অনিতেশ চক্রবর্তী
১৩৪৭ বঙ্গাব্দে চৈত্রের শেষপাত। নিজের হাতে শেষ গানটি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ঐ মহামানব আসে’। জীবনের শেষ চৈত্র। যদিও, ‘শেষ লেখা’য় বা ‘সভ্যতার সংকট’-এ এই গানের রচনাকালের উল্লেখ রয়েছে পয়লা বৈশাখ। ‘রচনাকাল’ যদি নিছক একটি দিন বা মুহূর্ত না হয়, যদি তার প্রস্তুতি বলেও আবহমান কিছু সত্যি হয়, তাহলে এই গানের শুরুটা ঘটে গেছে চৈত্রেই।
সে চৈত্র বড় সুখের সময় নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বেঁচে থাকার মতো একটা ন্যূনতম চাহিদাকেও ঘোরতর অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্তফাটা মাটিতে দাঁড়িয়েও স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভেবেছিলেন, এই ধ্বংসের ভিতর দিয়েই আত্মপ্রকাশ হবে সৃষ্টির। মনে পড়ে ‘ফাল্গুনী’র কথা? যেখানে শীতবুড়োর ছদ্মবেশে বসন্ত আসে। সেই স্বপ্ন ভেঙেছে। রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন জীবন আর খুব বেশি সময় দেবে না তাঁকেও। এমনই একদিন আসন্ন নববর্ষের প্রভাতে বৈতালিকের জন্য একটা নতুন গানের আবদার জোড়েন শান্তিদেব ঘোষ। এদিকে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাবিও ছিল মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখে দেওয়ার। বাসভবন উদয়নে সদ্য লেখা সেই কবিতাতেই সুরারোপ করলেন রবীন্দ্রনাথ। বড় কবিতায় সুরারোপের ধকল একবারে নিতে পারে না শরীর। তাই সুর হল দুদিনে। স্বরলিপি করে দিলেন শান্তিদেব ঘোষ। ভৈরবী আঙ্গিকের গান। সকালের প্রথম প্রহরের। যে ভোর নবজীবনের বোধন গাইছে।
চারপাশে স্থায়ী ধ্বংস। একসময় যে ইউরোপকে আধুনিক সভ্যতার দূত মনে হয়েছিল, তাদের সাম্রাজ্যবিস্তারের রক্তমুখ দেখে, সেই বিশ্বাসও টাল খেয়েছে। খোদ ইউরোপের মানুষরাই নিজেদের অপার, নিরর্থক শূন্যের ভিতরে আবিষ্কার করছে ক্রমশ। এরমধ্যেও কোন আশ্চর্য দরজা দিয়ে প্রত্যয় এসে বাসা বাঁধে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মনে। একইসময়ে নববর্ষের অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’-এ তিনি বলছেন – “জীবনের প্রথম-আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের সম্পদ অন্তরের এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব।” অমিয় চক্রবর্তীকে বলছেন— আর সময় নেই, যা বলার এখনই বলে যেতে হবে। বলছেন এক শাশ্বত বিশ্বাসের কথা। নবজীবনের আশ্বাস নিয়ে মহামানবের আসার কথা। সময় ফুরিয়ে আসছে জেনে আরও নিবিড়ভাবে তিনি নতজানু হচ্ছেন স্বপ্নের কাছে। কী অনন্ত বিশ্বাসে লীন সেই স্বপ্ন।
সেই স্বপ্নেরই ফসল—“ঐ মহামানব আসে,/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে”। এরপর, ভরা গ্রীষ্মে, নিজের শেষ জন্মদিনের আগে অবশ্য আরও একটি গানের জন্ম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তথ্যগতভাবে এটিই তাঁর শেষ গান। ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার’। কিন্তু, গানটি কবিতা হিসেবে রচিত ঢের আগে। ১৩২৯ বঙ্গাব্দে লেখা ‘পূরবী’র ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতার একটা অংশকেই সামান্য বদলে সুর দিয়েছিলেন তিনি। এটিও ভৈরবী আঙ্গিকের গান। ‘হে নূতন/ তোমার প্রকাশ হোক কুজ্ঝটিকা করি উদ্ঘাটন/ সূর্যের মতন”– চারপাশে ওলোটপালট করা ক্ষয়ের মধ্যে, ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়েও এভাবে ভাবতে পারেন কেউ। এইটুকু মাত্র বুনে তারপর থেমে যেতে পারেন চিরকালের মতো।
গ্রীষ্মপোড়া দেশে চৈত্র, বৈশাখ এমনিতেই খুব নিষ্ঠুর দুটো মাস। সামনে অনন্ত দহন। বৃষ্টি কবে নামবে! যে বর্ষায় সমস্ত দহন মিটিয়ে চলে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেদিন শেষ গানের পাশাপাশি আড়ালে বয়ে চলবে তাঁর শেষের গান। ‘সমুখে শান্তিপারাবার, /ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।’ ১৩৪৬-এর ভরা শীতে এই গান রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘ডাকঘর’ নাটকের অভিনয়ে ব্যবহার করবেন বলে। সেই অভিনয় আর হয়নি। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল, এই গান যেন তাঁর শেষযাত্রায় জুড়ে থাকে। বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথের সাক্ষ্য জানান দেয়, কবির এই ইচ্ছা অপূর্ণ থাকেনি। বাইশে ও বত্রিশে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রায় ও শ্রাদ্ধবাসরে এই গানই গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কেন এই গান? জীবনব্যাপী এত সৃষ্টির ভিতর থেকে কেন এই গানকেই নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন কবি? “বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয়, / পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয় / মহা-অজানার।” মৃত্যুর শেষ ছাপিয়ে তিনি খুঁজে নিতে চাইছেন মহা-অজানার অন্য আকাশ। তাই হয়ত ‘ডাকঘরের’ জন্যই এই গান বেঁধেছিলেন তিনি। যে ‘ডাকঘর’কে মৃত্যু-বিধ্বস্ত ইউরোপ আবিষ্কার করেছিল আশ্চর্য বিস্ময়ে। নাৎসি ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে ঢোকার আগে একগুচ্ছ কচিকাঁচাদের নিয়ে এই নাটকের অভিনয়ই করেছিলেন ডাক্তার ইয়ানুশ কোরজ্যাক। তারপর দৃঢ় পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন বিষাক্ত গ্যাসের ভিতর। এই ছোটছোট ফুলো-ফুলো গালের, জল শুকিয়ে আসা উজ্জ্বল মুখের কচিকাঁচারাও তো ‘নূতন’। তাদেরকেও মৃত্যু-অতিক্রান্ত জীবনের সন্ধান দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ! তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ কবি এরপর লিখবেন, মানুষের মৃত্যুর পরেও মানবের থেকে যাওয়ার কথা। সেই মানবই কি মহামানব? জীবনের শেষ গানেও যাঁকে ডাক পাঠান রবীন্দ্রনাথ।
কৃতজ্ঞতা: বঙ্গদর্শন
