প্রাচীন ভারতে বিমানের অস্থিত্ব সন্ধানে

Reading Time: 3 minutes

প্রাচীন ভারতে কি বিমান ছিল? এমন প্রশ্ন বার বার ঘুরে ফিরে আসতো ছোটবেলার মনে। মনে আছে বিমান আবিষ্কারের গল্প জানার আগে মহাভারত রামায়নের গল্পে দেব দেবী মুনি ঋষিদের উড়ে যাওয়া। কিংবা রথে দেব দেবীর যাতায়াত বা নারায়ন, নারায়ন বলতে বলতে ঢেঁকিতে চেপে উড়ে আসা নারদকে দেখে মনে হত প্রাচীন ভারতে অবশ্যই বিমান ছিল। শৈশব পেরিয়ে গেছে। শৈশবের খেয়ালখুশির ইচ্ছা এখন বাস্তবতায় মিলিয়ে দেখলে কেমন হয়?

৩-৭ জানুয়ারি ২০১৫ এর মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে নিচের এই দাবি গুলি করা হয় ৷

১.সাত হাজার বছর আগে বৈদিক যুগে প্রাচীন ভারতের মুনি ঋষিরা গাড়ি এবং এরোপ্লেন তৈরি করেছিল৷
২. এই এরোপ্লেন সামনে পিছনে ,ডাইনে বাঁয়ে যেতে পারত৷
৩. এই প্লেন জ্বালানী হিসাবে পারদ বাষ্প ,সৌরশক্তি এমনকি বায়ু ব্যবহার করতে পারতো
৪. এই এরোপ্লেনগুলি এক দেশ থেকে অন্য দেশে এমনকি অন্য গ্রহেও পাড়ি দিত৷
৫. এগুলি লম্বায় ছিল ২০০ ফুট, পাঁচতলা সুন্দর বিমান ১২৮০০ মাইল বেগে যেতে পারত এবং এতে গরু ও হাতির মুত্র জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার হত৷
৬. চালকের পোশাক তৈরি হতো জলের নীচের গাছপালা থেকে
‘বৈমানিক শাস্ত্র ‘ নামে একটি বইয়ের প্রেক্ষিতে এই দাবিগুলি করা হচ্ছে ৷ দাবি করা হচ্ছে যে এই বইটির লেখক পৌরানিক ব্যক্তিত্ব মহর্ষি ভরদ্বাজ ৷ ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের এরোন্যাটিকাল ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচ বিজ্ঞানী অধ্যাপক জে এস মুকুন্দ ,এস এম দেশপান্ডে,এইচ আর নাগেন্দ্র ,এ প্রভু এবং এস পি গোবিন্দরাজ এই বইটি ভালো করে পাঠ করেন এবং ‘ critical study of the work vaimanika shastra’ শীর্ষক একটি গবেষনা পত্রে লেখেন যা ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় ৷তারা প্রমান করেন যে তথাকথিত বৈমানিক শাস্ত্রটি সাত হাজার নয় ১৯২৩ সালে সংস্কৃত পন্ডিত সুব্বারায়া শাস্ত্রীর মস্তিস্ক প্রসূত এবং রচিত ৷ ১৯৫১ সালে মহীশুরের ইন্সটিটিউট অফ সংস্কৃত একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা শ্রী এ এম জয়সার বইটি প্রকাশ করেন ৷

বইটিতে যে এরোপ্লেনের নকশা দেখানো হয়েছে তা ব্যাঙ্গালোরের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নকশাকার শ্রী আলাপ্পার আঁকা এবং এগুলি ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত বইটির ইংরাজি সংস্করনে দেখানো হয়েছে ৷ এই পাঁচ বিজ্ঞানী প্রমান করেন যে উরান গতিবিদ্যার নীতি এবং নিউটনের সূত্র অনুযায়ী ঐসব এরোপ্লেনের পক্ষে ওরা সম্ভব নয় ৷ এই ধারনার দ্বারা তৈরি যেকোন বিমান ভয়াবহ দুর্ঘটনার সন্মুখিন হবেই ৷

এর পূর্বে মহাঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর বই ‘ ঋকবেদ ভাষ্য ভূমিকায় একটি মন্ত্র উল্লেখ করে দেখানোর চেষ্টা করেন যে বৈদিক যুগে ভারতে এরোপ্লেন ছিল৷ মন্ত্রটি হল –

” ত্রয়ঃ স্কম্ভাসঃ স্কভিতাসঃ আরভে
ত্রির্নক্তং য়াথঃ ত্রিঃ ঊ ইতি অশ্বিনা দিবা ৷৷
( ঋক অস্ট ১; অধ ৩ ; বর্গ ৪;মন ২)

তিনি এটিকে এভাবে অনুবাদ করেন – এই বাহনে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যেতে তিনদিন এবং রাত্রি …” ৷

এই মন্ত্রে দয়ানন্দ সরস্বতী এরোপ্লেনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন ৷খুবই আশ্চর্যজনকভাবে সুপ্রিসিদ্ধ বাখ্যাকার সায়ন এই শ্লোক সম্পর্কে বলেছেন ” মধু বহনকারী রথটিতে তিনটি চাকা আছে ,সোমের ভালবাসার পাত্রী ভেনার বিবাহের সময় দেবতারা যেমন দেখেছিলেন, হে আশ্বীন ,রথটিতে তিনটি স্তম্ভ আছে,এবং রথটিকে তুমি তিনবার দিবাকালে আর তিনবার রাত্রিকালে সঞ্চালন করবে ” ৷ এইভাবে দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর কল্পনাপ্রসুত ধারনার সঙ্গে যাতে মানানসই হয় সেইরকম করে সংস্কৃত শ্লোকের ভুলভাবে অনুবাদ করেছেন ৷

যদি তার দাবি মতন এরোপ্লেন অতীতে কোনও সময়ে সত্যিই থাকতো তাহলে তার কিছু ধ্বংসাবশেষ – ধাতব যন্ত্রাংস ,ডানা এবং অন্যান্য অংশ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে পাওয়া যেত ৷কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউই এখনো পর্যন্ত তা খুঁজে পায় নি ৷
যদি প্রাচীন ভারতে এরোপ্লেন এবং আধুনিক মানের যুদ্ধাস্ত্র থেকে থাকে তাহলে বহিঃশত্রুর বার বার আক্রমন ঠেকানো গেল না কেন? এগুলি যুদ্ধে ব্যবহার করা হলো না কেন? এই প্রশ্নের স্বাভাবিক ভাবে কোন উত্তর নেই ৷

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল এরোপ্লেনের মতো উন্নত প্রযুক্তি হঠাৎ করে কোথা থেকে এল? তাপ গতিবিদ্যার সূত্র,উড়ান গতিবিদ্যা ,ধাতু নিস্কাষন এবং অন্যান্য বিষয়ে যখন সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায় তখনই উড়ান যন্ত্র তৈরি করা যায় ৷ এই সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান একত্রিত করে তবেই উড়ান যন্ত্রের নানা যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব ৷ এই জ্ঞান তখন আসা সম্ভব নয় ৷ আর এই উড়ান গতিবিদ্যা ,তাপ গতিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানের অগ্রগতির কোন প্রমান বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায় না ৷ ( মজার বিষয় হলো প্রবক্তারা এই বিষয়ে কোনও দাবিও করেনি)

যাদের প্রাথমিক রসায়নবিদ্যার সাথে পরিচয় আছে তারা জানে গরু বা হাতির মুত্র জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারেনা ৷ পারদের বাস্পও জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা যায় না কারন অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় এটি তাপ উৎপন্ন করে না ৷ বায়ু জ্বলতে সাহায্য করে কারন এতে অক্সিজেন আছে কিন্তু জ্বালানী হিসাবে শুধু বায়ুকে ব্যবহার করা যায় না ৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৌরশক্তি শক্তি জোগায় ,কিন্তু পৃথিবী পৃষ্টে যে হারে সৌরশক্তি আপাতিত হয় ( প্রায় 1kw/m^2 ) তা ধাতু দিয়ে তৈরি উড়ানযন্ত্র ওড়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগায় না ৷ বৈমানিক শাস্ত্র বইতে যে উড়ানযন্ত্রের নকশা দেখানো হয়েছে (ছবিতে) তাতে চালক পাখা আছে ৷ যদি ধরে নেওয়া যায় যে বৈদিক মুনি ঋষিরা চালকপাখা আবিষ্কার করেছিলেন ,মহাশূন্যে তো চালক পাখা কাজ করে না – তাহলে কীভাবে এই উড়ানযন্ত্র অন্য গ্রহে পাড়ি দিত?

নৃতত্ত্ববিদ্যার সাথে যাদের পরিচয় আছে তারা জানেন যে সাত হাজার বছর আগে মানুষ প্রস্তর যুগেই ছিল ৷ এই দাবির প্রবক্তরা কি আমাদের বিশ্বাস করতে বলবেন যে পাথর দিয়ে এইসব উড়ানযন্ত্র তৈরি হয়েছিল??

 

তথ্যসূত্র
প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান বাস্তব বনাম কল্পনা
ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>