলো, লজ্জা একটু লাগছে বৈকি কিন্তু গাছটা তো কাটা হলো। এবার আর ঘুড়ি আটকানোতে নো পবলেম।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত