Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

মারেক মারেক

Reading Time: 6 minutes

বাচ্চাটার মধ্যে অত্যন্ত সুন্দর কিছু একটা আছে প্রত্যেকে এমনই বলত। নিষ্পাপ দেবদূতের মতো একটা মুখ ছিল মারেক মারেকের আর সোনালী সাদা চুলের গুচ্ছ। বড় বোনেরা তাকে খুব ভালোবাসত। তারা একটা পুরনো জার্মান প্যারাম্বুলেটরে বসিয়ে পাহাড়ী রাস্তায় ঠেলে ঠেলে ঘুরতে বের হত আর তার সঙ্গে এমনভাবে খেলত যেন সে একটা পুতুল। তার মা তাকে বুকের দুধ দেয়া বন্ধ করতে চান নি; যখন সে বুকের দুধ টেনে টেনে খেত, তার মনে হত যেন সে নিজেকেই বোঁটার মধ্য দিয়ে ঢেলে দিচ্ছে সন্তানের মুখে যেরকম অনুভূতি পরবর্তীকালে আর কখনো হয়নি। কিন্তু মারেক মারেক বড় হয়ে উঠল আর মায়ের স্তন্য খোঁজা বন্ধ করল। তার বদলে, এটা খুঁজে নিল বড় মারেক আর তাকে আরো কয়েকটি সন্তানের মা বানিয়ে ফেলল।

এত সুন্দর চেহারা হওয়া সত্তে¡ও ছোট মারেক মারেক খুব অল্প পরিমাণে খেত আর রাতভর চিৎকার করত। তার বাবা তাকে পছন্দ করে না, তার কান্নার এটাও একটা কারণ হতে পারে। যখনই সে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরত ছোট মারেক মারেককে পিটানো শুরু করত। যদি তার মা তাকে বাঁচাতে আসত, পিটিয়ে স্ত্রীকেও শুইয়ে ফেলত বড় মারেক, যতক্ষণ না তারা লুকিয়ে পড়ত চিলে কোঠার ঘরে গিয়ে, এরপর সারা ঘরে শোনা যেত শুধু বড় মারেকের নাক ডাকার শব্দ। মারেকের বোনেরা ছোট্ট মারেকের মার খাওয়া নিয়ে খুব কষ্ট পেত, কাজেই তারা ছোট্ট মারেককে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিল, আর পাঁচ বছর বয়স থেকে মারেক মারেক তার জীবনের অধিকাংশ সন্ধ্যাগুলো গুদাম ঘরে লুকিয়ে কাটালো। সেখানে সে নীরবে কেঁদে চলত, কোনো অশ্রু ছাড়াই।

সেখানে বসে সে অনুধাবন করল যে তার মর্মবেদনা বাইরে থেকে আসে না, আসে তার ভিতর থেকেই, তার মদ্যপ বাবা এবং মায়ের ¯েœহ থেকে বি ত হওয়ার বিষয়ে তার কাছে কোনো প্রতিকার নেই। কোনো বিশেষ কারনে সে কষ্ট পাচ্ছে না, যেভাবে প্রতি সকালে সূর্য ওঠে আর প্রতিরাত্রে তারা জাগে আকাশে, এভাবেই সে কষ্ট পায়। এটা শুধুই একটা আঘাত। সে ঠিক জানে না যে এ বেদনা কীসের, কখনো কখনো তার কাছে অনুভব হত একটা অস্পষ্ট স্মৃতির মতো উষ্ণ গরম আলো যেন এই পৃথিবীতে নেমে আসছে আর সারা পৃথিবীকে গুলিয়ে বিলীন করে দিচ্ছে । এটা যে আসত কোথা থেকে সে জানত না। তার পুরো শৈশবে সে অন্তর্গত গোধূলিকে স্মরণ করতে পারে, একটা অন্ধকার আকাশ, পৃথিবী বিষাদে নিমগ্ন হয়ে আছে, ঐ শীতল ও অভিশাপগ্রস্থ সন্ধ্যাটা শুরু হচ্ছে অথবা শেষ হচ্ছে। গ্রামে যেদিন বিদ্যুত আনা হয়েছিল সে ঐদিনটার কথাও স্মরণ করতে পারে। আশেপাশের গ্রাম থেকে কুচকাওয়াজ করে আসা বিদ্যুতের খামগুলোকে মনে হত যেন একটা বিশাল চার্চের পিলার। মারেক মারেক তাদের গ্রামের প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা জেলা লাইব্রেরি নোয়া রুদার সদস্য হয়েছিল চাঁদা দিয়ে। তো এরপরে সে তার বাবার কাছ থেকে লুকানোর জন্য সঙ্গে করে একটা বই নিয়ে নিত, লুকিয়ে থাকার সময়টিতে যে বই পড়ত।

নোয়া রুদা লাইব্রেরিটি একটা পুরনো ভাঁটিখানার দালানে ছিল আর এটা থেকে তখন পর্যন্তও আর বীয়ারের গন্ধ বের হত; দেয়াল, মেঝে এবং কক্ষের ছাদ এসব জায়গা থেকে এই একই রকম কটু গন্ধ বের হত Ñ এমনকী বইয়ের পাতাগুলো থেকেও এত বেশি পরিমানে বীয়ারের গন্ধ বের হত যেন ওগুলোর উপরে বীয়ার ঢেলে দেয়া হয়েছে। মারেক মারেক এই গন্ধ পছন্দ করত। পনের বছর বয়সে সে প্রথমবারের মতো মদ্যপানে মাতাল হয়। এতে তার বেশ ভালো লাগে। মদ্যপান করে পুরোপুরি নিজের বিষণœতাকে ভুলে গেল, এরপর সে আলো আর অন্ধকারের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখতে পেল নাতার শরীর টলমলে হয়ে গেল আর সে শরীর আর তার কথা শুনল না। সেই মাতাল অবস্থাটাও পছন্দ করে ফেলল। তার মনে হচ্ছিল যেন সে তার নিজের শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং তার পাশে পাশেই বসবাস করছে, যে শরীর কোনোকিছু চিন্তা বা অনুভব করতে পারছে না।
তার বড়বোন কজনের বিয়ে হয়ে গেল এবং তারা বাড়ি থেকে চলে গেল। একটা পুঁতে রাখা মাইনে তার একজন ছোট ভাই মারা গেলো আর একজনকে ভর্তি করা হল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ক্লোডজকো স্কুলে, বুড়ো মারেক শুধু মারেক মারেককেই হাতের কাছে পেল নিজের জান্তব পেটানোর সুখকে মেটানোর জন্য মুরগীর ঘরের দরজা কেন বন্ধ হয়নি, ঘাস কেন ছোট করে ছাঁটা হয়নি, ধান ঝাড়াই মেশিনের কীলক কেন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মারেক মারেকের বয়স বিশ বছর হলে সে তার পিতাকে আবার উল্টে পিটুনি লাগাল আর সেদিন থেকে তারা নিয়মিত ব্যবধানে পরস্পর পিটাপিটি করতে থাকল। এর মধ্যে মারেক মারেকের হাতে যখন মদ্যপানের জন্য পর্যাপ্ত টাকাপয়সা থাকতো না এবং কিছুটা সময় থাকতো, সে বীট জেনারেশনের কবি সাচুরার কবিতা পড়ত। লাইব্রেরির ভদ্রমহিলাটি এই কবিতা সংগ্রহ বিশেষ করে মারেক মারেকের জন্যই এনে দিয়েছিল, এই বইটার মলাট ছিল সবুজ কাপড়ে বাঁধাই করা, ঠিক যেন জিনস কাপড়-পরা।

মারেক মারেক এখন পর্যন্ত আগের মতোই সুদর্শন। তার ঘাড় ছোঁয়া চমৎকার চুল এবং মসৃণ মেয়েলি মুখ। এবং তার চোখ ছিল ভীষণ বিষণ্ণ, ফ্যাকাশে, মনে হয় যেন অন্ধকার গুদাম ঘরে তাকিয়ে থাকার ফলে তারা তাদের প্রকৃত রঙ হারিয়েছে, যেন চোখগুলো নীলরঙা বইয়ের রচনাবলী পড়তে পড়তে সেগুলো তার দীপ্তি হারিয়েছে। কিন্তু নারীরা তাকে ভয় পেত। একদিন ডিস্কোতে সে একজনকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এল, একটা এলডার ঝোপে তাকে টেনে নিয়ে গেল এবং তার ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলল। ভাগ্য ভালো যে নারীটি চিৎকার করেছিল, সেজন্য অন্য ছেলেরা দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল আর তাকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছিল। কিন্তু সেই মেয়েটি মারেক মারেককে পছন্দই করত; সম্ভবত আগে আগে জানত না যে কী করে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আরেকবার সে একজন লোককে ছুরিই মেরে বসল, মারেক মারেকের চেনা এক মেয়ের সঙ্গে সে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল বলে, এত গভীর বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল যে ভাবটা ছিল মেয়েটির উপরে লোকটির একমাত্র অধিকার রয়েছে। পরে বাড়ি ফিরে এসে, হাউমাউ করে কেঁদেছিল মারেক মারেক।
সে তার মদ্যপান চালিয়ে যেতে থাকল, আর এ অবস্থায় যখন তার পা তাকে নিয়ে ইচ্ছেমত পাহাড় পাড়ি দেয় তখন সবকিছু তার ভিতরে থাকে এবং এভাবে সকল বেদনা বিলুপ্ত হয়ে আসে, যেন হঠাৎ করে একটা বোতাম টেপা হল আর হঠাৎ করেই নেমে এল ঘন আঁধার। সে লিডো পাবে বসে থাকতে পছন্দ করতো হট্টগোলের মধ্যে আর ধুমপান করে যেতো এরপরে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করতো, ঈশ্বরই জানেন কী করে, পুষ্পিত তিসিক্ষেত্রের মধ্যিখানে আর সেখানে সে সকাল পর্যন্ত শুয়ে থাকত। মারা যাবার জন্য। অথবা জুবলাকটা দোকানে মদ্য পান করতো, এরপর হঠাৎ করে সর্পিল গতিতে হাইওয়ে ধরে গ্রামের দিকে হাঁটতে শুরু করতো ভাঙা দাঁত আর রক্তাক্ত চেহারা নিয়ে। শুধুমাত্র আংশিক জীবিতভাবে, শুধুমাত্র আংশিক সচেতনভাবে, ধীরে ধীরে এবং মৃদুভাবে সব থেমে আসত। সকালবেলা মাথাধরা নিয়ে জেগে উঠে। সে কমপক্ষে এটা জানত যে কোন বিষয়টা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। একটা অসীম পিপাসা, আর তা সে মেটাতেও পারত।
শেষপর্যন্ত মারেক মারেক তার বাবার সঙ্গে ধরা পড়ল। সে বৃদ্ধ লোকটিকে একটা পাথরের বেে এত জোরে ফেলল লোকটির হাড় ভেঙ্গে গেল আর অজ্ঞান হয়ে গেল। পুলিশ এসে যখন মারেক মারেককে শান্ত করতে সঙ্গে নিয়ে গেল আর জেলহেফাজতে ঢোকাল, সেখানে আর তার পান করার মতো কিচ্ছু ছিল না।
তার মাথায় ব্যাথা আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের মতো, একেবারে শুরুতে, তন্দ্রালু , মদ্যপ অবস্থায়, সে পড়ে গেল; একবার তার শরীর সটান হল, আর এরপর সে মেঝেতে শুয়ে পড়ল। সে ডুবন্ত অনুভূতি এবং ভীতিকে স্মরণ করল ভীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু একটা, যা বলে বোঝানো যায় না। মারেক মারেকের বোকা শরীর, মনের সাড়া ছাড়াই এই ভীতি মেনে নিল এবং কাঁপতে শুরু করল ; তার হৃদপিন্ড এত জোরে স্পন্দিত হতে লাগল যেন ফেটে যাবে। কিন্তু তার শরীর জানত না কি করে এটার উপর নিয়ন্ত্রণ পেতে হয়। শুধুমাত্র একটি অমর আত্মাই এই রকম ভয়ানক ভীতিকে সহ্য করে নিতে পারে। তার শরীর এটার জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল, কুঁচকে গেল, আর আছড়ে পড়ল তার ছোট্ট সেলের দেয়ালে, মুখ থেকে ফেনা বের হতে লাগল। ওয়ার্ডার চিৎকার করে উঠল, ‘গোল্লায় যাও মারেক!’ তারা তাকে মাটিতে চেপে ধরল, দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধল, পুশ করল একটা ইনজেকশন।
তাকে ডেটক্স ওয়ার্ডে সরিয়ে নেয়া হল, সেখানে অন্য বাসিন্দাদের রংচটা পায়জামা, সে হাসপাতালের প্রশস্ত করিডোর ধরে সবাইকে এড়িয়ে সিঁড়িতে ঘুরঘুর করত। ওষুধের জন্য বাধ্যলোকের মতো লাইনে দাঁড়াতো এবং এই অপেক্ষা করাটাকে এমনভাবে নিত যেন সে পরস্পর গল্পগুজবে অংশ নিচ্ছে। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো তখন এটা তার মনের মনের মধ্যে এমন একটা অনুভূতি তৈরি করে যে প্রথমবারের মতো তার মনে হলো, তার লক্ষ স্থির করে দিলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মরতে হবে, এই পঁচা দেশ থেকে, লালচে ধূসর মাটি থেকে, এই অতিরিক্ত গরম হাসপাতাল থেকে, এইসব ধোয়া পরিচ্ছন্ন পায়জামা থেকে, এই টেনে চলা শরীর সব কিছু থেকে মুক্তি পাবার জন্য তাকে মরতে হবে। এই সময়টা থেকে সে তার একেবারে ক্ষুদ্রতম চিন্তাকেও মরার একটা উপায় বের করার জন্য কল্পনা করাতে লাগলো।
একরাত্রিতে সে তার রক্তশিরাকে ঝরনাধারায় বইয়ে দিলো। তার কনুই থেকে কব্জির সাদা চামড়া বিভক্ত হয়ে খুলে গেল আর মারেক মারেকের ভেতরের সবকিছু দেখা যেতে লাগলো। এই অংশ লাল এবং মাংসল ঠিক তাজা গরুর মাংসের মতো। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে সে খুব বিস্মিত বোধ করল, ঈশ্বর জানে কেন, সে ভেবেছে যে সে সেখানে একটি অনির্ববচনীয় আলো দেখেছে।

স্বাভাবিকভবেই তাকে আলাদা করে নজনবন্দী করে রাখা হলো, একটা উত্তেজনা তৈরি হল এবং তার হাসপাতালে থাকার মেয়াদ বেড়ে গেল। সে পুরো শীতকাল সেখানে কাটাল, আর যখন সে বাড়ি ফিরে এলো, সে আবিস্কার করলো যে তার বাবা-মা শহরে তাদের মেয়ের বাড়িতে চলে গেছে এবং এখন সে সম্পূর্ণ একা। তারা তার জন্য ঘোড়াটি রেখে গেছে, এরপর মারেক মারেক ঘোড়াটিকে নিয়ে জঙ্গলে যেত, এগুলোকে টুকরা করতো এবং বিক্রি করত। তার কাছে এখন টাকা ছিল, কাজেই সে আবারও মদ খেতে শুরু করল।

 

 

ওলগা তোকারচুকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক ওলগা তোকারচুক ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। ২০১৮ সালে জিতে নেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। তিনি পোল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। এরপর অনেকবছর নীরব থাকার পরে তিনি আবার ১৯৯৩ সালে তার উপন্যাস দি জার্নি অব দি বুক পিপল (১৯৯৩) নিয়ে পাঠকের মাঝে হাজির হন। যে বইটি পাঠকের মাঝে ইতিবাচক সাড়া ফেলে। তাঁর ফ্লাইট উপন্যাস সর্বাধিক জনপ্রিয়। ২০১৮ সালে এই বইয়ের জন্য তিনি ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>