| 25 এপ্রিল 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া সাহিত্য

নক্ষত্রবেলা: অনুভূতির ছায়াপথ ভ্রমণ

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

এক অনন্ত নক্ষত্রবীথির সদস্যের মতোন মানুষের বিজন যাত্রা৷ একান্ত বিরান কক্ষপথে কী অদ্ভুত আর স্বকীয় ঘূর্ণন তার! হাসিকান্না, দুঃখব্যথার নির্যাসে জারিত অথচ প্রত্যেকের গল্পটা আলাদা। সেই গল্পগুলো মুক্তোদানার মতো গাঁথা হয়েছে গল্পকার দেবদ্যুতি রায়ের কলমে আর রচিত হয়েছে ‘নক্ষত্রবেলা’। অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০২০ এ পেন্সিল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত এই বইটি তাঁর তৃতীয় গল্পগ্রন্থ। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য।

১২ টি ভিন্ন ধাঁচের গল্প নিয়ে মলাটবন্দি হয়েছে ‘নক্ষত্রবেলা’। বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে ঠাঁসবুনোটে যূথবদ্ধ শব্দরাজি শুকনো বালুকাবেলায় আছড়ে পড়েছে নিটোল উর্মিমালার মতোন। গল্পকার বড্ড আলগোছে অনুভূতির সুতোগুলো ছুঁয়ে গেছেন। তাইতো প্রথম গল্পটি অর্থাৎ নয়নতারা আর মাহমুদ খন্দকারের গল্পটি পড়তে গিয়ে সত্যিই প্রেম কিংবা অপ্রেমের ধোঁয়াশায় নিমজ্জিত হতে হয়। বাসন্তীরঙা বিকেলের সেই আনতমুখটার মাঝে বা বছর কুড়ি পর অন্যমনস্ক চশমার কাচে তাই নিজের প্রতিবিম্বটা দেখতে পাওয়া যায়। বসন্তদিন ফিরে আসে চোখের পাতায়, নিশ্চুপ বনভূমির বুক চিরে উড়ে যাওয়া বকপাতির মতো চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মাহমুদ যখন ‘মাঝ সমুদ্রে দিশা হারানো নাবিকের মতো বলে বসে – আবার কোথাও আমাদের দেখা হবে তো?’ তখন একটা অদ্ভুত দ্যেজাভুতে আক্রান্ত হতে হয় পাঠককে।

‘এইসব ছাইগন্ধী দিন’ দহনদিনের গল্প। একই লোহিতকণিকার স্রোত বহন করেও মানুষের মন যখন তীব্র আফিমে অন্ধ আর মূক হয়ে যায়, বিদ্বেষের লেলিহান শিখা তখন পুরো একটা জনপদকেই অনায়াসে গ্রাস করে নিতে পারে। গল্পের অন্যতম চরিত্র আসাদুলের মুখে ‘দ্যাশটাত আর মানুষ নাই বাহে!’ কথাটির মধ্যে সেই প্রলয় পরবর্তী পোড়ামাটির ঘ্রাণ ভেসে আসে। ছানিপড়া চোখের দৃষ্টিসীমায় সব আগের মতো দেখালেও বদলে যাওয়া সময়টা নিয়ে সংশয় জাগে মাস্টার এবং পাঠকের মনেও ৷ কিন্তু গল্পের শেষে এসে সেই অবিশ্বাস আর সন্দেহটুকু এক চিলতে রোদের ওমে মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায়। বুকের ভেতর জমা হতে থাকা গুমোট হাওয়া পথ পায় খোলা জানালার।

‘বেসাতি’ গল্পটি মৌসুমী আক্তারের মনে হলেও সত্যি বলতে এটি এসমোতারার গল্প। সেই কবে চুরি হয়ে যাওয়া মেয়েবেলার এসমো, যাকে ফিরে পেতে বছরের পর বছর রক্তমাংস আর ঘামের বেসাতি করতে হয়েছে আজকের মৌসুমীজ কিচেনের মালিক, ফ্রন্ট লেয়ার কাটের, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা আকর্ষনীয় মেয়েটিকে। এই গল্পটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে চরিত্রের সংখ্যা কিছুটা বেশি। তাই মাঝেমাঝে দু’বার পড়তে হয়েছে। হয়ত কিছু চরিত্র বাদ দেয়া যেত। তবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম

বর্ণনা দৃশ্যপট রচনায় দারুণভাবে সফল হয়েছে অথচ কখনোই বাহুল্য বলে মনে হয়নি।

এই বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে ‘দেখা’ গল্পটি আলাদা। কথকের উদ্দেশ্য ক্রমশ প্রকাশিত হতে থাকলেও সমাপ্তিতে এসে চমৎকৃত হতে হয় ‘রুকাইয়া আহমেদ’ চরিত্রটির আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। গল্পের শেষ লাইনে গল্পকার আরো একবার পাঠককে চমকে দিয়েছেন ভীষণভাবে। কিছু ইংরেজি শব্দের ব্যবহার আছে এই গল্পে যেগুলো এড়ানো গেলে গল্পের গতি বোধ হয় আরো মসৃণ হতো।

একাত্তরের গল্প, বাবার কলমে লেখা স্মৃতির পাতায় প্রচেতার যুদ্ধ দেখার গল্প ‘এলিজি-১৯৭১’। গল্পভাবনাটি নতুন নয় তবু সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কিংবা সেই সময়টাকেই আরেকবার ফিরে পাবার আকুতি মনকে আর্দ্র করেছে। গল্পকারের কাছে প্রত্যাশা তিনি ভবিষ্যতে নতুন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপহার দেবেন পাঠককে।

গল্পের মতোই সুন্দর গল্পটির নাম -‘কোথাও একটা ফুল থেকে যায়’৷ সাহেদা আর রোজিনার সম্পর্কের শীতলতা, সাহেদার ব্যক্তিগত ও গোপন আক্ষেপ আর নিজের সাথে দ্বন্দ্বটিও নিপুণভাবে অংকিত হয়েছে লেখকের তুলিতে। শেষদিকে অভিমানের মেঘ ঝরে বৃষ্টি এলে সাহেদার অন্তঃকরণ ‘একটা জলধোয়া ফুল’ হয়ে ওঠে। আর পাঠকহৃদয় ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়।

‘একটা নিঃসঙ্গ ঘাসফুল বা একজোড়া প্রেমিক শালিকের গায়ে চনমনে দু’ফোটা বৃষ্টিজল’ পড়ার মতো অনুভূতি নিয়েই পাঠ করলাম বইটি। গল্পকার যে তার ভাষাশৈলী আর ভাবনার পরিপক্বতা দিয়ে দ্যুতি ছড়িয়ে যাবেন আরো বহুদিন, বইটির পাঠ শেষে সাহিত্যানুরাগীরা এ বিষয়ে একমত হবেন।

বইয়ের তথ্য:

গল্পগ্রন্থ: নক্ষত্রবেলা

গল্পকার: দেবদ্যুতি রায়

প্রচ্ছদশিল্পী: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

গল্পসংখ্যা : ১২

মূল্য: ১৬৭ টাকা (২৫% ছাড়ের পর)

প্রকাশনী: পেন্সিল পাবলিকেশনস

প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০

বইটি বাংলাদেশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে সংগ্রহ করা যাচ্ছে। পাঠকের কাছে প্রত্যাশা বই সংগ্রহ এবং পাঠের এই চর্চাটি শুধুমাত্র বইমেলা কেন্দ্রিক না হয়ে বছরজুড়ে চলুক। শুদ্ধ সাহিত্য বাঙালির মানসঘরে আলোকের ঝর্ণাধারা হয়ে প্রবেশ করুক চিরকাল।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত