| 11 ডিসেম্বর 2024
Categories
ইতিহাস সাহিত্য

আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার জনক

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

রানা চক্রবর্তী


গত শতকের একেবারে গোড়ার কথা (১৯০৬)। প্রতিবেশী যুবকের হাত ধরে কলকাতার সরকারি শিল্পবিদ্যালয়ে হাজির বছর বাইশের এক যুবক। মনে প্রবল ইচ্ছা ভর্তি হওয়ার। যদিও এর আগে শহর কলকাতার তিন-তিনটে কলেজ তার ঘোরা হয়ে গিয়েছে। কোথাও সুবিধা করতে পারেননি। জেনারেল এসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশনে প্রথমে অকৃতকার্য হয়ে মেট্রোপলিটনের গুড়ি ছুঁয়ে শেষে প্রেসিডেন্সিতে। সেখানেও গতানুগতিক বাণিজ্যিক বিষয়ের পঠন পাঠনে যে সফল হবেন না, তা বুঝে উঠতে তাঁর বেশী সময় লাগেনি। অবশেষে সরকারি আর্ট স্কুল। কেননা ইতিমধ্যে সেখানকার এনগ্রেভিংয়ের ছাত্র সত্যেন বটব্যালের মুখে এ কলেজ সম্পর্কে তার অনেক গল্প শোনা হয়ে গিয়েছে। সম্পর্কে আত্মীয় এক দাদাও সেখানকার ছাত্র। তা ছাড়া প্রেসিডেন্সিতে থাকার সময় ছবি আঁকার কাজে খানিকটা হাতও পাকিয়েছে। চিত্রকলায় তার গভীর আগ্রহ। আর্ট স্কুলে তখন সবে শুরু হয়েছে দেশীয় শিল্পচর্চার কর্মযজ্ঞ। যার পুরোভাগে ঋত্বিকের ভূমিকা নিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির প্রখ্যাত শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর শিল্পকর্মের সোনালী ফসল প্রবাসী পত্রিকা মারফত দেশের ঘরে ঘরে ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। সে সব দেখে ভালোলাগার এক আবেশ জমাট বেঁধেছে আমদের এ যুবকের মনে। অবনীন্দ্রনাথের ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’ ‘বজ্রমুকুট’ দেখে মুগ্ধ সে। প্রতিবেশী সত্যেন বটব্যাল ছেলেটিকে এক দিন অবনীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, স্যার একে আপনার নিতে হবে। তিনি তখন সেখানকার ভাইস-প্রিন্সিপাল। মুখ তুলে তাকালেন অবনীন্দ্রনাথ। দেখলেন শ্যামবর্ণ একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্কুল পালিয়ে আসা হয়েছে বুঝি? পড়াশুনায় মন নেই, তাই মশকো করতে এসেছো। লেখা পড়া শিখেছ কিছু?’ উত্তর এল –‘আজ্ঞে স্কুল নয় ,কলেজ। তবে ফেল করেছি’। মানতে চাইলেন না মাস্টারমশাই। ‘‘উঁহু বিশ্বাস হচ্ছে না। সার্টিফিকেট দেখতে চাই।’ পরে বললেন, ‘দেখি তোমার হাতের কাজ।’ ছেলেটি একটি ছবি বার করলো, লতাপাতা গাছগাছালির মাঝে একটি মেয়ে, পাশে হরিণ, শকুন্তলার ছবি। অবনীন্দ্রনাথের মন ভরল না তাতে। বললেন, ‘এতে হবে না। কাল একখানা গনেশের ছবি এঁকে নিয়ে এসো দেখি।’ পর দিন আবার হাজির সে। সঙ্গে শ্বশুর মশাই। গোটানো একখানা কাগজ বের করে মেলে ধরলো অবনীন্দ্রনাথের সামনে— একটা কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো আর সেই ন্যাকড়ার ওপর সিদ্ধিদাতা গনেশের অবয়ব। চমৎকার ছবি অবনীন্দ্রনাথ অস্ফুটে বলে উঠলেন, শাবাশ। শ্বশুরমশাই পাশ থেকে বললেন— ‘ছেলেটাকে আপনার হাতে দিলাম’। অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘লেখাপড়া শেখালে বেশী রোজগার করতে পারবে কিন্তু।’ এতক্ষণ চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা সে ছেলের মুখ থেকে এ বার কথা সরল, ‘লেখাপড়া শিখলে তো ত্রিশ টাকার বেশী রোজগার হবে না। এতে আমি তার বেশী রোজগার করতে পারবো।’ ভাইস-প্রিন্সিপাল আর না করতে পারলেন না। সেই থেকে ছেলেটি নাড়া বাঁধল অবনীন্দ্রনাথের কাছে। পরবর্তীকালে এই ছেলেই হয়ে উঠেছিলেন ভারত শিল্পের অন্যতম পথিকৃত নন্দলাল বসু।

” alt=”” aria-hidden=”true” />

কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেল সাহেব বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথকে ভাইস প্রিন্সিপালের পদে বসিয়েছিলেন। দুপুরে ঘুমের ব্যাঘাত হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মনিষ্ঠার অসহ্য বেড়াজালের ওজর তুলে অবনীন্দ্রনাথ সাহেবের মাস্টারির প্রস্তাবকে পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন। হ্যাভেল কিন্তু তাঁকে ছাড়েননি। কলেজেই দুপুরের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছিলেন। শেষে সাহেবের জেদের কাছে হার মেনে ভাইস-প্রিন্সিপাল হলেন অবনীন্দ্রনাথ। শুরুতে সুরেন গাঙ্গুলি ও আরও দু-চার জনকে নিয়ে তার মাস্টারি জীবনের পথ চলা শুরু। এমন সময় হঠাৎ এক দিন নন্দলালের আবির্ভাব। এরপর এক পাশে নন্দলাল আর অন্য পাশে সুরেন গাঙ্গুলিকে রেখে অবনীন্দ্রনাথ ভারত-শিল্পের পথ পরিক্রমা করলেন সারথী হয়ে। তার শিক্ষাগুণে আর নন্দলালের হাতের যাদুতে এ সময়ে রূপ পেল ‘কর্ণের সূর্যস্তব’, ‘কৈকেয়ী-মন্থরা’, ‘সতী’, ‘শিব ও সতী’, ‘উমার তপস্যা’র মতো বিখ্যাত সব ছবি।

সে বার জনৈক আইরিশ দুহিতা এসেছেন আর্ট স্কুলে। অবনীন্দ্রনাথ তাকে ছাত্রদের শিল্প-কর্ম দেখাচ্ছেন। তিনটে ছবিতে অতিথির চোখ আটকে গেল। প্রথমটি কৃষ্ণ-সত্যভামা’র তো পরের দু’টি কালী আর দশরথ-কৌশল্যা’র। ‘কৃষ্ণ-সত্যভামা’র ছবিতে সত্যভামার পা ধরে বাসব তার মানভঞ্জনে রত। অবাক হলেন অতিথি নারীর পা ধরে পুরুষের মানভঞ্জন! দৃষ্টিকটু বটে, খারাপ দেখায়। শিল্পীকে এ জাতীয় ছবি আর আঁকতে নিষেধ করলেন। মা কালীর ছবি তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল যদিও, তবু দীর্ঘ বস্ত্র পরিহিতা সে কালীমূর্তি যেন স্বাভাবিকতার গণ্ডি খানিকটা অতিক্রম করে গিয়েছিল। মা-কালী যে দিগ্‌বসনা, প্রলয়ঙ্করী। শিল্পীকে তিনি কালী সম্পর্কে স্বামীজীর লেখা কবিতাখানি (‘Kali the Mother’) একটিবার পড়তে বললেন। আইরিশ দুহিতার ভারতীয় নাম ভগিনী নিবেদিতা এবং শিল্পীর নাম শ্রী নন্দলাল বসু।

নিবেদিতার সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের প্রথম দেখা কলকাতায় মার্কিন-কনসালের দেওয়া এক অভ্যর্থনা সভায়। ১৯০২ সালে বিখ্যাত জাপানি মনীষী ওকাকুরা ভারতে আসেন। তাঁকে ঘিরে বাংলার শিল্প জগতে সে সময়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, যার থেকে দূরে থাকতে পারেননি ঠাকুর বাড়ীর শিল্পীরাও। অবনীন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ কেউই নয়। ওকাকুরার আগমন উপলক্ষে মার্কিন কনসালের বাড়ীতে সেই অভ্যর্থনা সভায় অবনীন্দ্রনাথ প্রথম দেখেন নিবেদিতাকে। শ্বেতশুভ্র ঘাঘরা পরিহিতা, কন্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা শোভিতা সে নিবেদিতা যেন মর্মর তপস্বিনীর মূর্তি। ওকাকুরা যেমন, ঠিক তেমনটি নিবেদিতা। দু’টি তারা যেন মিশেছে এক বিন্দুতে। প্রথম দর্শনের সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ ধরে রেখেছেন তাঁর লেখনিতে— ‘সাজগোজ ছিল না, পাহাড়ের ওপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন হয়, তেমনি ধীরস্থির মুর্তি তার। তার কাছে গিয়ে কথা কইলে মনে বল পাওয়া যেত।’ শিল্পী মনে এমনই প্রভাব ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লোকমাতা।

অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ ছবির মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষ যেন শিল্প ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করল। প্রবাসী-তে রামানন্দ যখন ‘সীতা’ছবিখানি ছাপলেন নিবেদিতা লিখলেন একখানি চিত্র-পরিচিতি। তাঁর ভাষায়, “সত্য বটে ভাব ও চিন্তা ব্যক্ত করিবার আধুনিক যুগের নানাবিধ উপায়ের সাহায্য লইয়া অবনীন্দ্রবাবু এই ছবি আঁকিয়াছেন, কিন্তু তাহা হইলে চিত্রপটে তৎকর্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শটি খাঁটি ভারতীয় ছিল। আকার প্রকারও ভারতীয়। পদ্মগুলির বক্ররেখা ও শিরোবেষ্টক প্রভাত মণ্ডলের শুভ্রদীপ্তি সংযোগে এশিয়োদ্ভুত কল্পনাজাত মূর্তিটি সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। চারিবাহু দৈবশক্তির বহুত্বের চিত্র স্বরূপ। ইহাই প্রথম উৎকৃষ্ট ভারতীয় চিত্র, যাহাতে এক ভারতীয় শিল্পী যেন মাতৃভূমির অধিষ্ঠাত্রীকে—ভক্তিদায়িনী-বাদ্যদাত্রী, বসন-দায়িনী, অন্নদা মায়ের আত্মাকে—দেশরূপী শরীর হইতে স্বতন্ত্র করিয়া তাহার সন্তানগণের মানস ক্ষেত্রে তিনি যেরূপ প্রতিভাত হন, সেই ভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন। মায়ে শিল্পী কি দেখিয়াছেন, তাহা এই চিত্রে আমাদের সকলের কাছে বিশদ হইয়া গিয়াছে। কুহেলিকার মত অস্পষ্ট পদ্মরাজি ও শ্বেত আভা, তাঁহার চারিবাহুও অনন্ত প্রমেরই মত, তাঁহাকে অতিমানব করিয়া রাখিয়াছে। অথচ তাঁহার শাঁখা, তাঁহার সর্বদেহাচ্ছাদক পরিচ্ছদ, তাঁহার খালি পা, তাঁহার খোলা, অকপট মুখের ভাব, এই সকলে তিনি কি আমাদের পরম আত্মীয়, হৃদয়ের হৃদয়, একাধারে ভারতের মাতা ও দুহিতা বলিয়া প্রতিভাত হইতেছেন না? প্রাচীন কালের ঋষিদিগের নিকট বৈদিক উষা যেমন ছিলেন?” (প্রবাসী, ৬ষ্টভাগ, ৫ম সংখ্যা) নিবেদিতার এ স্তুতি নিঃসন্দেহে অবনীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করে থাকবে।

শিল্প-তাত্বিক নিবেদিতা মনে করতেন, শিল্প-সৃষ্টির মহতি শৈলীগুলি আত্মবিনাশ না ঘটিয়ে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাসে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে যুগে যুগে। বোধকরি এ ধারণাই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল ভারতবর্ষের স্বকীয় শিল্প-বৈশিষ্ট্যের জাগরণকে আহ্বান করতে। পরানুকরণ নয়, অন্য শিল্পের মহৎ বৈশিষ্ট্যের সাঙ্গিকরণের মাধ্যমে স্বতন্ত্র নিজস্ব শিল্পরীতি বিকাশের ওপর যে গুরুত্ব তিনি আরোপ করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর প্রতিমূর্তি। ১৯০৮-এর মডার্ন রিভিউ-এর মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হল অবনীন্দ্রনাথের ‘সীতা’, সঙ্গে বেরলো নিবেদিতা রচিত চিত্র-পরিচিতি। তাঁর দৃষ্টিতে অবনীন্দ্রনাথের ‘সীতা’ ভারতীয় ধরনের শ্রেষ্ঠ সুমুখশ্রী নয়। ঢালু কপাল, স্থূল গ্রীবা সমন্বিত সে মূর্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় হিন্দু রমণীর বৈশিষ্ট্য । এ সীতা যতখানি মহিয়ষী নারী, ততখানি মহিয়ষী পত্নী নন। নিবেদিতার ভাষায় একটুখানি শোনা যাক যে ‘সীতা’র বর্ননাঃ “In this picture, with its noble proportions and splendid vigour, we see that Sita who could laugh at hardships, and burn with her disdain Ravana himself, we catch a glimpse even of the woman of the last great scene of wounded withdrawal, before the popular insult.” ‘রাজ্ঞীগর্বে সমুন্নত শক্তিময়ী মহিমান্বিত নারীত্বের’ যে প্রকাশ এখানে ঘটেছে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিবেদিতা এ সীতাকে ভারতীয় ম্যাডনার নবরূপ বলে চিহ্নিত করলেন। আর লিখলেন, “The outstanding impression made by this picture is one of extraordinary mental intensity…In the strong and noble womanhood, in the regal pride brought low, and the hoping yet despairful wifehood, of this Sita, by Mr. Tagore, we have achieved something too deeply satisfying for us again to be contented without an effort in its direction.”

মর্ডান রিভিউতে ১৯০৭-এর মে মাসে ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ চিত্রটি প্রকাশিত হলে, নিবেদিতা তাকে “superb original of the drawing” বলে তাঁর আহ্লাদ ব্যক্ত করলেন। প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উচ্চকিত নিবেদিতা এ সময়ে লিখেছিলেন, “not only is he what could not have been expected in India at present, but also probably of first rank in Europe.” ‘শাহজাহানের তাজ-স্বপ্ন’ ছবিতে যমুনা তীরে রাত্রিকালে অশ্বারূঢ় মুঘল সম্রাট তাজ নির্মাণের কথা ভাবছেন। নিশিথের নিস্তব্ধতা আর কল্পিত তাজ বিবির শৌধের ওপর চুইয়ে পড়া অবগুণ্ঠিত চন্দ্রালোকের আলোআঁধারিতে শাহজাহানের অন্তরের আধ্যাত্মিকতা যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। চিত্রের বিষয়বস্তু ও ভাবাবেগের চালচিত্র মেলে ধরে এর চিত্র-সমালোচনায় নিবেদিতা লিখলেন, “The drawing is full of strength. But we do wish that we might again enjoy colour at the hands of Mr. Tagore! We long for some of those bright and tender interpretations which were once so characteristic of the art of this land of bright skies and limpid atmospheres, those interpretations in which Mr.Tagore himself is so well fitted to excel!” (‘Notes on Abanindranath Tagore’ in The Modern Review January, 1910 )

জন্মলগ্ন থেকেই মর্ডান রিভিউ-এর পাতায় চিত্র-সমালোচক রূপে নিবেদিতা আমৃত্যু অবনীন্দ্রনাথ ও অন্য তরুণ শিল্পীদের দেখিয়ে দিতেন কোথায় কি বর্জন করতে হবে, আর কোন পথ অনুসরণ করতে হবে। ইতিহাস, জাতিবিজ্ঞান, চারুকলা—সর্বত্র আমাদের আধুনিক গবেষণাকে অগ্রসর করার জন্য, উৎসাহ দেবার জন্য—সমালোচনা ও সংশোধন করার জন্য নিবেদিতা সর্বদা আগ্রহী ছিলেন। তার এ সব কর্মকাণ্ডের পিছনে প্রত্যক্ষদর্শী ইতিহাসচার্য যদুনাথ সরকার দেখেছিলেন অকদর্প দেশ সেবার প্রেরণা। (আচার্য যদুনাথ সরকার, ‘ভগিনী নিবেদিতা’)। ঠিক একই কথা বলেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুও।

বড় তেজি ছিলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ। এতটাই যে, বড় দাদা গগনেন্দ্রনাথও তাঁর সামনে দাঁড়ানোর সাহস পেতেন না। এক দিন চৌরঙ্গির আর্ট স্কুলের বাড়িতে ছবি আঁকছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সকলে বিস্মিত হয়ে দেখছেন। অবনীন্দ্রনাথকে সে ছবি দেখানোর জন্য অনেক সাধ্যসাধনা করে নিয়ে এসেছেন গগনেন্দ্রনাথ। ছবি দেখেই ভাইয়ের হুঙ্কার— ‘‘এ কী এঁকেছ? এ কি ছবি হয়েছে?’’ কখনও হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচাও মারতেন ছবিতে। গগনেন্দ্রনাথও কম রাগী নন, তবে তখন কাঁচুমাচু। রানী চন্দ লিখছেন— ‘‘অবনীন্দ্রনাথকে খুব ভয় পেতাম আমি। শুধু আমি কেন, সকলেই তাঁকে খুব ভয় পায় দেখতাম।’’ কেবল রবিকা-র কাছেই বোধ হয় একটু জব্দ ছিলেন তিনি!

সে দিন ৭ অগস্ট, ১৯৪১। ইংরেজি তারিখ অনুসারে অবনীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মদিন। অথচ সে দিন বদলে গিয়েছিল জন্মদিনের তাৎপর্যটাই। এমন বিয়োগান্তক জন্মদিন আগে তো কখনও আসেনি! বেদনা, বিষন্নতায় ভরা সেই দিনটা যেন জীবনের গতি পথটাকেই বদলে দিয়েছিল। কিছু ক্ষণ আগেই রবিকাকা পাড়ি দিয়েছেন অমৃতলোকে। আর শোকে স্তব্ধ ৭০ বছরের অবন ঠাকুর তখন পাঁচ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে আপন মনে এঁকে চলেছেন একটি ছবি— সে ছবি রবিকাকার অন্তিমযাত্রার। ছবিতে শুধু অসংখ্য ঊর্ধমুখী হাতের সারি। তার উপর দিয়ে যেন ভেসে চলেছে রবিকাকার শায়িত মরদেহ। এ যেন ইহলোক থেকে অমৃতলোকের পানে তাঁর যাত্রা। সে ছবি পরে প্রবাসীতে ছাপাও হয়েছিল।

জোড়াসাঁকোর দুই বাড়ির প্রাঙ্গন সে দিন লোকে লোকারণ্য। রবীন্দ্রনাথকে এক বার শেষ দেখা দেখতে উদগ্রীব সকলেই। কিছু পরেই বাড়ির ফটক পেরিয়ে তাঁর দেহ চিরকালের জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে, দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি পেরিয়ে চলে যাবে নিমতলা ঘাটে। সেখানেই তার নশ্বর দেহ চিতার লেলিহান শিখায় বিলিন হবে পঞ্চভূতে। অথচ এই রবিকাকাই তো লিখেছিলেন,

‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চোখে আলোকে…’।

রোগশয্যায় রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল, উৎসব করে পালিত হোক অবনীন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জন্মদিন। সে দিন দেশের সকলে শিল্পগুরুকে সম্মান জানাক, এমনই ছিল আকাঙ্ক্ষা। তবে যাঁর জন্মদিন, গোল বাধল তাঁকে নিয়েই। দেশের লোক জন্মদিন পালন করবেন, কিন্তু তিনি যদি বেঁকে বসেন? সুতরাং পয়লা কাজ অনুমতি আদায়। উৎসবে অবনীন্দ্রনাথের ঘোর আপত্তি সম্পর্কে সকলেই অবগত, কাজেই প্রস্তাব নিয়ে এগোতে চাইলেন না কেউ। শেষে দু’-এক জন সাহসে ভর করে যেই কথা বলার জন্য সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলেন, প্রায় তেড়ে এলেন অবনীন্দ্রনাথ। স্পষ্ট কথা—

‘‘আগে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামো, তার পরে তোমাদের কথা শুনব।’’

অতঃপর শান্তিনিকেতন থেকে নন্দলাল বসুকে জোড়াসাঁকো পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ বারান্দায় কৌচে বসে কুটুম-কাটাম গড়ছেন, মুখে চুরুট। ততক্ষণে ওটা কিন্তু নিভে গিয়েছে। তবে কাজ করলে ওটা মুখেই ধরা থাকত। নন্দলাল অনেকটা দূরে নিচু মোড়া টেনে নিয়ে বসলেন। অবনীন্দ্রনাথ চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁকে দেখেই মতলব বুঝলেন। ধরা পড়ে গিয়েছেন, বুঝলেন নন্দলালও। তাই মাথা তুলে তাকালেন, আবার মুখ নামিয়ে নিলেন। খানিক পরে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে গুরুকে প্রণাম জানিয়ে চলেই গেলেন। যাওয়ার সময়ে পাশে বসা রানী চন্দকে বললেন, ‘‘আমি পারব না বলতে, যা বলবার তুমিই বোলো।’’ নন্দলাল চলে যেতেই অবনীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘‘কিছু বলতেই দিলুম না নন্দলালকে!’’ রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে আয়োজনের ব্যাপারে খোঁজ নিলেন। রানী চন্দ বিপদটা জানালেন। সকালবেলা অবনীন্দ্রনাথ যখন রবিকা-কে দেখতে এলেন তখন শুরু হল ধমক— ‘‘তোমার এতে আপত্তির মানে কী? দেশের লোক যদি চায় কিছু করতে— তোমার তো তাতে হাত নেই কোনো।’’ অবনীন্দ্রনাথ মাথা চুলকে বললেন, ‘‘তা আদেশ যখন করছ— মালাচন্দন পরব, ফোঁটানাটা কাটব— আর কোথাও যেতে পারব না কিন্তু—’’ এই বলে প্রণাম করেই একদৌড়! পাছে আরও কিছু আদেশ আসে। রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘‘পাগলা বেগতিক দেখে পালালো।’’

এই রবিকাকাই তাঁর জীবনে অনেক কিছুর অনুপ্রেরণা। যখন তিনি চিত্রাঙ্গদা লিখেছিলেন তখন অবনীন্দ্রনাথের উপর নির্দেশ এসেছিল ছবি দেওয়ার জন্য। সেই প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

“…এই হল রবিকাকার সঙ্গে আমার প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। তার পর থেকে এত কাল রবিকার সঙ্গে বহু বার আর্টের ক্ষেত্রে যোগাযোগ হয়েছে, প্রেরণা পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আজ মনে হচ্ছে আমি যা কিছু করতে পেরেছি তার মূলে ছিল তাঁর প্রেরণা।”

আবার রবীন্দ্রনাথের রাখি বন্ধন ও স্বদেশি অন্দোলনের তিনিই ছিলেন অন্যতম সঙ্গী এবং উদ্যোক্তা। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে তাঁর লেখালেখির শুরু। প্রথমে ‘শকুন্তলা’ লিখে রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা পেয়ে তার পরে লিখেছিলেন ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘বুড়ো আংলা’ ইত্যাদি। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থ অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

“রবিকা বলতেন ‘অবন একটা পাগলা’ সে কথা সত্যি। আমিও এক এক সময় ভাবি, কী জানি কোন্ দিন হয়তো সত্যি খেপে যাব।…চির কালের খ্যাপা আমি। সেই খ্যাপামি আমার গেল না কোনো কালেই।”

সেই দক্ষিণের বারান্দাটা তখন নীরব হতে বসেছে৷ বড়দাদা গগনেন্দ্রনাথ রাঁচী বেড়াতে গিয়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন৷ নির্বাক, নিশ্চল হয়ে রইলেন বাকি জীবনটা৷ অবনীন্দ্রনাথও তখন ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন৷ রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেন, কী হলো অবন, ছবি-আঁকা ছেড়ে দিলে৷ অবনীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কী জান রবিকা, এখন যা ইচ্ছে করি তাই এঁকে ফেলতে পারি, সেইজন্যেই চিত্রকর্মে আর মন বসে না৷ নতুন খেলার জন্য মন ব্যস্ত৷’

সে খেলা যাত্রাপালার খেলা৷ নাটকে অভিনয় অবনীন্দ্রনাথ সেই জোড়াসাঁকোর তরুণ আলোতেই করেছেন বহু৷ যে-বাল্মীকি-প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন বাল্মীকি, তাতেই ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ডাকাত৷ ডাকঘরে সেজেছিলেন মোড়ল৷ কিন্তু এ নাটক নয়, যাত্রাপালা৷ তা-ও একেবারে খেয়াল-খুশির যা-তা যাত্রাপালা৷ আর তার মুখ্য অবলম্বন রামায়ণ৷

রামায়ণ নিয়ে অনেক দিন ধরেই ভাবছেন তিনি৷ ভাবছেন একেবারে উল্টো করে৷ পালা লেখারও আগে, নানা রকম পুঁথি লিখছেন রামায়ণ নিয়ে৷ বীর হনুমান সেখানে কাজ-পালানো, অলস৷ মারুতির পুঁথি-তে তিনি চলেছেন কিষ্কিন্ধ্যায়, মতং মুনির কাছে বিদ্যাশিক্ষা করতে৷ কিন্তু ‘পথ চলতে আর মন চায়না পবন-পুত্রের৷ ইচ্ছা করে এই সব গাঁয়ের এখানে থেকে যাই— ফলও প্রচুর ছায়াও মেদুর/বসলেই হল বিছায়ে মাদুর,/কে আর যায় কিষ্কিন্ধ্যায়— অতদূর! চলতে চলতে কোনখানে দেখা যায়— একটি কুয়োতলা, একটি বটগাছ, একটি কালো কোলো পল্লীবালা, পোড়ো মন্দির, ইষ্টকালয়, দেখে হনুমানেরই মন খারাপ হয়ে যায়, মানুষ তো দূরের কথা—এমন সুন্দর সেসব স্থান৷’

এ পুঁথি রামায়ণের নয়, একেবারে আমাদের ঘরের কথার পুঁথি৷ ‘সত্য ত্রেতা দ্বাপর, তারপর কলির তিপ্পান্ন হাজার বচ্ছর গতে গন্ধমাদন পর্ব্বত ক্ষয় পেতে পেতে হয়ে পড়েছে যখন মরুত্তাশ্রমের চাঁই-বুড়োর ঠেসান দেবার গের্দ্দাটি, সেই কালে আশ্রমের ভোগমণ্ডপের সামনে গাঁজাল-কুঞ্জে জোড়া-পেঁপেতলায় সেই গন্ধমাদনের সামনে আসন পেতে বসে চাই-বুড়ো মারুতির পুঁথি পাঠের পূর্বেব গণ্ডূষ করছেন আর মন্ত্র পড়ছেন…’৷

১৩৪৪-’৪৫ বঙ্গাব্দের মৌচাক পত্রিকায় মারুতির পুঁথি যখন প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক, তখনই একটি গোপন খাতাও তৈরি হয়ে উঠছে অবনীন্দ্রনাথের, ‘খুদ্দুর যাত্রা’ বা ‘খুদি রামলীলা’-র খাতা৷ নিজের মতো এক রামায়ণ লিখে চলেছেন তিনি সেখানে৷ তার মধ্যে তৈরি হয়ে উঠছে তাঁর নিজের তৈরি কাল্পনিক চরিত্র হাঁচি-টিকটিকি, তাল-চড়াই, ঢেঁকি, ভোম্বল, বুড়ন, বনমানুষ, মেটেভূত, জলসাভূত, মহামারি কিংবা আদিমধ্যিঅন্তি৷

কিন্তু এ কি কেবল ছেলেভুলানো খেলা? নয় যে, সেটা বোঝা যায় এই রামায়ণে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজেরই করা অলংকরণে৷ এত কাল ছবি এঁকে অলংকরণ করতেন তিনি৷ এ বার করতে চাইলেন ছবি সেঁটে৷ নিজের আঁকা ছবি নয়, খবরের কাগজ বা পাঁজি থেকে কেটে নেওয়া ছবি, কিংবা দেশলাইয়ের বাক্সের ছবি৷ আর এমন আপাত-উদ্ভট ভাবে ছবিগুলি লেখার সঙ্গে সেঁটে দেন যে রামায়ণের আর একটা মানে তৈরি হতে থাকে৷ রাবণের দরবার বোঝাতে পাশে সেঁটে দিয়েছেন ফুটবল-শিল্ডের চারপাশে বিদেশি খেলোয়াড়দের মুখ৷ সীতাকে খোঁজার জন্য হনুমান যখন আয়োজন চালাচ্ছেন তখন তাঁর পাশে সংবাদপত্র থেকে কেটে নেওয়া হেডিং, সাম ইনফরমেশন নেসেসারি৷ পঞ্জিকার পাতা থেকে কাটা লঙ্কার ছবি অনায়াসে চলে এসেছে লঙ্কাকাণ্ড শুরুর সময়৷ আর এই নতুন রামায়ণে মকরাক্ষ রাম-বাহিনীর গরু-ভক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ-কৌশল তৈরি করছে,

“মকরাক্ষ নিশাচর বুদ্ধি বড় সরু
যুদ্ধ জিততে রথে বেন্ধে গরু৷

গোচর্ম্মেতে ঢাকে রথ করিয়া মন্ত্রণা
সর্ব্ব অঙ্গে ঢাকা দিল গোচর্ম্মের শানা৷”

এর পাশে অবনীন্দ্রনাথ সেঁটে দিলেন সে কালের গোরক্ষাপ্রচারের বিজ্ঞাপন৷

তাঁর ‘নোয়ার কিস্তি’ পালায় এক নতুন পৃথিবীর কথা বলেছিল নোয়ানী, বলেছিল ‘মানুষগুলোর আলোতে বার হবার পথটা পরিষ্কার করে দাও৷’ সেখানে মনু বলছেন, ‘ধর্মের ঘুণ বড়ো ভয়ানক৷ চেনো না তাই ওকথা বলছ৷ গোবর মাটি কাঁচাপাতা, এমন কি জলে পর্যন্ত সে গিয়ে ধরে৷ কোনদিন দেখবে ঐ মানুষগুলো তোমার হাতের ন্যায়দণ্ড মুগুরে পর্যন্ত ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে৷’

মৃত্যুর প্রায় সাত দশক পরে ‘ভারতমাতা’র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের ভারতে মনুর কথাগুলো এমন ফলে যাবে কে জানত!

তিনিই বেঙ্গল স্কুলের সেই পথিকৃত, যাঁর শিল্পসত্ত্বা জন্ম দিয়েছিল এক নব্যবঙ্গীয় চিত্রকলার রীতির। তিনি সেই শিল্পাচার্য, যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেঙ্গল স্কুলের পরবর্তী শিল্পীরা এ দেশের আধুনিক চিত্রকলার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। অসামান্য এক শিক্ষক, এসরাজ বাদক, অভিনেতা। এ সবের পাশাপাশি চলত সাহিত্য চর্চাও। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আটপৌরে, স্নেহশীল, কর্তব্যপরায়ণ এক জন মানুষ। নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন,

“কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই, অতি নিষ্কর্মা মানুষ আমি। নিজে হতে চেষ্টা ছিল না কখনও কিছু করবার, এখনও নেই। তবে খাটিয়ে নিলে খাটতে পারি, এই পর্যন্ত।”

১২৭৮ সালের ২৩ শ্রাবণ ঠাকুরবাড়িতে জন্ম অবনীন্দ্রনাথের। বাড়ির রীতি অনুসারে তাঁর জন্য ছিল এক জন দাসী: পদ্মদাসী। তার কাছেই দুধ খাওয়া, খেলাধুলো, গান শুনতে শুনতে ঘুমোনো। তেজি ছেলেটা ছেলেবেলায় ছিল দুরন্ত। পদে পদে অপ্রস্তুত হত পদ্মদাসী। প্রবল শীতের দিনে জানালার শার্সি বন্ধ করার পরেও ঠান্ডা কমছে না দেখে তুলোর পর্দা ঝোলানোর বন্দোবস্ত হয়েছিল বাড়িতে। পাতলা ওয়াড়ে মোড়া শালুর লেপের ভিতর বাড়ির ছোটরা সকলে একসঙ্গে গুটিসুটি মেরে ঘুমোত। যদি একটু শীত কমে! সকালে সবাই লেপ ছেড়ে বেরোল। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথকে আর পাওয়া গেল না। ‘ছেলে কোথা গো’ বলে কান্না জুড়ল পদ্মদাসী। শোরগোলের মধ্যে অবশেষে আবিষ্কৃত হল, ওয়াড়ের ভিতর ঢুকে ঘুমোচ্ছেন তিনি। সারা গা তুলোয় মাখামাখি!

‘সেয়ানা’ হয়ে ওঠার পরে দাসীর কোল থেকে চলে যেতে হত চাকরের জিম্মায়। অন্দরমহল থেকে বাহিরমহল। অবনীন্দ্রনাথ গিয়ে পড়লেন রামলাল চাকরের কাছে। এ বার আর দুষ্টুমিটা সহজ হল না। অবনীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, ‘‘ছোটোকর্তা ছিলেন রামলালের সামনে মস্ত আদর্শ, কাজেই একালের মতো না ক’রে অনেকটা সেকেলে ছাঁচে ফেল্‌লো সে আমাকে— দ্বিতীয় এক ছোটোকর্তা করে তোলবার মতলবে। ছোটোকর্তা ছুরি-কাঁটাতে খেতেন, কাজেই আমাকেও রামলাল মাছের কাঁটাতে ভাতের মণ্ড গেঁথে খাইয়ে সাহেবি দস্তুরে পাকা করতে চল্‌লো; জাহাজে করে বিলেত যাওয়ার দরকার হ’তেও পারে, সেজন্যে সাধ্যমত রামলাল ইংরিজির তালিম দিতে লাগলো,— ইয়েস, নো, বেরি ওয়েল, টেক্ না টেক্— ইত্যাদি নানা মজার কথা।’’

ছেলেবেলায় দুষ্টুমির জন্য তাঁকে বাড়িতে ‘বোম্বেটে’ নাম দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় দোতলার বারান্দায় একটা জল ভর্তি টবে কিছু লাল মাছ থাকত। এক দিন তাঁর হঠাৎ মনে হল লাল মাছ তাই লাল জলে থাকা উচিত। অমনি লাল রঙ জোগাড় করে তাতে ঢেলে দিয়েছিলেন। পরে মাছগুলি সব মরে ভেসে উঠেছিল। আর এক বার বাড়িতে তখন পাখির খাঁচা তৈরি হচ্ছে। মিস্ত্রিরা দুপুরে টিফিন খেতে গিয়েছে এমন সময় তিনি হাতুড়ি, বাটালি নিয়ে কাঠের উপর যেমনি ঘা মেরেছেন, বাটালি বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে মাঝ দিয়ে চলে গেল। অমনি তিনি আঙুল চুষতে চুষতে দে ছুট। আসলে নানা কারণে অবন ঠাকুরের ছোটবেলাটা তাঁর সারা জীবনের উপর গভীর ভাবে একটা প্রভাব বিস্তার করেছিল।

তবে দস্যিপনা কি আর বাগ মানে! এক দিন দেউড়ির দারোয়ান বুড়ো মনোহর সিংহের দাড়িতে হাত দিয়ে দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ব্যস, বেজায় বিপদ— বকাঝকা নয়, একেবারে হুঙ্কার। ভয়ের চোটে পলায়ন। তবে তাতেও লাভ হল না। মনোহর সিংহের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে তবে নিষ্কৃতি।

দুষ্টুমির ‘খ্যাতি’ ছড়িয়েছিল স্কুলেও। নর্মাল স্কুলে লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত নামে প্রচণ্ড রাগী এক ইংরেজির মাস্টার ছিলেন। তিনি ক্লাসে পড়াতে গিয়ে খাবারের নাম বললেন ‘পাডিং’। অবনীন্দ্রনাথ বলে বসলেন, ‘‘রোজ বাড়িতে পুডিং খাই, আমি জানি না!’’ মাস্টার ধমকালেন, ‘‘বল্, পাডিং।’’ ছাত্র আবার বলল, ‘‘না, ওটা পুডিং।’’ শাস্তি হিসেবে ছুটির পরে এক ঘণ্টা ‘কনফাইন’-এর নিদান হল। ‘পুডিং’ তবু ‘পাডিং’ হল না। টানাপাখার দড়িতে হাত বেঁধে পিঠে সপাসপ বেত। ফল মিলল না তা-ও। তবে ঠাকুরবাড়ি সেই তেজ বুঝেছিল। অবনীন্দ্রনাথকে স্কুলে যেতে বারণ করলেন বাবামশায় গুণেন্দ্রনাথ। নাম কাটা গেলে বাড়িতেই শুরু হল লেখাপড়া।

হয়তো ভালই হল, কারণ ছবি আঁকার হাতেখড়িও এই পর্বেই। ছোটবেলা থেকেই খুব ছবি দেখতে ভালবাসতেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর ছোটপিসিমার ঘরে ঝোলানো থাকত দেবদেবীর পট আর অয়েল পেন্টিং। অবাক হয়ে সকলে দেখতেন ‘শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ’, ‘শকুন্তলা’, ‘মদনভস্ম’, ‘কাদম্বরী’।

ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও প্রথমে প্যাস্টেলে হাত পাকিয়ে তার পরে অয়েল পেন্টিং শিখেছিলেন সি এল পামারের কাছে। তার পরে জল রঙের কাজ শিখেছিলেন। প্রথম দেশীয় ধরনের ছবি ‘শুক্লাভিসার’ এঁকে তাঁর মন ভরেনি। তাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন দেশীয় টেকনিক শেখার কথা। সেই সময় রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়িতে পবন নামের এক মিস্ত্রি ছবির ফ্রেমে সোনা লাগানোর কাজ করত। তাঁর কাছে গিয়ে ছবিতে সোনা লাগানোর পদ্ধতি শিখেছিলেন। এর পরই বৈষ্ণব পদাবলীর এক সেট ছবি এঁকেছিলেন। এর পরে একে একে এঁকে ছিলেন কৃষ্ণলীলা, আরব্য রজনী, শাহজাহানের মৃত্যু, ভারতমাতা ইত্যাদি কত না ছবি।

এক দিন সে রকম সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই আঁকতে শুরু করলেন। ছোট পিসেমশাই একখানা হাঁসের ছবি দিয়েছিলেন, সেটাই প্রথম কপি করলেন অবনীন্দ্রনাথ। পরে একটা ঘষা কাচের ট্রেসিং স্লেটও কিনে দিয়েছিলেন তিনি। আর গুণেন্দ্রনাথের টেবিলে সব সময়ই লাল-নীল পেনসিল পড়ে থাকত। সেই পেনসিল দিয়ে কিংবা হলুদ গুলে ছবি রং করার কাজ শুরু হল।

অবনীন্দ্রনাথের বয়স যখন নয় কি দশ, তখন কিছু দিনের জন্য সপরিবার এক বাগানবাড়িতে গেলেন তাঁরা। কলকাতা থেকে মাইল পনেরো দূরে গঙ্গার তীরে কোনও এক জায়গা। ফুল-ফলের গাছের সারি; চড়ে বেড়াত হরিণ, ময়ূর, বক। কারুকার্যখচিত আসবাবে সাজানো ঘরগুলি। এ সব দেখেই কাগজ-কলম-তুলি-পেনসিল নিয়ে বসে পড়লেন অবনীন্দ্রনাথ। কলসি কাঁখে মেয়েরা নদীর ঘাটে যাচ্ছে, রাখাল গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে, নদীর বুকে ভেসে যাচ্ছে পালতোলা নৌকো— দেখলেন আর আঁকলেন। আসলে, ছবি আঁকার আবহ তাঁর বাড়িতেই ছিল। গুণেন্দ্রনাথের আঁকার শখ ছিল। গগনেন্দ্রনাথ আঁকা শিখতেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। পোর্ট্রেট আঁকতেন কাকা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। হাতির দাঁতের কারুকাজে ঝোঁক ছিল দাদা সমরেন্দ্রনাথের।

অবনীন্দ্রনাথের প্রথাগত অঙ্কনশিক্ষার শুরু পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে, গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। ভাইস প্রিন্সিপ্যাল গিলার্ডি সাহেবের বাড়িতেই তাঁর আঁকা শেখার ব্যবস্থা হল। প্রথমে লাইন ড্রয়িং, পরে প্যাস্টেল, তেলরঙের কাজ শিখলেন, শিখলেন প্রতিকৃতি অঙ্কনও— সবই বিদেশি পদ্ধতিতে। গিলার্ডি সাহেবের কাছে যখন আঁকা শিখছেন, সেই সময়েই কলকাতায় এলেন বিখ্যাত ইংরেজ আর্টিস্ট সিএল পামার। তাঁর কাছে জলরং আর তেলরঙের কাজ শিখলেন। তখন অবনীন্দ্রনাথ নাকি এতটাই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন যে, দু’ঘণ্টা সময়ের মধ্যে আবক্ষ প্রতিকৃতি এঁকে ফেলতে পারতেন। দক্ষ শিল্পীকে পামার সাহেব এ বার অ্যানাটমি শেখাতে বসলেন। আঁকার জন্য এনে দিলেন একটা মড়ার খুলি! অবনীন্দ্রনাথের শরীর খারাপ লাগতে থাকল। সাহেব জানালেন, যা-ই হোক, আঁকতেই হবে। শিক্ষকের আদেশ অমান্য করলেন না। তবে বাড়ি ফিরে ধুম জ্বর এল। ১০৬ ডিগ্রি। বেশ কিছু দিন পামার সাহেবের বাড়ি যাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ।

অবনীন্দ্রনাথের জীবনে হ্যাভেল সাহেবের বড় প্রভাব ছিল। সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন,

“ভাবি সেই বিদেশী-গুরু আমার হ্যাভেল সাহেব অমন করে আমায় যদি না বোঝাতেন ভারতশিল্পের গুণাগুণ, তবে কয়লা ছিলাম কয়লাই হয়তো থেকে যেতাম, মনের ময়লা ঘুচত না, চোখ ফুটত না দেশের শিল্প সৌন্দর্যের দিকে।”

তবে এ সবই হল ইউরোপীয় শিল্প। এতে অবনীন্দ্রনাথের মন ভরেনি। অতৃপ্তির শূন্যস্থান পূরণের সুলুকসন্ধান মিলল প্রপিতামহ দ্বারকানাথের গ্রন্থশালায়। হাতে পেলেন মুঘল যুগের প্রাচীন চিত্রের পুঁথি। এর পরই তাঁর ভগ্নীপতি শেষেন্দু উপহার দিলেন এক পার্সি ছবির বই। সেখানে ছিল দিল্লির ইন্দ্রসভার অপূর্ব নকশা। আবার এ সময়েই ছোট দাদামশাই নগেন্দ্রনাথের বন্ধু মিসেস মার্টিনডেল পাঠিয়েছিলেন ‘ইলিউমিনেটেড’ কবিতার বই। বইয়ের পাতাকে নকশা দিয়ে সুন্দর করে তোলার অঙ্কনপদ্ধতিকে বলে ইলিউমিনেশন করা। অবনীন্দ্রনাথের চোখের সামনে খুলে যেতে লাগল এক নতুন জগৎ। মুঘল যুগের ইতিহাস নিয়ে গড়ে উঠল তাঁর অমর সব সৃষ্টি— শাহজাহানের স্বপ্ন, শাহজাহানের মৃত্যু, আলমগীর, ঔরঙ্গজেব ও দারার ছিন্নমুণ্ড।

আবার চণ্ডীদাসের অভিসারের বৈষ্ণব পদ,

“পৌখলী রজনী পবন বহে মন্দ।
চৌদিকে হিমকর, হিম করু বন্দ।।”

অনুসারে অবনীন্দ্রনাথ ছবি আঁকলেন। কিন্তু রাধিকাকে পছন্দ হল না। তাঁর মনে হল ‘মেমসাহেবকে শাড়ি পরিয়ে শীতের রাত্রে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে’! ভাবলেন, দেশি টেকনিক শেখা দরকার। বলছেন, ‘‘তখনকার দিনে রাজেন্দ্র-মল্লিকের বাড়িতে এক মিস্ত্রি ফ্রেমের কাজ করে। লোকটির নাম পবন, আমার নাম অবন। তাকে ডেকে বল্লুম— ওহে সাঙাত, পবনে অবনে মিলে গেছে, শিখিয়ে দাও এবার সোনা লাগায় কি-ক’রে। সে বল্লে— সে কি বাবু, আপনি ও কাজ শিখে কি করবেন। আমাকে বলবেন, আমি ক’রে দেবো।’’ অবনের জেদ চাপল— নিজের ছবিতে নিজেই সোনা লাগাবেন। বৈষ্ণব পদাবলির ছবিতে সোনা-রুপোর তবক লাগিয়ে এঁকে ফেললেন।

আসলে ছবি আঁকা বিষয়টা তাঁর প্রাণের ভীষণ কাছাকাছি ছিল। ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ প্রসঙ্গে তাঁর লেখায় সে পরিচয় পাওয়া যায়— ‘‘এ ছবিটি এত ভালো হয়েছে কি সাধে? মেয়ের মৃত্যুতে যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম। ‘শাজাহানের মৃত্যু-প্রতীক্ষা’তে যত আমার বুকের ব্যথা সব উজাড় করে ঢেলে দিলুম।’’ নিকটজনদের সঙ্গে খুব জড়িয়ে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ১৮৮৯ সালে সুহাসিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর। এক পুত্র অলোকেন্দ্রনাথ। দুই কন্যা সুরূপা আর উমা। তবে তাঁর আত্মীয়তার পরিসরটি যেন আরও বড় ছিল। রবিকা কিংবা রানী চন্দের সঙ্গে তাঁর সখ্যের গল্পে তা বোঝা যায়।

নিকটজনদের অভিজ্ঞতা থেকেও অবনীন্দ্রনাথের এই মনটি বোঝা যায়। বিখ্যাত ‘ভারতমাতা’ দেখে ভগিনী নিবেদিতা ‘প্রবাসী’ (ভাদ্র ১৩১৩) পত্রিকায় লিখেছিলেন— ‘‘এই ছবিখানি ভারতীয় চিত্র-শিল্পে এক নবযুগের প্রারম্ভ সূচনা করিবে বোধ হয়… চিত্রপটে তৎকর্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শটি খাঁটি ভারতের জিনিস; আকার-প্রকারও ভারতীয়।’’ এই ভালবাসা আর একাগ্রতা ছিল গোড়ার দিনগুলো থেকেই। এক বার ঠাকুবাড়িতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিল্পী রবি বর্মা। অবনীন্দ্রনাথের স্টুডিয়ো দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করে শিল্পী বলেছিলেন, তাঁর ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল।

পরবর্তী কালে ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়ে ওঠার পরেও তিনি ছিলেন ঠিক সেই রকমই। এক দিন এক শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের কাছে হাজির হয়ে বললেন, আঁকা শিখবেন। শিল্পগুরু বললেন, ‘‘তা তো শিখবে, কিন্তু কিছু এঁকেছো কি? দেখাও না।’’ তিনি একটি দুর্গার ছবি দেখালেন। অবনীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘‘তা দুর্গা যে আঁকলে, কি ক’রে আঁকলে শুনি?’’ শিল্পী বললেন, ‘‘ধ্যানে ব’সে একটা রূপ ঠিক ক’রে নিয়েছিলুম। পরে তাই আঁকলুম।’’ সহাস্য জবাব— ‘‘তা হবে না। ধ্যানে দেখলে চলবে না, চোখ খুলে দেখতে শেখো, তবেই ছবি আঁকতে পারবে। যোগীর ধ্যান আর শিল্পীর ধ্যানে এইখানে তফাৎ।’’ আঁকা-শেখানো পর্বে ছড়িয়ে আছে এমনই সব মজার গল্প। যা রসেরও, শেখারও। তিনি ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শৈলেন্দ্রনাথ দে, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, সুরেন কর, মুকুল দে-র মতো ছাত্রদের মধ্যে। প্রসঙ্গত, ১৯০৫ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল পদে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯০৬ সালে হন অধ্যক্ষ।

ছবি আঁকা হোক বা লেখালেখি, মনেপ্রাণে ভারতীয় ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। ভারতীয় শিল্প এবং প্রাচ্যশিল্প যাতে বিশ্বের দরবারে সমাদর পায়, সেই জন্য প্রবল পরিশ্রম করেছিলেন। ১৯০৭ সালে তাঁর এবং গগনেন্দ্রনাথের উৎসাহ-উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস। অবনীন্দ্রনাথের কথায়— ‘‘আমরা করেছিলুম এমন একটা সোসায়েটি। যেখানে দেশী-বিদেশী নির্বিশেষে সবাই একত্র হয়ে আর্টের উন্নতির জন্য ভাববে। শুধু ভারতীয় শিল্পই নয়, প্রাচ্যশিল্পের সবকিছু জিনিস দেখানো হবে লোকেদের।’’ লর্ড কারমাইকেল, লর্ড রোনাল্ডসে, এডউইন মন্টেগু, মিস কার্প্লে, ভবানীচরণ লাহার মতো শিল্পানুরাগীরা এর আজীবন সদস্য হয়েছিলেন। সোসাইটিই হয়ে উঠেছিল অবনীন্দ্রনাথের ধ্যানজ্ঞান। ১৯১৫ সালে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে সোসাইটির কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেন। মনে পড়তে পারে, রামলাল চাকরের ইংরেজি শেখানো। সেটা স্রেফ মাঠে মারা গিয়েছিল। বহু আমন্ত্রণ সত্ত্বেও কোনও দিন দেশের বাইরে যাননি অবনীন্দ্রনাথ।

শিক্ষক অবনীন্দ্রনাথকে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনি। তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র নন্দলাল বসু উমার তপস্যা নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটা দেখে অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন ‘‘এত রং কম কেন? আর কিছু না কর উমাকে একটু চন্দন, ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দাও।’’ ছবি হাতে নন্দলাল ফিরে গেলেন। তবে সারা রাত অবন ঠাকুরের ঘুম হল না। মনে মনে ভাবলেন কেন তিনি নন্দলালকে এমনটা বললেন। সে হয়তো উমাকে সেই ভাবে দেখেনি। তপস্যায় রত উমা কেনই বা ফুল-চন্দনে সাজবে? পর দিন ভোর হতেই তিনি ছুটলেন ছাত্রের ঘরে। দেখলেন রং তুলি হাতে নন্দলাল ছবিটিকে বদলানোর কথা ভাবছেন। তাঁকে আচমকাই থামিয়ে বললেন, ‘‘তোমার উমা ঠিকই আছে।…আর একটু হলেই ভাল ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিলুম আর কী’’। শিক্ষক হিসেবে এমনটাই অবনীন্দ্রনা‌থ। নিজের ছাত্রের কাছে নিজের ভুল স্বীকার করতে তাঁর এতটুকুও সংকোচ ছিল না।এক দিন সে কালের প্রখ্যাত শিল্পী রবি বর্মা জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি দেখতে। অবন ঠাকুর সেই সময় অবশ্য বাড়িতে ছিলেন না। কোনও একটা কাজে বাইরে বেরিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের ছবি দেখে রবি বর্মা খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন ‘ছবির দিকে এর ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল।’ তেমনই লর্ড কার্জন এক সময় অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি কিনতে চেয়েছিলেন।

আর একটা জরুরি কথা হল, ছবি আঁকার ক্ষেত্রে এক এক সময় এক এক পথে হেঁটেছেন অবন। কাগজ, কাপড়, কাঠ— ব্যবহার করেছেন হরেক মিডিয়াম। হাতের কাজ তো ছিলই। বলা ভাল, পুতুল খেলা। সেই পুতুল তাঁর নিজেরই বানানো। পথ চলতে চলতে জড়ো করতেন টুকরো কাঠ, বাঁশের গাঁট, নারকেলের মালা, সুপুরিগাছের খোলা। সে সব দিয়েই তৈরি হয়ে উঠত চিল, বাঘ, কুকুর, হরিণ, উট, কুটির, সৈনিক, এমনকি রবীন্দ্রনাথও। নাম ‘কুটুম-কাটাম’। কিছু কেটেকুটে গড়ে নেওয়ার ব্যাপার ছিল না। শিল্পী খুঁজে বেড়াতেন, কোন গাছের গুঁড়ি কুকুরের মুখের মতো দেখতে কিংবা কোন বাঁশের গাঁট দিয়ে সারসের ঠোঁটের আদল তৈরি হতে পারে। তার পরে সেগুলো কুড়িয়ে এনে কিছু একটার উপরে বসিয়ে সাজানো। ব্যস, পুতুল তৈরি!

এক দিনের গল্প বললে পদ্ধতিটা আর একটু বিস্তারে বোঝা যাবে। আমগাছের একটা মোটা ডাল ভেঙে পড়ল মাটিতে। অবনীন্দ্রনাথ দেখলেন, সেটা দেখতে বেশ বড় পাখির মতো। কুড়িয়ে নিলেন। অন্য ক’টা ডাল দিয়ে বানালেন একটা স্ট্যান্ড। এক কোণে মোটা ডালের অংশটাকে বসিয়ে দিলেন। পিছন ফিরে রইল সেটি। দূর থেকে দেখে মনে হল, একটা চিল গাছের ডালে পিছন ফিরে বসে আছে। কল্পনাকে খেলানোর জন্য অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েই হল সৃষ্টি।

অবনীন্দ্রনাথের সামনে যে কাঠের টেবিলটা থাকত, তার উপরে ছড়ানো থাকত এই সব গুচ্ছের কাঠকুটো। রাজার মুকুটের জন্য সিগারেটের রাংতা, বিয়ের কনের নোলকের জন্য কাচের পুঁতি— এই রকম সব জিনিস। সঙ্গে করাত, ছুরি, লোহার কাঁটা, হাতুড়ি-বাটালি। কিছু জোড়া দিতে গেলে কাজে লাগত সেগুলো। ‘কুটুম-কাটাম’ প্রসঙ্গে ‘ঘরোয়া’তে লিখেছিলেন, ‘‘সেদিন আমার পুরোনো চাকরটা এসে বললে, বাবু, আপনি এ-সব ফেলে দিন। দিনরাত কাঠকুটো নিয়ে কী যে করেন, সবাই বলে আপনার ভীমরতি হয়েছে। আমি বললুম, ভীমরতি নয়, বাহাত্তুরে বলতে পারিস, দুদিন বাদে তো তাই হবে। তাকে বোঝালুম, দেখ, ছেলেবেলায় যখন প্রথম মায়ের কোলে এসেছিলুম তখন এই ইট কাঠ ঢেলা নিয়েই খেলেছি, আবার ঐ মায়ের কোলেই ফিরে যাবার বয়স হয়েছে কিনা, তাই আবার সেই ইট কাঠ ঢেলা নিয়েই খেলা করছি।’’

তাঁর নিজস্ব শিল্পধারা ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয়। তার জীবদ্দশাতেই তাঁর শিল্পধারা দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক সময় কলকাতা প্লেগে আতঙ্কে ভুগছিল। চারদিকে মহামারির আকার ধারণ করেছিল। সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও বাড়ির সকলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথ ও সিস্টার নিবেদিতা বিভিন্ন পাড়ায় ইনস্পেকশনে যেতেন। কিন্তু সেই প্লেগ ঢুকল অবন ঠাকুরের নিজের ঘরে। ছিনিয়ে নিয়েছিল তাঁর ছোট্ট মেয়েটিকে। সেই শোক ভুলতে কিছু সময়ের জন্য জোড়াসাঁকো ছেড়ে তাঁরা চৌরঙ্গীর একটা বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে বেশ কিছু পাখি পুষেছিলেন। সেই সময়ে এঁকে ছিলেন ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ সেই বিখ্যাত ছবিটি। অবনীন্দ্রনাথের কথায়,

“মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।”

অবনীন্দ্রনাথ ছবি লিখতেন আর কথা আঁকতেন— কথাটা সাহিত্য-সমালোচক মহলে পরিচিত। সেই অপরূপ গদ্যের শুরুর দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিকা তাঁকে এক দিন বলেছিলেন, ‘‘অবন, তুমি লেখো-না,—যেমন ক’রে মুখে মুখে গল্প ক’রে শোনাও, তেমনি ক’রেই লেখো।’’ সাহসে কুলোয়নি প্রথমটায়। রবিকা ভরসা দিলেন— ‘‘তুমি লিখে যাও, আমি তো আছিই। ভাষার কোনও দোষ হ’লে তার ভার আমার ওপরেই না-হয় ছেড়ে দিয়ো, শুধরে দেবো।’’ উৎসাহ পেয়ে লিখে ফেললেন ‘শকুন্তলা’। ‘‘এক নিবিড় অরণ্য ছিল। তা’তে ছিল বড় বড় বট, সারি সারি তাল তমাল, পাহাড় পর্ব্বত, আর ছিল— ছোট নদী মালিনী।’’ অনাবিল গল্প বয়ে চলল এ ভাবেই। রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া পড়লেন। কিচ্ছু কাটলেন না। অবনীন্দ্রনাথ বল পেলেন— ‘‘আমিও তাহ’লে গল্প লিখতে পারি।’’ একে একে লিখলেন ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূতপত্নীর দেশে’।

ছোটদের জন্য লিখতেন সরল মধুর ভাষায়। আবার বড়দের জন্য লিখেছিলেন ‘বাংলার ব্রত’, ‘কথিকা’, ‘আপন কথা’র মতো প্রবন্ধ। সে লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ঘরোয়া’র ভূমিকায় লিখেছিলেন— ‘‘আমার জীবনের প্রান্তভাগে যখন মনে করি সমস্ত দেশের হয়ে কাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া যেতে পারে তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের নাম। তিনি দেশকে উদ্ধার করেছেন আত্মনিন্দা থেকে, আত্মগ্লানি থেকে তাকে নিষ্কৃতি দান করে তার সম্মানের পদবী উদ্ধার করেছেন। তাকে বিশ্বজনের আত্ম-উপলব্ধিতে সমান অধিকার দিয়েছেন।’’ (১৩ জুলাই ১৯৪১) তার আগে এর পাণ্ডুলিপি পড়ে চিঠিও দিয়েছিলেন ভাইপোকে— ‘‘অবন, কী চমৎকার— তোমার বিবরণ শুনতে শুনতে আমার মনের মধ্যে মরা গাঙে বান ডেকে উঠল। বোধ হয় আজকের দিনে আর দ্বিতীয় কোনো লোক নেই যার স্মৃতি-চিত্রশালায় সেদিনকার যুগ এমন প্রতিভার আলোকে প্রাণে প্রদীপ্ত হয়ে দেখা দিতে পারে— এ তো ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্য নয়, এ যে সৃষ্টি— সাহিত্যে এ পরম দুর্লভ।’’ অবনও সেই কথাটা বারবার জানিয়ে এসেছেন— ‘‘গল্প লেখা আমার আসতো না। রবিকা-ই আমার গল্প-লেখার বাতিকটা ধরিয়েছিলেন।’’ তবে রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন তিনি। সে যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে এই গুণ বিরল। অবনীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন নিজস্ব ভাষা।

ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও এই যোগটা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রাঙ্গদা’ শেষ করে অবনকে বললেন, ‘‘অবন, তোমায় ছবি দিতে হবে চিত্রাঙ্গদার জন্যে।’’ অবনীন্দ্রনাথের বাড়িতেই স্টুডিয়ো। চিত্রাঙ্গদার ছবি কেমন হবে, দেখিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের উপরে ভরসা ছিল সম্পূর্ণ। আসলে ছবি নিয়ে এত প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য আর কারই বা ছিল? কারই বা ছিল এমন ভালবাসা?

বস্তুত, অনুরাগীরা যখন তাঁকে ভালবেসে ডাকতেন ‘শিল্পগুরু’, অবনীন্দ্রনাথ নিজে বলতেন, ‘‘নামের আগে কতগুলো বিশেষণ জুড়ে দিলেই কি খুব বড়ো হয়ে যাবো!’’

ঠাকুরবাড়ির প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমীর দিনই প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হত কেননা জন্মাষ্টমীর দিনেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথের ইংরেজি জন্ম তারিখ ৭ অগস্ট। সেই উপলক্ষে এক বার রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে অবনীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের পৌত্র সুমিতেন্দ্রনাথের একটি লেখা থেকে জানা যায়, এতে উপস্থিত ছিলেন নন্দলাল বসু, গৌরী ভঞ্জ, রানি চন্দ, বিনায়ক মাসোজি প্রমুখ। ঠাকুরবাড়িতে বরাবরই জন্মাষ্টমীর দিনে অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করা হত। তবে তাঁর অন্যতম কৃতী ছাত্র মুকুলচন্দ্র দে প্রতি বছর ৭ অগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে জন্মদিন পালন করতেন। অথচ ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট সব কিছু কেমন যেন বদলে গিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেই একটু একটু করে বদলে গিয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়ির সমগ্র আবহাওয়াটা। জমিদারির আয় কমে যাওয়ায় মূলত অর্থনৈতিক কারণেই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে পরিবার এত দিন মিলেমিশে ছিল তা এবার পৃথক হয়েছিল। ১৯৪১-এ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারকে। পরবর্তী ঠিকানা হল বরাহনগরের গুপ্ত নিবাস। এখানেই কেটেছিল তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলি।

ভালবাসা থেকেই সব কাজ করতেন। তাই হয়তো জীবনের প্রান্তভাগে পৌঁছে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আঁকার কাজ এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কাজ করার অনুরোধ করেছিলেন। শিল্পগুরুর জবাব ছিল, ‘‘মনে আর রং ধরে না।’’ এমন ভালবাসা না থাকলে সৃষ্টি কি চিরন্তন হয়?

তথ্যসূত্র:
১- জোড়াসাঁকোর ধারে: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী চন্দ, বিশ্বভারতী (বৈশাখ ১৪১৮)।
২- ঘরোয়া: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রানী চন্দ, বিশ্বভারতী (ভাদ্র ১৪১৭)।
৩- ঠাকুরবাড়ির জানা অজানা, সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১৭) (ফাল্গুন ১৪১৪)।
৪- অবনীন্দ্রনাথ, মনোজিৎ বসু।
৫- শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ, রানী চন্দ।
৬- অবনীন্দ্র রচনাবলী।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ই আগস্ট ২০১৭ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১লা ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই আগস্ট ২০১৮ সাল।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ই ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।
১২- উইকিপিডিয়া।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত