অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একশ বছরে সাম্যবাদী বাঙালিনী
কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সেকালের বাঙালি মেয়েদের অনীহার কারণ ছিল প্রধানত তিনটি— এটা একটা ধর্মদ্রোহীদের আখড়া, স্বাধীনতা সংগ্রামে এদের অংশগ্রহণ কোথায় আর সেই তো মজুর খেপানো ধর্মঘট। এ ছাড়া পার্টিটা আর করে কী!
স্বাধীনতা সংগ্রামের অভূতপূর্ব জোয়ারে খালবিল নালাকে পেছনে রেখে বাঙালি মেয়ের প্রথম রাজনীতির অকূল গাঙে ভাসা, ইষ্টদেবীকে পূজা করে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আকুলতা তার স্বপ্নে, নিদেনপক্ষে গান্ধিজির আবেদনে সাড়া দিয়ে দেশমাতৃকার চরণে গায়ের গয়না খুলে দেবার আত্মোৎসর্গে সে বিশ্বাসী, তার কাছে ধর্মহীন, শ্রেণিহীন সমাজের গল্প পানসে ও উদ্ভট ঠেকবে এটাই স্বাভাবিক।
জননেত্রী মণিকুন্তলা সেন এই ডিলেমাটিকে অননুকরণীয় ভাষায় বর্ণনা করেছেন তাঁর আত্মজীবনী সেদিনের কথায়—হোস্টেলে বসে সেদিনের সেই মার্ক্সসিজম পড়ার ক্লাসে এত রাগ হয়েছিল। ভগবানের সঙ্গে কেন কমিউনিজমের এই ঝগড়া? প্রচারের এই উল্টো পদ্ধতির কথা ভাবলে এখনও আমার রাগ যায় না কেন? কমিউনিজমের অর্থনীতি, শ্রমিকের ধর্মকেও যে বিভাজনের সবচেয়ে ধারালো হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায় একথা জানতে হলে মণিকুন্তলাকে বিজেপির ভারতে বাস করতে হত, যেখানে প্রতিমুহূর্তে নাগরিকের মাথার পরে ঝুলছে ডেমোক্লিসের খাঁড়ারূপী এনআরসি, যার ভিত্তিই হচ্ছে ধর্ম। তবে একথা তো ঠিক কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ প্রাপ্তির নিয়মাবলীতে কোথাও লেখা নেই আবেদনকারীকে ধর্মত্যাগী বা নাস্তিক হতে হবে। কোনও দেশেই না। বরং ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৯২তে কিউবানদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববিহীন ধর্মাচরণের অধিকার স্বীকার করে নিলেন। নিজের নাস্তিক বিশ্বাসে তিনি ছিলেন আমৃত্যু অবিচল, কিন্তু জীবনের শেষে ধর্মকে কাস্ত্রো দেখছেন বহুস্তরীয় সামাজিক চৈতন্যের মিলনস্থল হিসেবে। তাঁর উপলব্ধি হয়েছে বিশ্বাসীর খিল্লি না উড়িয়ে ধর্মবিশ্বাসকে মৌলবাদের টক্সিক এলিমেন্ট থেকে আলাদা রাখতে পারলে তা মানুষকে অনেক নীচতা থেকে মুক্তি দেয়।
ফিদেলের এই এষণা গভীর পর্যালোচনাযোগ্য, বিশেষত আজকাল অন্তর্জালে একধরনের দায়হীন ফ্রি লেফটের দাপটে বামপন্থার ল্যাজামুড়ো আলাদা করে চিনবার সুযোগ যখন ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে। যাই হোক, প্রথম কমিউনিস্ট পার্টিতে আসেন যে বাঙালি মেয়েরা তাঁরা এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব পার হয়েই এসেছিলেন এইটাই বড় কথা। বামপন্থী হওয়া তাদের কাছে কোনও ফ্যাশনদুরস্ত হুজুগ ছিল না। ভার্চুয়াল বিশ্বে নিরাপদ দূরত্বে বসে মেঘনাদ হয়ে তির নিক্ষেপের কোনও সুযোগ তাঁরা পাননি। বরং বহু যুগের সঞ্চিত সংস্কার, পিতৃতন্ত্র দ্বারা নির্দিষ্ট ভূমিকা, নানা মানসিক ও সামাজিক অভিঘাত ইত্যাদিকে পেছনে ফেলেই এগিয়েছিলেন। আর তাঁদের লড়াই ছিল মাঠে ময়দানে। সময়ের নিরিখে তাঁরা বহুযোজন এগিয়ে থাকা মানুষ, যাঁদের তুলনা কমই মেলে। তাই নানা লক্ষ্মণরেখা পেরিয়ে এদেশে নারী আন্দোলনের ঢেউকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, একথা বললে অতিশয়োক্তি হয় না মোটেই।
বামদলগুলির দুর্দিনেও, যখন বামেদের সাইনবোর্ড করে দেওয়া গেছে বলে তুমুল চেঁচামেচি ও হাসাহাসি, তখনও কিন্তু সবচেয়ে বড় বামদলটির মহিলা সংগঠনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষ। পরম্পরা বহু পুরনো না হলে এরকম হবার কথা নয়। অবিভক্ত বাংলার প্রথম বৃহত্তম মহিলা সংগঠন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির (১৯৪৩) উজ্জ্বল উত্তরাধিকার প্রমাণ করে এই তথ্য। এই সমিতির গোড়াপত্তন হবার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কালে কালে দেশভাগ পার্টিভাগের মতো বিশাল বিপদ বিড়ম্বনাকে পার করার পরও সমিতি কাজ করে যাচ্ছে, শুধু নামটা অন্য। ওই ১৯৪৩ সালেই সমিতির প্রথম সম্মেলন, গঠনতন্ত্র ইত্যাদি রচিত হয়ে গেলেও দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সমিতিও দু টুকরো হয়ে গেল। পূর্ববঙ্গে আর তেমন জানান দিতে না পারলেও পশ্চিমবঙ্গীয় টুকরোটির নাম হলো পশ্চিমবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। ১৯৫৯এ আত্মরক্ষা তুলে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি। কিন্তু আত্মরক্ষার বিলোপ হয়তো অন্যভাবে প্রভাবিত করে থাকবে বিভাজিত কমিউনিস্ট পার্টিকে, কারণ এরপরই ১৯৭০ সালে এল গণসংগঠনগুলির আভ্যন্তরীণ বিভাজন। তাই পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির পাশাপাশি এল এবং এখনও কাজ করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি।
আলোচনা মূলত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্বিভাজনের আগে অব্দি আটকে রাখতে চাইছি বলে দেখে নেওয়া যাক মহিলা আত্মরক্ষা কমিটির অনুপ্রেরণায় কী কী ঘটেছিল, কারাই বা ছিলেন সামনের সারিতে।
ভয়ঙ্কর সময় তখন। একদিকে রোজ মানুষ শুনছে হিটলারের দানবীয় কার্যকলাপের কথা, অন্যদিকে অবিভক্ত বাংলাদেশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে মারাত্মক দুর্ভিক্ষে। গ্রাম ছেড়ে অগুন্তি মানুষের শেষ যাত্রা শহরের বাঁধানো ফুটপাথে। সেই বোধহয় ফুটপাথে সংসার পাতার শুরু। সৈন্যদের জন্য চাল মজুত করছে সরকার, আর অতিরিক্ত মুনাফার জন্য তা মজুত করছে চোরাকারবারিরাও। দুই মজুতের গর্ভে পড়ে বাজারে একদানা চাল নেই। তাই রব উঠল ফ্যান দাও। এইসময় পার্টির নির্দেশে সমস্ত সদস্য ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফ্যাসিবাদের স্বরূপ চেনাতে এবং মুমূর্ষু ক্ষুধাতুরের সেবাকার্যে।
বামকর্মীদের এই নিরলস প্রচেষ্টার পাশে কংগ্রেসকে সক্রিয়ভাবে পাওয়া যাক না যাক সাধারণ মানুষ দলে দলে এসে দাঁড়াল। চাঁদার টাকায় পাড়ায় পাড়ায় ক্যান্টিন খোলা হতে লাগল। কিন্তু চালই যখন বাড়ন্ত তখন ক্যান্টিনে কী পরিবেশন করা হবে!
এই ইস্যুতেই মহিলা আত্মরক্ষা কমিটির ফর্মাল আত্মপ্রকাশের আগেই বাঙালি মেয়েদের এক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধল। চালের দাম কমানো এবং রেশন দোকান খোলার দাবী নিয়ে তারা অ্যাসেম্বলিতে চড়াও হলেন। সামনে বামনেত্রীরা। টাউন হলে বিশাল জনসভার পর ট্রামে চড়ে হাজার হাজার মহিলা অ্যাসেম্বলিমুখো হলেন। তাঁদের কাছ থেকে ট্রাম শ্রমিকরা একপয়সা ভাড়াও নিলেন না।
পাঁচ হাজার মহিলার বিপুল তরঙ্গ কে রোধ করবে! অচিরেই তাঁরা হতভম্ব ফজলুল হকের সামনে আঁচলে বাঁধা পয়সা দেখিয়ে বলতে লাগলেন মজুতপূর্ব দামে তাদের চাল কেনার অনুমতি দেওয়া হোক। নাহলে হকসাহেব অন্যান্যদের নিয়ে আইনসভা থেকে বেরোতে পারবেন না। প্রচণ্ড বাদানুবাদের পর চালভর্তি লরির আগমন এবং প্রত্যেক মহিলাকে বিনা পয়সায় ২ সের চাল দেওন। এই নারী আন্দোলনের প্রাপ্তি কলকাতায় ১৬টি ন্যায্য দরের দোকান খোলা এবং সরকারি ক্যান্টিনের পত্তন।
ডাক্তার মৃগেন্দ্রলাল মিত্রের কন্যা এলা রিডের সযত্ন নেতৃত্ব তো ছিলই, ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী, নেলি সেনগুপ্তা, প্রভাবতী দেবীসরস্বতী, রানি মহলানবিশকে মহিলা আত্মরক্ষা কমিটির সভানেত্রী ও অন্যান্য গুরুত্ববহ পদে দেখা গেল। রাজ্য সম্মেলনের আগে কার্যকরী সমিতির সভানেত্রী হলেন লীলা মজুমদার। মাসিক পত্র ‘ঘরেবাইরে’ আত্মপ্রকাশ করল। মেয়েরাই লেখেন, ছাপেন, মেয়েরাই বিক্রি করেন, বিজ্ঞাপন যোগাড় করেন। সেই পরম্পরা আজও প্রবহমান।
কলকাতা শুধু নয়, জেলায় জেলায় সংগঠিত হতে লাগল খাদ্য সম্মেলন, ভুখ মিছিল। মেয়েদের অংশগ্রহণ দেখবার মতো। বাঁকুড়ায় শ্রমিক ও কৃষক মেয়েদের নেতৃত্বে ভুখ মিছিল, ফরিদপুরে সামিল প্রায় ২০০০ মহিলা। ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিতে বাধ্য হন বাজারে যত ধানচাল আছে সব খাদ্য কমিটির সহায়তায় বার করে ১০ টাকা মণ ধান ও ১৫ টাকা মণ চাল দরে বিক্রি করা হোক। গণ আন্দোলনে ফেটে পড়ল ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালি, রাজশাহী, জলপাইগুড়ি।
তেভাগা আন্দোলনের কৃষক রমণীরা
কলকাতায় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির রাজ্য সম্মেলনে কারা সভানেত্রী ইত্যাদি পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তা আগেই উল্লেখ করেছি। জেলা কমিটির সম্পাদকের তালিকায় ছিল এইসব নাম— অনিলা দেবী, বীণা সেন, নিবেদিতা নাগ, বিভা দত্ত (কোনার) ইত্যাদি। মণিকুন্তলা সেন, যুঁইফুল রায়, কমলা চ্যাটার্জি, সুধা রায়, কনক মুখার্জি, নাজিমুন্নেসা আহমেদ এবং আরও অনেকের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাঙালি মেয়েদের নিজস্ব গণসংগঠন গড়ে উঠল।
ছাত্র ফেডারেশন অনেক আগেই গঠিত হয়েছিল। সাম্যবাদী আদর্শ ছাত্রীদেরও প্রবল আকর্ষণ করেছিল। পার্টিতে যোগ দেবে মেয়েরা এই ইচ্ছা ব্যক্ত করতেই পরিবারের সঙ্গে প্রবল সঙ্ঘাত। যে ইচ্ছাশক্তি এবং দুর্মর সাহস দিয়ে মেয়েরা জয়ী হয়েছিলেন দেশকালের বিচারে তা অনন্য। কনক মুখোপাধ্যায় এবং বেলা চ্যাটার্জি ছিলেন এঁদের পুরোধা। পার্টির হোলটাইমার হয়ে গোপন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং টিউশনি ইত্যাদি ছোটখাটো কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কঠিন জীবন এঁরা এবং আরও অনেকে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হয়েও স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন।
