Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ইতিহাসের ৬ বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যর্থতার গল্প

Reading Time: 4 minutes

বড় ধরনের ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ডে ব্যর্থতার ঘটনা ইতিহাসে অনেক রয়েছে। এখানে সংক্ষেপে দেওয়া হলো ৬টি ব্যবসায়ীক ব্যর্থতার ইতিহাস। এর কারণে পরবর্তিতে বড় ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিদ্রোহ, অসংখ্য মৃত্যু, মুদ্রাস্ফীতি এবং দুটো দেশের এক হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষজ্ঞদের কাছে এই ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ডগুলো বড় ধরনের দুর্যোগ হয়ে রয়েছে।

১. মেডিসি ব্যাংক (১৩৯৭-১৪৯৪) : রেঁনেসা যুগে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ফ্রান্সের ফ্লোরেন্সের মেডিসি ব্যাংক। অনেক দিক দিয়েই আধুনিক ব্যাংকের প্রতিনিধি ছিলে ব্যাংকটি। তারা পয়সা ঋণ দিতো, জমা রাখতো এবং কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে শাখা স্থাপন করতো। ব্যাংকটি প্রিন্স ও রাজাদের ঋণ দেওয়ার নিয়ম বন্ধ করে এবং প্রত্যেক শাখার ম্যানেজারকে মালিকানার একটি অংশ প্রদান করে। সেই সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিল প্রতিষ্ঠানটি। হার্ভার্ডের প্রফেসর রেমন্ড ডি রুভার তার ১৯৬৩ সালের বইয়ে লিখেছেন, এই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি জমা রাখতো এবং এখান থেকে পুঁজিবাদের ধারণা এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ভালো অবস্থা সব সময় একরকম থাকে না। মেডিসি পরিবারের কজিমোর মৃত্যুর পর অন্যান্যরা অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেন এই ব্যাংকিং ব্যবস্থায়। এতে হিতে বিপরীতটাই ঘটে। তা ছাড়া প্রতিযোগী পাজ্জি পরিবারের নানা ষড়যন্ত্রও ছিল। অবশেষে ১৪৯৪ সালে ভেঙে পড়ে এই ব্যাংক।

২. ভার্জিনিয়া কম্পানি (১৬০৬-১৬২৪) : ষোলো শ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মতো বড় বড় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে ভার্জিনিয়া কম্পানি। ইংল্যান্ড তখন রানি এলিজাবেথ প্রথমের কল্যাণে বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ১৬০৬ সালে রাজা জর্জ জয়েন্ট-স্টক ভেঞ্চার হিসাবে ভার্জিনিয়া কম্পানি ইস্যু করেন। বিশেষজ্ঞ ড. জেমস হর্ন বলেন, বড় বড় বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভার্জিনিয়া কম্পানি। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দামী ধাতুর খোঁজকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এরা দুটো শাখায় বিভক্ত হয়ে কাজ করতো- প্লেমাউথ এবং লন্ডন। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় কম্পানিটি। একে অপেশাদারদের মহাব্যবস্থাপনা বললে ভুল হবে। আসলে ওই কম্পানির কর্মীরা জানতেন না তারা আসলে কি করছেন। তারা সোনা, রূপা এবং আরো অনেক কিছু খুঁজছে। কিন্তু তা পাচ্ছে না। তবে শেষ পর্যন্ত তামাক কম্পানিকে টিকিয়ে রাখার মূল উপকরণ হয়ে ওঠে। তামাকের মাধ্যমেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে তারা। কিন্তু উৎপাদন কারখানায় বিস্ফোরণে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। তবে একে ঘিরে রাজার কাছের মানুষ এবং পার্লামেন্টারিয়ান সদস্যদের রাজনীতিতে শেষ হয়ে যায় বাকিটুকু।

৩. টিউলিপ মেনিয়া (১৬৩৬-১৬৩৭) : ১৬৩৭ সালে নেদারল্যান্ডসের পরিস্থিতি ছিল, একটি টিউলিপ বাল্ব কিনতে মানুষের বার্ষিক বেতনের দশ গুন খরচ হয়ে যেতো। আসলে নিজের সম্পদের জানান দিতে এই ফুলকে নিজের কাছে রাখা ধনীদের ফ্যাশন হয়ে ওটে। লেখক মাইক ড্যাশ জানান, ইউরোপের সবচেয়ে বড় জুয়াড়ি হিসাবে পরিচিত ছিল ডাচরা। তারা পাগলাটে নানা কাজ করতো। কয়েকজন হয়তো রোমের একটি বিশাল পিলার দেখতে কেমন হবে তা নিয়ে বাজি ধরেছেন। আর তা দেখতে ছুটে গেছেন রোমে। যুদ্ধরত অবস্থায় ডাচ সেনারা বাজি ধরেছেন, এ যুদ্ধে কে জয়ী হবে তার ওপর। তাদের এই বাজিকরের মানসিকতায় টিউলিপের ঝড় ওঠে। ১৫৫০ এর দশকে গোটা ইউরোপে পরিচয় ঘটানো হয় টিউলিপকে। টিউলিপের প্রতি এই উন্মাদনা অবশেষে বিশাল বাণিজ্যিক খাত তৈরি করে। তাই একটি টিউলিপ চুরি বা লুটপাট হয়ে ওঠে বড়লোক হওয়ার উপায়। ১৯৩৭ সালে অবস্থা চরমে পৌঁছে। নিলামে ক্রেতারা স্রেফ না আসার কারণে এর দামের পতন ঘটে।

৪. কম্পানি অব স্কটল্যান্ড (১৬৯৫-১৭০৭) : স্কটল্যান্ডের জন্য ১৬৯০ এর দশকটি ছিল দুঃসময়। ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকার উইলিয়াম পেটারসনের নেতৃত্ব পরিচালিত হয় কম্পানি অব স্কটল্যান্ড। এখানে তিনি জড়ো করেন নির্বাসিত জীবন থেকে সদ্য ফিরে আসা জমির মালিকদের। তারা একযোগ হয়ে ফান্ড গঠন করেন যার মাধ্যমে স্কটিশ কলোনিকে নতুন বিশ্বে তুলে ধরা হবে। লেখক ডগলাস ওয়াট জানান, প্রথমে ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়া ভালোমতোই এগিয়ে যায়। প্রাথমিক সফলতায় তারা আরো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে এগিয়ে যেথে থাকে। একটা সময় ইয়োলো ফিভার, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য কারণে বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া এ অবস্থার মাঝে পেটারসনের এক অ্যাসোসিয়েট তাদের ১০ শতাংশ পুঁজি নিয়ে হাওয়া হয়ে যান। আরো খারাপ কিছু বাকি ছিল। বছর দুয়েকের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দেখে, তাদের কাছে কোনো অর্থ নেই।

৫. সাউথ সি কম্পানি (১৭১১-১৮৫৩) : আঠারো শতকের প্রথম দিকে ওয়ার অব স্প্যানিশ সাক্সেশন এবং গ্রেট নর্দান ওয়ারের ঋণে বেশ প্যাঁচের মধ্যে পড়ে যায়। আর সেখান থেকেই ১৭১১ সালে সাউথ সি কম্পানি তৈরি হয়। জাতীয় ঋণ সামাল দিতে এবং ইংলিশ নেভিতে সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধ ছিল লক্ষ্য। বিশেষজ্ঞ ড. হেলেন পল জানান, এই কম্পানিতে যে শেয়ার কিনবেন, তাকে কম ঝুঁকিপূর্ণ, সরকারের গ্যারান্টিসহ লাভের স্বপ্ন দেখানো হয়। এই কম্পানির মডেল গঠিত হয় দক্ষিণ আমেরিকায় মনোপলি ব্যবসার কথা মাথায় রেখেই। দাস ও পণ্যের ব্যবসা করে লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি করছিল প্রতিষ্ঠানটি। ১৭১৩ ও ১৭১৯ সালের স্প্যানিশদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে কম্পানির দক্ষিণ আমেরিকার সম্পদ হাতছাড়া হয়। অনেক মানুষ এতে বিনিয়োগ করে শেয়ার মার্কেটের মতো। কিন্তু শেয়ার মার্কেটে ধসের মতো ধস নামে কম্পানিতে। নানা ঘটনা ও রাজনীতির মধ্য দিয়েও কম্পানিটি শত বছরের বেশি টিকে থাকে। সবার শেষে তিমি কেন্দ্রিক ব্যবসায় নেমে পড়ে তারা।   

৬. দ্য কম্পানি অব দ্য ওয়েস্ট (১৭১৭-১৭৩১) : এই তালিকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো ঘটেনি। কম্পানি অব দ্য ওয়েস্টের উত্থান ও পতন ঘটে ফ্রান্সের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং অর্থমন্ত্রী জন ল’কে কেন্দ্র করে। ১৬৭১ সালে এডিনবার্গের ব্যাংকার পরিবারে জন্ম তার। ২৩ বছর বয়সে জেলে যান। ফাঁসির আদেশ হয়। কিন্তু জেল থেকে পালান তিনি। বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিসকো ভেলদে জানান, জন তার নিজের ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছিলেন। অবশেষে তিনি ফ্রান্সে সুযোগ পান। স্প্যানিশ সাক্সেসন যুদ্ধের পর ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে দেশ। রাজা লুইস পঞ্চদশকে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছিল। তাকে একটি পরিকল্পনা দেন জন। তিনি ছিলেন অর্থনীতিবিদ। কিন্তু তখনও অর্থনীতিবিদ নামে কোনো পেশা ছিল না। ১৭০৫ সালে তার লেখা বইয়ের মাধ্যমে নানা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু মানুষ মনে করতো, তার তত্ত্বগুলো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ১৭১৬ সালে তিনি নিজের ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মিসিসিপি কম্পানি কিনে নেন। এটার নাম দেন কম্পানি অব দ্য ওয়েস্ট। এটি উত্তর আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে তামাকের ব্যবসায় মনোপলি গড়ে তোলে। ১৭১৯ সালে জনের ব্যাংক কম্পানি অব দ্য ওয়েস্টের সঙ্গে মার্জ যুক্ত হয়। পরের বছর তাকে ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়। এর পর তিনি তার কম্পানির শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন পাবলিকের কাছে। অতি উচ্চমূল্য নির্ধারণ করেন। এটাই ছিল তার বড় ভুল। একটা পর্যায়ে বিপুল অর্থের ওপন নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি। ফরেন এক্সচেঞ্জের ধস নামে। জন সবাইকে বাধ্য করে সোনা ও রূপাকে কাগুজে নোটে রূপান্তরিত করতে। সরকারের ঋণ সামাল দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন জন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। সূত্র : বিজনেস ইনসাইডার

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>