আমার গ্রন্থাগার ।। ওরহান পামুক
অনুবাদ: আহসান হাবীব
আমার গ্রন্থাগারের অন্তঃস্থলে আমার পিতার গ্রন্থাগার। আমার বয়স যখন সবে ১৭ কি ১৮, তখন বেশির ভাগ সময় পড়ায় নিমগ্ন থাকতাম। আবার ইস্তাম্বুলের বইয়ের দোকানে যেসব বই মিলত, তা সবই পড়তাম। বাবার সংগ্রহের যে বই পড়ে ভালো লাগত, সেটিই নিয়ে যেতাম আমার ঘরে। আমার বইয়ের সঙ্গে রেখে দিতাম। ছেলে বই পড়ছে দেখে বাবার ভালো লাগত। তাঁর কোনো পুরোনো বই আমার বইয়ের তাকে দেখলেই টিপ্পনী কেটে বলতেন, ‘হু, বইটার পদোন্নতি ঘটেছে দেখছি।’
১৯৭০ সাল, ১৮ বছর বয়স। অন্য সব তুর্কি কিশোরের মতো কবিতা লেখা শুরু করলাম। তখন আমি ছবি আঁকি আর স্থাপত্যে পড়ি। এসবে যে মজা পেতাম একসময়, তা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করল। রাত নামলে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাই আর কবিতা লিখি। বাবার কবিতাসংগ্রহগুলো তখনই পড়ি। তরুণ বয়সে বাবা কবি হতে চেয়েছিলেন।
তুর্কি সাহিত্যজগতের প্রথম (বিংশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক) ও দ্বিতীয় তরঙ্গের (ষাট ও সত্তরের দশক) কবিদের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া চটি বইগুলো ভালো লাগল। তাঁদের কবিতা পড়ে তাঁদের মতো করে লিখতে চাইতাম। দ্বিতীয় তরঙ্গের কবিদের দ্বারাও আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এ পর্যায়ের কবিরা কবিতায় বর্ণনাত্মক, অভিব্যক্তিমূলক স্বর নিয়ে এসে এবং সময়ে সময়ে দাদাবাদ, পরাবাস্তববাদ ও আলংকারিক ভঙ্গির মিশ্রণ ঘটিয়ে পরের প্রজন্মের কাছে সৃষ্টিশীল চেতনা পৌঁছে দিয়েছিলেন।
অল্প কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে তুরস্কের অন্য সব কবির কাজ কৃত্রিমতা আক্রান্ত, দৈনন্দিন জগৎ থেকে দূরে। তাই কবিতা হিসেবে সেগুলো আমাকে টানেনি। তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিভূমির প্রতি ছিল আমার উৎসাহ। পশ্চিমায়ন, আধুনিকায়ন ও ইউরোপের বিধ্বংসী প্রভাবের অধীন থেকে লড়াই করে স্থানীয় কোনো কবি দ্রুত বিলীয়মান উসমানীয়-তুর্কি সাহিত্যিক ঐতিহ্য থেকে কি রক্ষা করতে পারতেন, আর কী হতো সেই পথ? ফারসি সাহিত্যের প্রভাবে উসমানীয় অভিজাতেরা যে দিওয়ান বা রাজসভার কবিতা তৈরি করেছিলেন, তার কী হবে? আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে সেসবের কী প্রাসঙ্গিকতা থাকল, যখন সেসব কবিতার সৌন্দর্য ও সাহিত্যিক ব্যঞ্জনা পরবর্তী প্রজন্মকে বুঝতে অভিধান ও নির্দেশিকার সহায়তা লাগে?
আমার আগের প্রজন্মের লেখকেরা অনেকাংশে ‘ঐতিহ্য থেকে আহরণের’ দুরূহ সমস্যা নিয়ে নিমগ্ন ছিলেন। আমার প্রজন্মেরও একই দশা। উসমানীয় কবিতার কয়েক শতক ধরে সমৃদ্ধি অর্জন এবং পশ্চিমা প্রভাব থেকে সব সময় দূরে থাকার ফলে এক ধরনের পরম্পরার বোধ ছিল। এতে কবিতার সাপেক্ষে সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রশ্নের আলোচনা অনেক সহজ ও আরামদায়ক হয়েছিল।
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে কবিতা নিয়ে আমার উদ্দীপনা হঠাৎ জ্বলে উঠে দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিই, ঔপন্যাসিক হব। তুরস্কে তখনো কবিতাকেই মনে করা হতো সত্যিকারের সাহিত্য। আর উপন্যাস কম গুরুত্বপূর্ণ, লোকরঞ্জনবাদী সাহিত্যের একটি ধরন। বিগত সাড়ে তিন দশকে উপন্যাসের গুরুত্ব তেমন বাড়েনি, তবে কবিতা কিছুটা গুরুত্ব হারিয়েছে। এই সময়কালে প্রকাশনাশিল্পের অবিশ্বাস্য বিস্তার ঘটেছে। প্রতি মুহূর্তে বাড়তে থাকা পাঠকের সামনে নিত্যনতুন বৈচিত্র্য হাজির করা হচ্ছে।
যখন আমি লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখন কবিতা কিংবা উপন্যাস কোনোটাকেই শিল্পীর সংবেদনশীলতা, এক অদ্ভুত চেতনা, এক সত্তা হিসেবে মূল্যায়ন করা হতো না। প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, মননশীল লেখকেরা যৌথভাবে কাজ করতেন। আর কোনো সামাজিক ইউটোপিয়া তৈরি করতে কীভাবে তা অবদান রাখত এবং কোনো সাধারণ ধারণা (আধুনিকতাবাদ, সমাজতন্ত্র, ইসলামপন্থা, জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিকতা) কীভাবে প্রতিফলিত করত, এর ভিত্তিতে সাহিত্যকর্ম মূল্যায়িত হতো। ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে যে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিলেখক নানা উপাদান তুলে আনেন, তাঁর সমস্যা কিংবা তাঁর স্বরকে সবচেয়ে ভালো মতো ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম যে সাহিত্যিক ধরন, তার ওপর তেমন আগ্রহ ছিল না সাহিত্য গোষ্ঠীগুলোর।
উল্টো, ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ছিল সাহিত্য; সাহিত্যের কাজ ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে চলে একটি সুখী ও সংগতিপূর্ণ সমাজ ও জাতি নির্মাণ। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, প্রজাতন্ত্রী কিংবা সমাজতান্ত্রিক সমতাবাদী যে ধরনের ইউটোপীয় আধুনিকতাবাদই হোক না কেন, সাহিত্যের দৃষ্টি এমন দৃঢ়ভাবে ভবিষ্যতের ওপর গাথা ছিল যে কখনো কখনো আমার মনে হয়, বিগত শতাব্দীজুড়ে ইস্তাম্বুলের অলিগলিতে, ঘরে ঘরে যা কিছু ঘটেছে, তার প্রতি পুরোপরি অন্ধ থেকেছে। আমার মনে হয়েছে, তুরস্কের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কীভাবে তৈরি করা যায়, সেই ভাবনায় লেখকেরা যতটা মশগুল, ততটা সৎভাবে তাঁরা আমাদের জীবনের গল্প বলেননি। পশ্চিমায়ন ও দ্রুতগতির আধুনিকায়নের যুগে শুধু তুরস্কে নয়, পশ্চিমের বাইরের সব সাহিত্যের কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি, আজকের রঙে আগামীর স্বপ্ন আঁকার ফ্যাসাদ, নৈমিত্তিক পরম্পরার আরাম আঁকড়ে থেকে আধুনিক মূল্যবোধসম্পন্ন আধুনিক দেশের স্বপ্ন দেখার ঠেকা।
আফসোস, জীবনের জন্য আমাদের প্রস্তুত করতেই বই—এই আলোকময়তার উপযোগিতাবাদী ধারণা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। কারণ হয়তো তুরস্কে লেখকের জীবনই এ কথার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। তবে পছন্দমতো যেকোনো বই সহজে পাওয়ার মতো বড় গ্রন্থাগারের তখন ঘাটতি ছিল তুরস্কে। বোর্হেসের কাল্পনিক গ্রন্থাগারে প্রতিটি বইয়ে মরমি রং চড়ে, আর গ্রন্থাগার নিজেই কাব্যিক ও অধিবিদ্যক অসীমতার ইঙ্গিত দেয়, বাইরের দুনিয়ার জটিলতা প্রতিধ্বনিত করে। এই স্বপ্নের আড়ালে আছে বাস্তব গ্রন্থাগার, যার বই গুনে বা পড়ে শেষ করা যাবে না কোনো দিন। বুয়েনস এইরেসে এমনই এক গ্রন্থাগারের পরিচালক ছিলেন বোর্হেস। আমার কৈশোরের ইস্তাম্বুল কিংবা তুরস্কের অন্য কোথাও তেমন কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। বিদেশি ভাষার বই পাওয়া যেত না কোনো গণগ্রন্থাগারে। সেসব বই পড়তে চাইলে এবং জাতীয় সাহিত্যের প্রতিবন্ধকতা (সাহিত্যিক দলাদলি, সাহিত্যিক কূটনীতির দ্বারা আরোপিত, কণ্ঠরোধী নিষেধাজ্ঞা দ্বারা বাস্তবায়িত) উতরে যেতে চাইলে আমার নিজের বিশাল গ্রন্থাগার নিজেকেই গড়ে নিতে হতো।
১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সময়কালে লেখালেখির পর আমার প্রধান কাজ ছিল আমার গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা। আমি চাইতাম, যেসব বই গুরুত্বপূর্ণ কিংবা কাজে লাগতে পারে, তার সবই যেন সেখানে থাকে। বাবা আমাকে বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ দিতেন। ১৮ বছর বয়স থেকে আমি প্রতি সপ্তাহে পুরোনো নগরের কেন্দ্রস্থলে পুরোনো বইয়ের বাজারে সাহাফ্লারে যেতাম। ছোট ছোট দোকানে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। পুরোনো বইয়ের দোকানে বইপত্র ঘেঁটে শেষে দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে দরাদরি করে পছন্দের সব বই কিনে নিতাম। প্রথমে সংগ্রহ করি যাবতীয় ধ্রুপদি বিশ্ব ও তুর্কি সাহিত্য কীর্তি। অন্যান্য বই পড়ার কথাও ভাবতাম। আমার মা মনে করতেন আমি খুব বেশি পড়ি। এ নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা ছিল। যতটুকু পড়তে পারি, তার চেয়ে বেশি বই নিয়ে আসছি দেখে তিনি বলতেন, ‘এসব পড়া শেষ না করে আর কোনো বই আনতে যেয়ো না যেন!’ আমি বই সংগ্রাহকদের মতো করে বই কিনছিলাম না। বরং তুরস্ক কেন এত গরিব ও অস্থির, তা উপলব্ধি করতে মরিয়া এক তরুণের মতো কিনছিলাম।
বইয়ের ভেতর নিজেকে ডুবিয়ে রাখার ফলে জীবনের বহু কিছু হারাচ্ছিলাম। কিন্তু এটা বুঝতে পারার পরও বই কেনা অব্যাহত রাখলাম। যেন যে জীবন থেকে পালাচ্ছিলাম তার ওপর প্রতিশোধ নিতে। একটানা ১০ বছর সাহাফ্লার মার্কেটে পুরোনো বইয়ের দোকানে বই ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত ল্যাটিন হরফে যত বই বেরিয়েছে, সবই আমার হাত দিয়ে গেছে। একবার হিসাব কষে দেখলাম, ১৯২৮ সালে আতাতুর্ক আরবি হরফ ছেড়ে ল্যাটিন হরফ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরের ৫০ বছরে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সাল নাগাদ এই সংখ্যাটি এক লাখ ছাড়িয়েছে। এসব বই আমার গ্রন্থাগারে নিয়ে আসার গোপন পরিকল্পনা দ্বারা হয়তো আমি চালিত হচ্ছিলাম। তবে বই বাছাই করতাম মূলত স্বতঃস্ফূর্ততা ও সাময়িক উত্তেজনার বশে। একটা একটা করে বই কেনা অনেকটা পাথরের পর পাথর দিয়ে বাড়ি নির্মাণের মতো ব্যাপার।
৩০ বছর আগে আশির দশকে তুরস্কে বছরে যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হতো, ২০০৮ সালে প্রায় তার তিনগুণ প্রকাশিত হয়। তখন প্রতিবছর গড়ে প্রায় তিন হাজার বই ছাপা হতো। বেশির ভাগই দেখতাম। প্রায় অর্ধেকই ছিল অনুবাদের বই। বিদেশ থেকে অত্যন্ত কম বই আসায় বিশ্বসাহিত্যে কী ঘটছে তা জানতে নির্ভর করতে হতো তাড়াহুড়ো করে করা অসতর্ক অনুবাদের ওপর।
আমাদের কালের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো ইতিহাস, উপন্যাস বা স্মৃতিকথা পাঠের আকর্ষণ আমি ফেলতে পারতাম না। উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষভাগে একের পর এক সামরিক পরাজয় কিংবা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যার পেছনে সব সময় কোনো রহস্য, বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র কিংবা কলকাঠি নাড়ার হদিস মিলত, সেসবের ব্যাপারে আমার দুর্দমনীয় টান ছিল।
বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে মনে হতো আমি একটি সংস্কৃতির, একটি ইতিহাসের অংশ। ভবিষ্যতে কোনো একসময় আমি যে বই লিখব, সেটার ব্যাপারে ভাবতাম, ভালো লাগত। তবে কখনো কখনো ভয়ানক বিষণ্নতা ভর করত। বইয়ের ভেতর ছাপার ভুল কিংবা লেখক ও প্রকাশকের অযত্নের ছাপ আমার মন বিক্ষিপ্ত করত। কোনো খেলো, যা-তা বইয়ের বিরাট কদর কিংবা কোনো রসবহুল, মনোহর বইয়ের একদম মনোযোগ না পাওয়ার ঘটনায় দুঃখ পেতাম।
গভীরতর অন্ধকার সময়ে আমার দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য সাইলেন্ট হাউস-এর নায়ক ফারুকের মতো অনুভূতি কাজ করত। উসমানীয় মহাফেজখানায় কয়েক শতক আগের দলিল পাঠ করত ফারুক। তার মাথায় থেকে যেত সব তথ্য, কিছুই ভুলত না। কিন্তু সেসব তথ্যের কোনোটার সঙ্গেই সে কোনো সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারত না। তেমনি পুরো একটা ইতিহাসের, পুরো একটা সংস্কৃতির, পুরো একটা ভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণী ঠিকভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা আমিও ভাবতাম।
যেসব বই আমি খুশিমনে বাড়ি নিয়ে আসি, সেসব থেকে যে সত্য জানতে পারি তার তাৎপর্য বাদবাকি দুনিয়ার কাছে কত নগণ্য। আমার বয়স যখন ত্রিশের ঘরে, প্রথমবারের মতো আমেরিকা গেলাম। বহু গ্রন্থাগার দেখলাম এবং সমৃদ্ধ বিশ্বসংস্কৃতি চাক্ষুষ করলাম। তখন খুব পীড়িত বোধ করলাম তুর্কি সংস্কৃতি ও তুর্কি পাণ্ডিত্যের বিষয়ে তারা কত কম জানে, তা দেখে। একই সঙ্গে এই বেদনা সংস্কৃতি ও তার নির্যাসের ক্ষণস্থায়ী দিকের মধ্যকার পার্থক্যকে আমার ভেতরের উপন্যাসিক সত্তার কাছে আরও স্পষ্ট করল। এটাকে সতর্কবার্তা হিসেবে নিলাম: জীবন ও গ্রন্থাগারকে আমার আরও গভীরভাবে দেখা উচিত।
মিলান কুন্ডেরার স্লোনেস উপন্যাসে একজন চেক নাগরিক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে যখনই কথা বলার সুযোগ পায় তখনই বলে, ‘আমার দেশে এমন হয়’, ফলে তাকে উপহাস্য হতে হয়। কেবল নিজের কথা ভাবা কিংবা নিজের মানবিকতার সঙ্গে বাদবাকি দুনিয়ার সম্বন্ধ দেখতে না পারার কারণে তার প্রতি তাদের ছি-ছি করা ন্যায্য। কিন্তু স্লোনেস পড়ার সময় উপন্যাসে ছি-ছি করছিল যারা, তাদের কাতারে আমি নিজেকে দাঁড় করাতে পারিনি। আমি একাত্মবোধ করেছি সেই উপহাস্য লোকটার প্রতিই, যিনি কথায় কথায় ‘আমার দেশ’ না বলে পারছিলেন না। না, আমি তাঁর মতো কোনো হাস্যস্পদ প্রাণী হতে চাইনি। বরং উল্টোটা চেয়েছি বলেই।
তুরস্ক কখনো পশ্চিমা উপনিবেশ ছিল না। আর তাই যখন তুর্কিরা আতাতুর্কের আদেশে পশ্চিমের অনুকরণ করল, সেটা নিন্দনীয় (কুন্ডেরা, নাইপল ও এডওয়ার্ড সাইদ যেমন বলেছেন) পদক্ষেপ হয়নি মোটেই, হয়ে উঠেছিল তুর্কি পরিচয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমার লেখালেখির ৩৫ বছরে অন্যের বই নিয়ে বিদ্রূপ না করতে শিখেছি। প্রদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে তো প্রাদেশিকতা এড়ানো যায় না, বরং প্রদেশটিকে নিজের করে নিতে হয়। এভাবে আমি ধীরে ধীরে সমপ্রসারিত হতে থাকা গ্রন্থাগারের ভেতর নিজেকে বিসর্জন দিতে শিখলাম। কীভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় তাও শিখলাম। বয়স ৪০ পেরোনোর পর আমি শিখলাম যে আমার গ্রন্থাগারকে ভালোবাসার সবচেয়ে জবরদস্ত কারণ হলো, এই গ্রন্থাগারটির কথা তুর্কি কিংবা পশ্চিমারা কেউ জানত না।
কিন্তু এখন তারা বলে, ‘আপনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আর বইয়ের জগতে তুরস্কের খ্যাতি অনেক ছড়িয়েছে। সুতরাং, আপনার তুর্কি গ্রন্থাগারের কথা কি আমাদের বলবেন?’ আমি বলতে প্রস্তুত। আমার গ্রন্থাগার অর্থাৎ তুর্কি গ্রন্থাগার ভালোবাসতে পারার সুযোগ পাক অন্যরা। তবে যেই না আমি তার কথা বলতে যাই, তখনই আমার মাঝে ভর করে তার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ার আশঙ্কা।
কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো