| 20 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে সাহিত্য

ওমেন হ্যাভ নো ফাদারল্যান্ড

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি কবি ও কথাসাহিত্যিক অদিতি ফাল্গুনীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


জার্মান পরিবেশ-নারীবাদী মারিয়া মাইস তার ‘ওমেন হ্যাভ নো ফাদারল্যান্ড’ প্রবন্ধে ইংরেজি ‘নেশন’ শব্দটির মূল খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছেন যে বিজিত জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য রোমক শাসকেরা ‘নেশিও’ শব্দটি ব্যবহার করত। আর খাস রোমকদের জন্য তারা ব্যবহার করত ‘পপুলাস রোমানাস’ বা ‘রোমের অধিবাসী’ শব্দদ্বয়। ‘নেশিও’ শব্দটি আবার ‘নেটাস’ শব্দটি হতে উদ্ভূত, যার অর্থ ‘জন্ম নিয়েছে যে বা জাতক।’

কাজেই ‘নেশিও’ একজন ব্যক্তির জন্মভূমি, গোত্র, এলাকা বা স্বদেশ। শব্দের এই যে শিকড় তা হয়তো অতীতের মাতৃ অধিকারভিত্তিক সমাজ বা সংস্কৃতির অবদান যখন একটি নির্দিষ্ট গোত্র বা সম্প্রদায়ের সবাই সমভাবে সেই গোত্র বা সম্প্রদায়ের সন্তান হিসেবে চিহ্নিত হতো। কিন্তু কালক্রমে জার্মানিসহ ইউরোপের নানা অঞ্চলেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মাতৃ-অধিকারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বা ‘মাতৃভূমি’র ধ্বংসাবশেষের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করল ‘পিতৃভূমি’ আর তার পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাদি। নতুন পরমতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রথমে অভিজাত সামন্তশ্রেণি ও পরে বুর্জোয়ারা ‘নেশন’ শব্দটিকে চয়ন করল ‘রাষ্ট্র’কে জনগোষ্ঠীর অতীত ‘জন্মভূমি’ বা ‘মাতৃ আশ্রয়ে’র প্রতীককে স্মরণ করিয়ে দিতে। মারিয়ার ভাষায়, ‘ফাদার স্টেট হ্যাড টু বি ম্যারেড টু মাদার নেশন।’
ভারতে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় ‘মাতৃরূপী জাতি’কে ‘পিতৃরূপী রাষ্ট্রে’ পরিণত করার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের মতো শক্তিশালী পুরুষ লেখকদের রচনা বিশেষত, ‘বন্দে মাতরম’-এর কথাও উল্লেখ করেছেন মারিয়া। পৌরাণিক কালপর্ব থেকে ভারতে মাতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি বা কালী কি দুর্গার মতো ‘শক্তিময়ী’ দেবীরা কম ছিলেন না। তবু ইউরোপীয় রেনেসাঁর সংস্পর্শে আসতে আসতে নব্য ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় লেখক-চিন্তকেরা সেই ইউরোপীয় নাইটহুডের মতোই ‘মা’/ ‘মাতৃভূমি’/ নারীসত্তা’কে ‘দুর্বল, ফেমিনিন’ হিসেবে দেখল যাকে রক্ষা করবে পুরুষের শৌর্য।
দুঃখিত, নারী বলেই হয়তো অখ- স্বদেশভূমির মানস নির্মাণে পুরুষতন্ত্রের ছায়া নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। জাপানি নারীবাদী লেখক ইয়াভোই আওকি যেমন দেখিয়েছেন কীভাবে মেইজি শাসনামলে তখন পর্যন্ত মাতৃ-অধিকারভিত্তিক ঐতিহ্য ‘ওয়াকোমনোভাদো’ (যে ঐতিহ্য আজও উত্তর ভারতে দেখতে পাওয়া যায়) ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়। কিন্তু মেইজি রাজবংশের যে সময় থেকে জাপানকে পশ্চিমের আদলে নব জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা শুরু হয়, তখন থেকেই পিতৃতান্ত্রিক কনফুসীয় ধর্ম, সভ্যতা ও আলোকায়নের যাবতীয় প্রকল্প হাতে নেওয়া শুরু হয়।
পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানির একত্রীকরণের সময় কীভাবে ‘দরিদ্রতর পূর্ব জার্মানি এবং তার নর-নারী’ হয়ে উঠেছিল একীভূত জার্মানির পশ্চিমাংশের ‘উপনিবেশ,’ সোভিয়েত যুগে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের মোড়কে কীভাবে যুগোস্লাভিয়া বা চেকোস্লোভাকিয়াসহ গোটা পূর্ব ইউরোপীয় ব্লককে অখ- সোভিয়েত এবং খানিকটা স্লাভ স্বাদেশিকতার আওতায় আনা হয় এবং পরে তা ভেঙেও যায় সেসবও মারিয়া আলোচনা করেছেন তার নিবন্ধে। দেখিয়েছেন যে কীভাবে তাতারস্থানের ফৌজিয়া বায়রামোভা লড়াই করছেন একটি মুসলিম পিতৃতন্ত্রের জন্য। নিজে মুসলিম নারী হয়ে। যদিও নারীর জন্য পৃথিবীর কোনো ধর্মই বিধান দেয়নি খুব ভালো কিছুর।
সুসান ব্রাউনমিলার সেই নারীবাদীদের একজন যিনি ভিনদেশি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে (যা জাতিরাষ্ট্রের উত্তেজনার অন্যতম প্রণোদনা) একজন পুরুষের দ্বারা একজন নারীকে ধর্ষণের সঙ্গে সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। অধুনা বিশ্বের র‌্যাম্বো বা ধরা যাক আরও হালের আর্নল্ড সোয়ার্জনিগারের যে মাচো, আগ্রাসী পুরুষ সৌন্দর্য প্রদর্শিত হয়ে থাকে তা নারীকে আরও দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় ইমেজে প্রদর্শন করে। আধুনিক উন্নয়ন ও জাতিরাষ্ট্রের মডেলে নারীর এই নিষ্ক্রিয় সৌন্দর্য ও পুরুষের বীরত্ব…দুটোই প্রদর্শন করা হয় বলে পশ্চিমের আর এক নারীবাদী সিনথিয়া এনলো বলেন।
বন্দনা শিবা, বিখ্যাত আর এক পরিবেশ নারীবাদী, পাওলা বাশেত্তাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে রামকৃষ্ণ এবং শ্রী অরবিন্দর ‘ভারত মাতা’ ছিল ভারতের সব সন্তানের শক্তির আদিরূপ যেখানে আজকের হিন্দুত্ববাদে এই ‘মা’ দুর্বল এবং তাকে রক্ষা করে তার পুরুষ সন্তানেরা। ‘মাসকুলাইজেশন অব দ্য মাদারল্যান্ড’ প্রবন্ধে বন্দনা দক্ষিণ এশিয়ার দুটো এলাকার মডেল উপস্থাপন করেন। পাঞ্জাব এবং শ্রীলঙ্কা। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ এবং শ্রীলঙ্কা নামের জাতিরাষ্ট্র…দুটোই খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এবং খুব দ্রুতই ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতায় শেষ হয়ে যায়। পাঞ্জাবে খালিস্থান আন্দোলনে প্রচুর পাঞ্জাবি নারী অংশ নিয়েছিলেন যদিও আন্দোলনটি ছিল শিখ ধর্মীয় ও অনেকাংশে পুুরুষতান্ত্রিক আন্দোলন। উদার অ্যাজেন্ডার অভাবে সহিংস আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেয়েই এর শেষ হয়। আবার শ্রীলঙ্কাকে শুরুতে বলা হতো ‘দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুর।’ অথচ, ১৯৮৯ সালে সিংহলি-তামিল সংঘাতে ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০০৯-এ রাজাপক্ষে ক্ষমতা নেবার পর প্রভাকরণের মৃত্যু ও তামিল জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার লড়াই চিরতরে গুঁড়িয়ে দেবার নির্মম যজ্ঞ সমাপ্ত হয়।
আমি আমার আলোচনায় মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতীয়তাবাদে’র প্রশ্ন, সংকট নিয়ে আলোচনার আগে- দক্ষিণ এশিয়ার সংকটগুলো আমরা মোটামুটি জানি- বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের কাশ্মীর-ত্রিপুরা-মিজোরাম-আসাম-মনিপুরসহ বিদ্রোহী সেভেন সিস্টার্স, পাকিস্তানে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের সমস্যা, শ্রীলঙ্কার তামিল হত্যাযজ্ঞ প্রভৃতি প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলোকপাতের আগে অন্য দু-একটি কথা বলে নিতে চাই। সেটা হলো জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঠিক কবে থেকে? স্টিভেন ওয়েবার, ডেভিড উডওয়ার্ড এবং জেরেমি ব্ল্যাকের মতো বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করেন যে পঞ্চদশ শতকে রাজনৈতিক অর্থনীতি, পুঁজিবাদ, রাজনৈতিক ভূগোল ও মানচিত্রবিদ্যাই জাতিরাষ্ট্রের সম্ভব করে তুলেছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধিকাংশ তত্ত্বেই জাতিরাষ্ট্রকে উনিশ শতকের ইউরোপীয় ধ্যানধারণার প্রতিফলন মনে করা হয়, যা রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত সর্বজনীন শিক্ষা কর্মসূচি ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়। ইতিহাসবিদেরা অবশ্য গোটা ইউরোপের মাঝে পর্তুগাল ও স্পেনে প্রথম তুলনামূলকভাবে একীভূত একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব দেখতে পান। ফ্রান্সে যেমন এরিখ হবসবম দেখান যে সেই অর্থে ফরাসি জাতিসত্তা গঠিত হবার আগেই ফ্রান্স রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল। উনিশ শতকে ‘দ্রেইফুস ঘটনা’র আগে ফরাসি জাতীয়তাবাদ বলতে তেমন শক্ত কিছুর অবস্থান ছিল না। হবসবম আরও বলেন যে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সময় জনগোষ্ঠীর মাত্র অর্ধেক মানুষ ফরাসিতে কথা বলত আর তাদেরও মাত্র ১২-১৩% মানুষ এটি শুদ্ধভাবে বলতে পারত। ইতালির একত্রীকরণের সময় ইতালীয় ভাষা বলতে পারা মানুষের সংখ্যা ছিল আরও কম। ফ্রান্স ফরাসি ভাষায় অসংখ্য উপভাষা একীভূত হবার সুযোগ দিয়েছে। জার্মানিতে ভল্কিশ্চ আন্দোলন জার্মান জাতিরাষ্ট্র গড়ার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছিল। ১৬৮৪ সালের ‘ওয়েস্টফ্যালিয়া চুক্তি’র সময় থেকে জাতিরাষ্ট্রের ধারণাটি পশ্চিমে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হতে থাকে। তবে প্যান-জার্মান বা প্যান-স্তাভিক আন্দোলনে জাতীয়তাবাদের আড়ালে সূক্ষ্মভাবে বর্ণবাদও পুষ্ট হতে থাকে। জাতীয়তবাদ ও বর্ণবাদের আন্তসম্পর্ক চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ২০ শতকে, জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ ও নাজিবাদ প্রবল চেহারা পায়। জার্মানিতে ‘ভল্ক’ বা জনগণের অংশ হিসেবে সংখ্যালঘুদের আর গণ্য করা হলো না। ইহুদি ও জিপসিদের বরং হত্যাযোগ্য মনে করা হলো। জাতীয়তা আইন নামে নতুন আইন অ-জার্মান সব নাগরিককে নাগরিকত্বের অযোগ্য ঘোষণা করল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আজকের বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক করপোরেশন ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে জাতিরাষ্ট্রের ক্ষয় ধরাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। জি-৭, ন্যাটো, ইউই, আসিয়ান বা সার্কসহ নানা সামরিক বা আঞ্চলিক জোটে বিভক্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবী। আবার সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ব্রেক্সিটও দেখেছি।
ইউরোপে এমনকি অষ্টাদশ শতকেও ধ্রুপদী অনেক রাষ্ট্রই ছিল বহুজাতীয়তাবাদী। অস্ট্রীয়, ফরাসি, হাঙ্গেরি, রুশ বা অটোমান কি ব্রিটিশ এমপায়ারে বহু জাতির মানুষ বাস করত, যাদের শাসন করতেন একজন রাজা, এমপেরোর বা সুলতান। এই মানুষেরা হতো বহু ভাষাভাষী। তবে মূলত এই নানা জাতির ভেতর থেকে একটি জাতিসত্তারই কর্তৃত্ব থাকত এবং তাদের ভাষাই ছিল জনপ্রশাসনের ভাষা। শাসকেরাও সেই জাতিসত্তা থেকেই আসত। আজকের পৃথিবীও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতে হিন্দির দৌরাত্ম্য, বাংলাদেশে পাক আমলে উর্দুকে চাপানোর চেষ্টা, স্পেনে ক্যাটালান ভাষীদের বিচ্ছিন্নতা বোধ বা আজ আমাদের দেশেও আদিবাসী ভাষাগুলোর তেমন কোনো স্বীকৃতি লাভ না করার কথা বলা যেতে পারে। এমনকি বাংলারই নানা উপ-ভাষা সম্পর্কে কতটা সচেতন আমরা? কদিন আগে সিলেটের গ্রামে গিয়ে দেখলাম মধ্যবিত্ত হিন্দু বা মুসলিমের ‘মা’ বা ‘আম্মা’ ডাকের বাইরে গিয়ে সেখানকার গ্রামের হিন্দু-মুসলিম মাকে ডাকে ‘মাঈ’। উত্তর বাংলায় যেমন ‘দাদা/ভাই’য়ের ডিকোটোমি এড়িয়ে রয়ে গেছে মিষ্টি সম্বোধন ‘বাহে’। কিন্তু কতটা গুরুত্ব পায় এই সব ডায়ালেক্ট? মূল প্রসঙ্গে ফিরি। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ ভাষা ছিল মূল ভাষা ও রুশরাই রাষ্ট্রক্ষমতার অধীশ্বর ছিল।

উনিশ শতকে জাতিরাষ্ট্রের বিজয়ের পর থেকে আঞ্চলিক সত্তাকে নানা জায়গাতেই জাতীয় সত্তার অধীন করা হয়। যেমন, স্পেনের ক্যাটালোনিয়া, ইতালির কর্সিকার কথা বলা যায়। ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে পুনরায় জাতিরাষ্ট্রের আওতায় সবকিছুকে কেন্দ্রাভিমুখী করার বিপক্ষে একটি উল্টো হাঁটার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। তবে এটাও সত্য যে আজকের অধিকাংশ জাতিরাষ্ট্রে শতকরা আশি বা নব্বই শতাংশ মানুষই একটি নির্দিষ্ট জাতিসত্তার হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে আলবেনিয়া (৯৮.৬% ভাগ), আর্মেনিয়া (৯৮%), বাংলাদেশ (৯৮%), চীন (৯২%- হান), মিসর (৯৯%), এস্তোনিয়া (৮৮.২%), গ্রিস (০১.৬%), হাঙ্গেরি (৯৫%) এমন বহু রাষ্ট্রের কথাই বলা যেতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত