আজ ১৫ জানুয়ারী কবি শেখর বালার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
নিজস্ব কুড়াল
প্রত্যেক মানুষেরই হাতে আছে নিজস্ব কুড়াল
তাই কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারলে
আর ফিরানোর পথ থাকে না কারো।
কেউ কেউ সে কুড়াল ব্যবহার করে
সাফ করে বিস্তীর্ণ জঙ্গল
আর মানুষের কল্যাণের জন্য তৈরি করে নিরাপদ পথ।
আবার কেউ কেউ মানুষের মাথায় কুড়াল ঠেকিয়ে
লুট করে সর্বস্ব সম্পদ।
কুড়ালকে কোন কাজে ব্যবহার করবে সে বিবেচনা তাই একান্তই তোমার।
হালচাল
আমরা রোজ একটু একটু করে পঁচে যাচ্ছি
গন্ধ সইতে সইতে এখন আর বিচলিত হই না
বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে আমাদের।
আমরা মানে এই আমজনতা
যাদের একটা বড় অংশ এখন ঘৃণার চাষাবাদে লিপ্ত
মাঝে মাঝে গুজব আর ধর্মীয় উসকানি এতে সার তেলের কাজ করে বিধায়
দিকে দিকে বাম্পার ফলন আজ ঘৃণার।
জাতির মনন গঠনে ভূমিকা রাখা
আমাদের কবি ও সাহিত্যিকদের অনেকেই পঁচে গেছেন বেশ ভালোভাবে
তাদেরকে অযাচিত সুবিধার অফার দিলে এখন আর না করতে পারেন না
অন্যায়ের সংগে বেশ আপোষ করতে আজ শিখে গেছেন তারা!
আমাদের রাজনীতি এখন কলুষিত
অর্থ ও গুন্ডামীর কাছে মাথা নত
মূলতঃ ১৫ই আগস্টের পর থেকে রাজনীতি চলে গেছে বিশ্ববেহায়াদের খপ্পরে
আমাদের রাজনীতিবিদেরা এখন পরিনত হয়েছে এক একটা জোঁকার এবং ভাঁড়ারে
নীতি নেই প্রজ্ঞা নেই দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটা নেই
নিজের পকেট ভরায় দক্ষ এরা ভাল।
অন্যের সমালোচনা বেশ তো হল
নিজের দিকে এবার আয়নাটা ধরো…….!
যুক্তিতে নেই, মানবিকতায় নেই, জ্ঞান অন্বেষণে নেই, নেই সমাজ বিনির্মানের কর্মে
সবাই ব্যস্ত খুব অন্যের দোষের খোঁজে!
সামান্য দাবি
রাষ্ট্র তুমি শোষিতরে কথা কইতে দাও
রাষ্ট্র তুমি জুলুমকারীর প্রতি কঠোর হও।
রাষ্ট্র তুমি নির্যাতিতের কথা শুনে যাও
রাষ্ট্র তুমি দরদী হয়ে পাশে দাঁড়াও।
রাষ্ট্র তুমি কবিকে কথা বলতে দাও
রাষ্ট্র তুমি কট্টরপন্থীর বিরুদ্ধে খাঁড়াও।
রাষ্ট্র তুমি লেখককে কথা বলতে দাও
রাষ্ট্র তুমি হাত থেকে খড়গটি নামাও।
রাষ্ট্র তুমি সমকামীর অধিকারটা বোঝো
রাষ্ট্র তুমি বন্ধু হয়ে তাদের পাশে থেকো।
রাষ্ট্র তুমি হিজরাদের কল্যাণে কাজ কর
রাষ্ট্র তুমি তাদেরকে দক্ষ করে গড়ো।
রাষ্ট্র তুমি মানুষকে কথা বলতে দাও
রাষ্ট্র তুমি সবার কথা একবার শুনে যাও।
রাষ্ট্র তুমি মানুষের মুখে লাগাম দিলে
রাষ্ট্র তোমার জনগন বোবা হয়ে যাবে।
রাষ্ট্র তুমি বাউলকে গান গাইতে দাও
রাষ্ট্র তুমি বয়াতিকে মুক্তি দিয়ে দাও।
রাষ্ট্র তুমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঠিক রাখো
রাষ্ট্র তুমি শেখ মুজিবের আদর্শকে মানো।
রাষ্ট্র তুমি ত্রিশ লক্ষ শহীদকে ভুলো না
রাষ্ট্র তুমি প্রতিক্রিয়াশীলদের মাথায় তুলো না।
রাষ্ট্র তুমি সংস্কৃতির চর্চা করে যেও
রাষ্ট্র তুমি বাঙালিত্বের স্মারক মনে রেখো।
রাষ্ট্র তুমি দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দিও না
রাষ্ট্র তুমি মামা খালুর হিসাব ধরো না।
রাষ্ট্র তোমার কালো আইন খারিজ করে দিও
রাষ্ট্র তুমি মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটতে দিও।
রাষ্ট্র তুমি যুক্তিবাদকে লালন করে যেও
রাষ্ট্র তুমি বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্বরোপ করো।
রাষ্ট্র তুমি সবার প্রতি সমান সদয় থেকো
রাষ্ট্র তুমি সাম্যবাদের গানটি গেয়ে যেও।
রাষ্ট্র তুমি উদারতার কথা বলে যেও
রাষ্ট্র তুমি ন্যায়বিচারের পাল্লাটা ঠিক রেখো।
রাষ্ট্র তুমি মানবিকতার স্থান দিও আগে
রাষ্ট্র তুমি বৈষম্যকে পাঠাও নির্বাসনে।
রাষ্ট্র তোমার কাছে আমার এই সামান্য দাবি
রাষ্ট্র তোমার কাছে রইলো ইতিহাসের চাবি।
লোকটির একলা হওয়ার গল্প
একদিন লোকটিকে তার বন্ধু ডেকে নিলো মর্নিং ওয়াকে
হাঁটতে হাটঁতে তারা ক্লান্ত হয়ে দাঁড়ালো এক বুড়ো বটগাছের নিচে
সেখানে ছিলো লাল পিঁপড়াদের বাসা
হঠাৎ একটা পিঁপড়া কামড় বসালো তার পায়ে
আর লোকটি ভেবে নিলো পিমড়ার কামড় খাওয়াতে বুঝি বন্ধুটি ডেকে আনল এই সকালে!
বলে রাখা ভাল, লোকটি পিঁপড়াকে পিমড়া বলে ডাকতো।
একদিন ছোট ভাই
লোকটির দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুললো
জনক জননীর প্রতি তার অবহেলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো
সেই থেকে ভাই তার চির শত্রু হল।
একদিন চায়ের দোকানদার ভুল করে তার কাপে
চিনি দিল বেশি
ডায়াবেটিসের রোগী সেই থেকে দোকানের ছায়া মাড়ালো না আর।
একদিন পাড়ার বড় ভাই
লোকটির গর্জন তর্জন শুনে কাছে এসে কয়
নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত কর
আগে একটা চাকরি তো জোটা
চাচার উপর থেকে বোঝাটা কমা
তারপরে লেকচার দিস লম্বা লম্বা।
সেই থেকে দাদার সাথে লোকটি আর কথা বলে না।
একদিন বস তাকে
অফিসের প্রয়োজনে ছুটি দেয় নাই
উপরন্ত কটু কথা শোনালো বেশ কিছু
ঝিম মেরে বসে থাকার জানতে চাইলো কারণ
সেই থেকে বসের সাথে আর কথা নাই।
গতবছর ভাবী আর তার বোনকে
কী সুন্দর পাঁচখান শাড়ি তুমি কিনে দিয়েছিলো!
আসছে বৈশাখে ওইরকম একখান বৈশাখী শাড়ি আর রেশমি চুড়ি আমার চাই ই চাই।
এই আবদার জানিয়েছিলো সবার ছোট বোন
বড় ভাইয়ের সংসারে এই বিল পাস হয় নাই।
সেই থেকে ছোটবোনের সাথে লোকটি কথা কয় না।
একদিন পিতামাতা খাবার টেবিলে বসে
কথায় কথায় জানতে চাইলো
খোকা, বেতন পাও কত?
এই অপরাধে লোকটি পিতামাতাকেও করল পরিত্যাজ!
একদিন প্রিয়তম স্ত্রী তার
কোন এক উছিলায় ঝগড়া করে শুরু
তারপর একদিন সময় সুযোগ বুঝে
সোনা দানা টাকা পয়সা বেবাক নিয়ে
এক পরদেশী যুবকের হাত ধরে পালাইলো সূদুর।
অন্যের কথা ঠিক পছন্দ না হলে কিংবা
পান থেকে চুন খসার সামান্য দোষে
অনেকেই আপনজন করে পরিত্যাগ।
একসময় চেয়ে দেখে কেউ পাশে নাই!!
এভাবেই কেউ কেউ একা হয়ে যায়।
সেন্সরশিপ
মায়ের সামান্য কথায় একদিন
নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো দূরদেশে চাকরি করা যুবক সন্তান
সেই খবরে মা তো পাগল প্রায়-
খাওয়া নাই নাওয়া নাই দুই চোখে ঘুম নাই
শুধুই ক্রন্দন আর বিলাপ সংগীত।
ফিরে আয় মানিক তুই ফিরে আয় ঘরে
আমি তোরে আর কিছু কইতাম না
আমি তো জানতাম না রে খোকা… ও খোকা
বাড়িত আইবার কইলে তর মন বেজার হয়
যতই পরাণডা পোড়ায় দেখতি মন চায় তবুও কইতাম না রে তোরে আবার বাড়িত আয়
এইসব প্রলাপ বকে আর মূর্ছা যায়।
প্রতিবেশীরা কয়, না খাইয়া মরবা নাকি বৌ?
মা হিংস্র চোখে তাদের দিকে চায় আর কয়-
মইরা গেইলে মরুম….
তোমরা আমারে ক্যান খাইবার কও?
আমার পোলার খবর না পাইয়া কিছু খাইতাম না
আমার যাদুর খবর না পাইয়া ঘুম যাইতাম না
আমার সোনার খবর না লইয়া আমি মরুম না
আমারে তোমরা ক্যান বিরক্ত করতাছো
তোমরা আমারে ক্যান জ্বালায়া মারতেছো
একবার চক্ষু বুইজা তারে দেখতি দাও
আমার খোকারে দেইখা পরাণডা জুড়াই
একবার তার গায়ে হাতটা বুলাই।
ছোটবেলায় খোকা তুই কত ভাল ছিলি
কোল থাইকা কখনও নামতে না চাইতি
আজ তোর পাখা হইছে লম্বা হইছে পা
তাই আমারে আজ দাগা দিয়া গেলি
কোন সুদুরে গিয়া নিজেরে লুকাইলি।
মূর্ছা গেছে মা আবার ডাক্তার এলো ঘরে
স্যালাইন আর ঘুমের বড়ি চলতেছিল ধীরে।
অবশেষে একদিন খোকা ফিরে আসে
মায়ের আহাজারি সেইদিন থামে।
তারপর বহুদিন পরে…
সন্তান ফোন দেয়-
মা, কেমন আছো?
মা কয় ভাল আছি তোমরা ভাল তো?
ঠিকমত খাইয়ো দাইয়ো আর ভাল থাইকো।
মায়ের আরো কত কথা ছিলো বলা হয় নাই,
আরো কত গল্প ছিলো বলা হয় নাই
তোর পিতার শরীর ভাল নাই জ্বর হয় খালি
তা বলা হয় নাই
আমার শরীরেও বাঁধছে নানা রোগে বাসা
পেয়ারা গাছে পেয়ারা হইছে বড় ডাসা ডাসা
সেইসব কথা আর বলা হয় নাই।
কতদিন দেখিনা খোকা ওরে বাছাধন বাড়িতে আইসো
সেই সব কথা আর বলা হয় নাই
মনে সদা ভয়-
যদি খোকা আবার কোনো কথায় কষ্ট পাইয়া দূরে চলে যায়!
এইভাবে মা বাবা ভাইবোন স্বজনের প্রতি
কতজনে আরোপ করে নিষ্ঠুর সেন্সরশিপ কালো সব আইন।
কুলাঙ্গার সন্তানেরা সে খবর রাখে না!