সব শুরুর যেমন একটি শুরু থাকে, তেমনি ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একশো বছরে মেয়েদের ভূমিকার পর্যালোচনায় চলেই আসে কিছু পূর্বজার কথা যাঁরা বিশ বা ত্রিশের দশকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং নানা সমাজসেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পরে এঁদের অনেকে এবং অনুশীলন, যুগান্তরের মতো বিপ্লবী দলগুলি থেকে অনেক মহিলা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। আবার অনেকেই খোলাখুলি পার্টিতে যোগ না দিলেও পার্টিদরদী এবং অসাধারণ কর্মী ছিলেন। নারী আন্দোলনের ভিত তৈরিতে এদের অবদান ভোলার নয়। এই পথিকৃতদের মধ্যে উজ্জ্বল বরিশালের মনোরমা বসু, সবার মাসিমা।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যে বালিকাবধূটি অংশ গ্রহণ করেছিল সারা জীবন সে আর পেছন ফিরে তাকায়নি। অশ্বিনীকুমারের শিষ্যা মনোরমা কালক্রমে হয়ে ওঠেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেত্রী। কতবার জেল খেটেছেন। সংসার সামলে তিনি আবার শিশু, বয়স্ক বিদ্যালয়ের পরিচালিকা, নিজের গৃহে প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দিরের সর্বেসর্বা। মাতৃমন্দিরে বরিশালের সংসার পরিত্যক্তা অথবা বিপথ থেকে ফিরে আসা মেয়েদের মা তিনি। সেখানে তারা থাকত মুক্ত এবং স্বাধীন। আরও আছে বস্তি উন্নয়নের কাজ। কমিউনিস্ট হবার পর পার্টির জন্য অর্থ সংগ্রহ, সর্বক্ষণের কর্মীদের খরচ চালাবার জন্য বাড়ি বাড়ি মুষ্টিভিক্ষার ঘট বসানো, সবেতেই আছেন মনোরমা বসু। দেশভাগের পরও তিনি মুসলমান নারীদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনোরমার মাতৃমন্দির পাক সৈন্যেরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশ সরকার এবং সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। শোনা যায় মুক্তিসেনারাই কাঁধে তুলে অশক্ত মাসিমাকে বহুদূরের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছিল।
কমিউনিস্ট পার্টি সঠিকভাবেই ব্যক্তিপূজার বিরোধী, কিন্তু মনোরমা বসু, ইলা মিত্রের মতো দু একজনের বিশেষ উল্লেখ না থাকলে বোধহয় বঙ্গীয় নারী আন্দোলনের ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হয় না।
মেয়েদের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান বাংলার সাংস্কৃতিক চালচিত্রকেও পালটে দিয়েছিল। পরিবর্তিত গণ সংস্কৃতির জোয়ারে নারী পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণে পুষ্ট হল লেখক শিল্পী সঙ্ঘ, গণনাট্য সঙ্ঘ। বিদগ্ধ শিল্পী সাহিত্যিকদের সঙ্গে সাধারণ মেহনতি মানুষ, ছাত্রছাত্রী, নারীপুরুষ— সত্যিকার জনজোয়ারে ভেসে গেল বাংলার সংস্কৃতি। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কলিম শরাফি, শম্ভু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শোভা সেন, তৃপ্তি মিত্র, সুচিত্রা মিত্ররা তো ছিলেনই, নবান্ন নাটকে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে অভিনয় করে ফেললেন নেত্রী মণিকুন্তলা। চিত্তপ্রসাদের স্কেচে বা শক্তিময় রেখায় অমর হয়ে রইল ক্ষুধাতুর হতভাগ্যরা অথবা শকুন চিলে ঠোকরানো তাদের মৃতদেহ। সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল, শেফালী নন্দী প্রমুখেরা নতুন চালে সাহিত্যচর্চা করতে শুরু করলেন। তারাই পরবর্তীতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যের সৃষ্টির পরোক্ষ ধাত্রী মাতা। শহিদ হলেন কথাশিল্পী সোমেন চন্দ। সব মিলিয়ে সে এক মহা ডামাডোলের অথচ চূড়ান্ত সৃষ্টিশীলতার সময়। গণ আন্দোলন এবং গণ সংস্কৃতির এইরকম হাত ধরাধরি বিকাশ বাংলার মাটিতে আর কখনও ফিরে আসেনি।
ধর্মীয় পরিচয় একজন কমিউনিস্টকে গলা বাড়িয়ে জানান দিতে হয় না। কিন্তু গেরুয়া ভারতবর্ষে ধর্মান্ধরা আকছার জানতে চায় স্বাধীনতা সংগ্রামে বা অন্য আন্দোলনের ইতিহাসে সংখ্যালঘুর অবদান কী। এই সুযোগে সত্যমিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদেরকে অপদস্থ করার চেষ্টা আর কী! বাংলায় শুধু নয় গোটা দেশেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে কিন্তু এই ধর্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা সবসময় জারি আছে। এর শুরুই হয়েছিল নানা ধর্মের নারীপুরুষদের চেষ্টায়। মুজফফর আহমেদ পরিষ্কার ভাষায় লিখে গেছেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি পত্তনের ইতিহাস— তাসখন্দে মানবেন্দ্র রায়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুহম্মদ আলি (আহমদ হাসান), মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকি, এভেলিনা ট্রেন্ট রায়, রোজা ফিটিংগোফ, এ মুখার্জি। হয়তো একথা ঠিক যে কমিউনিস্ট পার্টির পর্যালোচনায় জাতিসত্তার রাজনীতিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। তার লিঙ্গনিরপেক্ষ শ্রেণিসংগ্রাম মেয়েদের বিশেষ সমস্যা অগ্রাহ্য করেছে এবং সেই কারণেই নারী আন্দোলনের যুগোপযোগিতাকে বাম অভিমুখী করে তোলায় খামতি রয়ে গেছে। এখন সে প্রচেষ্টা চললেও তা যথেষ্ট নয়। তবু ইদানীংকালে নারীমুক্তির অনেক অচেনা দিক নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। ফিদেল কাস্ত্রো লাইনে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল এসেছে। কিন্তু পার্লামেন্টে নারীর অংশগ্রহণের আনুপাতিক হার বা পার্টিতে নারীনেতৃত্বের অবস্থানের তেমন কোনও পরিবর্তন এখনও আসেনি। এই পর্যন্ত মানা যায়, কিন্তু পার্টি সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট এই অপবাদ চরম দক্ষিণপন্থীও দেবার আগে দুবার ভাবে। বরং তোষণ নীতির মতো একটি বায়বীয় দোষারোপ করবার প্রবণতা দেখা যায়।
এই অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির শেকড় কিন্তু অনেকদূরে প্রোথিত। কমিউনিস্ট পার্টিতে যে মেয়েরা আসতেন অসাম্প্রদায়িকতা ছিল তাদের সহজাত কবচ-কুণ্ডল। ঘোষিত নীতি এবং প্র্যাকটিসও তাই ছিল। এই ঘোষিত অসাম্প্রদায়িক নীতির চর্চার ফলেই আত্মরক্ষা সমিতি হিন্দু মুসলমান নারীর যৌথ প্রতিষ্ঠান রূপে দ্রুত স্বীকৃতি পায়। দুর্ভিক্ষের সময়, মণিকুন্তলা সেন লিখছেন, মনোরমা বসুর নেতৃত্বে তারা চাঁদা তুলছেন তিনশো মেয়ের জন্য লঙ্গরখানা খুলবেন বলে। এক ব্যবসায়ী চাঁদার খাতা দেখে বলে উঠলেন, আপনারা হিন্দু মুসলমান মেয়েদের একসাথে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন, আপনাদের চাঁদা দেব না। এ কথায় মনোরমা বসুর জ্বলন্ত মূর্তি মণিকুন্তলা সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। তিনি ব্যবসায়ীটিকে বললেন, কী বলছেন আপনি! এ জেলায় শতকরা ৮০ জন মুসলমান আপনি জানেন না। ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ করতে বলেন আপনি! আপনি চাঁদা দিলেও নেব না।
তারপর আর কেউ এমন প্রশ্ন তোলেনি। মুসলমান ও হিন্দু মেয়েরা একসঙ্গে রাঁধা খাওয়া সবই চালিয়ে গেছে।
বন্দিমুক্তি আন্দোলনও কমিউনিস্ট পার্টির নারীকর্মীদের মুকুটে আর একটি পালক। সাব কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলেন বিমল প্রতিভা দেবী। কর্মীদের ওপর নির্দেশ ছিল কংগ্রেস অকংগ্রেস হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলকে একই মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করা। অনেক সাধারণ মুসলমান মেয়ে, আবার তৎকালীন মন্ত্রী মনসুর হাবিবুল্লা সাহেবের বাড়ির সদস্য রাবেয়া, মাকসুদা, সামসুন নাহার, পাশের বাড়ির কবি সুফিয়া কামাল সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির ছায়ায় ছিলেন। গৃহকর্তারা ন্যাশনালিস্ট হলেও ছেলেমেয়ে, বধূ বামপন্থী হয়েছেন। কড়া পর্দাপ্রথার বাইরে এসে এই মেয়েরা সাম্যবাদের শরিক হয়েছিলেন। রশিদ আলি দিবসেও গোটা কলকাতায় যে মহামিছিল তাতে সামিল ধর্ম বর্ণ জাত নির্বিশেষে নারীপুরুষ। দাঙ্গার সময় এই ঐক্য মুখ লুকালেও পার্টির প্রতিরোধ গল্পকাহিনী হয়ে রয়েছে। আর সেই প্রতিরোধের সামনের সারিতে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির মেয়েরা। মফস্বল এবং কলকাতার বিভিন্ন সংগঠনের মহিলাদের উদ্যোগে যৌথভাবে শান্তি বাহিনী গঠিত হয়। সে ব্যাপারে বামনেত্রী কমলা চ্যাটার্জির ভূমিকা ভোলবার নয়।
আজ পশ্চিমবঙ্গ অসাম্প্রদায়িক বলে আমরা যে অহঙ্কার করি তাতে বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকলেও তার বেশিটা পাওনা নারী কমিউনিস্টদের, কারণ আজন্মলালিত সংস্কার, পর্দা, পিতৃতন্ত্রের নানা ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে তারা এই মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং এই অর্জনে সাফল্য লাভ করেছেন। আজ এই উলটো পুরাণের যুগে, নানা সাধ্বীর নানা দুষ্কার্যে চব্বিশ পরগনার দুখমন বিবি, জলপাইগুড়ির লায়লা সামাদ, কলকাতার মিসেস সালেহা গণির পরম্পরা যেন না হারিয়ে যায়।
তবে কমিউনিস্ট পার্টিতে মেয়েদের অবস্থান ও তাদের প্রতি পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অনুযোগের জায়গা অবশ্যই আছে। বহুকাল থেকেই আছে, কোনও নিরসন ছাড়াই আছে। তেভাগা আন্দোলন, যেখানে বহু ইলা মিত্র নারীশক্তির জয় সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছেন, তার পরেও পার্টি কেন এব্যাপারে যত্নবান হল না জানা নেই।
নেত্রকোনা কৃষক সম্মেলনে মহিলাদের অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাটি এখানে প্রাসঙ্গিক। দিল্লি থেকে আসা প্রথম সারির কমিউনিস্ট নেত্রী হাজরা বেগমের সতর্ক নজরে হাজার হাজার অংশগ্রহণকারীর জন্য সব ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সকালবেলাতেই পি সি যোশী জিবি ডাকলেন তাও রেওয়াজ মোতাবেক পার্টি সদস্য বা পার্টিঘনিষ্ঠদের নিয়ে জিবি নয়, সম্মেলনে যারা সাহায্য করেছেন সবাই সেখানে আহুত। সেই বিশাল সমাবেশে প্রাথমিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পর যোশী হঠাতই প্রকাশ্যে মেয়ে কর্মীদের কঠোর সমালোচনা করতে শুরু করেন। মূল অভিযোগ মেয়েরা কৃষক রমণীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে পারেননি। মণিকুন্তলা লিখছেন, কমরেড যোশীর প্রতি তখন আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অন্ত ছিল না… উনি যদি আমাদের আলাদা করে বলতেন বা পার্টি সভায় বলতেন, তাহলে আমাদের এত খারাপ লাগত না। কিন্তু এ যে জনসভা। জানি না, কেন তিনি আমাদের এত ছোট করে দিলেন।
এই ঘটনার পরেই কনক মুখার্জি হোলটাইমারের জীবন ত্যাগ করেন। পার্টির কাজ আগের মতোই করতে থাকেন, কিন্তু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য আবার চাকরি নেন।
হয়তো পি সি যোশী সত্যি আদর্শিক কারণেই তিরস্কার করেছিলেন, প্রকাশ্য তিরস্কার হয়তো আর যাতে অন্তরঙ্গতার অভাবের পুনরাবৃত্তি না হয় সেকারণেই। কিন্তু যোশীজির সন্ততিকুলে মহিলা কমরেডদের প্রতি অতি কঠোরতা, রোয়াকি বাংলায় তাদের চেপে দেওয়া, এখনও বেশ চালু। তাদের ইনফিরিওর ও অযোগ্য প্রমাণ করবার মধ্য দিয়ে হয়তো নিজেদের যোগ্যতা জ্বলজ্বলিয়ে ওঠে। আরও হতাশাজনক যে কিছু সুযোগসন্ধানী নারীকর্মী ক্ষমতার লোভে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে সচেতনভাবেই জড়ান, পার্টির আনুকূল্যে কিউবা অথবা অন্যত্র শিক্ষাভ্রমণের পর যাঁদের আগ্রহে যাওয়া তাঁদেরকেই ছোট করতে লেগে যান। কিম্বা অধ্যাপক সমিতির মতো আপাতরংহীন সংগঠনেও বজ্রমুষ্টি কায়েম করার তাগিদে সহযোদ্ধার ক্ষতি করেন। সৌভাগ্যবশত এদের সংখ্যা খুবই কম। এখনও বেশিরভাগ মেয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসেন ক্ষমতালিপ্সায় নয়, সাম্যবাদের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। সে স্বপ্নে এখনও হানা দেন সাতাশে এপ্রিলের অমর শহিদ লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া, গীতা। আসল অনুপ্রেরণা যোগান তাঁরাই, বৌবাজারের মোড়ে যতই যানজটে হারিয়ে যাক না কেন তাঁদের ধুলো-ঢাকা স্মারক। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেত্রীর ভূমিকায় উঠে আসা মফস্বলী মেয়েটি জানে গীতা মুখার্জি, মুক্তা কুমার, পঙ্কজ আচার্য ঠিক কী ধরনের আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে পার্টির কাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
নির্বাচনী ফলাফল যাইই বলুক না কেন এখনই সবচেয়ে নিকৃষ্ট আবার সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট সময়, যখন ডাঙায় বাঘ জলে কুমীরকে লড়াই দিতে নতুন করে দায়িত্ববান মেয়েরা আসছেন কমিউনিস্ট পার্টিগুলিতে, পেছনে পড়ে থাকছে সব সঙ্কীর্ণতা আর স্বার্থবন্ধন, লাল পতাকা সগৌরবে আন্দোলিত হচ্ছে তাঁদের মাথার ওপর।
আকর:
- আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি — মুজফফর আহমেদ। (এনবিএ)
- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস — ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ (ঐ)
- নারীমুক্তি আন্দোলন ও আমরা — কনক মুখোপাধ্যায় (ঐ)
- সেদিনের কথা — মণিকুন্তলা সেন (নবপত্র প্রকাশন)
- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা — সরোজ মুখোপাধ্যায় (এনবিএ)
অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক