গুরুগৃহ থেকে অনলাইনশিক্ষা
সাধারণ ভাবে শিক্ষা হলো উপদেশ দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন। মনের অন্ধকার দূর করার মধ্য দিয়ে অভ্যাস গতিশীল রাখার প্রক্রিয়া হচ্ছে শিক্ষা। আদিম যুগেও মানুষ শিক্ষা অর্জন করত। সেই সমাজে শিক্ষার একমাত্র লক্ষ ছিল আত্মরক্ষার কৌশল আয়ত্ব করা। তখন প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকার জন্য কৌশল আয়ত্ব করাই ছিল শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য। এই লক্ষ অর্জনে গোষ্ঠীর অভিজ্ঞ ব্যক্তির অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী বংশধরের মধ্যে শিখিয়ে দেওয়ার নীতি হিসেবে শিক্ষার উদ্দেশ্য স্বীকৃত হয়। এরপর বিবর্তনের পথ ধরে মানুষ যতই এগিয়েছে তার শিক্ষাও তত বিচিত্র রূপে বিবর্তীত হয়েছে, তার শিক্ষা ব্যাবস্থায়ও এসেছে নানা পরিবর্তন।
ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এর তিনটি পর্যায় দেখতে পাই। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ। প্লেটো ৩৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে যখন গ্রীসের রাজধানী এথেন্সের ‘একাডেমাস’ নামক বাগানে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেন তারও প্রায় হাজার বছর পূর্বে ভারত বর্ষে বৈদিক যুগে গুরুশিষ্য শিক্ষা পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছিল।গবেষকগণ জানান ভারতবর্ষে আনুমানিক ১৮০০ বা ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বব্দে ‘ বৈদিক যুগের’ শুরু আর ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এর সমাপ্তি। তখনই আর্য ঋষিরা বিশ্ব মানবকে বলছেন, ‘অমৃতস্য পুত্রঃ’ অর্থৎ অমৃতের সন্তান। এই উপলব্দি বোধ থেকেই তাদের মধ্যে সমবয়ের মনোভাব লক্ষ করা যায়্। তাছাড়া তারা ছিল গণের অধীন। গণ হল যারা সম্মিলিত ভাবে একই রকম কাজ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ এরা ছিল একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আন্তর্গত সদস্য। এদের গোষ্ঠীকে যারা শাসন করত তাদের বলা হত ‘গণপতি’। গণের লোকেরা কখনওই ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না। ফলে যেখানে গ্রীকের সোফিস্টগণ অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দান করতেন এবং শিষ্যের মধ্যে প্রবল ভাবে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবোধ জাগিয়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন সেখানে ভারতীয় আর্য ঋষিগণ ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। তারা বিনা পারিশ্রমিকে জ্ঞান বিতরণ করতেন। তারা মনে করতেন ‘আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্দিই, হচ্ছে শিক্ষার চরম লক্ষ। ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে সত্যোপলব্দির সাধনাই ছিল প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আর্য ঋষিগণ জাগতিক সুখকে জীবনের চরম লক্ষ বলে মনে করেননি।তারা শিষ্যকে সুখ-দুঃখের অতীত উপলব্দি বা বোধকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। শিষ্যকে জানাতে চেয়েছেন তার নিজের স্বরূপ সম্পর্কে। মোট কথা পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণ শক্তির সন্ধান দিতে চেয়েছেন তারা। একারণে প্রাচীন বৈদিক শিক্ষাার চরম লক্ষ হল ‘আত্মজ্ঞ হওয়া’।
প্রাচীন ভারতে সন্তানের পাঁচ বছর বয়স হলে চৌল কর্ম ও চুড়া কর্ম সম্পন্ন হয়। এরপরই পিতারা তাদের শিশুকে বেদশিক্ষা দিতেন। ব্রাহ্মণ বালকেরা ৮ বছর, ক্ষত্রিয়রা ১১ বছর এবং বৈশ্য শ্ক্ষিার্থীরা ১২ বছর পর্যন্ত পরিবারে পিতার কাছেই শিক্ষা গ্রহণ করত। তারপর উপনয়ন সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থরা গুরুগৃহে প্রবেশ করত। উপনয়ন হচ্ছে সমীপে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ যার দ্বারা বালক বেদাধ্যয়নার্থে গুরু সমীপে নীত হয়। তাই ব্রহ্মচর্যা পালনের জন্য গুরুগৃহে উপস্থিত হওয়াকে উপনয়ন বলা যায়। উপনয়ন হলেই তার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন হয়।উপনয়ন হলে তখন শিশুকে বিদ্যা শিক্ষার জন্য গুরুগৃহেই থাকতে হতো। শিক্ষার্থীর কাছে গুরু পারমার্থিক পিতা হিসেবে সম্মানিত হতেন। আচার্য ছিলেন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। পক্ষপাতহীন ভাবে তিনি বিদ্যাশিক্ষা দিতেন। গুরু গৃহে শিক্ষার্থরা কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা লাভ করত। তারা গুরুর গো-পালন করত, তার জন্য ভিক্ষে করত, বন থেকে কাঠ কেটে আনত। এছাড়া তারা ঘরের নানা রকম কাজ করত। ফলে তাদের মধ্যে স্বাবলম্বন, কর্মক্ষমতা, শ্রমের মর্যাদা, আত্মত্যাগ, সেবার মনোভাব ও মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হত। এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অবৈতনিক। শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষার্থরা সাধ্য মত গুরুদক্ষিণা দিত।
মহাভারতে উল্লেখ আছে- যা ব্যক্তির অব্যর্থ অন্তদৃষ্টি এবং উন্নত চরিত্র ও আচরণের নিশ্চয়তা বিধান করে না ঐ প্রকার শিক্ষার কোনো গুরুত্ব নেই। তাই বৈদিক শিক্ষাব্যবস্থায় ঋক, সাম, যজু, অথর্ব বেদ, ৬টি বেদাঙ্গ- ছন্দ,ব্যকরণ শিক্ষা অর্থাৎ ধ্বনি বিজ্ঞান, নিরুক্ত, কল্প ও জ্যোতিষশাস্ত্র, উপনিষদ, আরণ্যক প্রভৃতি পাঠ্যক্রমে অন্তর্গত থাকলেও উন্নত চরিত্র গঠনের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করা হতো। আশ্রমে শিক্ষার্থীদের কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতে হতো। মাদকদ্রব্য সেবন, বিলাস সামগ্রী, বেশভূষা, অট্টহাসি, যেখানে সেখানে থুথু ফেলা, গুরুর সামনে বসা ও চলা ফেরা শিক্ষার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। আশ্রম শিক্ষায় শিক্ষার্থদের শারিরীক ও মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হত। সেই সময় শিক্ষার্থীরা অস্ত্রচালনা, চিকিৎসাবিদ্যা চর্চ করত। মেয়েরা নাচ গানের চর্চা করত। প্রায় ৬ মাস থেকে ১২ বছর ধরে শিক্ষা দেওয়া হতো। শিক্ষা সম্পন্ন হলে ‘সমাবর্তন’ নামে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছাত্রকে স্নাতক ঘোষণা করা হতো। গুরু গৃহ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শিক্ষার্থী গুরুকে দক্ষিণা দিত। বৈদিক যুগের এই প্রথা খ্রিষ্টপূবৃ ৬ষ্ঠশতক নাগাদ চালু ছিল। সেই সময় ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যাবস্থা এতটাাই ঐতিহ্যবাহি ছিল যে বিশ্বের বিভিন্নদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসতে শুরু করে। পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয় ভারতে খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে, তক্ষশীলায়। এখানে ৬০টিরও বেশি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হত। সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ১০,০০০। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০অব্দে তৈরি হয়েছিল ‘নালন্দা’ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্তমান ছিল। সম্পুর্ন অবৈতনিকভাবে এখানে শিক্ষা দান করা হত। প্রতি ৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছিল ১ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৫০০। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি এটি ধ্বংস করে দেন। এই দুটি বিশ্ব বিদ্যালয় ছাড়াও আরও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল- বিক্রমশীলা, জলা, উদন্ডপুর, ভলাভি, মিথিলা, উজ্জয়নী, অমরাবতী, কাঞ্চি, মাধুরা প্রভৃতি। এগুলা ছিল বৌদ্ধমন্দির। এগুলো তখন মহাবিহার নামে প্রসিদ্ধ ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকের দিকে জীবিকা ও পড়াশুনার মধ্যে একটি বিশেষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। শুরু হয় নতুন শিক্ষা পদ্ধতি।প্রাচীন কালের এই শিক্ষাপদ্ধতিকে কেন্দ্র করে বেনারস শহরতলীতে একধরনের পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই পদ্ধতিটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মধ্যযুগের ভূ স্বামী ও স্থানীয় প্রশাসকগণ। এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল ২০/২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। তখন পাঠগৃহটি ছিল মাটির আর তার চালা হত তৃণপত্রের অর্থাৎ ছন, বা ঘাসের। সেখানে ব্যাকরণ, সাহিত্য, দর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র পড়ানো হত। মধ্যযুগের শেষ দিকে এটি টোল শিক্ষা নামে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে। তাছাড়া মধ্যযুগের দেশীয় সনাতন পদ্ধতির ধারা হিসেবে টোল ও পাঠশালা চালু হতে শুরু করলে অন্য দিকে মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষাও চালু হতে থাকে। টোল সাধারনত কোনো বিদ্বান ব্যাক্তির নিজস্ব উদ্যোগে পরিচালিত হত। তিনিই সেখানে পাঠদান করতেন। শিক্ষার্থীরা সাধারণত ব্যকরণ, কাব্য, অঙ্ক, আয়ুর্বেদ, জ্যোতিষশাস্ত্র, সং!স্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে সেখানে শিক্ষা লাভ করত। মুসলিম শাসনামলে মুসলিমদের জন্য চালু হয়েছিল মক্তব মাদ্রাসা। মুঘল আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল বিশেষ সিলেবাস ভিত্তিক।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের শিক্ষার প্রভাব আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থায় নেই। সুদীর্ঘ ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের দীর্ঘদিনের প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তা গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে। ব্রিটিশরা এদেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল তার উদ্দেশ্য ছিল কম মাইনেতে ইংরেজ শিক্ষায় শিক্ষিত কেরানি দল তৈরি করা। কেননা এই দেশের বিচিত্র সংস্কৃতি ও ভাষাভাষির মানুষের সঙ্গে কাজ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তাই তারা চেয়েছিল এমন একটা শ্রেণি তৈরি করতে যারা নেটিভদের সঙ্গে তাদের হয়ে কাজ করে দিতে পারবে। মোট কথা দালাল শ্রেণি তৈরি কররাই ছিল তাদের শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কোম্পানির শিক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান টমাস র্যাবিংটন বলেন,‘ বর্তমানে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণি তৈরি করতে যারা আমাদের এবং আমরা যাদের শাসন করছি তাদের মাঝে ব্যাখ্যাকার হিসেবে কাজ করবে ( অর্থাৎ দালাল)। এটি এমন মানুষের শ্রেণি যারা রক্তে এবং বর্ণে ভারতীয়, রুচিতে -মতামতে- মূল্যবোধে এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংলিশ।’ এই বক্তব্যে এটা পরিস্কার প্রমাণিত হয় যে ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যাবস্থার আসল উদ্ধেশ্য চাটুকার, দাস ও দালাল শ্রেণি তৈরি করা। এদিকে উডের ডেসপ্যাচে শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশীয় ভার্নাকুলার স্কুলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধাপে পশ্চিমা শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে ভারতের শিক্ষা কাঠামোর তৈরির কথা বলা হয়। ডেস প্যাচের কারণে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন হলেও গুণগত মানের কোনও পরিবর্তন হয়নি।। এরপর হান্টার কমিশন, মাইকেল সেডলার কমিশন, হার্টগ কমিশন ইত্যাদি কমিশন গঠন করা হয় শিক্ষা ব্যাবস্থার উন্নয়নের জন্য কিন্তু তাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। ব্রিটিশরা এদেশে যে শিক্ষা কাঠামো তৈরি করেছিল তা ছিল মূলত এদেশিয় মানুষের জীবন বিচ্ছিন্ন এক ধরনের পাঠ। এর মূল উদ্দেশ্য প্রকৃতি, পরিবেশ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাজুয্য স্থাপন। ফলে মানবিক গুনাবলীর বিকাশের চেয়ে তত্ত¡গত শিক্ষা ও যান্ত্রিক ব্যাপস্থাপনা দক্ষতার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং বলাই বাহুল্য আমাদের দেশে এই প্রক্রিয়াটি আজও অব্যাহত।
একবিংশ শতকে ব্যাবহারিক ও প্রযুক্তিগত বিদ্যার প্রয়োগ ও প্রসার ঘটেছে মাত্র। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মানের কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখন শিক্ষকের গৃহে বা বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্জনের প্রয়োজন প্রায় ফুরিয়েছে। ঘরে বসেই শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তার বিষয় ভিত্তিক শিক্ষা অর্জন করছে। অনলাইন শিক্ষা হল এমন শিক্ষা ব্যবস্থা যা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় আধুনিক প্রযুক্তি যেমন- কম্পিউটার, মোবাইল ও ইন্টারনেট সংযোগ্ অর্থাৎ ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগের মাধ্যমকে ব্যবহার করে ক্লাস পরিচালনা করাই হল অনলাইন শিক্ষা। এই পদ্ধতিতে একজন শিক্ষক ক্লাস রুমের বাইরে সুবিধাজনক যে কোনো স্থানে থেকে পাঠদান করতে পারেন। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে বসে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে লাইভে ক্লাসে অংশ নিতে পারে। এর মাধ্যমে পারস্পারিক মতবিনিময়ও সম্ভব। শুধুমাত্র শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকা ব্যাতিত অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে গতানুগতিক পদ্ধতির কোনো পার্থক্য নেই। এর বাড়তি সুবিধা হল ক্লাস সমমূহ সেভ করা যায় ফলে আলাদা করে নোট করার দরকার পড়ে না। আবার কেউ এই লাইভে অংশ নিতে না পারলেও পরে তা তারিখ অনুযায়ী সার্চ করে ডাউনলোড করে দেখতে পাবে। আপদকালে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা শিশুদের জন্য সহায়ক হলেও বিদ্যালয় ভিত্তিক পাঠাভ্যাসের ফলে এক জন শিক্ষার্থীর চরিত্রগঠন, আচরণ, সঙ্গীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কৌশল, দলে নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করার যে সক্ষমতা তৈরি হয় অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষাব্যাবস্থায় সেটা সম্ভব নয়।
ভারতবর্ষের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী সমাজের স্বার্থে কাজ করার কথা ভাবলেও বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাকে অগ্রাধীকার দিচ্ছে। ফলে পারস্পারিক সামাজিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে। প্রাচীন কালের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা গেছে একজন শিক্ষার্থী মধ্যে বাগপটতাু, নেতৃত্ব গ্রহণের ক্ষমতা অর্জনের সক্ষমতা সহ দলে কাজ করার মানসিক সক্ষমতাও অর্জন করেছে। তারা জ্ঞান দিয়ে প্রজ্ঞা দিয়ে মিথ্যা ও অন্যায়কে প্রতিহত করার ক্ষমতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে শাসন করার ক্ষমতা নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিতে শেখে। আর এজন্য শিক্ষককে বুঝতে হয় শিক্ষার্থীর মনজগতের পরিবেশ। বুঝতে হয় সে অর্ন্তমুখি না বহির্মুখি স্বভাবের। আর এটি অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিতে সম্ভব হয় না । ফলে এতে শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়। এতে করে তারা এমন একধরনের প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হবে যেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের জয় জয়কার। এখন সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে ‘সত্যের ভাত নেই’- এরকম প্রবাদকে চিরন্তন মনে করে মিথ্যের চাষবাস করতে আগ্রহী হচ্ছে অনেকে এবং এটাকে সমর্থন করছে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মৌল লক্ষ এখন আর অর্জিত হচ্ছে না। ফলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেও বেশির ভাগ লোকেরা খুব দ্রুত ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের চাটুকার ও দালালে পরিনত হচ্ছে। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশুনার সুযোগ পেতে পারে। যারা নতুন নতুন বিষয়ে শিখতে আগ্রহী তাদের জন্য এই ব্যবস্থা একটি অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। তবে সেটা অবশ্যই শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়ে যাওয়ার পরে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হতে পারে। করোনা কালে বা আপদ কালে শিক্ষাজীবনকে গতিশীল রাখতে এই শতকে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলাই বাহুল্য।
কবি, গবেষক