| 19 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

একুশের কবিতা ও গান

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

রফিকুল ইসলাম

বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়, সেই অমর একুশে নিয়ে আমাদের দেশে যত কবিতা লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো একক ঘটনা নিয়ে তত কবিতা রচিত হয়নি, ২১ ফেব্রুয়ারি যত গভীরভাবে আমাদের কবিতাকে আলোড়িত করেছে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বিষয় তা করতে পারেনি। একুশের রক্তাক্ত স্মৃতি কবিতায় তাৎক্ষণিক এবং সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া ও অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছে। একুশে ঘটেছিল ঢাকায় অথচ কবিতার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে তার অনুরণন উঠেছিল চট্টগ্রামে। সেই দিনই রচিত হয়েছিল মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর দীর্ঘ কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। কবিতাটি দ্রুত রচিত হয়েছিল, প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল সমান গতিতে আর নিষিদ্ধ হওয়ার গৌরব ও লাভ করেছিল সঙ্গে সঙ্গে। কবিতাটি দীর্ঘদিন প্রকাশিত হয়নি, তবে পুনঃপ্রকাশের আগে কবির স্মৃতি থেকে যতটুকু উদ্ধার করা গিয়েছিল তার কিছুটা,
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার নিচে
যেখানে আগুনের ফুলকীর মতো
এখানে-ওখানে জ্বলছে রক্তের আল্পনা,
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই,
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই,
আমি আজ রক্তের গৌরবে অতিষিক্ত।…
যে শিশু আর কোনো দিন তার পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না,
যে গৃহবধূ আর কোনোদিন তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ
ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না,
যে জননী খোকা এসেছে বলে উদ্দাম আনন্দে অন্তানকে আর
জড়িয়ে ধরতে পাবে না,
যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে বার বার একটি প্রিয়তমার
ছবি চোখে আনতে চেষ্টা করেছিল,
তাদের সবার নামে শাস্তি দাবি করতে এসেছি
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমি তাদের ফাঁসির দাবি
নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাই বোনকে হত্যা করেছে,
যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত
মাতৃ সম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে
আমার এইসব ভাই বোনদের হত্যা করেছে
আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…।
একুশের ঘটনাবলির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ক্রোধের, ক্ষোভের, ঘৃণার, প্রতিশোধের। ঘটনার আকস্মিকতা, অমানুষিকতা সেদিন মানুষকে কি তীব্রভাবে আন্দোলিত করেছিল একুশের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামে রচিত মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর সতের পৃষ্ঠা দীর্ঘ কবিতায় তা ধরা পড়েছিল বিশ্বস্তভাবে। উদ্ধৃত বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত পঙ্ক্তি নিয়ে যে দাবি সোচ্চার তা ছিল সেদিনকার দেশবাসীর সবার। যা কখনও পূরণ হয়নি। দেশে দেশে যুগে যুগে যে দাবি ওঠে, যা কখনও পূরণ হয় না। যে দাবি পূরণের জন্য আরও অনেক রক্ত ঝরে। একুশে আমাদের রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল তাই আমরা তার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিত ফিরে পেতে বিলম্ব হয়নি, তারপর আমরা দেখেছি একুশেতে ইতিহাসের এক মহতি অভিযাত্রার শুরু।
ঠিক তাৎক্ষণিক না হলেও একুশের প্রথম বছরের মধ্যেই যে কয়েকটি কবিতা রচিত হয়েছিল অর্থাৎ ঘটনার উত্তাপ নির্বাপিত হওয়ার আগেই আরও যেসব আবেগ কবিতায় বিধৃত হয়েছিল হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে ফেব্র“য়ারি সংকলনে তা প্রথিত হয়েছে। এ সংকলনটিও নিষিদ্ধ হওয়ার গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়নি, তবে সৌভাগ্যক্রমে তা পুনঃপুন প্রকাশিত হয়েছে।
একুশের ঘটনা একজন কবিকে কীভাবে আলোড়িত করেছিল একুশে নিয়ে যারা কবিতা লিখেছেন, সে কথা তারা লেখেননি, তা আজ স্মৃতি। কিন্তু সে আবেগ যে কত তীব্র, বিধ্বস্ত ও উত্তপ্ত ছিল তা অনুভব করতে পারি যখন শামসুর রাহমান-এর কবিতা পাঠ করি,
আর যেন না দেখি কার্তিকের চাঁদ কিংবা
পৃথিবীর কোনো হীরার সকাল,
কোনোদিন আর যেন আমার চোখের কিনারে
আকাশের প্রতিভা, সন্ধ্যানদীর অভিজ্ঞ আর
রাত্রি রহস্যের গাঢ় ভাষা কেঁপে না ওঠে,
কেঁপে না ওঠে পৃথিবীর দীপ্তমান দিগন্তের তারা।
এই সুন্দর পৃথিবীর নিসর্গের রূপ থেকে কবি নিজেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছেন। ঘটনার পাশবিকতায় ব্যাকুল, বিহ্বল, শোকাতুর কবি প্রকৃতির মোহ থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছেন। উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোতে যে কামনা প্রকাশিত তা আবেগের কোনো স্তর থেকে উৎসারিত তা আরও স্পষ্ট হয় কবি যখন ভয়ংকর কিছুর জন্য অনুনয় করেন,
আগুনতাঁতা সাঁড়াশি দিয়ে তোমরা উপড়ে ফেলো আমার দুটি চোখ
সেই দুটি চোখ, যাদের প্রাজ্ঞ দীপ্তির মৃত্যুহীন, বিদ্রোহী জ্বালায়
দেখেছি নির্মম আকাশের নিচে মানবিক মৃত্যুর তুহিন-স্তব্দতা,
দেখেছি বাস্তুহারা কুমারীর চোখের বাষ্পকণার মতো কুয়াশা ঢাকা
দেখেছি মোহাম্মদ, যীশু আর বুদ্ধের বিদীর্ণ হৃদয়, তাদের রক্ত
ঝরে ঝরে পড়ছে সাদা সাদা দাঁতের কুটিল হিংস তায়।
এ যেন রবীন্দ্রনাথের সুরদাসের প্রার্থনা-এই অপার ভুবন, উদার গগন, শ্যামল কাননতল, বসন্ত অতি মুগ্ধমুরতি, স্বচ্ছ নদীর জল, বিবিধ বরণ সন্ধ্যানীরদ, গ্রহতারাময় নিশি, বিচিত্র শোভা শস্যক্ষেত্র, সুনীল গগনে ঘনতর নীল অতিদূর গিরিমালা সুরদাসকে সতত ভোলায়, কোথায় নিয়ে যায়। তাই প্রার্থনা,
আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ম দীপ্ত প্রভাব রশ্মি-সম-
লও, বিঁধে দাও বাসনাসঘন এ কালো নয়ন মম।
এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই, ফুটেছে মর্মতলে-
নির্বানহীন অঙ্গর-সম নিশিদিন শুধু জ্বলে।
সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও জ্বালাময় দুটো চোখ,
সুরদাসের প্রার্থনা ছিল তার চক্ষু দুটির উৎপাটনের কিন্তু শামসুর রাহমানের আবেদন,
টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলো সূর্যের মতো হৃৎপিণ্ড…
কিন্তু শোনো, এক ফোঁটা রক্তও যেন পড়ে না মাটিতে,
কেননা আমার রক্তের কণায় কণায় উজ্জ্বল স্রোতের মতো
বয়ে চলেছে মনসুরের বিদ্রোহী রক্তের অভিজ্ঞান।
তোমরা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলো আমার হৃৎপিণ্ড-
যে হৃৎপিণ্ডে ঘনঘন স্পন্দিত হচ্ছে আমার দেশের গাঢ় ভালোবাসা,
কবির হৃৎপিণ্ডের ঘনঘন স্পন্দিত আমার দেশের গাঢ় ভালবাসা, কবির হৃদয়ের এ দেশ কোন দেশ? সে দেশের পরিচয় কী? সে দেশের সীমানা কী? কবির অবচেতনায় কী দেশ তথা স্বদেশের আবহমান চিরন্তন প্রতিশ্র“তি উদ্ভাসিত? তারপরে কবির চেতনায় ইতিহাসের কয়েকটি অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে,
দোহাই চেঙ্গিসের উলঙ্গ তরবারি হিংস তার,
দোহাই ফ্যারাওয়ের মামিগন্ধি বীভৎসতার,
দোহাই তৈমুরের পৈশাচিক রক্ত-নেশার
তোমরা নিশ্চিহ্ন করে দাও আমার অস্তিত্ব,
পৃথিবী হতে চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন করে দাও
উত্তরাকাশের তারার মতো আমার ভাস্বর অস্তিত্ব
নিশ্চিহ্ন করে দাও, নিশ্চিহ্ন করে দাও॥
উদ্ধৃত স্তবকে চেঙ্গিসের উলঙ্গ তরবারির হিংস তার, ফ্যারাওয়ের মামিগন্ধি বীভৎসতার, তৈমুরের পৈশাচিক রক্ত-নেশার উল্লেখ প্রতিপক্ষের স্মারক কিন্তু যে অস্তিত্ব ভাস্বর তাকে নিশ্চিহ্ন করার শক্তি কার? কবিতার পরিসমাপ্তিতে উত্তরাকাশের তারার মতো ভাস্বর অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করার যে আহ্বান তা বস্তুত চেঙ্গিস, ফ্যারাও, তৈমুরের উত্তরসূরিদের প্রতি চ্যালেঞ্জ, সে অস্তিত্বের বোধ কবিকে শোকের স্তব্ধতা থেকে বিদ্রোহীতে রূপান্তরিত করে।
একুশের শহীদের নাম প্রথম কবিতায় উচ্চারণ করেন হাসান হাফিজুর রহমান, যে কবিতায় সে নামগুলো উচ্চারিত সে কবিতার শুরুতে রয়েছে মাতৃ সম্বোধন। কবিতাটি আরম্ভ হয়েছে আম্মা তার নামটি একবারও ডাকবে না তবে আর? এ প্রশ্নের উত্তর পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলোতে নিঃসৃত হয়ে আবার জিজ্ঞাসার রূপ নিয়েছে,
ঘূর্ণিঝড়ের মতো সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে ডাকবে,
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতোদিন?
তারপর শহীদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তার দৈহিক গঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিকে মথিত করে, এ শহীদ অচেনা অজানা দূরের মানুষ ছিল না, পরিচিত চত্বরেই ছিল তার আনাগোনা, হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় সে পরিচয়ের অন্তরঙ্গ ছাপ,
আবুল বকর নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
তাকে ডেকো না;
ঐ কবিতায় শহীদের নামের পরিচর্যা করা হয়েছে বেদনা আর মমতা দিয়ে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটা গৌরব একটা অহংকার,
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার- কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারী নাম বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে;
একটি বিশেষ দিনে বিশেষ সময়ে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি মৃত্যু, যারা এর নায়ক তারা এ পৃথিবীর থেকে বিদায় নিয়ে গেল, কিন্তু সে কয়টি নাম মুছে না গিয়ে কী করে চিরন্তন হয়ে গেল কী করে একটা জনগোষ্ঠীর বিস্মৃত স্বদেশকে নতুন করে সৃষ্টি করে দিয়ে গেল, কবির চেতনায় তা অনুভূত হয়েছে,
যাদের হারালাম তারা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে,
কণা কণা করে প্রাণে দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে
আবুল বরকত; সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ন নাম! এক সার জ্বলন্ত নাম।
থোকা থোকা এক সার বিষণ্ন নামের এক সার জ্বলন্ত নামে রূপায়ন এবং দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কণা কণা করে প্রাণে দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়া। হাসান হাফিজুর রহমানের এ দেশ কি শামসুর রাহমানের দেশ থেকে আলাদা? নিশ্চয়ই নয়? হাসানের কবিতার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের কথা এসেছে, কবি বিশ্বাস রেখেছেন জনতার গভীরে,
কৃষাণ যেমন বর্ষার পলিসিক্ত মাঠে রোয়া ধানের চারাগুলি
রেখে আসে সোনালী শস্যের জন্মের আকাক্সক্ষায়
তেমনি সরু সরু অনুভূতিগুলো জনতার গভীরে
বুনে এসেছি।
একুশের তাৎপর্য দেশ ও দেশের মানুষের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস অর্পণ; দেশকে আপন জানা থেকে দেশাত্মবোধের সৃষ্টি হয়, সেদিন মানুষ একটি দেশের কথা জানতে পেরেছিল যা তার নিজের দেশ। স্বদেশের অনুভূতিতে সেদিন যারা গভীরভাবে স্নাত হয়েছিল তাদের আবেগ এ কবিতায় ধরা পড়েছে,
দেশ আমার, ইতিহাসের ধারা যে জ্ঞান আমাকে দিয়েছে, তারই
পবিত্র সন্তান একটি দিনে তোমার হৃদয়ের বিদীর্ণ আভাকে
দেখিয়েছ-বিদীর্ণ আভায় জ্বলেছিল;
সমকালীন মানুষের চেতনায় স্বদেশ সেদিন সহসা সচকিত হয়ে উঠেছিল, দেশ ছিল, ছিল মানুষ। ছিল না স্বদেশ আর তার সন্তান। একুশে দেশকে স্বদেশ করেছে, দেশের মানুষকে দেশের সন্তান করেছে, দেশ হয়ে উঠেছে দেশমাতৃকা। একটি দিন কি আশ্চর্যজনকভাবে সব বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে একটি জাতিকে তার মাতৃভূমি দিয়ে গেল,
দেশ আমার তোমার প্রাণের গভীর জলে স্নান করে এবার এলাম…
একবার তোমার গ্রাম যমুনার ঘোলা স্রোতে দৃষ্টিকে ডুবিয়ে নিয়ে
লক্ষ লক্ষ চারা ধানের মতো আদিগন্ত প্রাণের সবুজ
শিখাগুলো দেখি,
কি আশ্চর্য প্রাণ ছড়িয়েছে- একটি দিন আগেও তা বুঝতে পারিনি,
কি আশ্চর্য দীপ্তিতে তোমার কোটি সন্তানের প্রবাহে প্রবাহে
সংক্রমিত হয়েছে-
একটি দিন আগেও তো বুঝতে পারিনি দেশ আমার।
দেশ আমার বাক্যটির পূর্বশর্ত দেশকে একান্ত আপনার অনুভূত হওয়া, এক্ষেত্রে তা ঘটেছিল। রাষ্ট্র আর দেশ যে একার্থ বা অভিন্ন ছিল না সে বোধেরও সৃষ্টি একুশে থেকে, আবার যে বোধ থেকে স্বদেশ চেতনার সৃষ্টি, এ বোধ ও চেতনার তথা স্বদেশের শত্রুর মোকাবেলার জন্য কবিকে স্বাভাবিকভাবেই মন্ত্রের সাধনা করতে হয়েছে,
হে আমার জ্ঞান একটি মাত্র উচ্চারণের বিষ আমাকে দাও
যা হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়ায়,
ওষুধি জন্মের মতো একবার স্পন্দিত হয়ে যে ঘৃণা আর
কখনো মৃত্যুকে জানে না, হে আমার জ্ঞান।
এ জ্ঞান মাতৃভাষার মন্ত্র, একুশের সঙ্গে মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির চেতনা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যে মাতৃভাষায়,
আয়ুর প্রথম হৃদয়মথিত শব্দ,
মনুষ্যত্বের প্রথম দীক্ষা যে উচ্চারণে
সেই মাতৃভাষার সম্মানের জন্যে যারা যূথবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, জীবনের শত্রু শয়তানেরা সেই পবিত্র দেহগুলো ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের অমর আত্মা ছিনিয়ে নিতে পারেনি, তা আজ স্বদেশ আর স্বদেশবাসীর হৃদয়ে সম্প্রসারিত,
আর আমরা সেই অমর শহীদদের জন্যে
তাদের প্রিয় মুখের ভাষা বাংলার জন্যে একচাপ পাথরের মতো
এক হয়ে গেছি
হিমালয়ের মতো অভেদ্য বিশাল হয়ে গেছি।
হে আমার দেশ বন্যার মতো
সমস্ত অভিজ্ঞতার পলিমাটিকে গড়িয়ে এনে একটি চেতনাকে উর্বর করেছি;
একটি চেতনাকে সমস্ত অভিজ্ঞতা সেদিন উর্বর করেছিল, সেই চেতনা মানুষকে একাত্ম করেছিল, স্বদেশের শত্র“র সঙ্গে দ্বৈরথে সেদিন সবাই এক হয়ে গিয়েছিল,
এখানে রয়েছে মা আর পিতা
ভাই আর বোন, স্বজন বিধুর পরিজন
আর তুমি আমি, দেশ আমার!
এখানে আমরা ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ কটি বছরের ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি,
এখানে আমরা পৃথিবীর শেষ দ্বৈরথে দাঁড়িয়ে,
দেশ আমার, স্তব্ধ অথবা কলকণ্ঠ এই দ্বন্দ্বের সীমান্তে এসে মায়ের স্নেহের
পক্ষ থেকে কোটি কণ্ঠ চৌচির করে দিয়েছে;
এবার আমরা তোমার।
স্বদেশের শত্র“ মোকাবেলায় সেদিন মানুষে মানুষে ব্যবধান ঘুঁচেছিল, দূর হয়েছিল মা আর মাতৃভূমির ব্যবধান। মা তথা মাতৃভূমির জন্যে মানুষ নিবেদন করেছিল নিজেকে। মানুষ সেদিন শহীদ ভাইয়ের মৃত্যুশোক বিস্মৃত হতে পেরেছিল। মা তথা মাতৃভূমিকে খুঁজে পেয়ে মায়ের আকাক্সক্ষা উপলব্ধির মধ্য দিয়ে হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতাটির সমাপ্তি। সে আকাক্সক্ষা কবির মতো সবারই জানা। বায়ান্নর একুশের পর একুশের প্রথম শহীদের রক্ত যেখানে ঝরেছিল সেখানে মানুষ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল, মাত্র একটি রাতের মধ্যে অসংখ্য হাত শহীদদের স্মৃতিতে ওই প্রতীকটি স্থাপন করেছিল, পরদিন সেটি হয়ে উঠেছিল তীর্থক্ষেত্র কিন্তু প্রতিক্রিয়ার হস্ত ওই প্রতীকটি নিশ্চিহ্ন করে দিতে বিলম্ব করেনি। কিন্তু ওই একটি মাত্র দিনের ঘটনা, প্রথম শহীদ মিনারে পুষ্পের স্তবক সেদিন মানুষের জন্য ছিল এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। সেই স্মৃতির মিনার যখন চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ধূলিকণাসহ অপসৃত হল তারও একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সমকালীন কবির কবিতায় ধরা পড়েছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের ভাষায়,
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো।…
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চার কোটি পরিবার।
শুধু শহীদ মিনার নয়, যাদের স্মৃতিতে সেই মিনার, তাদের মৃত্যুকে মহিমাময় করেছেন আজাদ। যে মৃত্যুতে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠে, রচিত হয় কবিতা, বাঁধা হয় গান, সে মৃত্যু অমরতার অপর নাম, তার প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন,
এ কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্র“?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
বিরহে যেখানে নেই হাহাকার?
এই জনপদের ইতিহাসে মানুষ এর আগে কোনো মৃত্যুকে এত মহিমা আরোপ করেনি, সাধারণ মানুষ মৃত্যুর কারণে এত অসাধারণত্ব লাভ করেনি, তারা শুধু শহীদ বলে পরিগণিত হয়নি, তারা কিংবদন্তির নায়কে পরিণত হয়েছে। আমাদের যে পুরাণ ছিল না একুশে সে পুরাণের অভাব পূরণ করেছে। সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায় একুশের সে মহিমা কীর্তিত,
দেশের মানুষ একটি দণ্ডে
একাত্ম হয়েছিল, স্নায়ু-গ্রন্থিতে পাঁজরে-পেশীতে,
মেখে দিয়েছিল একটি অঙ্গীকার-
সেদিন প্রথম।
এবং প্রথম নতুন দিগ¦লয়ে
সঞ্চারমান এ দেশের ইতিবৃত্ত।
একুশে ফেব্র“য়ারি শুধু কিংবদন্তি, কেবল ঐতিহ্য বা নিছক পুরাণ নয় একুশে আধুনিক পুরাণ। তাই একুশে এদেশের ইতিবৃত্তকে নতুন দিগ¦লয়ে সঞ্চারমান করেছিল। তারপরে আরও অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে, আরও অনেক বড় সংগ্রাম, গভীর ত্যাগ, ভয়াবহ যুদ্ধ হয়ে গেছে, আরও অনেক অনেক রক্ত ঝরেছে কিন্তু একুশের মহিমাকে কোনো ঘটনা ক্ষুণœ করতে পরেনি, অতিক্রম করতে পারেনি। আর কোনো দিন, কোনো ঘটনা এ দেশে আর দেশবাসীর হৃদয়ে এত গভীর দাগ কাটতে পারেনি, কারণ, সেদিন আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল,
চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রা
নানান মুখীন হাজার লোকের
একত্র অস্তিত্ব
একুশে ফেব্রুয়ারি
রক্তঝরা একুশের রঙ লাল, একুশের স্মৃতি রক্তাক্ত, কিন্তু একুশের পতাকার রঙ কালো, শোকের চিহ্ন। একুশেতেই এ দেশে প্রথম কালো পতাকা ওড়ে, যে পতাকা প্রায় বিশটি বছর এ দেশের জাতীয় পতাকার মতো উড়েছে যতদিন না লাল সূর্যখচিত পতাকার উদয় হয়েছে ততদিন। একুশের রঙিন ও সশব্দ চিত্রকল্প সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায়,
কালো পতাকায়
প্রাচীর-পত্রে
অশ্রু-তরল রক্তরঙের লিপি
ক্রোধের
ঘৃণার
ভয়াল বিস্ফোরণ
একুশে ফেব্রুয়ারি।
একুশের কবিতা রচিত হয়েছিল তাৎক্ষণিক আবেগে কিন্তু প্রয়োজন ছিল গানেরও, তাই একটি কবিতা গান হয়ে উঠেছিল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতা আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একটি কবিতা হিসেবেই রচনা করেছিলেন যা আবৃত্তি করা হয়েছিল গেণ্ডারিয়া ধূপখোলা মাঠে যুবলীগের এক উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে। আবদুল লতিফের সুরে ওই কবিতা প্রথম গান হয়ে ওঠে আবদুল লতিফ ও আতিকুল ইসলামের কণ্ঠে। তিপ্পান্ন সালের একুশে ফেব্র“য়ারি শহীদ দিবসে ঢাকা কলেজের অনুষ্ঠানে ওই গান গেয়ে আর ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার তুলে আতিকুল ইসলাম এবং আরও কয়েকজন কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে আলতাফ মাহমুদ গানটি আবদুল লতিফের কাছ থেকে শিখে নেন এবং আরও পরে নতুন করে সুর করেন। এখন আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি গীত হয়। একুশে প্রথম গান শুধু একুশের স্মৃতিচারণ নয় বরং তার স্তবকে স্তবকে যে প্রশ্ন, যে জবাব তা ছিল সেদিনকার জিজ্ঞাসা ও উত্তর,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবি
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না, খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্র“য়ারি একুশে ফেব্র“য়ারি॥
রচনাটি একটি স্তবকে একটি দেশের উল্লেখ আছে আর আছে সে দেশের নাম, একুশের কোনো রচনায় স্বদেশের নামোল্লেখ বোধ করি এই প্রথম। এই স্তবকে আরও উল্লেখিত আছে, আরেক শ্রেণীর মানুষের কথা ঘৃণার সঙ্গে :
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের ভাইয়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবিকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুসের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্র“য়ারি একুশে ফেব্র“য়ারি!!
একুশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যে কবিতাগুলো সৃষ্টি হয়েছিল তার কয়েকটিতে আবেগের যে পরিচর্যা পাওয়া গেল পরবর্তীতে রচিত কবিতাগুলোতে তার অনুরণন ছাড়াও নব নব প্রেক্ষিত যুক্ত হয়েছে। প্রতি বছর একুশেতে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে সে পরিচয় ছড়িয়ে আছে, পরে রচিত কবিতাগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই একুশের স্মৃতি দূরাগত। কিন্তু শহীদ স্মৃতির অমরতা অমলিন। ক্রমে ক্রমে প্রাধান্য পেয়েছে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার চেতনা, মাতৃভূমি তথা বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর সামগ্রিকভাবে মানুষের সংগ্রাম। বাংলা ভাষা তথা বাংলা বর্ণমালা বাঙালির সত্তায় ইতিমধ্যে যে আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সগৌরব পরিচয়, শামসুর রাহমানের বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা কবিতায়,
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের পূত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই।
আটচল্লিশ থেকে ঊনসত্তরের মধ্যে বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক চক্রান্ত গেছে। বাংলা বর্ণমালা উচ্ছেদের প্রয়াস কবিকে একটা সময়ে ব্যথিত করেছিল, বাংলা বর্ণমালাকে বায়ান্নর একুশের স্মৃতির ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত করে কবি বেদনার্ত হয়ে লিখেছিলেন,
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহিয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংস তা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি।
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষ মাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা!!
কিন্তু কবির ওই হতাশা, নৈরাশ্য, বেদনা কেটে যায় ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থানে। ফেব্র“য়ারি ১৯৬৯ কবিতাকে ফেব্র“য়ারি ১৯৫২ ফিরে আসে নবগৌরবে। একুশের শহীদেরা বিগত বছরগুলোতে কবিতা ও গানে যেভাবে উচ্চারিত হয়েছিল তাতে একটা একঘেয়েমি, একটা গতানুগতিকতা এসে গিয়েছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তারা আবার নতুন করে সৃষ্টি হল, শামসুর রাহমানের ভাষায়,
বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা,
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
লক্ষণীয় যে, শামসুর রাহমান বাংলা বর্ণমালা নিয়ে খেঙরার নোংরামি, খস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস প্রত্যক্ষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা সেই কবি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে জনসাধারণের সঙ্গে একাÍ হয়ে ওই হতাশা আর নৈরাশ্য থেকে মুক্তি লাভ করে বলছেন,
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবে চত্বরে
তিপ্পান্ন সাল থেকে একাত্তর সালের প্রতি বছর একুশে ফেব্র“য়ারি শহীদ দিবস উপলক্ষে আমাদের দেশে অসংখ্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সেসব সংকলনে সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত হয়েছে কবিতা। একুশের তথা বাংলা ভাষার শহীদদের জন্যে এ দেশের মানুষের অকৃত্রিম আবেগের প্রকাশ ঘটেছে ওইসব কবিতায়। একুশে ফেব্র“য়ারি বা একুশের শহীদদের নিয়ে যত কবিতা লেখা হয়েছে তার সবই কালোত্তীর্ণ হয়নি কিন্তু একুশে নিয়ে যারা কবিতা রচনা করেছেন তাদের আবেগ ছিল অকৃত্রিম।
১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি প্রথম শহীদ দিবসে প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়েছিল গাজীউল হক রচিত ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্র“য়ারি ভুলব না সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে অবস্থিত সেকালের ব্রিটানিয়া সিনেমা হল মঞ্চে প্রথম গাওয়া হয়েছিল আবদুল লতিফের সুরে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি। একুশের প্রথম সংকলন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্র“য়ারি (মার্চ ১৯৫৩)-তে তোফাজ্জল হোসেনের একটি গান রয়েছে, রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি। তবে একুশের রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে একুশের গান অবশ্য প্রথম রচিত হয়েছিল খুলনায় মশাররফ উদ্দিন আহমদ রচিত মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে। অপর একটি গান শামসুদ্দীন আহমদ রচিত সেটি হল, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি। আবদুল লতিফের বিখ্যাত গান ওরা আমার মুখের কথা কাইরা নিতে চায় রচিত ও গীত হয়েছিল প্রথম ১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্র“য়ারি। একুশের প্রথম দুটি গানে অর্থাৎ মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি পরবর্তীতে সুর করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি, আমি কি ভুলিতে পারে গানে আবার সুরারোপ করে অমর হয়ে গিয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। বাংলা ভাষার শহীদদের নিয়ে রচিত গানে সুরারোপ এবং ষাটের দশকে ওইসব গানকে জনপ্রিয় করে তোলার অপরাধেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান বাহিনী তাকে আটক এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে পৈশাচিক দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করে কিন্তু বীর শিল্পী আলতাফ মাহমুদ পাকিস্তান বাহিনীর নির্দেশ মতো পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি উচ্চারণ করতে অসম্মত হন এবং জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মহাবীর নায়কের মতো মৃত্যুবরণ করেন। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের এই অকুতোভয় শিল্পী সৈনিককে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম বা বীর প্রতীক কোনো উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়নি যদিও একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দুজন শিল্পীর বাড়িতে ঢাকার মুক্তিবাহিনীর ব্যবহারের জন্য অস্ত্র মজুদ থাকত তারা হলেন কণ্ঠশিল্পী আলতাফ মাহমুদ এবং বংশী বাদক ওস্তাদ ধীর আলি মিয়া। কি অপরিসীম সাহস থাকলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোতে নিজের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র ভাণ্ডার রাখা যায় তা সহজেই অনুমেয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি গানের প্রথম সুরকার আবদুল লতিফ ১৯৫৪ সালের একুশে ফেব্র“য়ারি উপলক্ষে রচনা করেছিলেন দীর্ঘ সঙ্গীত ওরা আমার মুখের ভাষা/কথা কাইড়া নিতে চায়, ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়। বাংলা লোকগাথার আদলে লোক সুরে জারী গানের আঙ্গিকে রচিত এই গানটিতে আবহমান বাংলা ও বাঙালির মুখের ভাষা ও কণ্ঠের গানের ঐতিহ্য মূর্ত হয়ে উঠেছে। আবদুল লতিফ একাত্তরের নয় মাস তার গ্রামের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন, রেডিওর স্টাফ আর্টিস্ট হওয়া সত্ত্বেও একদিনের জন্যেও ঢাকা বেতার থেকে কোনো অনুষ্ঠান করেননি আর সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অহরহ তার রচিত ও সুরারোপিত দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হয়েছে। আবদুল লতিফের অবদান আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অত্যন্ত বলিষ্ঠ আর তার স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছিলেন স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে। অপর একজন মহান শিল্পী শেখ লুৎফর রহমান যার সুরারোপিত বলিষ্ঠ গণসঙ্গীতগুলো ভাষা, স্বাধিকার, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে বারবার গীত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে সিকান্দার আবু জাফর রচিত শেখ লুৎফর রহমান সুরারোপিত জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই জনতার সংগ্রাম চলবেই গানটির উদাহরণ যথেষ্ট। আমরা শামসুদ্দীন আহমদ রচিত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলিরে গানটি উদ্ধৃত করছি,
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালি
(তোরা) ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।
ও বাঙালি…।
মা-ও কান্দে বাপ-ও কান্দে জোড়ের ভাই
বন্ধু বান্ধব কাইন্দা কয় হায়রে খেলার সাথী নাই
রে বাঙালি…।
ইংরেজ যুগে হাঁটুর নিচে চালাইতো গুলি
স্বাধীন দেশে ভাইয়ে ভাইয়ে, উড়ায় মাথার খুলি
রে বাঙালি…।
গুলি খাওয়া ছাত্রেরই লাশ কবরে না দেয়
সেই লাশের উপর পেট্রল দিয়া হায়রে আগুনে পোড়ায়
রে বাঙালি…।
গুলি খাওয়া বাঙালির রুহ কাইন্দা কাইন্দা কয়
তোমরা বাঙালি মা ডাকিয়ো আমার
জনম দুঃখী মায়েরে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত