কী হচ্ছে এইসব! প্রতিদিন একটা দেশে এত রেইপ হয় কেমন করে? আইন কানুন কিচ্ছু নাই নাকি দেশটায়- এক রাশ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আনোয়ার সাহেব হাতের সংবাদপত্রটা নামিয়ে রাখেন। গতকাল সাভারে এক শিশু ধর্ষনের পর নির্মমভাবে খুন হয়েছে এক কিশোরের হাতে, পত্রিকার প্রথম পাতার দুই কলামজুড়ে সে খবর ছাপা হয়েছে। সঙ্গে ছাপা হয়েছে দুটো ছবি- শিশুটির বাবার বুকভাঙা কান্নার ছবি, গ্রেফতার হওয়া ধর্ষক ও খুনি কিশোরের অনুশোচনাহীন মুখ।
দৈনিক ‘প্রথম কিরণ’ এদেশের সর্বাধিক বিক্রিত পত্রিকা। তার প্রথম পাতার এই খবরটিই শুধু নয়; শেষ পাতা, সব অঞ্চলের খবর, সম্পাদকীয়- কোথায় নেই একটা না একটা ধর্ষনের খবর? কেবল আজ নয়, পত্রিকার পাতা আর টেলিভিশনের বুলেটিন- সব জায়গায় অন্তত কয়েকটা ধর্ষনের সংবাদ আসা আজকাল প্রতিদিনকার বিষয় হয়ে উঠেছে। আর শুধু কি ধর্ষণ? খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, সড়ক দুর্ঘটনা, গুম কোন জিনিসটা রোজ রোজ ঘটে না এই দেশে? কী অরাজকতা সারা দেশ জুড়ে! এসব খবর দেখলেই আজকাল আনোয়ার সাহেবের গা রি রি করে ওঠে। এই দুর্ভাগা দেশের কথা ভেবে শিউরে উঠতে উঠতে তিনি ভাবেন ভাগ্যিস একমাত্র মেয়ে ইনায়াকে সময় থাকতে কানাডায় পাঠিয়ে দিতে পেরেছেন!
সেন্টার টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে নিঃশব্দে পুরোটা পানি শেষ করে তিনি আবার বলেন- বুঝছ ইরিনা, এদেশে থাকার আর উপায় নাই। এবার নিজেদেরও চলে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে।
ইরিনা আহমেদ আনোয়ার সাহেবের স্ত্রী আর ইনায়ার মা। বেশ অনেকদিন ধরে বিভিন্ন অসুখে ভুগে ভুগে আজকাল তিনি ক্লান্ত থাকেন সব সময়, একটার পর একটা ধকল সামলাতে সামলাতে অবসন্ন হয়ে গেছেন মানুষটা। শরীরের অস্বস্তিকর ক্লান্তি আর একঘেয়ে সময় কাটিয়ে উঠতে ক’দিন আগে একটা উলের সোয়েটার বুনতে শুরু করেছেন তিনি। আনোয়ার সাহেবের আকস্মিক এই কথা শুনে ক্রমাগত নীল-সাদা উল বুনে চলা চিকন কুরুশ-কাটা থেকে চোখ তুলে তাকান। তার চোখের নিচে পুরু কালির উপস্থিতি আর মুখের মানচিত্রে অনেকটাই ভাঙাচোরার অস্তিত্ব স্বত্ত্বেও বোঝা যায় এ মুখ এক সময় বড় সুন্দর ছিল। হাতের কাজ থামিয়ে ইরিনা উত্তর দেন-
এ কথা তো তুমি অনেক দিন থেকেই বলছ। কিন্তু ইনায়ার কাছে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও তো এ পর্যন্ত করলে না।
তা ইরিনার কথায় যুক্তি আছে বটে। এই দিন-রাতের অঘটন দুর্ঘটনার দেশে থাকবেন না বলে রোজই তো একবার করে আক্ষেপ করেন আনোয়ার কিন্তু সত্যি সত্যিই আটঘাঁট বেঁধে দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টাও তিনি করেন না। তিনি প্রতিপত্তিশালী, পৈতৃক সম্পত্তি ছাড়াও এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার সূত্রে নিজে সম্পত্তি নেহাত কম করেননি। পৃথিবীর অনেক দেশেই পিআর আবেদন করাও তার পক্ষে সামান্য বিষয় তবু আজ কাল করতে করতে জোর দিয়ে কিছু করা হচ্ছে না।
আসলে জ্যোতিষশাস্ত্রে তার কিঞ্চিত বিশ্বাস আছে। নিয়মিত যার কাছে যান সেই জ্যোতিষ সম্রাট নবনিধি পাল তাকে বলেছেন ঊনষাট বছর বয়স থেকে তার উন্নত দেশে বসবাসের যোগ আছে। তা সে এখনও মোটামুটি বছর সাতেকের ব্যাপার। বায়ান্নোর আনোয়ার সাহেবের ঢিমেতাল এজন্যই এখনও কাটছে না ঠিকমতো। তবু দেশের এই হালচাল দেখে ইদানিং তার সত্যিই মনে হচ্ছে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সত্যিই একটু সিরিয়াসলি ভাবার দরকার এবার। নবনিধি পালের সঙ্গে একবার কথা বলা প্রয়োজন। লোকটাকে বুঝিয়ে বলতে হবে সমস্যার কথাটা।
স্ত্রীর কথার জবাবে একটু ধীরেসুস্থে আনোয়ার সাহেব বলেন-
না, ইরিনা। এবার সিরিয়াসলিই চিন্তা করতে হচ্ছে যাওয়ার কথা। দেখছ না দেশটার অবস্থা।
তিনি এবার উঠে পড়েন। অফিসের হাজারটা ঝক্কি সামলে বাসায় ফিরে ক্লান্ত বিষণ্ণ স্ত্রীর মুখ বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। সারাদিনের কাজের ধকলের চেয়ে এই কাজটা তার কাছে বেশি কষ্টকর। তার চেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে তিনি একটা বই পড়বেন এখন। জীবনের একেক বছর পাড়ি দিয়ে এই বয়সে আসতে আসতে কত অভ্যাস বদলাতে হয়েছে কিন্তু তিনি বই পড়ার অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি কিছুতেই। প্রতি রাতে অন্তত আধাঘণ্টা না পড়লে তার ঘুমই আসে না। পরিচিত মহলের অনেকেই অবশ্য এই রোজ বই পড়ার স্বভাবের জন্য তাকে খোঁটা দিয়ে আঁতেল বলে থাকেন।
পাওলো কেয়েলহোর ‘দ্য স্পাই’ শুরু করেছিলেন পরশু, এখন প্রায় শেষের পথে। কী অসাধারণ লিখেছেন কোয়েলহো! আর মাতাহারি! ভাবা যায়, আজ থেকে আরও একশো বছরেরও বেশি আগে ভদ্রমহিলা নাচের সঙ্গে নগ্নতাকে মিলিয়ে নিজেকে এমন অসাধারণ গুপ্তচর বানিয়ে তুলেছিলেন! কোয়েলহোর ইংলিশ পড়তেও আরাম। আনোয়ার সাহেব পৃথিবীর প্রথম বিখ্যাত ও রহস্যময়ী নারী গুপ্তচরকে নিয়ে লেখা চমৎকার বইটার পাতায় বুঁদ হয়ে যান। সত্যি কথা বলতে কী, প্যারিসে মাতাহারির প্রথম শোয়ের বর্ণনা পড়ে শরীরের ভেতর এক অসহ্য ছটফটানি অনুভব করেন তিনি। আহ্! প্রিয় জীবন! ওই সময়ে তিনি যদি ওখানে থাকতে পারতেন!
স্যার, ম্যাডাম খাইতে ডাকে- এ বাড়ির ড্রাইভার হায়াতের ডাকে বাস্তবে ফিরে আসেন আনোয়ার সাহেব। কতক্ষণ সময় কেটে গেছে কে জানে। তিনি মাথা তুলে সামনে তাকান। দেয়ালের দামি পেন্ডুলাম ক্লকের কাঁটা জানান দেয় সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। উপন্যাসটার মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠা বাকি আছে। পড়ার এমন অবস্থায় উঠে যেতে ইচ্ছে না করলেও ইরিনার বানিয়ে দেয়া প্রজাপতি বুকমার্কটা বইয়ের পাতার ফাঁকে গুঁজে উঠে পড়েন তিনি, অসুস্থ স্ত্রীকে অনেকটা সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখতে মন চায় না।
তাদের খাবার টেবিল সব সময়ই পরিপাটি করে গোছানো থাকে। তবে আজকাল খাবারের পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গে আয়োজনেও স্বল্পতা এসেছে। নানান অসুখ বিসুখের কারণে ইরিনার অনেক কিছু খাওয়া বারণ হয়ে গেছে। আর আনোয়ার সাহেব বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ, বয়স হয়েছে বলে তিনি নিজেই অনেক কিছু খান না আজকাল। তবু আজ টেবিলজুড়ে নানারকম সুস্বাদু খাবারের সমাহার দেখে তিনি অবাকই হন। ভালো ভালো খাবারের দারুণ সুগন্ধ ভাসছে এ ঘরের বাতাসে। অনেক দিন পর আনোয়ার সাহেব সে ঘ্রাণ নেন নাক ভরে।
কী খবর? আজ হঠাৎ এত সব খাবারদাবার যে!
আরে আমি না। নয়নিকা করেছে সব- চেয়ার টেনে বসতে বসতে ছোট করে উত্তর দেন ইরিনা।
ওহ্। তা কী উপলক্ষ্যে হঠাৎ- নয়নিকার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করলেও আনোয়ার সাহেব আশেপাশে দেখতে পান না মেয়েটাকে।
আংকেল, আজ বাবা-মার বিবাহবার্ষিকী যে। প্রতি বছর এই দিনে আমি নিজে রান্নাবান্না করি তাদের জন্য। বাড়ি যাওয়া হয়নি এবার, তাতে কী হয়েছে? এখানে আমরা তো আছি, আমরা সবাই মিলে অন্তত খাওয়া দাওয়াটা করি।
ওর ঘর থেকে বের হতে হতে নয়নিকা বলে। একটু হেসে আবার বলে-
এক বেলা একটু বেশি খেলে তেমন অসুবিধা হবে না আংকেল।
না তা হবে না, জানেন আনোয়ার সাহেব। নয়নিকা ওদের দু’জনের বন্ধু শফিকের মেয়ে। দু’মাস আগে এসেছে এ বাসায়। এসেছে বললে ভুল হবে। চুয়েটে সিভিলে বিএসসি করার পর ও যখন এসে বুয়েটে এমএস ভর্তি হলো, বলতে গেলে ইরিনা ওকে জোর করেই নিয়ে এসেছে এ বাসায়। শুধু কাজের লোকদের সঙ্গে থাকতে থাকতে এই ক’বছরে বিরক্তিও এসে গেছে ওদের। নয়নিকা আসার পর সেই একঘেয়েমিটা যেন এক ফুঁয়ে উড়ে গেছে দূরে কোথায়। মেয়েটা ভীষণ হাসিখুশি, কেমন চঞ্চল একটা প্রজাপতির মতো বাড়িটায় প্রাণ ফিরিয়ে এনেছে আবার।
শফিক-নন্দিতার বিয়ে বার্ষিকী উপলক্ষ্যে সেদিন রাতে সবার খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেল। অনেক দিন পর এমন ভারী খাবার এত তৃপ্তি নিয়ে খেলেন আনোয়ার সাহেব। নয়নিকা ঠিক ওর মায়ের মতোই রান্নার হাত পেয়েছে। এক কালে নন্দিতার হাতের রান্না কত খেয়েছেন তারা। নন্দিতার হাতের আলুর দম আর পায়েসের স্বাদ আজও ওদের জিভে লেগে আছে বলা যায়।
বন্ধুর বিয়ের ছাব্বিশ বছর পূর্তিতে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে তারা দু’জনেই অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলেন। এমন একটা দিন এলে কত অর্থহীন কথাই মনে পড়ে যায়! ইরিনার ক্লান্তি আর অবসন্নতাও যেন আজ এক ফুঁয়ে কেটে গেছে। অনেক দিন পর ইরিনার চোখ মুখও আজ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে।
দুই
পর পর কয়েকটা দিন খুব দৌড়াদৌড়ি গেল। হঠাৎ করে সেদিন ইরিনার ব্লাড সুগার নিল হয়ে যা তা অবস্থা হলো। দু’দিন বলতে গেলে হাসপাতালেই থাকতে হলো এ বাড়ির সবার। নয়নিকার ওপর দিয়েও কম ঝক্কি যায়নি। ওর একটা সেশনাল মিস হয়েছে সেদিন, দু’দিন ক্লাসও মিস হয়ে গেছে। ইরিনাকে বাড়ি আনা হয়েছে পরশু বিকেলে। এখন অবস্থা একটু ভালোর দিকে। আচমকা এত বড় ধকলটা সবাইকে ভুগিয়েছে খুব। তবু যাহোক সবাই আবার সামলে উঠছে একটু একটু করে।
ঘুমন্ত অবসন্ন ইরিনাকে একটা ঝরা ফুলের মতো মনে হয় আনোয়ার সাহেবের। নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়া শরীরটা যেন একটা বড়সড় ঝড়ের ধাক্কা সামলে উঠেছে কেবল। এখনও তেমন ভালো করে খাওয়া দাওয়া করতে পারছেন না। সন্ধ্যাবেলায় নয়নিকা একটা স্যুপ বানিয়ে দিয়েছিল, সেটা খেয়ে আর কিছু খাননি রাতে। ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই ন’টার দিকেই। ঘুমাক, এখন তার পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। ডাক্তার বলে দিয়েছেন ইরিনার পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। ঘুম আর খাওয়াটা ঠিকঠাক মতো হলে দ্রুত সেরে উঠবেন তিনি।
ঘড়ির কাঁটা টুক টুক করে এগোচ্ছে গভীর রাতের দিকে। এমন সময়ে সাধারণত ঘুমিয়ে পড়েন আনোয়ার সাহেব। কিন্তু আজ তার কিছুতেই ঘুম আসছে না। ইরিনার ঘুমন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে অযথাই বিছানায় এপাশ ওপাশ করেন তিনি।
এত দিনের চেপে রাখা ইচ্ছেটা আজ কিছুতেই বাঁধ মানছে না। তার ঘুমহীন শরীর আজ আবার আদিম শান্তির খোঁজ করে হঠাৎ। বাইরে থেকে শান্তশিষ্ট মানুষ আনোয়ার সাহেব এবার অস্থির হয়ে ওঠেন। বেড সাইড টেবিলের ওপর ঢেকে রাখা পানির গ্লাসটা খালি করেন নিমেষেই। তারপর উঠে পায়চারি শুরু করেন এ ঘরে। এক সময় তিনি বুঝতে পারেন আর কিছুতেই সম্ভব না। কিছুতেই তিনি আর ধরে রাখতে পারছেন না নিজেকে।
বয়স বায়ান্নো হলেও নিয়মিত ব্যায়াম আর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের দরুণ তার শরীর যথেষ্ট ভালো এ বয়সেও। সে শরীরের ভেতর আজ অনেকদিন বাদে একটা আগ্নেয়গিরির আভাস পান তিনি। এমন বাঁধভাঙ্গা কামনাকে কিছুতেই দমন করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
এ বাড়ির কাজের লোকজন কেউ রাতে থাকে না, রাতের খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই চলে গেছে। প্রায় তিন হাজার স্কয়ার ফিটের এই বিশাল বড় ফ্ল্যাটটাতে এখন তারা মাত্র তিনজন মানুষ। ইরিনাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, তিনি এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আনোয়ার সাহেব তাই নিশ্চিন্ত। আর নয়নিকা? হা হা। তার নিজের যেমন আনোয়ার সাহেব মনে মনে জানেন নয়নিকাও অন্যসব ন্যাকা মেয়েদের মতো নয়। সে স্টাইলিস্ট, আধুনিক, সুন্দরী। শরীর বিষয়ে নিশ্চয়ই অত শুচিবায়ু তার নেই। থাকলে এত দিনে তিনি অবশ্যই টের পেতেন। না না। এ মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ধুমসে আড্ডা দেয়, ডিশার্ট পরে বাইরে যায়, কথাবার্তাও মোটেই সেকেলে নয়। নয়নিকাকে পাওয়া তেমন কঠিন হবে বলে মনে হয় না তার।
আচ্ছা, তারপরও যদি ঠিক সময়মতো বেগড়বাই করে বসে মেয়েটা? তখন আর কী- তখন জোর খাটানো ছাড়া আর উপায় থাকবে না তার। আজ পর্যন্ত যা চেয়েছেন তার প্রায় সবকিছুই হয় পেয়েছেন, নয়ত আদায় করে নিয়েছেন। নয়নিকার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হওয়ার কথা ভাবেন না তিনি। যতই ইরিনা বলুক নয়নিকাকে দেখলে তার ইনায়ার কথা মনে হয়, আনোয়ার সাহেব কিন্তু তা মনে করেননি কোনোদিন। একটা চব্বিশ বছরের ডাগর মেয়েকে কোনো পুরুষ তার নিজের মেয়ে বলে ভাবতে পারে? অন্তত কই, তার মতো সুশীল সজ্জন মানুষও তো পারছেন না।
নয়নিকা যে ঘরে থাকে সেটা আসলে ইনায়ার শোবার ঘর। এই মেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে তিনি জানেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার ধকল যে খুব, তা তার অজানা নয়। তার ওপর গত কিছুদিন থেকে নয়নিকার পড়াশোনায় একটু ঝামেলা হলো। এই মাঝ রাতেও ওর ঘরের দরজার নিচ দিয়ে মৃদু আলোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
আনোয়ার সাহেব সে ঘরের দরজায় টোকা মারেন আস্তে আস্তে। একবার দু’বার তিনবার… দরজা খোলার কোনো লক্ষ্মণ নেই। আনোয়ার সাহেব এবার মোবাইলে নয়নিকার নম্বর ডায়াল করেন, রিং হচ্ছে। কলটা কেটে গেল। মৃদু পায়ের শব্দ তিনি টের পান নয়নিকা আসছে। আহ্ নয়নিকা! প্লিজ! তাড়াতাড়ি এসো! উত্তেজনায় দু’পায়ের মাঝখানে এক প্রবল টান অনুভব করেন তিনি।
দরজাটা আস্তে শব্দ করে খুলে যায়। নয়নিকার দারুণ সুন্দর মুখটা উঁকি দেয় সেখানে। আনন্দিত আনোয়ার সাহেব ঘরের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে থমকে যান। নয়নিকার ডান হাতে ব্রাউনিংয়ের পকেট নাইফের ধারালো ফলাটা চকচক করছে টিউব লাইটের আলোয়। হতভম্ব হয়ে তিনি নয়নিকার মুখের দিকে তাকান। তার মনে হয় এই মুখ আগে কোনোদিন দেখেননি তিনি, এ যেন নিতান্তই এক অচেনা মেয়ে। কিন্তু মেয়েটার সুন্দর বড় বড় চোখে ঘৃণার যে দুঃসহ চাহনি দেখা যায়, তা তিনি বিলক্ষণ চেনেন। আজ থেকে বছর ত্রিশেক আগে তার প্রথম প্রেমিকা রিপার বিধ্বস্ত শরীরের পাশে তিনি যখন সম্ভোগের সুখে বিহ্বল হয়ে শুয়ে ছিলেন, রিপার চোখের এই চাহনি পুড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। আজ রাতের সঙ্গে সেই দিনের পার্থক্য কেবল এই যে সেদিন রিপার হাতে কোনো চকচকে ছুরি ছিল না। উদ্ভ্রান্ত আনোয়ার সাহেব নিজের ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ান। নয়নিকার ঘরের আলোতে উজ্জ্বল ডাইনিং স্পেস থেকে তিনি দেখতে পান সে ঘরের দরজায় দাঁড়ানো শীর্ণকায়া ইরিনার ক্লান্ত চোখজোড়া জ্বলছে ধ্বকধ্বক করে।
গল্পকার
বেশ লিখেছো দ্যুতি। লেখায় লেখায় আরো আলো ছড়িয়ে পড়ুক। 🙂