| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ গল্প সাহিত্য

ফ্রানৎস কাফকা’র গল্প আইনের দরজায়

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

।।বিদ্যুৎ খাসনবিশ।।


আইনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন প্রহরী। গ্রাম থেকে আসা এক লোক তার কাছে ভেতরে যাবার অনুমতি চায়। কিন্তু প্রহরী সাফ জানিয়ে দেয়, এই মুহূর্তে ভেতরে যাবার অনুমতি সে দিতে পারবে না। গ্রাম্য লোকটি খানিকক্ষণ ভেবেচিন্তে আবারও জানতে চায়, পরে কোন এক সময় ভেতরে যাবার অনুমতি সে পাবে কিনা। প্রহরী বলে, ‘‘পরে সম্ভব, কিন্তু এখন নয়।’’
অন্য দিনের মত আইনের দরজা আজও খোলা। প্রহরীও একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে। এই সুযোগে লোকটি তার ঘাড় কিছুটা নিচু করে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করে। এ দৃশ্য নজরে পড়তেই প্রহরী হেসে বলে: ‘‘এতই যদি লোভ তবে আমার নিষেধ সত্বেও চেষ্টা করে দেখ না একবার, ভেতরে যেতে পার কিনা। তবে মনে রেখো: আমি ক্ষমতাবান। আর আমি এখানকার সবচেয়ে নিম্নপদস্থ প্রহরী। ভেতরের প্রতিটা কক্ষের সামনেই প্রহরী আছে, তারা প্রত্যেকেই তাদের পূর্ববর্তী প্রহরীর চেয়ে আরো বেশি ক্ষমতাবান। এমনকি, তৃতীয় প্রহরীর দিকে এক পলক তাকাবার সাহস আজও আমার হয়নি।’’
গ্রাম থেকে আসা লোকটি এতটা প্রতিবন্ধকতা প্রত্যাশা করেনি। তার চিন্তা-চেতনা বলে: আইনের দরজা সবার জন্য সবসময় উন্মুক্ত থাকা উচিত। কিন্তু যখন সে প্রহরীকে আরো কাছ থেকে লক্ষ্য করল, বিশেষ করে তার পশমের কোট, দীর্ঘ সুচাগ্র নাক, লম্বা-পাতলা-কালো তাতারদের মত দাড়ি, সে সিদ্ধান্তে পৌঁছল: ভেতরে যাবার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই মঙ্গলজনক হবে। প্রহরী তাকে একটি টুল দিয়ে আইনের দরজার এক পাশে বসার অনুমতি দেয়। লোকটি সেখানেই বসে থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। এই সময়ের মধ্যে সে বহুবার চেষ্টা করেছে ভেতরে ঢুকার। তার অনুনয়-বিনয় শুনতে শুনতে প্রহরীও ক্লান্ত। প্রহরী লোকটিকে মাঝে মধ্যেই জেরা করে, সবই ছোটখাটো প্রশ্ন– তার গ্রাম সম্পর্কে এবং এরকম আরো অনেক বিষয়ে। কিন্তু এসবই ছিল গড়পড়তা প্রশ্ন, উচ্চমার্গের লোকেরা সৌজন্যবসত যেসব প্রশ্ন করে থাকে আরকি। তবে প্রতিবারই জেরার শেষে প্রহরী তাকে একই কথাই শুনিয়েছে: এখনও সে তাকে ভেতরে যাবার অনুমতি দিতে পারবে না।
গ্রামের লোকটি ভ্রমণের প্রয়োজনে সাথে করে অনেক কিছুই নিয়ে এসেছিল। যত মূল্যবানই হোক না কেন, সে ওগুলোই প্রহরীকে ঘুষ দিয়েছে, শুধু তার মন জয় করার আশায়। লোকটি যাই দিয়েছে প্রহরী তার সবই নিয়েছে এবং বলেছে: ‘‘আমি এগুলো নিচ্ছি যাতে তুমি অন্তত এ কথা না ভাব যে তোমার চেষ্টায় ত্রুটি ছিল।’’ গ্রাম থেকে আসা লোকটি অনেকগুলো বছর ধরে এই প্রহরীকে নিরন্তর পর্যবেক্ষণ করেছে। সে অন্য প্রহরীদের কথা ভুলেই গেছে। কারণ এই প্রহরীই আইনের কাছে পৌঁছুবার পথে একমাত্র বাধা।
লোকটি এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিকে অভিশাপ দেয়। শুরুর বছরগুলোতে সে তার দুর্ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়েছে উচ্চস্বরে, কোন চিন্তাভাবনা না করেই আর এতগুলো বছর পর, যখন সে বৃদ্ধ, সে অভিশাপ দেয় বিড়বিড় করে। তার আচরণ এখন শিশুর মত। অনেকগুলো বছর সে এই প্রহরীকে পর্যবেক্ষণ করছে, তার পশমি কোটের কলারের উঁকুনগুলোও এখন তার চেনা। লোকটি এখন ঐ উঁকুনগুলোকেই অনুরোধ করে তার হয়ে প্রহরীর কাছে সাহায্য চাইবার জন্য। তার দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এতটাই ক্ষীণ যে সে বুঝে ওঠতে পারে না তার চারপাশটাই অন্ধকার নাকি তার চোখ জোড়াই তাকে ধোঁকা দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা সত্বেও লোকটি বুঝতে পারে আইনের দরজার ফাঁক গলিয়ে একটি উজ্জ্বল আলোর দীপ্তি ঠিকরে বেরুচ্ছে।
তার হাতে খুব একটা সময় নেই এখন, মৃত্যু আসন্ন। মৃত্যুর আগে এতগুলো বছরের অভিজ্ঞতা তার মাথায় জড়ো হয় একটি প্রশ্ন হয়ে, যে প্রশ্ন আজ অবধি সে ঐ প্রহরীকে করেনি। সে প্রহরীকে কাছে এগিয়ে আসার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করে। নিজের অসার দেহটাকে টেনে তোলার মত শক্তি তার এখন নেই।
লোকটির কথা শুনার জন্য প্রহরীকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়তে হল। দু’জনের দৈহিক উচ্চতার তফাৎ দিনে দিনে অনেক বেড়েছে। ‘‘তুমি এখন আবার কী জানতে চাও?’’ প্রহরী জিজ্ঞেস করে, ‘‘তোমার তৃষ্ণা কোনদিনই মিটবে না দেখছি।’’
‘‘সবাই তো আইনের কাছে পৌঁছুবার চেষ্টা করে। কিন্তু এতগুলো বছরেও আমি ছাড়া আর কেও এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করেনি কেন?’’ লোকটি প্রহরীকে জিজ্ঞেস করে। প্রহরী লক্ষ্য করে, লোকটি এখন মৃত্যুপথযাত্রী। তার শ্রবণশক্তির দুর্বলতার কারণে সে লোকটির কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘‘চাইলেও এই দরজা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারতো না। কারণ এই দরজা শুধু তোমার জন্যই খোলা ছিল। আর এখন আমি ওটা বন্ধ করতে যাচ্ছি।’’

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত