| 29 নভেম্বর 2024
Categories
জীবন যাপন লোকসংস্কৃতি

বাঙালি ফ্যাশনের আদিকথা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

সৃষ্টির আদি লগ্নে মানুষ পশুর চামড়া, পাখির পালক,গাছের বাকল ও লতা-পাতাকে পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করত এ কথা সবার জানা। তবে চিন্তাশিল ও বৈচিত্রপ্রিয় মানুষ নিজেকে সুন্দররূপে সাজাতে পছন্দ করে।

সৃষ্টির আদি লগ্নে মানুষ পশুর চামড়া, পাখির পালক,গাছের বাকল ও লতা-পাতাকে পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করত এ কথা সবার জানা। তবে চিন্তাশিল ও বৈচিত্রপ্রিয় মানুষ নিজেকে সুন্দররূপে সাজাতে পছন্দ করে। এরই ধারাবহিকতায় পরিধান থেকে শুরু করে সব কিছুতেই পরিবর্তনের চেষ্টাটা তার সহজাত।

দুনিয়ার সব জাতিই তার নিজ অঞ্চলের আবহাওয়া, ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে নিজস্ব রীতির পোষাকের একটি পরিচয় তৈরি করে নিয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ফ্যাশন রীতিও তার গতি আর বাঁক বদলায় নদীর মতই। তাই একেক জাতির ফ্যাশনের ধাঁচ আর বৈশিষ্ট্য একেক যুগে একেকরকম রূপ নেয়। অর্থাৎ মূল বৈশিষ্ট্যটা ঠিক থেকে কিছুটা বদলে যায় এর রং, ঢং, আঙ্গিক আর সৌকর্য শৈলী।

একইভাবে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাঙালি জাতির ফ্যাশনেও রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্র। আছে ধারাবাহিকতা। আধুনিক বা নিকট অতীতের বাঙালির ফ্যাশন রুচি বা রূপটা তো আমরা জানি। কিন্তু কেমন ছিল বাঙালির আদি ফ্যাশনের স্বরূপটা? কেমন ছিল সেসব দিনের মানুষের পোশাক-আশাক! তাদের চালচলন? আসুন এ ব্যাপারে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক:

কাপড়-চোপড় ও পরার স্টাইল
বাঙালির সাধারণ পোশাক ছিল সেলাইবিহীন একবস্ত্র। সেলাই করে জামা-কাপড় উত্তর-পশ্চিম ভারত হতে আমদানি হতো। কিন্তু সেটা অনেক পরে। পুরুষেরা পড়তো ধুতি, মেয়েরা শাড়ি। সামাজিক তথা আর্থিক অবস্থা ভালো হলে গায়ের ওপর একখণ্ড কাপড়ের ব্যবহার ছিল। এটা পুরুষের ক্ষেত্রে ছিল উত্তরীয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওড়না।

php glass

মেয়েদের এই ওড়না প্রয়োজনে ঘোমটার কাজ করত। তবে সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তে এক কাপড়ই যথেষ্ঠ ছিল এবং এরা প্রয়োজনে এর আঁচল দিয়েই ঘোমটার কাজ চালাত।

ধুতি এখনকার তুলনায় ছিল অনেক ছোটো। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ছিল প্রস্থ। নারীরাও প্রায় একইভাবে কাপড় পড়তো। তবে কাপড় ছিল পায়ের কব্জি পর্যন্ত ঝোলানো। তখনকার ফ্যাশন রীতিতে প্রায় পুরো কাপড়টা কোমরে পেঁচিয়ে নিতে হত। আঁচল দিয়ে দেহের ওপরের অংশ ঢাকার ব্যাপার ছিল না। তবে অভিজাত বা বনেদী মেয়েরা ওড়না দিয়ে দেহের ওপরের অংশ ঢেকে রাখত।
৭ম ও ৮ম শতকের দিকে কাপড়ে ফুল, লতাপাতা ইত্যাদির নকশার প্রচলন হয়, যা পশ্চিম ভারত থেকে আসে।

বিশেষ উপলক্ষে বিশেষ পোষাকের ব্যবস্থা তখনো ছিল। নর্তকীরা কোমড় থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আঁটসাঁট পাজামা, আর গলায় বড় একটা ওড়না ব্যবহার করত।

সাধু-সন্ন্যাসী ও দরিদ্র শ্রমিকেরা পড়তো নেংটি।
সৈন্য ও মল্লবীররা হাঁটু পর্যন্ত আঁটো পাজামা পড়তো।
শিশুরা পড়তো হাঁটু পর্যন্ত ধুতি নয়তো আঁটো পাজামা।

সূক্ষ্ণ কার্পাস ও রেশম কাপড়ের জন্য বাংলাদেশ ছিল বিখ্যাত। তবে এসব ছিল উচ্চবিত্তের জন্য। সাধারণ দরিদ্রের কপালে জুটত মোটা ছিন্ন ও জীর্ণ কার্পাস কাপড়।

মাথার ফ্যাশান
মাথায় ঘোমটা অথবা টুপি পরার বাধ্যবাধকতা বাঙালি ইতিহাসে কখনোই ছিলনা। মাথায় লম্বা বাবরী চুল; কোঁকড়া কোঁকড়া চুল কাঁধের ওপর থোকায় থোকায় ঝুলত। কেউ কেউ আবার মাথার উপর প্যাঁচানো ঝুটি রাখতো। মেয়েরা লম্বা চুল খোঁপা করে বেঁধে রাখতো, কেউ কেউ ঘাড়ের ওপর পেছন দিয়ে পিঠে এলিয়ে দিত এখনকার মতই।

শিশুদের চুল তিনটি `কাকপক্ষ` গুচ্ছে মাথার ওপর বাঁধা থাকত।

পাদুকা  
সৈন্য ও প্রহরীরা ফিতাবিহীন, পায়ের কণ্ঠা পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার জুতা পড়তো। তবে সাধারণ লোকেরা জুতা ব্যবহার করতো না। ধনীরা কাঠের পাদুকা (কাষ্ঠ পাদুকা বা খড়ম) ব্যবহার করতো।

মুখের সাজসজ্জা

বিবাহিত নারীরা কপালে কাজলের টিপ, সিঁথিতে ও ঠোঁটে সিঁদুর, পায়ে লাক্ষারস, শরীর ও মুখে চন্দনের গুড়া ও চন্দন বাঁটা এবং জাফরান ব্যবহার করত। ধনী বিবাহিতা নারীরা সন্ধ্যায় স্নান (গোসল) করে প্রসাধন ও অলংকার দিয়ে খুব সাজত।

গ্রামের মেয়েরা নগরের মেয়েদের সাজসজ্জা পছন্দ করত না। গ্রামের মেয়েরা যদি শহুরেদের নকল করার চেষ্টা করত তাহলে সামাজিক শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল। তবে গ্রামের মেয়েরাও কপালে কাজলের টিপ পড়তো, বিবাহিতারা হাতের শোভা বাড়াতে পড়তো শঙ্খের সাদা বালা, কানে কচি রীঠাফুলের দুল আর চুলে সুগন্ধ তেল।

কাজের ধরন
পুরুষেরা মাঠে আর মেয়েরা সংসারের হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে সব কাজ করত।

এই ছিল আমাদের আদি ফ্যাশনের রূপ তথা লাইফস্টাইল। তারই উত্তরসূরি আজকের আমরা। সেকালের সেই ফ্যাশন রীতি আর বৈশিষ্ট্যের ওপর ভর করেই যুগে যুগে বিভিন্ন ঐতিহাসিক-সামাজিক পটপরিবর্তনে ধীরে ধীরে আজকের বৈচিত্রময় বাংলাদেশি-বাঙালি ফ্যাশনের রূপ গড়ে ওঠেছে।

 

 

 

তথ্যসূত্র আর সি মজুমদার এর হিস্টরি অব বাংলা, নিহার রঞ্জন রায় এর বাঙালির ইতিহাসঃ আদি পর্ব।
দীনেশ চন্দ্র সেন এর বাংলার পুরনারী।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত