| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস চলচ্চিত্র বিনোদন সিনেমা

মেসবাড়ির পাঁচালি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

দামু মুখোপাধ্যায়


বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেন। ঠিকানাটা ঠিক কী কারণে আপামর বাঙালি হৃদয়ে চিরস্মরণীয়, তা বলার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। চিলেকোঠাবাসী ঘনশ্যাম দাস ওরফে ঘনাদার মৌরসীপাট্টা এই মেসবাড়ির জাঁকালো আড্ডায় মধ্যমণি অবশ্যই দীর্ঘকায়, ঘোর শ্যামবর্ণ, কিছুটা স্বভাব-আয়েসী মধ্যবয়েসী ভদ্রলোক স্বয়ং, যাঁর চটকদার গল্পসম্ভারের টানে প্রতি ছুটির দুপুরে হাজির হয় শিবু, শিশির, গৌর আর সুধীর। সত্যি বলতে কি, মেসবাড়ির ইতিহাসে এমন বর্ণময় চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার। কলকাতার বুকে মেসবাড়িকে চিরন্তন করে গিয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র সৃষ্ট যুগান্তকারী চরিত্র।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই শহরে মেসবাড়ির বোলবোলাও। অবশ্য তার আগেই কেরানিগিরির সুবাদে গ্রাম থেকে কলকাতায় পা ফেলতে শুরু করেছেন নব্য যুবারা। সরকারি-বেসরকারি অফিসে করণিকদের তখন চাহিদা তুঙ্গে। আবার, চাকরি জোটাতে প্রয়োজনীয় লেখাপড়া করতে গেলে কলেজে ভর্তি হওয়া জরুরী। কিন্তু প্রতিদিন গ্রাম থেকে শহরে আসার কথা পরিবহণ অপ্রতুলতার সে-যুগে দুঃস্বপ্নেও ভাবা যেত না। তাই অনিবার্য হয়ে ওঠে শহরবাস। চিলতে আস্তানার খোঁজে হন্যে হয়ে মহানগরীর অলি-গলিতে শুরু হল অনুসন্ধান। প্রথম দিকে নিকট বা দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়িতে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করলেও পরবর্তীকালে একান্নবর্তী পরিবার ক্রমশ অবলুপ্ত হওয়ায় তা অস্বস্তিকর ঠেকতে লাগল। আবার বাজারে পছন্দমতো বাড়ি মিললেও মাসোহারার টাকায় অথবা কেরানিগিরির বেতনে প্রতি মাসে তার ভাড়ার জোগান দেওয়া মামুলি ব্যাপার নয়।

অগত্যা মেস। দেখা গেল, ছটাকখানেক প্রাইভেসির সঙ্গে আপোস করতে পারলেই সুলভে শহরবাস কঠিন নয়। তবে হ্যাঁ, মেসের সদস্য হতে গেলে চোখ-কান খোলা রাখতে হত বই কি! যার-তার সঙ্গে তো আর রোজের জীবন ভাগ-বাঁটোয়ারা করা চলে না। তাই জোরালো রেফারেন্স ছাড়া মেসে ঠাঁই পাওয়া এক কথায় অসম্ভব ছিল। এর ওপর সাকিন ও ধর্ম মোতাবেক বিভাজন। এ ক্ষেত্রে মূলত প্রাদেশিকতাই প্রাধান্য পেত। যেমন, বরিশালের মেসে কস্মিনকালেও জায়গা পেতেন না বর্ধমানের যুবক। তেমনই, মেদিনীপুরের মেসবাড়িতে সেঁধোবার কথা কল্পনা করতেন না যশোরের তরুণ।

চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে প্রধানত আমহার্স্ট স্ট্রিট, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, মানিকতলা ও শেয়ালদা অঞ্চলেই মেসের রমরমা দেখা যায়। রেল স্টেশন, অফিসপাড়া এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈকট্যই এসব এলাকায় মেসবাড়ি গজিয়ে ওঠার অব্যর্থ কারণ। সেকালে প্রতিটি মেসবাড়ির নিজস্ব চরিত্র ছিল। মেজাজ, খাওয়া-দাওয়া, সখ-আহ্লাদের বিচারে যতই ব্যক্তি বিশেষের তফাৎ থাকুক না কেন, মাসের পর মাস, বা হয়ত বছরের পর বছর একই ছাদের নিচে মিলেমিশে থাকার অভ্যাসে অজান্তেই একসুরে বাঁধা পড়তেন বাসিন্দারা।

তবে মেসবাড়িতে থাকলেই স্বভাব-মিশুকে হতে হবে, এমন কোনও অকাট্য আইন জারি হয়নি কখনওই। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় শিব্রাম চক্কোত্তি। জনপ্রিয় কৌতুক রচনাকার ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন যথেষ্ট লাজুক প্রকৃতির। গোটা জীবনটাই তিনি কাটিয়েছেন মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের মেসবাড়ির তিনতলার একটেরে ঘরটিতে। স্বভাব ঘরকুনো রম্যরচনাকার ঘরের দেওয়ালজুড়ে স্বহস্তে লিখে রাখতেন দিনলিপি। অকৃতদার মানুষটি ছিলেন দস্তুরমতো ভোজনরসিক। রাবড়ির প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আকর্ষণ। আর একমাত্র তার টানেই না কি হপ্তায় দু-একদিন সাধের “মুক্তারামের তক্তারাম” ছাড়তে বাধ্য হতেন তিনি।

শিবরামের অভিনব মেসবাসের বহু আগেই কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাকাপাকি জায়গা করে ফেলে মধ্যবিত্তের এই সমবায় ডেরা। চোদ্দ নম্বর হাবশীবাগানের ছোট্ট, ছিমছাম মেসেই পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ গল্পের সূত্রপাত। অন্য দিকে, শরদিন্দুর ব্যোমকেশের সঙ্গে অজিতের আলাপ হয় উত্তর কলকাতার এক মেসবাড়িতে। তদন্তের প্রয়োজনে মেসের হট্টরোলেই আত্মগোপনের সুবিধা খুঁজে নিয়েছিলেন ছদ্মবেশী দুঁদে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সী। তবে এ ব্যাপারেও পথিকৃৎ হয়ত জোড়াসাঁকোর নোবেলজয়ীই। ১৯০১-০২ সালে লেখা রবীন্দ্র উপন্যাস ‘চোখের বালি’-র মহেন্দ্র স্ত্রীর ওপর বেদম চটে আশ্রয় নিয়েছিলেন এক মেসবাড়িতে। আবার, উনিশ শতকের গোড়ার প্রেক্ষাপটে কলকাতার মেসবাড়িতেই শুরু শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের সাবিত্রী-সতীশ উপাখ্যান। তিলোত্তমার মেসভবনে সময়ে-অসময়ে ভিন্ন প্রেক্ষিতে ঠাঁই নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের দিকপালরাও। তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-জীবনানন্দ থেকে শুরু করে সমরেশ মজুমদার-শুভ আচার্যরাও জীবনের বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন এ শহরের মেসে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও মেসের অবদান বড় সামান্য নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল বহু বিপ্লবীরই ঘাঁটি ছিল কলকাতার মেসবাড়িগুলোয়। লাল পাগড়ির শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসেই চলত ব্রিটিশ সিংহকে পদানত করার ছক কষা। আবার অগ্নিগর্ভ সত্তরের দিন-বদলের স্বপ্ন দেখার শুরুও এখানেই।

পূর্ব, মধ্য ও উত্তর কলকাতার সাবেক মেসগুলোর অধিকাংশই আজ স্রেফ ইতিহাস। নানা চিত্তাকর্ষক ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী যৌথ আস্তানাগুলো কালের নিয়মে এখন বহুতল আবাসন বা শপিং মলে রূপান্তরিত। আর প্রোমোটারের নেকনজর থেকে এখনও যারা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তারাও যত্ন ও যথার্থ বাসিন্দার অভাবে শেষের সে দিনের অপেক্ষায়। বরং শহর কলকাতার চেয়ে ঢের বেশি রমরমিয়ে চলছে মহানগরী লাগোয়া ছোট শহর বা মফস্বলের মেসগুলো।

মেস ঘিরে গল্প অসংখ্য। মেসজীবনের মার্কামারা ছবি ঘুরেফিরে বেশ কিছু জনপ্রিয় বাংলা সিনেমায় দেখা গিয়েছে। এদের মধ্যে অগ্রণী অবশ্যই ১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া বিজন ভট্টাচার্যের কাহিনি অবলম্বনে নির্মল দে-র ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। “অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউজের” তরুণ বাসিন্দারা বাঙালি হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন “আমার এ যৌবন চম্পা-চামেলি বন…” গানটিতে। আর চিরভাস্মর হয়ে রয়ে গিয়েছে মেসের ম্যানেজার রজনীবাবুরূপী তুলসী চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় মলিনাদেবীর অভিনয়।

মেসবাড়ি নিয়ে আর একটি জনপ্রিয় বাংলা ছবি ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া দীনেন গুপ্তর ‘বসন্ত বিলাপ’। পুরুষ ও মহিলাদের দুই মেসবাড়ির সদস্যদের নিয়ে তৈরি এ ছবিরও পরতে পরতে হাসির ফোয়ারা। অপর্ণা সেনের লিপে আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে “আমি মিস ক্যালকাটা” গানটা তো ‘অলটাইম হিট’ বলা চলে।

বাস্তবে মেসবাড়ির সদস্যদের জীবনে হাসি-হুল্লোড়ের অবকাশ তেমন নেই। কিছু কিছু রেওয়াজ বা বিক্ষিপ্ত ঘটনা ব্যতিক্রম হলেও বাসিন্দাদের মধ্যে অতীতের সেই আন্তরিকতায় ইদানীং বেশ ভাটা পড়েছে, জানালেন সাঁতরাগাছির এক মেসের বোর্ডার। তবে তাঁর কাছেই শোনা গেল মেসবাড়ির এক আজব দস্তুরের কথা।

মেসবাবুরা কেউই ধনী বা উচ্চমধ্যবিত্ত নন। তাই চাঁদা তুলে মাসে একবার একবেলা পাঁঠার মাংস খাওয়ার নিয়ম এই বাড়িতে। সাধারণত, সে দিনটা রবিবার। তবে সপ্তাহান্তে মেস ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরার অভ্যেস অনেকেরই। তাঁদের ভাগের মাংস তুলে রাখাই নিয়ম। তবে সেই নিয়মেও আছে শর্ত। পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বোর্ডারটির জন্য অপেক্ষা করা হয়। আটটা বেজে গেলেই সে মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন বাড়ির বাকি সদস্যরা। শোনা গেল, নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট বাকি থাকতেই মাংসের বাটি সামনে রেখে ঘড়ির কাঁটার দিকে মনঃসংযোগ করতে দেখা যায় অপেক্ষমান বোর্ডারদের। অনেক সময়েই না কি তাই গলির মোড় থেকে তারস্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হয় মেস-ফেরৎ সদস্যকে। মুহূর্তের বিলম্বেই না কি হাতছাড়া হতে পারে ন্যায্য বখরা।

কালক্রমে মেসের শূন্যস্থান পূর্ণ করেছে শহরের বিভিন্ন পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ‘পেয়িং গেস্ট’ সংস্কৃতি। বছর তিরিশেক আগেও অবশ্য কলকাতার বেশ কিছু পরিবারে মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে খাদ্য ও আস্তানার এই সুবিধে পাওয়া যেত। তবে এখন তার পরিসর বেড়েছে নিঃসন্দেহে। বহুজাতিক ও বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে আসা ভিনরাজ্যের ছেলেমেয়েরা তো আছেনই, কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসা দেশ-বিদেশের বহু ছাত্র-ছাত্রীর যৌথ ডেরাও এখন মধ্যবিত্ত পাড়ার বেশ কিছু ফ্ল্যাট।

নামের সঙ্গেই পাল্টেছে মেসবাড়ির অঙ্গসজ্জা। তক্তপোষ-তেলচিটে তোশকের আধিপত্যের অবসান ঘটেছে সিঙ্গল বেড-আধুনিক ম্যাট্রেসের বিলাসে। বারোয়ারি কলঘরের জায়গায় এসেছে অ্যাটাচড টয়লেটের সুবিধা। বিদায় নিয়েছে মেসবাড়ির আজীবন সদস্য ছারপোকারাও। তবু ভোল বদলে বহাল তবিয়তেই কলকাতার বুকে আজও বিদ্যমান মেসবাস।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত