| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

জটলা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

“মাস্টার, অ মাস্টার…”
ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের চা দোকানে প্রায় চোদ্দ-পনের বছরের একটা ছেলে। খাঁকি হাফপ্যান্ট ও ছেড়া গেঞ্জি পরে ময়লা মুখে সাদা দাঁত বের করে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রথমটায় ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না। কিন্তু পরক্ষণেই চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি।
“জটু, তুই?” স্বাভাবিকভাবেই বললাম, “এ দোকানে কবে থেকে?”
জটু হাসতে হাসতে বলল, “এই ত মাস্টার, আইজ দুদিন হল্য। তা তুমাকে আর উদিকে দ্যাখি নাই আইজ-কাইল ?”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “না রে, ওদিকে আর যাওয়া হয় না। কিন্তু তুই ও দোকান ছেড়ে দিলি কেন?”
জটু হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “না মাস্টার, মালিকটা ভাল লয়। উঁ শালা বেদম খাটায়। কথায় কথায় মারে। গাইল দ্যায়। তা বাদে ঠিক ক‌ইরে মাইনাটাও দ্যায় নাই। তাই ছাড়্যে দিলম।”
আমি ঈষৎ হেসে বললাম, “এই মালিকটা ভালো বুঝি?”
জটু গলার স্বরটা একটু চেপে বলল, ” তা ব‌ইলতে লাইরব। তবে দ্যেখে-শুনে ত ভাল‌ই মনে হয়।”
“হুঁ, ইস্কুল যখন গেলিনা তখন কি আর করবি বল? কাজ‌ই কর মন দিয়ে। তবে…” বলতে বলতে হঠাৎ চোখ চলে গেল শরতের মেঘ ভাসা আকাশে। কোন এক নাম না জানা পাখির দল সারিবদ্ধ ভাবে ভেসে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। দূরে আর একটা পাখি দলছুট হয়ে পিছনে পিছনে ধাওয়া করে আসছে তাদের। হয়তো একসময় দলের সঙ্গে মিশে যাবে অনায়াসে। কিন্তু জটু হয়তো আর পারবেনা । মূলস্রোত থেকে আলাদা হয়ে চিরকাল দলছুট হয়েই থেকে যাবে। কিংবা মিশে যাবে অন্য কোনো স্রোতে।
ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। সূর্যটা মেঘের আড়ালে ছিল এতোক্ষণ। মেঘ সরে যেতেই ঝকঝকে রোদ এসে লাগল আমার আর জটুর চোখেমুখে। চোখ নামিয়ে নিলাম। আবারও মেঘের ভেতর লুকিয়ে গেলো সূর্য। আবছায়া নেমে এলো আমাদের মাঝে, আগেরই মতো। একরাশ ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর মা কেমন আছে রে?”
“না মাস্টার, বেশ একটা ভাল নাই। জানোই ত, বাবা যাবার পর থাক্যেই মাথাটা গ্যাছে। এই ভাল ত এই খারাপ। আমি ত নাল্যে দকানে দকানে কাঁটাই দি। কিন্তু দিদিটার দমে কষ্ট। উয়ার লাগ্যে টুকু চিন্তা হয়।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিল জটু।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, “বেশি চিন্তা করিস না, পরে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কি করবি বল, এভাবেই চলতে হবে।”
জটু আমার কথাগুলোর যথার্থতা কতটা বুঝতে পারলো জানিনা। সে শুধু মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে বলল, “না মাস্টার, যাই ইবার। নাহল্যে মালিক আল্যে বুঝতেই ত পারছ্য, ধমকাবেক এখনি।”
“হুঁ, যা এখন।” বলেই সেখান থেকে চলে এলাম ঠিকই কিন্তু মনের ভেতর কেমন যেন একটা চাপা অস্থিরতা ধরে রাখতে পারছিলাম না। হাঁটতে হাঁটতে তার চিনচিনে যন্ত্রণাটা বেশ টের পাচ্ছিলাম।
আগের বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে একটি চা দোকানে জটুর সাথে প্রথম আলাপ। রোজ দুবেলা চা খেতে যেতাম সেখানে। ও নাকি আমাদের স্কুলেই পড়ত। অত ছাত্রের মাঝে আলাদা করে চিনতাম না ওকে। ও নিজে থেকেই আমার ছাত্র বলে পরিচয় দিয়েছিল। তখন থেকেই জটুর সাথে একটু একটু করে ভাব জমে ওঠে। বেচারা কে দেখে খুব খারাপ লাগত। মনে হত দেশে যেখানে শিশু শ্রমিক ব্যাপারটা নিয়ে এতো হৈ চৈ, সেখানে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি টা সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে জটুরা চিরকাল জটুই রয়ে গেছে। কিন্তু আমরা যারা স্বাধীন দেশের সভ্য নাগরিক, তারা কি আইনের সাহায্য নিয়ে কিছু করতে পারি না? কিছু তো করা যেতেই পারে। কিন্তু পরক্ষনেই ছাপোষা মধ্যবিত্ত সাংসারিক মন জবাব দেয়, না। সব আইন সবার জন্য নয়। যারা আইন করে, গলা ফাটায়, তারাতো পশ্চাৎপটের সমস্যারূপ অন্ধকারটা দেখেনি। যার সমাধান হয়তো কোন আইনের হাতেই এখনো আসেনি। তাই জটুরা এই চা দোকানের মতো পছন্দসই জায়গায় অনায়াসে সেটে যায়। বিকল্প খুঁজতে যায় না। ঠিক হোক বা ভুল, বহুবার ভাবতে ভাবতে এরকম নিজের যুক্তিতেই একসময় নিজে থেমে স্থির হ‌ই। স্থির হতে হয়।
কিছুদিন পর জটুর সাথে আবার রাস্তায় দেখা। একটা বস্তা মাথায় নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। আমাকে দেখে বস্তা নামিয়ে হাফছেড়ে বলল, ” অ মাস্টার, কথা যাচ্ছ গ?”
— আরে, জটু যে! বস্তায় কি নিয়ে যাচ্ছিস?
— সের কতক ধান আছে মাস্টার, ভানাব।
— ও আচ্ছা। কিন্তু তোকে আর দোকানে দেখতে পাইনা যে?
— ছাড়্যে দিয়েছি মাস্টার। উঁ শালা মালিকরা ভাল লোক লয়। উঁ শালাও ধড়িবাজ। ইবার থাক্যে হা বটতলার দকানটাতে থাইকব। ঐ লোকটা ভাল বঠে। ঠাণ্ডা পারা।
আমি একটু হেসে উঠলাম। ভাবলাম কর্মচারীর কাছে কোন মালিক‌ই কখনও ভাল হয় না। যখন যার কাছে থাকে তখন সেই ভালো। আবার কাজ ছেড়ে দিলে সেই খারাপ।
জটু একটু নরম গলায় বলল, “তুমার কাছেই যাব ভাবছিলাম মাস্টার। একটা কথা বলার ছিল।”
— হ্যাঁ বল।
— দিদির বিয়া লাগাইছি। ঘরে যা ছিল সব বিকে টিকে যে টাকা হঁইছিল তা বরের বাপ কে দিতেই ফুরাই গ্যাছে। কাজঘরটা পার করত্যে এখনও কিছু টাকা লাইগবেক। কাকা হাজার পাঁচেক দিব ব‌ইলেছে। তার বেশি লাইরবেক। মায়ের রাতে ঘুম নাই। দাও ন মাস্টার হাজার পাঁচ টাকা ধার। বড় হঁয়ে শুধে দিব।
আমি তো চমকে উঠলাম। এমনিতেই আজকাল যাকে-তাকে ধার দিতে গেলে দশবার ভাবতে হয়। আর এই নাবালকটিকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দেওয়া মানে যে আর ফিরে পাবার বিন্দু মাত্র আশা থাকবে না , তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া ব্যাংকের লোনের কিস্তি ঠেলে ঠেলে জেরবার হয়ে উঠেছি। ওদিকে আবার এলআইসির প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তারপর আবার গিন্নি যদি জানতে পারে ছোটখাটো একটা কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেতে পারে। এদিকে সামনের মাসেই তো আবার ভাইফোঁটা… না না, টাকা ধার দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ইতস্তত করতে করতে সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “এখন টাকা কোথায় পাবি? আমার এখন খুব টান। তুই বরং অন্য কোথাও দেখ।”
আমি আর সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে এলাম ।কিন্তু তার চোখের সেই করুণ দৃষ্টিটা কিছুতেই পিছু ছাড়ল না। যেদিকে যাই সেদিকেই যেন নিজের ছায়ার মত আমাকে অনুসরণ করতে লাগল।
রাত বেশি হয়নি। শরীরটা ভাল লাগছিল না বলে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঘুম ধরলে তো! এমনিতেই ব্লাড প্রেসারটা একটু বেড়েছে বলে রাতে ঠিকঠাক ঘুম আসেনি। তারপর আবার জটুর মুখটা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্ত্রী তখনও রান্নাঘরের টুংটাং শব্দ করে কি সব কাজ বাগাচ্ছিল। অসহ্য লাগছিল সবকিছু । সহানুভূতি আর সহায়তার মধ্যে ফারাকটা যে কতখানি তা বেশ উপলব্ধি করছিলাম। সহানুভূতি দেখানোটা যত সহজ, সহায়তা করাটা যে তার চেয়েও দ্বিগুণ বেশি জটিল এতদিনে তা টের পেলাম।
কিছুক্ষণ পর স্ত্রী পাশে এসে শুলো। “কি, ঘুমিয়ে গেলে?”
“হুঁ!” ছাড়া মুখ দিয়ে আর কিছু বেরুলো না।
স্ত্রী বাতিটা নিভিয়ে পর বলল, “জানো দিদি ফোন করেছিল। ওরা বলল পুজোর ছুটিতে সিমলা যাচ্ছে।”
আমি কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। কান খাড়া করে অপেক্ষা করছিলাম আরো কিছু বলে কিনা। কিন্তু না, অনেকক্ষণ হয়ে গেল চুপচাপ সে। আমি অন্ধকারে চোখ খুললাম। আবার চোখ বুজে পাশ ঘুরে শুয়ে পড়লাম। মাথায় তখন পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র-অরণ্য-মরুভূমি একসাথে ভিড় করেছে। আর তার সাথে জটুর করুণ মুখমণ্ডল। চক্রাকারে ঘুরছে সবকিছু। তবুও চোখ না খুলে বিছানা আঁকড়ে পড়ে রইলাম।
সকালে ঘুম ভাঙল কালি কাকার প্রভাতী শুনে। স্ত্রী আগেই উঠে পড়েছে। হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম আমার ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীরা অন্যান্য দিনের মতোই মাদুর পেতে বই খুলে পড়ায় মন দিয়েছে। এরা আসে বলেই বেশ ভালই কেটে যায় সকালের কিছুটা সময়। রীতিমতো তাদের পাঠ চুকিয়ে গিন্নীর কাছে বাজারের থলেটা নিয়ে রওনা হব বলে যেই বাইরের গেট খুলেছি, অমনি দেখি চোখে জল নিয়ে জটু দাঁড়িয়ে। আমি কিছু বলার আগেই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠল, “দাও ন মাস্টার হাজার পাঁচেক ধার। তুমি না দিলে আর কুথাও যাবার নাই। আর মাত্র কটা দিন বাকি। আসছে সোমবারে বিয়া। দাও ন মাস্টার। আমি তুমার পা ছুঁয়ে বলছি, আমি শুধে দিব।”
কি বলব ভেবে না পেয়ে নীরব দর্শকের মতো তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার আর কোন কথাই যেন কানে ঢুকছিল না আমার। তার চোখের সজল দৃষ্টি আর কম্পিত ঠোঁট মনের অনেক গভীরে শান্ত সমুদ্রে ঢেউ তুলে দিয়েছিল। জানিনা কেন কেউ যেন কানের কাছে বলে চলছিল, আজ যদি এই ছেলেটাকে টাকা না দিয়ে ফিরিয়ে দিই, তাহলে মানবিকতার প্রতি চরম অন্যায় করা হবে। জীবনে কতকিছু কতভাবে লোকসান হয়। কত টাকা কত হবে শেষ হয়ে যায়। যদি চিটফান্ডের দায়ে অত টাকা হারিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চুপচাপ বসে থাকতে পারি, তাহলে আজ এই কটা টাকা দিয়ে এই ছেলেটাকে সাময়িক উদ্ধার করলে ক্ষতি কি! স্থির করলাম এলআইসির টাকাটা পরের মাসেই দেব। তার জন্য হয়তো অনেক অদল বদল করতে হবে‌। তা হোক। আর কিছু না হোক, নিজের কাছে নিজেকে ছোট হওয়ার হাত থেকে তো বাঁচাতে পারবো।
জটু তখনো পায়ের কাছে বসে কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করে কি সব বলে চলেছে। আমি তাকে হাতে ধরে তুলে বললাম, “ধুর বোকা! অমন করে কেউ কাঁদে? চল আয়, ভেতরে বসবি আয়।”
জটু নড়ল না। সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি আর কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা না করে ভিতরে চলে গেলাম। ভাগ্য ভাল গিন্নি তখন বাথরুমে। তা না হলে এত সহজে বিনা কৈফয়তে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। বাথরুম থেকে আসা জল ঢালার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর আমার বুকের ঢিপঢিপানি মিলেমিশে একাকার।
আলমারি থেকে টাকা বের করতে করতে মনে হচ্ছিল, মাঝে মাঝে জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা অনেক সাত-পাঁচ ভেবেও, হাজার হিসাব-নিকাশ করেও, কুল পাওয়া যায় না। অথচ সেই ঘটনাই কখনো কখনো এক নিমিষের সিদ্ধান্তে কত সহজে সমাধান হয়ে যায়। আজ তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল বোধ হয়।
আমি টাকাটা নিয়ে এসে জটু্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, “পুরো পাঁচ হাজার টাকা। যা, খুশি মনে তোর দিদির বিয়ে দিবি যা।”
জটু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। অবাক হয়ে টাকাটা নিয়ে পকেটে ভরল। চোখের জল যেন বাগ মানছিল না। তবুও ঠোঁটের কোণায় একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল, অদ্ভুত সুন্দর । ঠিক যেন আমারই বুকের গর্বিত উচ্ছ্বাসের প্রতিবিম্ব।
“যা, বাড়ি যা।” শান্ত স্বরে বললাম, “পথঘাট ভালো নয়। ভালো করে বাগিয়ে নিয়ে যাস।”
জটু আর একটা কথাও বলল না। চোখ মুছে পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল। আমি রসিকতা করে বললাম, “কি রে, নেমন্তন্ন করবি না?”
“ইস্!” জটু আমার দিকে ফিরে মাথা চুলকে বলল, “ভুল্যে গ্যাছলম মাস্টার। তবে তুমি কি আর আমাদে ঘর যাবে?”
আমি হেসে হেসে বললাম, ” কেন রে আমার কি যেতে যেতে নেই? যা, সময় পেলে না হয় একবার যাবো তখন।”
জটু ঘাড় নেড়ে খুশি হয়ে চলে গেল। গিন্নি বাথরুম থেকে গলা উঁচিয়ে বলল, “কে গো, বাইরে কার সাথে কথা বলছো?”
আমি সমস্বরে জবাব দিলাম, “কেউ না, সেই চা দোকানের ছেলেটা।”
গিন্নি তখন সদ্য ভেজা চুল এলিয়ে, সুগন্ধি ছড়িয়ে, এক বালতি ভেজা কাপড় নিয়ে বারান্দায় এসে হাজির হল। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলল “কে এসছিল বললে, ওই জটলা?”
“আঃ” বলে নরম গলায় ধমক দিয়ে উঠলাম, “লোকের ছেলের নামটাকে বিকৃত করে ডাকতে ভালো লাগে? একটু ভালোভাবে ডাকলে কি গায়ে ফোসকা পড়ে যায়?”
— হ্যাঁ যায়। তা কী জন্য এসেছিল ?
— কী জন্য আবার! ওর দিদির বিয়ে তো তাই…
— তাই টাকা চাইতে এসেছিল?
— না, নেমন্তন্ন করতে।
গিন্নিকে সরাসরি এড়িয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে এড়িয়ে যেতে হয়। তা নইলে সংসার টিকবে না। এতদিন ঘর করে ঠিক বুঝে গেছি যে, দুটি মন একই ছাদের তলায়, একই বিছানায় বাস করলেও কখনো যে এক হয় না। কোথাও কোথাও তফাৎ থেকেই যায়।
— তা তুমি যাবে?
— দেখি।
— শোনো, তুমি যেখানে খুশি যাও। আমাকে যেতে বলো না। আমি ওই ছোটলোকদের বাড়ি যেতে পারব না। বলেই গিন্নি বালতি নিয়ে ছাদে চলে গেল। আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। শুধু মনে মনে বললাম, কে যে কী লোক তা যদি সবাই জানতো গিন্নি, তাহলে বোধহয় সংসারে এত অশান্তি হতো না।
কিছুদিন পর সকাল সকাল বৃষ্টি নামল খুব। মেঘ মেঘ মেঘময় সারা আকাশ। বোধহয় নিম্নচাপ। এ বৃষ্টি এখন আর ছাড়াবার নয়। কিন্তু স্কুল তো যেতেই হবে। তাই নিয়মমতো রেইন-কোর্ট পরে ছাতা নিয়ে যেই দুয়ারে এসে গেট খুলে বাইরে পা বাড়িয়েছি, অমনি দেখি জটু। ভিজে সপসপে হয়ে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে। আমি চমকে উঠলাম। ভাবলাম আরো টাকা চাইতে এলো নাকি! প্রথমে একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কি বলবো ভেবে পেলাম না‌। তবুও মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “জটু, তুই? কি ব্যাপার? সাত সকালে এভাবে ভিজে ভিজে…”
জটু কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। একবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর আবার চোখ নামিয়ে নিল পায়ের তলার জলের স্রোতের দিকে। যেখানে জলের ফোটায় সৃষ্টি হওয়া বড় বড় বুদবুদ ক্ষণিকের মিলিয়ে যাচ্ছে স্রোতের উপর।
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম, “আরে, বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছিস কেন? ভেতরে আয়।”
জটু মুখ তুলে গম্ভীর স্বরে বলল, “না মাস্টার, আর ভিতরে যাব নাই। এখনি হাসপাতালে যাত্যে হবেক।”
“কেন হাসপাতলে কেন? কার কি হল?” অবাক হয়ে বললাম, “আয়, আয়, ভেতরে আয়। সব শুনব আয়।” তাকে একরকম জোর করেই বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসালাম। আমিও একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম। তারে শুকনো গামছা রাখা ছিল, সেটা দেখিয়ে গা মুছতে বললাম। সে তাকাল, কিন্তু নিল না।
বুকের ভেতর থেকে একটা বড় প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করল। তার ভেতরে আরও একটা ছোট প্লাস্টিক। যাতে কিছু টাকা মোড়া ছিল। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম।
” মাস্টার, তুমার টাকাটা। আর লাইগবেক নাই।” খুব করুণ সুরে বলে টাকাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবুও বললাম, “কিন্তু তোর দিদির বিয়ে যে বললি। কাল‌ই তো ছিল, তাই না?”
ঘাড় নাড়ল জটু, “বিয়া তো কাল‌ই ছিল। তবে সব করেও আর কিছু করত্যে লারল্যম মাস্টার।”
— মানে?
— সব ঠিকঠাকই ছিল। বর‌ও আইসে গ্যাছল। কিন্তু দিদিটাই সব গড়বড় ক‌ইরে দিল। পাড়ার একটা ডাইভার ছ্যালার সঙ্গে পলায় গেল।
— তাই! কিন্তু তোর আগের থেকে কিছু জানতিস না?
— না মাস্টার, আমরা কভু জানতে পারি নাই।
কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা না বলে চুপ হয়ে রইলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল জানলা দিয়ে জলের ঝাপটা আসছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে বন্ধ করলাম। জটু বলত্যে লাগল, “লোকে সবাই ছি ছি করত্যে লাগল। বর ঘরের লোক গিলান ত মাকে যা মন যায় তাই বলত্যে লাগল। আমি তখন ত ভয়ে-ডরে কাটকাপাস। হঠাৎ দেইখলম মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তখন সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। উখেনে ভত্তি ক‌ইরেছে।”
— তুই যাসনি ?
— আমাকে যাত্যে দিল নাই। সকালে ভাইবলম তুমাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে একবার যাব। লাও মাস্টার তুমার টাকাটা।
— না রে, তুই রাখ। টাকাটা তোর কাজে লাগবে।
— না মাস্টার, যে কাজের লাগ্যে লিয়েছিলম, যখন সেই কাজটাই হল্য নাই তখন লিয়ে কি হবেক ?
— তোর মায়ের চিকিৎসা করাবি।
— লাভ নাই মাস্টার। আগেই ডাক্তার ব‌ইলেছিল মায়ের বড় রোগ হয়েছে। আর বেশিদিন বাঁচবেক নাই।
এই বলে জটু থেমে গেল। তারপর ঢোঁক গিলে বলল, “মরুক গা। মরলেই বাঁচি বরং। আর কনো পিছুটান থাইকবেক নাই। তখন বাইরে পালাব।
কথাগুলো শেষ করে একরকম জোর করেই টাকাটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে সোজা দৌড়ে ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে গেল জটু। বৃষ্টির ধারা তখন আরো উত্তাল। আমি শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, জীবনের প্রতি কতটা তিতিবিরক্ত হলে এই বয়সের একটা ছেলে মায়ের‌ও মৃত্যু কামনা করে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত