| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস নারী সাহিত্য

রাসসুন্দরী দেবী ও ‘আমার জীবন’

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সুবর্ণা দাশ


নারীকে লেখাপড়া শেখানোর প্রয়োজন বাঙালিরা খুব বেশিদিন ধরে অনুভব করেনি। সচেতনভাবে নারীকে শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াস দেখা যায় উনিশ শতকে অনেকটা পুরুষের প্রয়োজনেই। সে সময় শিক্ষিত তরুণদের পক্ষে অশিক্ষিত স্ত্রী নিয়ে সংসার করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ফলে নারী শিক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিল বেথুন স্কুল। এর আগে যেসব নারী লেখাপড়া শিখতেন, তাদের বেশির ভাগেরই মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মগ্রন্থ পাঠ কিংবা জমিদারি দেখাশোনা। ধর্মগ্রন্থ পাঠের প্রয়োজনেই রাসসুন্দরী দেবী নিজে নিজে লেখাপড়া শিখেছিলেন। ‘আমার জীবন’ নামে দুই খণ্ডের একটি আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন, যা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম আত্মজীবনী। পাবনার পোতাজিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী স্বশিক্ষিত এক নারী কীভাবে আত্মজীবনী রচনার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর।

১২১৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে রাসসুন্দরী দেবীর জন্ম। তৎকালীন রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠেননি তিনি। বাংলা স্কুল তাদের বাড়িতেই ছিল। সেখানে এক মেমসাহেবের কাছে গ্রামের সবাই পড়া শিখত। সকাল-সন্ধ্যা পাঠশালাতেই থাকতেন। ছেলেরা মাটিতে দাগ কেটে কেটে পড়া শিখত। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর প্রচলন তখনও হয়নি। ছেলেদের পড়া দেখতে দেখতে রাসসুন্দরী দেবীও মনে মনে পড়া শিখে ফেললেন। পার্সি শেখার প্রচলন থাকায় তা-ও শেখা হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যক্রমে বাড়িতে আগুন লেগে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারও বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই পড়া শেখাতে সেখানে ক্ষান্ত দিতে হয়।

রাসসুন্দরী দেবীর বিয়ে হয় বারো বছর বয়সে। শাশুড়ি বেশ স্নেহের চোখেই দেখতেন। বাড়িতে ছিল প্রায় নয়জন চাকরানি। পুত্রবধূকে কোনো কাজ করতে দিতেন না; বরং গ্রামের সব মেয়ের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। রাসসুন্দরী দেবীর ওপর সংসারের ভার পড়ে শাশুড়ির অসুস্থতার পর। মৃত্যুর পর কাজ আরও বেড়ে যায়। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন না থাকলেও চাকর-চাকরানিসহ প্রায় ২৫-২৬ জনের রান্নাই করতে হতো। কোনো কোনো দিন ১০ সের চাল রান্নার বর্ণনাও পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিগ্রহ পূজা, পথিক এবং অতিথি সেবার মতো কাজেও কমতি ছিল না। সংসারে কাজের চাপে মেয়েদের করুণ অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন-

‘তখন মেয়েছেলেরা লেখাপড়া শিখিত না, সংসারে খাওয়া-দাওয়ার কর্ম সারিয়া যে কিঞ্চিৎ অবকাশ থাকিত, তখন কর্তাব্যক্তি যিনি থাকিতেন, তাঁহার নিকট অতিশয় নম্রভাবে দণ্ডায়মান থাকিতে হইত। যেন মেয়েছেলের গৃহ কম্ম বৈ আর কোনো কম্মই নাই। তখনকার লোকের মনের ভাব ঐ রূপ ছিল। বিশেষত তখন মেয়েছেলের এই প্রকার নিয়ম ছিল, যে বউ হইবে, সে হাতখানেক ঘোমটা দিয়া ঘরের মধ্যে কাজ করিবে, আর কাহারও সঙ্গেই কথা কহিবে না, তাহা হইলেই বড় ভালো বউ হইল।’ (‘আমার জীবন’, পৃ:২৯)

মেয়েদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত থাকলেও সে পরিস্থিতির সঙ্গে একরকম মানিয়েই নিয়েছিলেন। মোটা কাপড়ে বুক পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে সব কাজ করতেন। তবে তার আক্ষেপের একটি ব্যাপার ছিল এই, কেবল মেয়ে হওয়ার দরুন তিনি বঞ্চিত হয়েছেন লেখাপড়া থেকে। তিনি বলেছেন, মেয়েদের সকলেই বিদ্যাশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলেন। তারা ছিল নিতান্তই হতভাগা, একরকম পশুর মতোই। মেয়েদের হাতে কাগজ দেখলে বৃদ্ধারা অসন্তোষ প্রকাশ করতেন।

পুঁথি পড়ার আগ্রহ থেকেই লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিলেন রাসসুন্দরী দেবী। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। পাঠশালায় ছেলেদের পড়া দেখে যা শিখেছিলেন, সেগুলোর কিছুটা মনে ছিল। স্বপ্নে দেখলেন ‘চৈতন্যভাগবত’ পাঠ করছেন। শরীর, মন পুলকিত হলো। এ যেন ঈশ্বরেরই আদেশ। রাসসুন্দরী দেবী ভাগ্যবতী ছিলেন। বাড়িতে ছিল প্রচুর বই। ঠিক করলেন ‘চৈতন্যভাগবত’ পড়বেন। কিন্তু তার পক্ষে সে বই খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না। কাকতালীয়ভাবেই হোক বা স্বামীর প্রয়োজনেই, হাতে পেলেন ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থ। অপরিসীম আনন্দে বইটি হাতে নিয়ে একটি পৃষ্ঠা লুকিয়ে রাখলেন রান্নাঘরে। অক্ষর চেনার সুবিধার্থে বড় ছেলের তালপাতায় লেখা একটি পৃষ্ঠাও লুকিয়ে রাখলেন। বইয়ের অক্ষর, তালপাতায় লেখা অক্ষর আর লোকের কথার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে বহু কষ্টে পড়ে শেষ করলেন ‘চৈতন্যভাগবত’।

বাড়িতে পুরাণ পাঠ এবং সংকীর্তনের প্রচলন থাকলেও অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। ঘরের পুঁথিই পাঠ করবেন বলে মনস্থির করলেন। তিনটি বিধবা ননদ সঙ্গেই থাকতেন। ঠিক করলেন তাদের ‘আহ্নিক-পূজা আহারাদির’ সময়ই নির্জন স্থানে পুঁথি পড়বেন। এদিকে প্রতিবেশী কয়েকজনও সঙ্গী হিসেবে যোগ দিলেন। কেউ যেন দেখে না ফেলে, তাই একজন প্রহরীও নিযুক্ত করা হলো। ননদরা কিন্তু রাসসুন্দরী দেবীর পুঁথি পাঠের খবরে খুশিই হলেন। এদের মধ্যে দু’জন কয়েক দিন লেখাপড়াও শিখলেন তার কাছে। এরপর আর গোপনে পড়ার প্রয়োজন হয়নি।

বই পড়ার আগ্রহ বাড়তেই থাকল। বাড়িতে যে কয়টি ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল, সব কয়টিই পড়লেন। একে একে শেষ করলেন ‘চৈতন্যভাগবত’, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, ‘জৈমিনিভারত’, ‘গোবিন্দলীলামৃত’, ‘বিদগ্ধমাধব’, ‘প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা’, ‘বাল্মীকি পুরাণ’। বাল্মীকি পুরাণের কেবল আদিকাণ্ড ছিল। গ্রামে সপ্তকাণ্ড পাওয়া গেল না। পঞ্চম পুত্র দ্বারকানাথ থাকতেন কলকাতায়। তার মাধ্যমেই বাড়িতে আনালেন সপ্তকাণ্ড। ক্ষুদ্র ছাপার অক্ষর ও পড়াকে দমিয়ে রাখতে পারল না।

পড়া চলছিল ভালোই। কিন্তু লিখতে জানেন না বলে আক্ষেপের অন্ত ছিল না। ‘কিন্তু এই কথাটি আমার ভারি আক্ষেপের বিষয় যে, আমি লিখতে জানি না।’ (পৃ. ৬৪) সপ্তম পুত্র কিশোরীলাল একদিন বললেন, ‘মা! আমরা যে পত্র লিখিয়া থাকি, তাহার উত্তর পাই না কেন?’ (পৃ. ৬৪) উত্তর তো আমাদের জানাই। লিখতে জানেন না বলে চিঠির উত্তর দেওয়া হয় না। কিশোরীলাল বেশ জোর দিয়ে বলে গেলেন, ‘ও কথা আমি শুনি না, মায়ের পত্রের উত্তর না পাইলে কি বিদেশে থাকা যায়! পত্রের উত্তর দিতেই হবে।’ (পৃ. ৬৪) তাই কাগজ, কলম, দোয়াত, কালি সবকিছু মাকে সংগ্রহ করে দিলেন। ছেলের এই ইচ্ছাতে বিপদেই পড়লেন মা। পরবর্তী সময়ে কেমন করে লিখতে শিখলেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লেখেননি। সংসারে কাজের চাপ খুব বেশি ছিল। তাও কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখার অভ্যাস করতেন। স্বামীর চিকিৎসার জন্য বড় ছেলের বাসায় অবস্থান করলে কাজের চাপ কিছুটা কম হয়। সে সময়ই লেখার অভ্যাসে মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন। স্বামীর সম্পর্কে তেমন কিছুই লেখেননি। বিয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে অন্তত কিছু লিখতে পারতেন। এমনকি তাদের আন্তঃসম্পর্ক কেমন ছিল, সে বিষয়েও তেমন কিছু জানা যায় না। রাতের বেলা ছাড়া যে তাদের দেখা হতো না, এমন আভাস পাওয়া যায়। সে সময়ের অবস্থা প্রসঙ্গে গোলাম মুরশিদ বলেছেন, ‘স্বামীর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় এবং অন্য সময়েও বিশেষ কোনো বাক্য বিনিময় না হওয়ায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক সময়ে স্বামী-স্ত্রীসুলভ স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠতো না’ (‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’, পৃ. ২৩৬)।

তাই স্বাভাবিকভাবেই ‘আমার জীবন’-এ রাসসুন্দরী দেবীর সঙ্গে তার স্বামীর আন্তঃসম্পর্কের কোনো উল্লেখ নেই। স্বামীকে উল্লেখ করেছেন কর্তা বলে। স্বামী কেমন লোক ছিলেন, তা বর্ণনা করেছেন প্রথম খণ্ডের শেষ দিকে। সে বর্ণনা এসেছে স্বামীর মৃত্যুসংবাদের মধ্য দিয়ে। বলেছেন, ‘আমার শিরে স্বর্ণমুকুট ছিল, কিন্তু এতকাল পরে সেই মুকুটটি খসিয়া পড়িল।’ (‘আমার জীবন’, পৃ. ৬৯) স্বামী ছিলেন দয়ালু। স্বামীর জয়হরি নামে একটি ঘোড়া ছিল। কোনো কারণে সেই ঘোড়া বাড়ির ভেতর এলে তার সামনে কোনোভাবেই যেতেন না। কেননা ঘোড়াটি তার স্বামীর। ঘোড়ার সামনে পড়া আর স্বামীর সামনে পড়া তাই একই কথা।

তবু কিছু কথা থেকেই যায়। রাসসুন্দরী দেবী স্বামীকে বা শ্বশুরবাড়ির সবাইকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, তা মূলত তার মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা থেকেই সম্ভব হয়েছে। কেননা তিনি নিজেই বলেছেন, শ্বশুরবাড়িতে তিনি একরকম বন্দি অবস্থাতেই ছিলেন। সংসারের কাজ বিঘ্ন হবে বলেই তাকে মায়ের কাছে পাঠানো হতো না। পাঠানো হলেও দু-চার দিনের মধ্যেই ফিরে আসতে হতো। সঙ্গে থাকত ১০-১৫ জন লোক, ২৬ জন সরদার এবং দু’জন দাসী। এমনকি মায়ের মৃত্যুকালেও যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। কেবল মেয়ে হওয়ার কারণেই যে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, তাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ সমস্যার মূলে যে রয়েছে স্বামীর অনুমতি, সে সম্পর্কে তার ধারণা যে খুব স্পষ্ট ছিল এমনটি বলা যায় না। বরং এ জন্য দায়ী করেছেন নিজেকে। নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করায় আক্ষেপ করেছেন। তিনি সে পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি- এ কথা আত্মজীবনীর অনেকাংশেই উল্লেখ করে বলেছেন- ‘এখন কখন মনে পড়ে সেই দিন/পিঞ্জরেতে পাখী বন্দী, জালে বন্দী মীন’ (পৃ. ২২)

রাসসুন্দরী দেবী আত্মজীবনী রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন স্বামীর মৃত্যুর এক বছর পর ১৮৭০ সালে, ৬০ বছর বয়সে। গোলাম মুরশিদ বলেছেন, ‘স্বামী জীবিত থাকলে তিনি হয়তো তার আত্মজীবনী কোনোকালেই লিখতেন না অথবা লিখলেও প্রকাশ করতেন না’ (‘রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া’, পৃ. ৩৫)। মূলত স্বামী, সন্তান, সংসারের বাইরেও যে নারীর একটি নিজস্ব জগৎ থাকা প্রয়োজন- এ ধারণা দীর্ঘকাল ধরে পুরুষ তো নয়ই, নারীও অনুভব করেনি। তাই ‘আমার জীবন’-এ রাসসুন্দরী দেবীর নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায় না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়েছে কেবল সংসারের কাজে। তাই হয়তো স্বামীর মৃত্যুর পরই জীবনের শেষ দিকে নিজেকে নিয়ে কিছুটা ভাবতে পেরেছিলেন। আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড রচনার পর দ্বিতীয় খণ্ডও রচনা করেছিলেন।

আত্মজীবনী কেবল জীবনের ধারাবাহিকতাকেই ধরে রাখে না, একটি কালকেও বহন করে। সেদিক থেকে রাসসুন্দরী দেবীর ‘আমার জীবন’ একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই আবদ্ধ। পুঁথি কিংবা ধর্মগ্রন্থ ছাড়া অন্য কোনো বই পড়েছেন বলে মনে হয় না। বাইরের কারও সঙ্গে মেলামেশারও সুযোগ পাননি। জীবনযাপন করেছেন নিতান্তই গৃহবধূর মতো। ছেলের অনুরোধ না পেলে হয়তো লেখাও শিখতেন না। আত্মজীবনী রচনার মতো কোনো দৃষ্টান্তও তার সামনে ছিল না। সে হিসেবে আত্মজীবনী রচনার মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন।

 


নারী বিষয়ক লেখা পাঠানোর ঠিকানা- [email protected] । লেখার সঙ্গে আপনার পছন্দের একটি ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠাতে ভুলবেন না।


 

 

 

কৃতজ্ঞতা: সমকাল

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত