Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

বিজয়ের মাসে স্মরণে জাতির এক সূর্যসন্তানঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমীন

Reading Time: 4 minutes

হেগেলের দর্শনতত্বের পরিচিত একটি উক্তি, ‘বুদ্ধিমানেরা ইতিহাসের সঙ্গে যান, নির্বোধকে ইতিহাস টেনে নিয়ে যায়।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমীন সচেতনভাবেই আমাদের জাতিসত্তার সংগ্রামসংলগ্ন ইতিহাসের সঙ্গী ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ফাইনাল সেমিস্টারে একটা গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে হয়। একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। অনেকটা পিএইচডি থিসিসের আদলে। এর পোশাকি নাম ‘মনোগ্রাফ’। তো ২০১১ সালে আমাকেও একটা মনোগ্রাফ টাইটেল বেছে নিতে হলো। গবেষণা শিরোনাম জমা দিলাম এবং কাজ শুরু করলাম।“The Roles of Freedom Fighters in Our Liberation War: Sector-5”

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বরাবরই আলাদা একটা কৌতূহল, আগ্রহ ও আবেগ ছিল। খুব ছোটবেলা আমার বড় চাচার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম। শুনতাম মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ দিনের বীরত্বগাঁথা, আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের কাহিনী। তিনি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের বাড়িতে আশ্রয় ও অপারেশনে সহযোগিতা করার গল্প করতেন। কিশোর মনে সাদাকালো সিনেমার মত ভেসে উঠতো সেসব দুঃসাহসিক দিনের দৃশ্যাবলি। সেসব স্মৃতি অবচেতন মনে হয়ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাদা আবেগ তৈরি করেছিল। যদিও আমাদের বেড়ে ওঠার কালে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী হতে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন ও লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এমন অপমান ও লাঞ্ছনা দেখে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সফল আন্দোলন শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চও আমরা গড়ে তুলেছি। যুদ্ধাপরাদীদের সীমাহীন দম্ভ আর ঔদ্ধত্য চূর্ণ করে বিচার নিশ্চিত করেছি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার একটি সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করিনি। গর্বের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের এগারোটি সেক্টরের অন্যতম পাঁচ নাম্বার সেক্টর জন্মস্থান ছাতকে অবস্থিত। বাঁশতলা হেড কোয়ার্টার(অধুনা হকনগর। পাঁচ নাম্বার সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা জননেতা আব্দুল হকের নামে নামকরণ করা হয়ছে)। বাড়ির পাশেই বলে পাঁচ নাম্বার সেক্টর নিয়ে বিস্তারিত জানতে বাড়তি কৌতূহল ছিল। বেশ কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে প্রাসঙ্গিক কিছু পড়শোনা(লিটারেচার রিভিউ) করে ফিল্ডেও কাজ করতে যাই। কেস স্টাডি হিসেবে পাঁচ নাম্বার সেক্টরের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নিতে ঢাকা থেকে সরেজমিন ছাতকে যেতে হয়। বলে রাখা ভালো পাঁচ নাম্বার সেক্টর নিয়ে আমার এ গবেষণা কাজে আন্তরিকভাবে নানা তথ্য, উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা ছাতক-দোয়ারার সংসদ সদস্য জনাব মুহিবুর রহমান মানিক।
কেস স্টাডির প্রয়োজনেই বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমীনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। উনাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনলেও উনি আমাকে অতোটা ভালো করে চিনতেন না। মানে কিছুটা চিনতেন। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক-জাউয়া রোড চালু না হওয়া পর্যন্ত চৌকা গ্রাম হয়েই আমাদের যোগাযোগ ছিল। সে সুবাধে উনার বাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের যাতায়াত। ছিমছাম সুন্দর একটি বাড়ি। সামনে একটি সুদৃশ্য পুকুর। কখনো সে পুকুরে লাল পদ্মফুল ফুটে থাকতে দেখেছি। আমার মায়ের সঙ্গে উনার সহধর্মিনীর সুসম্পর্ক ছিল। মা প্রায়ই সিলেট মামাদের বাসায় বা বিশ্বনাথে তাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে তাদের বাসায় ঢু মারতেন। তাই পারিবারিক পর্যায়েই অনেক আগের চেনাজানা ছিল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সাক্ষাৎকার গ্রহণে নির্ধারিত দিনে উনার বাড়িতে উপস্থিত হই। খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় উনি টগবগে এক তরুণ ছিলেন। কৃতী ফুটবলার হিসেবে এলাকায় উনার ব্যাপক সুনাম ছিল। এর প্রভাব পড়েছে উনার পরবর্তী জীবনেও। অন্যান্য পরিচয়ের পাশাপাশি এলাকায় একজন সফল ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে উনি আজীবন সক্রিয় ছিলেন। ছিলেন রাজনীতি ও সংস্কৃতিমনস্ক, উদার ও অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষ।
আদর্শিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস উনার অন্যতম বড় গুণ। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির একজন মানুষ সফলতার যত উচ্চ শিখরেই আরোহণ করেন না কেন তিনি বড় মানুষ নন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল আমরা একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলব। যেখানে সব ধর্ম মত পথ বিশ্বাসের মানুষ একত্রে বাস করবে। তিনি এই চেতনায় পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন। খেয়াল করলে আমরা দেখব আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সকলেই ছিলেন বয়সে তরুণ। যাদের রক্তে ছিল দ্রোহ আর প্রতিবাদী চেতনা। যারা ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানকে অস্বীকার করে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জাতীয়বাদী চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য রণাঙ্গনে সশস্ত্র লড়াই করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের এই প্রজন্মকে ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই দুঃখ করে বলি, আমাদের শেষ আদর্শিক প্রজন্ম।
সেদিন যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণায় হানাদার বাহিনীর হাতে নিজ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে শুরু করে সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেনিং, আবার যুদ্ধে যোগদান, বেশ কিছু অপারেশনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও ডিসেম্বরে ছাতককে হানাদারমুক্ত করার ইতিহাস সবিস্তারে বলছিলেন। যেন স্মৃতির সেলুলয়েডে আজও উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল সেইসব উত্থাল দিন। সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা, সম্মুখ সমরে ঝাঁ ঝাঁ শব্দে ছুটে আসা শত্রুর গুলি মুহুর্তে শেষ করে দিতে উদ্যত ছিল সেদিন। বিষাদ অনেক স্মৃতি ভুলে রণাঙ্গন থেকে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরেছিলেন। জীবনবাজি রেখে ছিনিয়ে এনেছিলেন জন্মভূমির স্বাধীনতা।বিদ্রোহী বিদ্রোহী কবি নজরুল ছিলেন উনার প্রিয় কবি। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেই আবৃত্তি করে শোনালেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা থেকে,
“বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!”
দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা একজন বীরের মুখেই এমন কবিতার সার্থক আবৃত্তি মানায়। ফলে উনার এক ভিন্ন সত্ত্বার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে সেদিন। ঢাকায় ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে একটি চিঠিও লিখেছিলাম উনাকে।
উনার সঙ্গে সবশেষ স্থানীয় এক নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা হয়। অনেকদিন পর কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তখনো জানতাম না এ দেখাই ছিল শেষ দেখা। শুনেছি অসুস্থ ছিলেন। ব্যস্ততা ও দূরে থাকায় দেখা হয়নি। অথবা একজন অসম সাহসী যোদ্ধার ক্লান্ত মুখ, ভগ্ন শরীর দেখতে ইচ্ছে হয়নি। যখন সুস্থ ছিলেন ফোনে প্রায়ই কথা হত। এলাকায় গেলে যেন দেখা করি। আন্তরিকভাবে চাইতেন। আরও অনেক না বলা গল্প ছিল বাকি। হয়ত বলতে চেয়েছিলেন। সময় সুযোগ হয়নি। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে বলতে ইচ্ছে করে,
‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার/ দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার– হায় রে।
মনে ছিল আসবে বুঝি, আমায় সে কি পায় নি খুঁজি/না-বলা তার কথাখানি জাগায় হাহাকার॥’

এই লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক একটা দুঃখের কথা বলি, মুক্তিযুদ্ধের উপর ইংরেজিতে লেখা আমার লেখা দীর্ঘ গবেষণা প্রবন্ধটি বাসা থেকে ল্যাপটপ চুরি হয়ে যাওয়ার সময় হারিয়ে গেছে। ব্যাক আপ ফাইলও নেই। মূল কপিটি শুধু ডিপার্টমেন্টে জমা দিয়েছিলাম। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ও ছবির সঙ্গে এই লেখাটি হারানো ছিল খুব বেদনাভরা এক অভিজ্ঞতা। তবু গবেষণা কাজের সুবাদে স্থানীয় অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের সাহচর্য পেয়েছি। তাদের মুখে আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সংগ্রামের দিনগুলির বীরত্বগাথা শুনেছি, লিখেছি—এ কম প্রাপ্য নয়। এ সকলই অমূল্য সঞ্চয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমীন আমাদের গৌরবের ধন। নতুন প্রজন্মের জন্য এমন দেশপ্রেমিক, নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী ও আত্মত্যাগী সংগ্রামী একজন মানুষের জীবন উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে রইবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উনার স্মৃতি, সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। উনার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি শ্রদ্ধাভরে, যত্নসহকারে যতদিন আমরা বাঁচিয়ে রাখব, সংরক্ষণ করব ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ। বিজয়ের মাসে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পুণ্যস্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

 

(লেখাটি পাঁচ নাম্বার সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমীন স্মরণ সংখ্যা ‘হৃদয়ে মম’-তে প্রকাশিত। ঈষৎ সংশোধিত)

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>