| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস বিনোদন

শচীন কর্তা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মহিউদ্দিন অনিক


কৃষ্ণ চন্দ্র দে, বিষ্ণুদেব চট্টোপাধ্যায়, ওস্তাদ বাদল খান, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এতসব বড় মানুষের শিক্ষা, সান্নিধ্য, সংস্পর্শে বড় হয়ে ওঠা বাংলা ও হিন্দি গানের জগতে অমর নাম শচীনদেব বর্মন, তবে শচীন কর্তা নামেই তার পরিচিতি বেশী। কিন্তু এসমস্ত মানুষের শিক্ষা দীক্ষা সান্নিধ্যের কারণেই এত উঁচু শিখরে উঠে আসেননি রাজ পরিবারে জন্ম নেয়া শচীন। তার গানের প্রভাবটা ছিল মূলত দুরন্ত কৈশোর এবং জন্মস্থান কুমিল্লার গ্রাম-বাংলাকে ঘিরে। যেটাকে একদম শেকড় বলা চলে।

১৯০৬ সালে কুমিল্লায় জন্ম হওয়া শচীন তার জীবনের প্রায় ১৯ টি বছর কাটিয়েছেন কুমিল্লায়। ১৯২৫ সালে কুমিল্লা ছেড়ে কোলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে চলে যান। রাজ পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তানের কুমিল্লা থেকে কোলকাতা গমন পর্যন্ত বেড়ে উঠার ঘটনা প্রবাহে তার শেকড়ের সন্ধান পাওয়া যায়, তার গানের ভিত্তির খোঁজ পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় তার গানের প্রেরণার খোঁজ।


শিশু শচীন দেব বর্মন বাঙালীয়ানা

শিশু শচীন দেব বর্মন


শিশু শচীন দেব বর্মন তাঁর পিতা মাতার সাথে      ছবি : ইন্টারনেট


একটু পেছনের ঘটনা প্রবাহের দিকে দেখা যাক। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মণ ত্রিপুরার বিখ্যাত রাজপরিবারের রাজত্বের অংশীদার ছিলেন। পারিবারিক জটিলতা আর ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে ক্ষোভ, অভিমান ও বিবাদ এড়াতে তিনি ত্রিপুরা ছেড়ে কুমিল্লায় পাড়ি জমান। ৬০ একর জমির ওপর গড়ে তোলেন রাজবাড়ী। সেখানেই নয় ভাই বোনের কনিষ্ঠ শচীন দেবের জন্ম হয়। কুমিল্লার রাজবাড়িতে রাজকীয় মহিমা-মর্যাদা বা উপাধি ছিল না, ঐশ্বর্য ছিল না তেমন, কিন্তু রাজপরিবারের আভিজাত্যের অহংকার অনেকখানিই ছিল।


শচীন দেব বর্মনের কুমিল্লার রাজবাড়ী

কুমিল্লার রাজবাড়ী


এই আভিজাত্য়ের অহংকারেই রাজপরিবারের নিয়ম ছিল সাধারণ মানুষ থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা। সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা নিষেধ ছিল। কিন্তু এ সব আদেশের তোয়াক্কা না করে শচীন ছোট বেলা থেকেই সাধারণ গ্রাম-বাংলার মানুষের সাথে চলাফেরা শুরু করেন, মাটির টানে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন। শচীন কর্তার ভাষায়-


রাজবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী জনসাধারণের থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে গুরুজনেরা আমাদের শৈশব থেকেই সচেতন করে দিতেন। তাঁরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন, যাতে তাঁদের মতে যারা সাধারণ লোক তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করি। আমি তাঁদের এ আদেশ কোনোদিনও মেনে চলতে পারিনি। কেন জানি না জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই মাটির টান অনুভব করে মাটির কোলে থাকতে ভালোবাসতাম। আর আপন লাগত সেই সহজ- সরল মাটির মানুষগুলোকে, যাদের গুরুজনেরা বলতেন সাধারণ লোক। যা-ই হোক, অসাধারণের দিকে না ঝুঁকে আমি ওই সাধারণ লোকদের মাঝেই নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে তাদের সাথে এক হয়ে গেলাম শৈশব থেকেই। আমার এ আচরণ রাজবাড়ির কেউ পছন্দ করতেন না।


তার লোকগানের হাতেখড়ি এই সাধারণ মানুষের হাত ধরেই। বাড়িই দুই পরিচারক মাধব ও আনোয়ারের কাছে তার প্রথম গানের কান তৈরী ও লোকগানের শিক্ষা ঘটে।

ত্রিপুরা সম্বন্ধে প্রবাদ আছে যে, সেখানকার রাজবাড়িতে রাজা, রাণী, কুমার, কুমারী থেকে দাস-দাসী পর্যন্ত সবাই গান গায়। গলায় সুর নেই, গান গাইতে পারে না এমন কেউ নাকি সেখানে জন্মায় না। ত্রিপুরার ধান ক্ষেতে চাষী গান গাইতে গাইতে চাষ করে, নদীর জলে মাঝি গানের টান না দিয়ে নৌকা চালাতে জানে না, জেলে গান গেয়ে মাছ ধরে, তাঁতী তাঁত  বুনতে বুনতে আর মজুর পরিশ্রম করতে করতে গান গায়। বাবার কাছে সংগীত শিক্ষা শুরু করা শচীনেরও রক্তে ছিল এমন সব মাটির মানুষের গান।

নিজের গান সম্পর্কে কর্তা বলেন, লোকসংগীত ও ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের সংমিশ্রণে একটি নিজস্ব গায়কী সৃষ্টি করেছি, যা বিদগ্ধজনের কাছে আদৃত হয়েছে।” কলকাতায় সলিল ঘোষকে গান শোনাতে গিয়ে কর্তা বলেন, “বুঝলে সলিল, গ্রাম্য কথাগুলি রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। এতদিন গ্রাম ছাড়া হয়ে থেকেও এখনো সেই কথাগুলি ঘুরেফিরে মনে আসে।”  

ধ্রুপদী সংগীত শিল্পী ও সেতার বাদক বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছ থেকে প্রথম মার্গসঙ্গীত শিক্ষা লাভ করলেও শুধু এটাতেই তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না। ঝুঁকে যান গ্রাম্য সংগীতের দিকে; লোকগান, ভাটিয়ালি গানের দিকে। বাড়ির পরিচারক মাধবের কাছে শ্রুতিমধুর রামায়ন শুনে, আনোয়ারের সাথে মাছ ধরে আর তাদের কাছে গান শুনে শচীনের সময় কাটত। তাঁর স্মৃতিকথায়, আনোয়ার ও আমি সুযোগ বুঝে ছিপ নিয়ে বসে যেতাম, আর দুজনে মাছ ধরতাম। তারপর গান গাইতে গাইতে পুকুরের ধারে ধারে ও বাগানে দুজনে বেরিয়ে মনের কথা বলতাম। আনোয়ার রাত্রে তার দোতারা বাজিয়ে যখন ভাটিয়ালি গান করত তখন আমার ব্যাকরণ মুখস্থ করার দফারফা হয়ে যেত।”

আনোয়ার আর মাধবের সাথে তিনি সারাদিন গাছতলা, মাঠে, ঘাটে, ধর্মসাগর দীঘিতে ঘুরে বেরাতেন আর গান করতেন। পড়া ফাঁকি দিয়ে রাত জেগে জেগে বিভিন্ন গানের মজলিসে বসে থাকতেন, কুমিল্লা ও আগরতলার চারপাশের গ্রামে ঘুরে ভাটিয়ালি , বাউল গায়কদের সংলাভ খুঁজে বেড়াতেন। তাদের গানের কথা সংগ্রহ করতেন। শচীনের ভাষায়, এসব গায়কের গানে গ্রামের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে থাকত।”

কুমিল্লার রাজবাড়িতে সর্বদা গান বাজনা লেগেই থাকতো। ভাটিয়ালি গান, গাজন গান, বাউল সংগীতের আসর বসত সবসময়।  পূজো, হোলির সময় ভারতবর্ষের বিখ্যাত গায়ক যন্ত্রশিল্পীরা এই বাড়িতে আসতেন। তাদের গানে রাত দিন মুখরিত থাকতো। বাড়ীর সবার সাথে বসে মুগ্ধ হয়ে গান শুনতেন ছোট শচীন কর্তা।

কুমিল্লায় আরও কয়েকজন সংগীত, সাহিত্য অনুরাগী কিশোর তরুণের সঙ্গ-সান্নিধ্য তাঁর ভেতরের গানের মানুষটিকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ, সুশীল মজুমদার, নারায়ণ চৌধুরী যাদের প্রত্যেকেই পরবর্তীতে কবি, গীতিকার, লেখক, সমালোচক বা চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

পুরো পূর্ব-বাংলা তিনি চষে বেড়িয়েছেন, গান সংগ্রহ করেছেন। এসব সংগ্রহের বলেই তিনি তাঁর গানের জগতকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর ভাষায়-


“পুর্ববঙ্গের এই অঞ্চলের এমন কোনো গ্রাম নেই বাঁ এমন কোনো নদী নেই, যেখানে আমি না ঘুরেছি। ছুটি ও পড়াশোনার ফাঁকে আমি গান সংগ্রহ করতাম। আমার এখনকার যা কিছু সংগ্রহ, যা কিছু পুঁজি, সে সবই ঐ সময়কার সংগ্রহেরই সম্পদ।”


রাজপরিবারে জন্ম নিয়েও সকল শ্রেণীর মানুষকে ধারন করে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন এমন শিল্পীর সংখ্যা নেহাতই কম, এমন সৃষ্টির সংখ্যাও কম। লোকগান, ভাটিয়ালি, গাজন, চাষাভুষা, মাঝি মল্লার-গান সব মিলিয়ে বললে সাধারণ মানুষের গান ছিল তাঁর সকল সৃষ্টির উৎস। এই উৎসের সন্ধান ছিল তাঁর শৈশব থেকেই, এই শেকড়ের সন্ধান ছিল সেই কুমিল্লার রাজবাড়ীর ঐতিহ্যকে ছিন্ন করে।

 

 

 

কৃতজ্ঞতা:

  • ‘সরগমের নিখাদ’ ; তৎকালীন দেশ পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত শচীন দেব বর্মনের আত্মকথা
  • ‘সরগমের নিখাদ’ আবুল আহসান চৌধুরী
  • সলিল ঘোষের রচনা
  • ইন্টারনেট

কৃতজ্ঞতা: বাঙালীয়ানা

 


ইতিহাস,বিনোদন,সংবাদ,ফিচার,লাইফস্টাইল,লোকসংস্কৃতি কিংবা খেলা বিষয়ক লেখা পাঠানোর ঠিকানা- [email protected]. লেখার সঙ্গে আপনার পছন্দের একটি ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠাতে ভুলবেন না।


 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত