নন্দিনী রায়
রাস্তার কলে দু’আঁজলা জল খেয়ে, মাথায় ঘাড়ে একটু জলহাত বুলিয়ে নেয় নিবারণ। এবার একটু ছায়ার খোঁজে ইতিউতি তাকায়।যদিও এ অঞ্চল তার চেনা। কিন্তু প্রতিদিন একটু একটু করে বদলাচ্ছে এই শহর। সব ছায়া মায়া গোগ্রাসে গিলে খেয়েছে দৈত্যের মত প্রকান্ড ফ্ল্যাটবাড়িগুলো। একটা বন্ধ দোকানের ছাউনি খুঁজে হাতের ব্যাগটা রাখে। সেই সকালে গ্রাম থেকে বেড়িয়েছে। এখন বেলা এগারোটা। মাথার চাঁদি গরম হয়ে উঠেছে।সেই সকালের চা মুড়ি কখন পেটের তলানিতে ঠেকেছে।এখন কলের জলে দুটি চিঁড়ে ভিজিয়ে, গুড় দিয়ে মেখে খেয়ে আবার কাজে লাগবে। সকাল থেকে মাত্র দুটো কাজ হয়েছে। তাতে সাকুল্যে রোজগার সত্তর টাকা। অন্তত শ’দুয়েক টাকা নিয়ে বাড়ি না গেলেই নয়।মাথায় চিন্তাটা নিয়েই ব্যাগ থেকে চিঁড়ে গুড় বার করে। নিবারণ শিল কাটে। রান্নাঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় মসলা বাটার শিল।এ তাদের সাত পুরুষের কাজ।আগে গাঁ-ঘরে নিবারণের বাপ তারক সাঁপুইয়ের হাতের কাজ বিখ্যাত ছিলো। তারই সুযোগ্য ছেলে নিবারণ। কিন্তু সে দিনও নেই, সে রমরমাও নেই। এখন সব ঘরে ঘরে মিক্সি মেসিন। আজকালকার মেয়েরা কেউ শিলে মসলা বাটে না। সব ঐ মেসিনে।তবু এখনো কিছু সাবেকি বাড়ি আছে, যেখানে শিলনোড়া ছাড়া আজও বাটনা বাটা হয়না। তারাই ভরসা নিবারণের। ঠাকুমা দিদিমারা মসলা বাটা প্রসঙ্গে বলতেন, “যদি হয় চন্দন, তবে হয় রন্ধন।” এখন আর এসব কথার চল নেই, ভাবনারও চল নেই। শিল্পের সেই কদর আর নেই। কতদিন শিলে ”শকুন্তলার তপোবন বাস” আঁকেনি। সূক্ষ্ম ছেনিতে লেখেনি ‘যদি হয় চন্দন…।” আগেকার বালিকাবধূরা সব ফরমায়েশি ছবির আবদার করতো। প্রিয় সইদের নাম লিখতে হত। কারো জন্য গঙ্গাজল, বকুলফুল আরো কত!
দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে সে সব ভুলতে বসেছে প্রায়।মায়া যখন তার সংসারে এলো, নতুন গৃহস্থালির নতুন সংসারে, শিলে লিখে দিয়েছিল “মায়াবন বিহারিণী হরিনী” লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছিল মায়ার মুখ।আজ কতবছর হয়ে গেল, মায়ার ওমন মুখ আর দেখেনি সে।বরং সংসারের জোয়াল আর হেঁসেল ঠেলা ক্লান্ত গনগনে মুখটাই দেখতে পাওয়া যায় এখন।এই দশবছরে তাদের কোনো সন্তান হয়নি। মায়ার চেহারা সেই অর্থে টসকায়নি তাই। জমির ধান মাড়াই, সেদ্ধ, শুকনো করা, এছাড়া ঘরের লাগোয়া জায়গায় সম্বৎসরের সবজি ফলিয়ে সংসারের হালটা শক্ত হাতে ধরে রাখে। আর এসব বজায় রাখতে গিয়ে কোথাও তার স্নিগ্ধ লাবণ্যটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। মায়ার হাতে লাগানো গাছ বড়ো ফলবতী হয়। এ নিয়ে পাড়া ঘরে বেশ নামডাক আছে তার। কিন্তু তার নিজের কোলটা কেন যে…।
চিঁড়েটা খেয়ে বেশ করে জল খেয়ে নেয়। এই দিয়ে টানতে হবে অনেকটা সময়। ভাগ্যিস তার যন্ত্রপাতির থলেটা বেশি ভারি নয়। কয়েকটা নানামাপের ছেনি বাটালি আর একটা ঠোকাই হাতুড়ি। তা আজকাল আর সূক্ষ ছেনিগুলো বার করেনা সে। মোটাগুলো দিয়েই জলদি হাতে কাজ সারে। কী লাভ! এইসব সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম কে বুঝবে?আর কেইবা তার কদর করবে! বরং আজকাল সে অনেক বেশি চালাকচতুর হয়ে গেছে। আগে বেশ গভীর করে শিল কাটতো।অনেকদিন সেই শিলে বাটনা বাটা যেত। এখন হালকার ওপর ছেড়ে দেয়। ফলে চার ছমাস পরেই, আবার শিল কাটানোর প্রয়োজন দেখা দেয়।
সাইকেলটা খারাপ হওয়ার পর থেকে কষ্টটা আরো বেড়েছে নিবারণের। ট্রেন ধরতে পাকা মাইল দুয়েক হাঁটতে হচ্ছে। ফিরতি পথেও তাই। বাবার আমলের সাইকেল সারাতে যা খরচ তাতে আর কিছু টাকা জোগার করতে পারলে নতুন সাইকেল হয়ে যায়। কিন্তু হতে আর পারছে কই! সংসার চালাতেই হিমসিম অবস্থা। একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে এগোয় নিবারণ। আজ পোদ্দার বাড়িতে নতুন একটা বৌকে দেখলো নিবারণ। প্রথমে তো বুঝতেই পারেনি, যে বউ!জামা প্যান্ট পরা কেমন কাঠখোট্টা চেহারা। কিন্তু হাসিটা বড়ো সুন্দর! ওরাই বলল বাড়ির ছোটবৌ, বিদেশে থাকে। ঐ মেয়েটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলো। কী করে শিখলো সে এই কাজ। কবে থেকে করছে, কী কী আঁকে। কত টাকা রোজগার হয়? আর বলল, তার কাজের ভিডিও করবে।অনেকদিন পর নিবারণ তার সূক্ষ্ম ছেনি বাটালি, হাতুড়ি বার করলো।তারপর চওড়া শিল জুড়ে ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তুলতে লাগলো শকুন্তলার তপোবন বাস। চারাগাছে জল দিচ্ছে শকুন্তলা। পাশে একটা হরিনশিশু। গোটা সময়টা ভিডিওবন্দি করে ঐ তিস্তা নামের বউটা। আর তোলে নিবারণের নানা ভঙ্গিমার ছবি। কয়েকদিনের না কাটা দাড়ি, ঘেমো চেহারা, আধময়লা কোঁচকানো ফতুয়ায় ছবি তুলতে বিব্রত বোধ করলেও বাঁধা দেয়না।কেবল জিজ্ঞেস করে, এই ভিডিও দিয়ে কী হবে? তিস্তা বলে, সে একজন ফিল্ম মেকার। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ডকুমেন্টারি সিনেমা বানায়। এসব ডকুমেন্টারি ফেন্টারি শব্দগুলো বুঝতে না পারলেও, সিনেমা ব্যাপারটা খানিকটা বোঝে। কিন্তু নিবারণ সিনেমা বলতে যা দেখে এসেছে এতদিন, কই তেমন তো কিছু দেখল না এখানে! নায়ক, নায়িকা নাচ, গান, কিছুই তো নেই। যাকগে, আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর নিয়ে কিই বা দরকার। যত্ন করে তার ছবি তুলেছে, এই কত! বাড়ির লোককে বলে জল মিষ্টি ও তার মজুরির টাকা দেয়। কিন্তু যখন মেয়েটা তারপর তার হাতে আরও দু’হাজার টাকার একটা চকচকে নোট তুলে দেয়, বিস্ময়ের অবধি থাকে না নিবারণের। ছলছল চোখে, অস্ফুটে মেয়েটাকে আশীর্বাদ করে নিবারণ। মেয়েটা তার বোনের বয়সী হবে মনে হয়। ফিরতি ট্রেনে নেমে একবার গঞ্জের বাজারে সাইকেলের দোকানে যেতে গিয়েও, কী ভেবে বাড়িমুখো হয়। নাহ্ এ টাকা সে এভাবে খরচ করবে না। বাড়ি ফিরে দেখল মায়া রান্নাঘর ঘেঁষা লাউমাচায় ঠেকনা দিচ্ছে। অসংখ্য জালি এসেছে গাছটায়। মায়া পরম মমতায় হাত বুলোচ্ছে তার ওপর।শেষ বিকেলের আলো, লাউপাতার ফাঁক দিয়ে মায়ার মুখে পড়ে মুখটাকে কেমন সিঁদুরে করে তুলেছে। সেই বাসররাতের মত!
গভীর রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে নিবারণ।হ্যারিকেনের শিখাটা বাড়িয়ে নিজেদের রান্নাঘর থেকে প্রায় সমান হয়ে আসা শিলটাকে বার করে। সূক্ষ্ম ছেনি হাতে নিয়ে ‘মায়াবন বিহারিণী’ লিখতে গিয়েও থমকে যায়। এরপর বড়ো মমতায় শিলের গায়ে হাত বুলিয়ে ফুটিয়ে তোলে মা যশোদার কোলে গোপাল। দরজার কোনে লুকিয়ে দাঁড়ানো মায়ার চোখ থেকে জল গড়ায় নিঃশব্দে। কাল সকালেই একবার পাঁচশো টাকা ভিজিটের শহরের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে মায়াকে। কে বলতে পারে, একটা পোয়াতি মেয়ের ছোঁয়া টাকায়, যদি আর একটা মেয়ে।