আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট“লিটিল ম্যাগাজিন কী ও কেন? এই নিয়ে বাঙালি লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটা বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরেই আছে। অনেকেই একে বড় পত্রিকার বিকল্প ভাবেন। আসলে ছোট পত্রিকা বা লিটিল ম্যাগাজিন নীরবে কাজ করেছে বা কাজ করে চলেছে , তবু এর ভেতরে রয়েছে বারুদ।সে বিশেষ কিছু বলতে চায়। যে কথা সচরাচর বলা যায় না তাই লিটিল ম্যাগাজিনে বলা যায় । যেমন মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের।”
এই সময়ের আলোচিত বিষয় লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে লিখেছেন অমিতাভ দাস।
লিটিল ম্যাগাজিন কী ও কেন? এই নিয়ে বাঙালি লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটা বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরেই আছে। অনেকেই একে বড় পত্রিকার বিকল্প ভাবেন। কেউ কেউ ভাবেন প্রতিযোগী। আবার অনেকে জানেন না লিটিল ম্যাগাজিন আসলে কী? তা নিয়েই দু-চার কথা লিখতে বসা। একটু বলার চেষ্টা করা লিটিল ম্যাগাজিন বলতে কী বুঝি আমরা? লিটল বা লিটিল ম্যাগাজিন ছোট পত্রিকা এই অর্থেই প্রযুক্ত। তবে এই ছোট তুচ্ছার্থে বা ক্ষুদ্রার্থে ব্যবহৃত নয়। লিটিল শব্দটি ‘জার্মান’ শব্দ, অর্থ ‘ছোটো’ আর ‘ম্যাগাজিন ‘অর্থে’ বারুদের স্তুপ’।যে’সব পত্রিকা কলেবরে ছোট কিন্তু ভাবনায় বৃহৎ তাই ছোট পত্রিকা। এই ছোট পত্রিকা কথাটার ভিতরে একটা কৌলিন্য তথা আভিজাত্য আছে। এই ছোটো কথাটা একটা প্রতিবাদ। বুদ্ধদেব বসু যেমন বলতেন “একজোড়া মলাটের মধ্যে সবকিছুর আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বহুলতম প্রচারের ব্যাপকতম মাধ্যমিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।” তিনি বলতেন যে পাঁচ-ছয় ফর্মার ওপরে যেন না যায় ছোট পত্রিকা। যদিও সর্বদা তা রক্ষিত হয়নি বা হয় না। আমরা জানলাম লিটিল ম্যাগাজিন কথাটি বিদেশ থেকে আমদানীকৃত। আমরা ছোট পত্রিকাকে অনায়াসে ‘চড়ুইপত্র’ বলতেই পারি। এমন অনেক পত্রিকা আছে যা সমকালে তেমন গুরুত্ব পেল না। তার পৃষ্ঠা ভালো না, ছাপাও হয়ত খারাপ কিন্তু সেখানে এমন সব লেখা আছে যার জন্য বহু বছর পর পাঠক সেই পত্রিকাটি খুঁজবেন; বেশি অর্থ দিয়ে কিনবেন। অর্থাৎ লিটিল ম্যাগাজিন কখনো মন জোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিল। সমকাল ছাপিয়ে তার প্রাসঙ্গিকতা বহু দূর বিস্তৃত। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সম্পদ-স্বরূপ। যেমন ধরুন, শতভিষা, কবিতা, কৃত্তিবাস, পরিচয় , চতুরঙ্গ… এমন আরো অনেক পত্রিকাই আছে, কেবল সমকালে নয়, আজো পাঠক খুঁজে খুঁজে পড়ে। আমিই যেমন ২০০১/২০০২ সালে বইমেলায় বিকল্পের স্টল থেকে বেশ কয়েকটি পুরনো’ কবিতা ‘পত্রিকা কিনেছিলাম, প্রত্যেকটি কপির দাম ছিল ২০০ টাকা। আমি সেগুলি বাঁধাই করে রেখেছি। যা আমার কাছে সম্পদ। এই অর্থে পত্রিকার কৌলিন্য- এই আভিজাত্য ছোট পত্রিকার মর্মমূলে নিহিত বলেই বিশ্বাস করি। অনেকেই বলেন, লিটিল ম্যাগাজিন আকারে ছোট, অনিয়মিত বা বেশি দিন বাঁচে না অথবা এর প্রচার কম তাই লিটিল ম্যাগাজিন। মনে হয় এই কথাগুলির সবকটিই সত্য।
অনেক সমালোচকের মতে সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “ভ্রমর” বাংলাভাষার প্রথম লিটিল ম্যাগাজিন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘সঞ্জীবনী সুধা’-তে লিখেছেন,” যাহারা বঙ্গদর্শনের মূল্য দিতে পারে না, অথবা বঙ্গদর্শন যাহাদের পক্ষে কঠিন, তাহাদের উপযোগী একখানি মাসিক পত্র প্রচার বাঞ্ছনীয় বিবেচনায়, তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম যে তাদৃশ কোন পত্রের স্বত্ত্ব ও সম্পাদকতা তিনি গ্রহণ করেন। সেই পরামর্শনুসারে তিনি ভ্রমর নামে মাসিক পত্র প্রকাশিত করিতে লাগিলেন। এই পত্রিকার আয়ু ছিল অল্পকালের। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, এক কাজ তিনি নিয়ম মতো অধিক দিন করিতে ভালোবাসিতেন না। ভ্রমর লোকান্তরে উড়িয়া গেল। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি সম্পাদকের মন-মর্জির ওপর লিটিল ম্যাগাজিন নির্ভরশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। তারুণ্যের আবেগ লিটিল ম্যাগাজিনের মূল চালিকা শক্তি। ওই যে লিটিল ম্যাগাজিন আবেগ চালিত ফলত অর্থ কষ্টে এক সময় তা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন,কোনো রকম বানিজ্যের কথা না ভেবেই লিটিল ম্যাগাজিন করা। এ যেন তুমুল এক উন্মাদনা। কিছু বলতে চাই- আমাদের কথা বলতে চাই। তাই লিটিল ম্যাগাজিন করা। আসলে ছোট পত্রিকা বা লিটিল ম্যাগাজিন নীরবে কাজ করেছে বা কাজ করে চলেছে, তবু এর ভেতরে রয়েছে বারুদ।সে বিশেষ কিছু বলতে চায়। যে কথা সচরাচর বলা যায় না তাই লিটিল ম্যাগাজিনে বলা যায়। যেমন মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। তিনি “সবুজ পত্রে” এমন অনেক লেখা লিখেছেন যা বড় বড় কাগজে বলতে পারেননি। সেই সব বিশেষ কথা, প্রচলিত আবর্তের বাইরে যে কথা তাই বলতে চায় লিটিল ম্যাগাজিন। তার পাঠক-বৃত্ত কম হলেও, যাঁরা পড়েন তাঁরা মননধর্মী, চিন্তাশীল, দীক্ষিত, রুচিবান অন্যধারার পাঠক।
যদি বলি ছোট পত্রিকা লেখকদের আঁতুর ঘর, তা কী খুব অত্যুক্তি হবে? ছোট পত্রিকার হাত ধরেই তো নতুন নতুন লেখক উঠে আসেন। তাহলে তা ছোট হয় কীভাবে? দীর্ঘদিন ছোট পত্রিকার এক সামান্য কর্মী হিসেবে বলতে পারি ছোট পত্রিকা আমাদের গর্ব, আমাদের অহং। ঐ ছোটত্বের মধ্যে বৃহতের বীজটুকু ভরা। হয়ত তার জৌলুষ নেই, আড়ম্বর নেই। যা আছে তা নিষ্ঠা, স্নেহ, গভীর মনন। আত্ম প্রেরণার নিষ্ঠা নিয়েই ছোট পত্রিকা। সে ব্যতিক্রমী, সহজ ভাবের অথচ প্রজ্ঞাবান। যাকে আপনি মুড়ে ইচ্ছে করেই ট্রেনের কামড়ায় ফেলে আসতে পারবেন না (যদি সত্যিই সাহিত্য-সাধক হন)। এইখানেই ছোট পত্রিকার মহত্ব। আসলে অনেকেই লিটিল ম্যাগাজিনকে যেমন গৌরবের মনে করেন, আবার অনেকে অবহেলাও করেন। তুচ্ছ -তাচ্ছিল্য পেয়ে থাকেন লিটিল ম্যাগাজিনের কর্মীরা। তবে এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব অনেক বদলে যাচ্ছে। লিটিল ম্যাগাজিন মেলা হচ্ছে, সংরক্ষণ হচ্ছে, সম্পাদকরা সম্মানিত হচ্ছেন। এসব আশার দিক। লিটিল ম্যাগাজিন তরুণের স্বপ্ন- বুকের বারুদ-আগুনের পাখি। যে সহজেই সমাজের ভুল বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে। বাজারি কাগজের খারাপ ও রুচিহীন লেখার বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে পারে। তাই লিটিল ম্যাগাজিন করা। সে সমাজ দর্পনের কাজও নীরবে করে থাকে।
কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । জন্ম-কর্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়াতে । পড়াশুনো হাবড়া হাই স্কুলে। শ্রীচৈতন্য মহা বিদ্যালয়ে কলেজ জীবন । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । পেশায় গৃহশিক্ষক , নেশায় লেখক । কিছু কবিতা , ছোটগল্প , অণুগল্প ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত । এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাব্যোপন্যাস ” পাখি-যাপনের জার্নাল ” । ২০১৯ এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ” বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম ” গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ” অনিলা দেবী সাহিত্য সম্মান ” । এছাড়াও পেয়েছেন বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার , সুতরাং সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার সহ আরো কিছু পুরস্কার ও সম্মান । ১৯৯৬ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছেন ‘ অবগুণ্ঠন সাহিত্যপত্র’টির । প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত কবিতা ” নির্বাচিত ১০০” । মূলত লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক বলতেই গর্ববোধ করেন । তবে বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজেও লিখেছেন । অণুগল্পের বই ” ছক্কুমামা , কর্নেল কাপুর ও অন্যান্য গল্প ” যথেষ্ট জনপ্রিয় ।
Related