| 19 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

চাবি

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আজ ২২ ডিসেম্বর কবি, গল্পকার ও অনুবাদক বিপাশা মন্ডলের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


লাভলীর মাল্টিফাংশনাল মোবাইলটা হারিয়ে গেছে।
এইমাত্র কম দামের সেটটা দিয়ে আমাকে জানাল। শপিং করতে গেছে ইস্টার্ন প্লাজায়, সেখানেই এই দুর্ঘটনা। অনেক দোকানে ঘুরেছে, কোন দোকানে ফেলে এসেছে মনে করতে পারছে না। আমি জানি, এখন ও সিঁড়ির পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে ঘটনার আকস্মিকতায়।
লাভলী আমার শৈশবের খেলার সাথী, স্কুলের সহপাঠী, যৌবনের প্রেমিকা, পাঁচ বছরের পুরনো স্ত্রী। আমাকেই এখন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ইস্টার্ন প্লাজা গিয়ে ওকে ওর ভূতগ্রস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে হবে।
লাভলীর ডুয়াল সিমের স্যামসাং মোবাইলটার কথা ভুলেই যেতাম, যদি না এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে অফিস যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মিজানকে দেখতাম। মিজান যেন আমাকে দেখেই তড়িঘড়ি কথা শেষ করে হুবহু লাভলীর মোবাইল সেটের মতোই একটা সেট পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি অফিস যাই। অফিস গিয়েও বসের বকুনি না খাওয়া পর্যন্ত ভাবতেই থাকি। মোবাইলটা ঘরেই হারালে মিজানকে চুরির জন্য সন্দেহ করা যেত। আবার মিজান ওরকম একটা মোবাইল কিনে নিতেও পারে। কিন্তু সেটাও অসম্ভব, কারণ আমার চাচার ছেলে-মেয়ে দুটিকে পড়ানো ছাড়া আর মাত্র দুটি টিউশনি রয়েছে মিজানের। টিউশনির বেতনের প্রায় সব টাকাই সে বাড়িতে পাঠায় মা-বাবা ও অবিবাহিত তিন বোনের জন্য। এসব বৃত্তান্ত আমি লাভলীর কাছেই শুনেছি। মিজান লাভলীর গ্রাম সম্পর্কের চাচাতো ভাই। কোথাও একটা গোলমাল পাকিয়ে গেছে।
মোবাইল হারানোর পর থেকে নতুন মোবাইল পাওয়ার পরেও লাভলী যেন একটু বিমর্ষ। এই বিমর্ষতা কি আমাদের পাঁচ বছরের সংসারে সন্তানহীনতার জন্য, নাকি অনেক দিনের পুরনো ব্যবহৃত জিনিসের মায়ায় আমি তা বুঝতে পারছি না। ওর মন ভালো করার জন্য একদিন প্রস্তাব দিই, ‘অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না। চলো অফিসের পিকনিকে সুন্দরবন ঘুরে আসি। চার-পাঁচ দিন লঞ্চের মধ্যে থাকব, কনসার্ট হবে। নদী দেখা হবে।’
তখন রাত প্রায় একটা, বেডরুম লাগোয়া বারান্দায় চাঁদের আলোর মধ্যে বসে আছে ও, মুখের বামপাশে ফুলের রেণুর মতো জোছনা লেগে আছে। স্মিত হেসে, বলে, ‘তোমার যে কী কথা, আমি আবার কোথায় যাব? তোমার অফিসের পিকনিক, তুমি যাও। এত হৈ-হুল্লোড় আমার ভালোও লাগে না।’
আমি চাইলে ওকে জোর করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। একটা উৎসবের মধ্যে ওর মনমরা ভাব অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হবে। আমি নিজের যাওয়াটাও বাতিল করে দিই। তবে ‘তোমার অফিসের পিকনিক, তুমি যাও’ কথাটা আমাকে ভেতরে ভেতরে অনেক দিন খোঁচায়। লাভলীরও একটা অফিস থাকতে পারত। বিয়ের পর আমি প্রবল উৎসাহে চাকরি খুঁজছি আর লাভলী চাকরির চেষ্টা করতেই তাকে নিরুৎসাহিত করছি। তাকে বাস্তব অবস্থাটা বোঝাচ্ছি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই যদি চাকরি করে, ঢাকা শহরে বাচ্চাদের অবস্থা হয় অনেকটা অনাথের মতো। চাকর-বাকরের কাছে বড় হয়। ঠিকঠাক মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। তাছাড়া আমাদের এত তো দরকারও নেই, কাস্টমস অফিসার বাবার কেনা ফ্ল্যাটে থাকছি, ব্যাংকেও কিছু রেখে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী চাচা আমাদের ভরসায় আজীবন গ্রামে বসবাস করা চাচীকে ঢাকা এনেছেন বাচ্চাদের ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য। এদিক থেকেও আমরা বেশ ইকনোমিক্যাল সাপোর্ট পাই। তো লাভলীর চাকরির দরকারটাই বা কী। প্রথমে কয়েক দিন জোর-জার করে পরে আমার মতেই মত দিয়ে দেয় ও। চাকরির চেষ্টা বাদ দেয়। শপিং, সংসার মেইনটেইন, নিজের বিউটি কেয়ার, আমার খুঁটিনাটি যত্ন করাও তো কম ঝক্কি নয়। আমার আম্মা তো এইসব করে করেই হাই ব্লাডপ্রেশারে মারা গেলেন। তবে এখন মনে হয় তখন লাভলীর চাকরি করাই ঠিক ছিল। ওর বোধহয় এই কর্মহীন জীবনের ভার খুব দুরূহ হয়ে পড়েছে। আমি এখন চাকরি করার কথা বললে সবসময় একই রকম নির্বিকার মুখ করে এক সুরে বলবে, ‘করুণা করছ? মা হতে পারছি না তাই চাকরির ব্যস্ততা দিয়ে আমার অফুরন্ত অবসরকে ভরিয়ে দিতে চাইছ?’
এরপর আর তাকে কী বলা চলে?
লাভলী মা হতে পারছে না, নাকি আমি বাবা হতে পারছি না এ ব্যাপারেও আমি ঠিক নিশ্চিত নই। চাচীমা লাভলীকে ছাড়া বাচ্চাদের জন্য চিপস কিনতেও যেতে পারে না। বাচ্চাদের স্কুল ঠিক করা, টিচার ঠিক করা, ড্রেস কেনা, সবকিছুই লাভলী এক হাতে করে। বাজারটাও নিজে দেখেশুনে করে। এদিকে বাচ্চারাও আন্টিকে ছাড়া কিচ্ছু পারে না। স্কুলের গাড়িতে পর্যন্ত লাভলীই তুলে দেয়। আমিও লাভলী সামনে না দিলে পানিটুকু পর্যন্ত গ্গ্নাসে নিয়ে খেতে পারি না। আমাদের সমস্যা নিয়ে লাভলীই ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে, কনসালট্যান্টদের সঙ্গে দেখা করে। ডাক্তার দেখায়। নিজে দেখায়, আমাকে দেখায়। রক্ত পরীক্ষা করে। দু’জনেরই স্পার্ম পর্যন্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। আমি শুধু ওর কথামতো ডাক্তারের কাছে যাই আর ডাক্তারের কথামতো তাদের যা দরকার দিয়ে আসি। আমার অফিসের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে ওর কড়া নজর। এমনিতেই দু’জনের মাত্র একজন চাকরি করি। সেই একটামাত্র চাকরিতে যেন কোনো আঁচড় না লাগে সেদিকে ওর তীক্ষষ্ট দৃষ্টি। বছরের পর বছর আমার পাওনা ছুটি ফেরত গিয়ে মোটা অঙ্কের বেতনে পরিণত হয়ে ব্যাংকে জমা হয়। এইসব ডাক্তার-ক্লিনিকের মধ্যেই একদিন অফিসফেরত টিভি দেখছি, লাভলী চাচার বাচ্চাকাচ্চাদের পাট চুকিয়ে ঘরে ঢোকে, আমার পাশে বসে বলে, ‘তুমি চাইলে আরেকটা বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হতে পার, আমার কোনো আপত্তি নাই, আমার বোধহয় বাচ্চা হবে না।’
জীবনে এই প্রথমবার ওর কথা আমি অবিশ্বাস করি। পাঁচ ফুট উঁচু, সুগোল, ঝলমলে স্বাস্থ্যের অধিকারী লাভলীর কোনো অসুবিধা থাকতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। আমি অবিশ্বাসের কথা বলি না, শুধু বলি, ‘না হলে নাই, আমি তো বাচ্চা ছাড়াই তোমাকে ভালোবেসেছি, বিয়ে করেছি, যদি ভাগ্যে থাকে হবে, না হলে নাই।’
লাভলী তীক্ষষ্ট গলায় বলে ওঠে, ‘শুধু আবেগ দিয়ে জীবন চলে না পারভেজ, কিছু দিন পরে তোমার কিন্তু অনুতাপ হবে।’
এখন কথার পিঠে কথা বলতে গেলে কথা কাটাকাটি হবে। যার কোনো অর্থ নেই, মীমাংসাও নেই। আমি চুপ করে থাকি। ও বিড়বিড় করে আরও কিছু বলে। আমি মনোযোগ দিই না। এরপর ও চার-পাঁচটা ডাক্তারের ফাইল এনে আমার সামনে রাখে, বলে, ‘দ্যাখো এগুলো, দেখলেই বুঝতে পারবে।’
ও খুব ভালোই জানে যে আমি এগুলো কখনোই দেখব না। এসব আমার ডিপার্টমেন্ট না। অফিসের কাজ, স্যালারি, ইনক্রিমেন্ট, বোনাসের বাইরে আমি কোনো কাগজ দেখি না, খবরের কাগজও না। আমি খবর টিভিতে দেখি। ত্রিশ-চলি্লশটা চ্যানেলে রোজ খবর দেখায়। এরপর ও পুরোপুরি নীরব হয়ে যায়। ফাইলগুলো তুলে নিয়ে নিজের আলমারিতে রেখে তালা লাগিয়ে দেয়। এই আলমারির চাবি আমার কাছে নেই। আমার কাছে স্টোররুমের তালারও চাবি নেই। এসব আমার ডিপার্টমেন্ট না।
একদিন খেয়াল হয় মিজান আর আমাদের বাসায় চাচার ছেলেমেয়েদের পড়াতে আসছে না। রাতে অফিস থেকে ফিরে আমি লাভলীকে জিজ্ঞেস করি, ‘মিজানের কি চাকরিবাকরি হয়ে গেছে? তানিয়া-রাসেলকে আর পড়াচ্ছে না ও?’
লাভলীর মুখ যেন একটু লাল হয়ে ওঠে, ‘চাকরি হয়নি, অনেক দূরে একটা ভালো টিউশনি পেয়েছে। তানিয়াদের জন্য আমি ওদের স্কুলেরই এক টিচারকে ঠিক করেছি, উনি সন্ধ্যায় আসেন। খুব ব্রিলিয়ান্ট টিচার।’
তানিয়াদের টিচার নিয়ে আমি খুব একটা আগ্রহী নই, উদ্বিগ্নও নই। লাভলী কথা শেষ করে কিচেনে চলে যায়। হঠাৎ করে মাথায় কী ঢোকে আমার, আমি শোবার ঘর থেকে লাভলীর নতুন ফোনসেটটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকি। ফোনটাকে খুলে কাটা মাছের মাছের মতো দুই টুকরো করে ফেলি, ব্যাটারি বের করি, ডুয়াল সিমের দুটোই হাতে নিই। নতুন একটা এয়ারটেল সিম। কিন্তু গ্রামীণ সিম সেই পুরনোই, পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবহৃত পুরনো সিম। অথচ গ্রামীণ সিমটা একেবারে নতুন হওয়ার কথা ছিল, হারিয়ে যাওয়া সিম আবারও সার্ভিস সেন্টার থেকে তুললে কি এত পুরনোই দেয় ওরা? ইস্টার্ন প্লাজায় লাভলীর হারিয়ে যাওয়া ফোনটায় এই গ্রামীণ নম্বরটাই ছিল। বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস আসে আমার। লাভলী আমাকে মিথ্যে বলেছে। এটাই কি তার প্রথম মিথ্যে? নাকি নিজের মানসিক অবসাদ তাকে মিথ্যেবাদীও করে তুলছে? ফোনটা দ্রুতই আবার রি-সেট করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে টেবিলে রাখি।
স্বস্তি পালিয়ে যায় আমার মন থেকে। আয়নার সামনে দাঁড়াই, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা আমি, চোখমুখ, নাক-কান যে কোনো গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে সুন্দর। নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারীতে কখনও আসক্ত হয়েছি এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু গোলমালটা কোথায়? আমার পাঁচ বছরের প্রেমময়ী স্ত্রী হঠাৎ আমাকে মিথ্যে বলছে কেন?
নিজের অস্বস্তির মধ্যেই একদিন লক্ষ্য করি, লাভলীর চেহারার ধূসরতা কাটতে শুরু করেছে। বিয়ের পরের লাভলীর মতোই আমার লাভলী হাসিখুশি ঝলমলে সহজ হয়ে উঠছে। নিজেই আমাকে নিয়ে এদিক-ওদিক বেড়াবার প্রোগ্রাম করছে। আমি এই আকস্মিক খুশির কারণ বুঝে উঠতে পারছি না। সেদিন বাসায় ফিরে দেখি আমার শ্যালিকারা তাদের স্বামী-সন্তানসহ সপরিবারে উপস্থিত। চারজন শ্যালিকা আমার। এমনকি একমাত্র শ্যালকও উপস্থিত তার ইউনিভার্সিটির বান্ধবীদের নিয়ে। খুব হৈ-হল্লা হলো রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। এরপর সবাই চলে গেলে ডাইনিংয়ে গোছগাছ শুরু করল চাচী ও লাভলী। আমি আর সহ্য করতে না পেরে চাচীর সামনেই লাভলীকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘আজকের গেট-টুগেদারের কারণটা কি আমি জানতে পারি?’
লাভলী তেমনই তরল গলায় বলল, ‘ভাইবোনদের গেট-টুগেদারের আবার কারণ লাগে নাকি? তোমার তো আপন ভাইবোন আর কেউ নেই। তানিয়া-রাসেল তো আমাদের সঙ্গেই থাকছে।’
যদিও সপ্রভিত উত্তর কিন্তু অপমানে ততক্ষণে লাভলীর মুখ কালো হয়ে গেছে। চাচী বিষয়টি বুঝতে পারলেন। আমাকে ডাকলেন, ‘একটু বারান্দায় এসো তো পারভেজ।’
চাচী আমাকে কিছু বলতে চাইছেন, ঠিক বলতে চাইছেন নয়, জানাতে চাইছেন। কিন্তু কী সেটা? আমি ধীর পায়ে বারান্দায় চাচীর সামনে এসে দাঁড়াই। চাচী খুশি মেশানো গলায় বলেন, ‘লাভলীর তিন মাস চলছে। ডাক্তার সাবধানে থাকতে বলেছেন, তুমি ওর সঙ্গে রাগ করে কথা বলো না কখনও।’
আমি প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, কিসের তিন মাস চলছে। একটা আলোছায়ার পর্দা দুলে যায় আমার চোখের সামনে। সহস্র খুশির কণা যেন আমার হাত-পা, সারা শরীর দিয়ে ফেটে পড়তে চাইছে। কিন্তু আমি যেন এখনও সেই বোধগম্যতা থেকে খানিকটা দূরে। আমি অস্টম্ফুটে জিজ্ঞেস করি, ‘কিসের তিন মাস?’
‘কিসের আবার! লাভলীর পেটের বাচ্চার, এ সময় মনে কষ্ট পেলে মা-বাচ্চা দুজনেরই ক্ষতি হয়। আজই ও সবাইকে জানাল। ওর বোধহয় আগেই অনুমান হচ্ছিল, তবে আজ ডাক্তার ওকে কনফার্ম রিপোর্ট দিয়েছে।’ চাচী কখন নিজের ঘরে ফিরে যায় আমি টের পাই না, তবে এতকিছুর মধ্যেও আমার বোধে ধরা পড়ে, অজপাড়াগাঁয়ের লেখাপড়া না জানা চাচী আম্মা এই সাড়ে চার বছরেই ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের মতো প্রমিত বাংলায় কথা বলছেন লাভলীর সঙ্গে থেকে। তবে এই ভাবনাটা ঢেউয়ের মতোই আমার চিন্তা ও অনুভূতির স্রোতে একটু দোলা দিয়েই মিলিয়ে যায়। আমি ভূতগ্রস্তের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি, চাঁদটা যেন সড়সড় করে নিচে নামতে থাকে, আমাকে জড়িয়ে ধরে, মিলেমিশে গলে আমার সত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। যখন হুঁশ হয়, তখন দেখি যে আমি দাঁড়িয়েই আছি, ডাইনিং লাগোয়া এই বারান্দার দিকে আমি নতুন চোখে তাকাই, বিশ-পঁচিশটা টবে নানা ধরনের ফুলের গাছে গ্রিলের ধার সাজানো, এর মধ্যে শিউলি গাছ পর্যন্ত আছে। এ সবই লাভলীর দিনরাত দৌড়ঝাঁপ করে করা। বসার জন্য সাজানো আছে কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, এককোণে অ্যাকুরিয়াম। অ্যাকুরিয়ামের ওপরে নৃত্যভঙ্গিমারত এক যুগলের এন্টিক শোপিস। আমি আলতো হাত রাখি শোপিসটায়। যেন তারা কথা বলে উঠবে।
দ্রুত নিজের বেডরুমে ফিরি। রাত আড়াইটা। নীল আলো জ্বলছে। বাম দিকে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে লাভলী। মুখে এখনও সেই অপমানের বিষাদ মাখা। আমার বুকের মধ্যে বেজে ওঠে অপরাধবোধ। এর মধ্যেও কেন জানি না আমি টেবিলের ড্রয়ারে রাখা চাবির গোছা থেকে লাভলীর নিজস্ব আলমারির চাবিটা খুঁজে চলি। আমার চোখের সামনে চকচক করে ওঠে চার-পাঁচটা ডাক্তারি ফাইল। কিন্তু আমি নয়টা চাবির একটা দিয়েও ওর নিজস্ব আলমারির তালা খুলতে সমর্থ হই না। ওই আলমারির মধ্যে একটা অন্য সত্য লুকানো আছে, যা আমার হাতের নাগালের বাইরেই থেকে যায়।
এরপরের দুটো সপ্তাহ আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। কিন্তু লাভলীর বারান্দায় প্রতি রাতে খাবার পরে আশ্রয় নিতে আমার ভুল হয় না। লাভলী বোধহয় সেটা উপভোগও করে। বারান্দার মতোই লাভলীকেও আমি নতুন করে আবিষ্কার করি। ঠিক বিয়ের পরপর যেভাবে ওকে ঘরের প্রতিটি কোন থেকে নতুন চোখে আবিষ্কার করতাম। ওর হাসি বা দুঃখের কারণকে বুঝতাম। ওর খুশি, ওর আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার প্রাণপণে চেষ্টা করি। যত অপরাধই করুক ও, যত মর্মান্তিকই হোক, আমি তা মেনে নেব, শুধরে নেব।
রাতে খাবার পরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। টবের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেড়ে ওঠা একরত্তি হাসনুহেনা গাছটায় একগোছা ফুল তীব্র সুবাস ছড়াচ্ছে। মায়ের কাছে শুনেছি হাসনুহেনার গন্ধে নাকি সাপ আসে। এই চারতলা বেয়ে সাপ কি এতদূরে উঠে আসতে পারবে? লাভলী এসে আমার হাতে হাত রাখে। আবেগকম্প নিচু স্বরে বলে, ‘মিজান আজ মিডল-ইস্টে চলে গেল, খুব ভালো একটা চাকরি পেয়েছে।’
আমি বিস্মিত স্বরে বলি, ‘তাই! ব্যবস্থা করল কে?’
‘জানি না, বলেনি আমাদের, ভালোই হলো ওর বোনগুলোর বিয়ে দিতে পারবে এখন।’
আমি দার্শনিকের গলায় বলি, ‘কেমন জঘন্য সমাজ দেখ, এখনও এদেশে বরপণ ছাড়া সুন্দরী মেয়েদেরও বিয়ে হয় না।’ যেন আমি সমাজের এই অব্যবস্থা নিয়ে ভীষণ ব্যাকুল। লাভলী আমার কপটতা বুঝতে পারে না। ও নিজেকে নিয়েই মগ্ন। ও চুপ করে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি একটা অ্যারোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে।
পরের দিন ভোরবেলা খুব দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামি। অফিসের গাড়ি এসে গেছে। লাভলী বেডরুম লাগোয়া ছোট বারান্দা থেকে বরাবরের মতো হাত নাড়ে। নিচ থেকে চারতলায় লাভলীর মুখটা ঠিকই দেখা যায় কিন্তু সেখানের বিষাদ বা আনন্দ, অশ্রু বা স্ফুলিঙ্গ কিচ্ছু বোঝা যায় না। তবে হাত নাড়া বন্ধ হওয়ার পরও গ্রিল থেকে অলসভাবে লাভলীর হাতটা ঝুলে আছে দেখা যায়। আমি হালকা মনে গাড়িতে উঠি। লাভলী সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও মিজান আর কখনও এই রাস্তা দিয়ে আমাদের চারতলায় উঠতে যাচ্ছে না। ও মিডল-ইস্ট চলে গেছে। এয়ারবাসে। ট্রলারে করে জীবনের ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তার মধ্যে নয়। এজন্য অনেক টাকা খরচ করেছি আমি।
রাতের বেলা খাবার পরে বারান্দায় ঢুকে আমার পাশে বসতে গিয়ে অ্যাকুরিয়ামের ওপর চোখ যায় লাভলীর। শোপিসটা সেখানে নেই। ও পাগলের মতো খুঁজতে থাকে। অ্যাকুরিয়ামের পেছনে দেয়াল ঘেঁষে পাওয়া যায় ওটা। ভাঙা। আমার দিকে ফিরে তীব্র কণ্ঠে বলে, ‘কে ফেলল এটা, কে ভাঙল?’
গতকালের মতোই নিরাসক্ত মুখে মিথ্যে বলি, ‘বাচ্চারা কেউ হয়তো, বিড়ালও হতে পারে।’
লাভলী আমার দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে। ও আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করেছে কি-না বুঝতে পারি না।
কৃতজ্ঞতা: সমকাল

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত