| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

‘ধরো পৃথিবীটা তোমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল’

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

      

মন খারাপ কাঁধে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে হুটহাট ছাড়িয়ে যাওয়া যায় ঠিকানা। হয়ত পাশেই দাউ দাউ করে গোটা একটা মানুষ পুড়ে যাচ্ছে।

হাওয়া থেকে তখনও শীত যায়নি। কাগজে লেখার উপর জল পড়লে যতটা আবছা হয়ে আসে, অতটাই কুয়াশা হয়ে আছে— মেহগনি ফুলে, মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানের গায়ে, তখনও জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয়, রাস্তা ঝাড় দেওয়া মহিলার পায়ের ফাটা দাগে, না খোলা দোকানের শাটারে।

দেখা যায় এমন দূরে থমথম করছে একটা নদী। তবুও দূরে তো!— মনে হচ্ছে চাইলে উড়তে পারত। তার পাড়ে দাঁড়িয়ে বাঁশপাতা ভেসে যাওয়া জলে, চারপাশে ঘুম জড়িয়ে আছে।

বৃষ্টি হবে। যতটা বাড়ির পথ তারও আগে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টিতে আমার মনে পড়ে জ্যোৎস্না! জ্যোৎস্না বৃষ্টিতে ভিজছে। একএকা। আচ্ছা, ভিজে গেলে জ্যোৎস্নাও কি চুল শুকোতে রোদে দাঁড়াবে। কিংবা নতুন জামাটা ভিজিয়ে রাখায়, সেদিন যেমন বিস্তর রঙ উঠেছিল, জ্যোৎস্নারও কি রঙ হালকা হবে অমন! কে জানে!— তবে জ্যোৎস্না জানে— অল্প ভেজা সালোয়ারে ঘরে ফিরলে মানুষ বলে কলঙ্ক।

বৃষ্টি পড়ছে। আমার মায়া হচ্ছে। ওই যে অফিস থেকে যারা বাড়ি ফিরছে, ওদের জুতোগুলোর জন্য। এমন মায়া হিমাংশু কাকুরও হত। ধরা যাক, হিমাংশু কাকুর মেয়ের নাম জ্যোৎস্না। বড় ভালো মানুষ ছিলেন কাকু। রোজ সকালে পত্রিকা পড়তেন। বাড়ির সামনের কলে চান করার সময় গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। বাজার শেষে একে ওকে ডাক দিয়ে মাছের দাম শোনাতেন। অথচ এই ভালো মানুষটাকে কাকিমা ধাক্কা দিয়ে একদিন সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ওই যে গড়িয়ে গেলেন, আর থামেননি। তার লাগানো জাম গাছটা এখনও হাওয়া দিলে বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠুকে দেয়। তার খোঁজ করে।

জ্যোৎস্নাও খোঁজে। ফুলের টবে। রান্নাঘরে ধুয়ে রাখা বাসনে। ছাদে মেলে দেওয়া কাপড়ের ভাঁজে। ফটো ফ্রেমে। তোষকের নিচে। মার ব্লাউজের ভিতর। শায়ার গিঁটে। বৃষ্টির নিষেধে। জাম গাছটার পাতার নরমে।

সে খুঁজে পায় গাছটার পাতার উপর দিয়ে পিঁপড়ের ডিম নিয়ে হেঁটে যাওয়া। একবার না বলে ওদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছিল মায়া। ভিতরে কাকিমা খালি গায়ে মুখে ডিম নিয়ে কার যেন বুকের উপর দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিলেন। সেবার সমস্ত বৃষ্টি ফুরানোর পর গোল হয়ে ঘুরতে থাকা হাওয়ার মতো মুচড়ে দিয়েছিল মেয়েটাকে।

কাকু মারা যাবার পর কাকিমার আরও একটি মেয়ে হয়েছিল— ধরা যাক তার নাম বৃষ্টি। আচ্ছা, ঘরের ভিতর কি কখনও বৃষ্টি হয়! তবুও জ্যোৎস্না গিয়ে দাঁড়ালে, ভিজে যেত। কাদামাটি হয়ে, পড়ে থাকত ঘরের ভিতর। কেউ আঙুলের উনিশ-বিশে গড়ে নিত মাটির সরা, বাসনকোসন, পাখি, পুতুল, উঁচু করে দিত খেতের আল।

এক দুপুর বৃষ্টির মধ্যে জ্যোৎস্না হঠাৎ করে পালিয়ে যায় টোকনদার সাথে। টোকনদা সাইকেল সার‍ত। নোংরা জামা পোরত। পান খেত। তাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুনিনি কখনও। তবুও তাকে নিয়ে পালিয়ে গেল জ্যোৎস্না। সদ্য চাকরি পাওয়া পাড়ার যুবক ছেলেটা গলার কাছে দলা পাকিয়ে থাকা ব্যথা গোপন করে প্রথমবারের মতো অফিস গেল। কলপাড়ে চান করতে নিরঞ্জন সেদিন আর বাড়তি সময় নিল না। চায়ের দোকানে ঝাপ আগেই নেমে গেল। ফুটবল টিমের নওশাদও পেনাল্টি মিস করল। অন্যদিকে, সিনেমার পোষ্টার। কাগজ ফেটে বেরিয়ে থাকা বি-গ্রেড মুভির নায়িকার শরীর। সে সমস্ত প্রকাশিত গোপনের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গণেশ কাকা। শুধু সেই তার টেকো মাথায় পুরো পাড়াটা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়েছিল।

দূরে মসজিদের মিনার টপকে যাচ্ছে পাখি। আর জ্যোৎস্না টপকে যাচ্ছে খেলার মাঠ, বিস্কুটের টিন, জবাফুলের বোঁটায় ধাক্কা লাগা হাওয়া, মা’র প্রেমিকের আঙুল, দেরীতে বাড়ি ফেরার কলঙ্ক।

এখন রোজ ভোরবেলায় অসংখ্য লোকের জামার ভিতর বৃষ্টি ঘেমে ওঠে। যে বৃষ্টির ভিতর ট্রাফিকপুলিশ কোন পাখির নাম। যে পাখির ঠোঁটে লুকিয়ে রাখা যায় খিল আঁটা দরজা, ফুল স্পিড পাখার নিচে ঘেমে যাওয়া শরীর, সালোয়ারের ফাঁকফোকরে তাকিয়ে থাকা চোখ, জবাফুলে কারও পালিয়ে যাবার আকুতি।

যখন শহরটা একাএকা রাস্তায় ভিজে যায়। বৃষ্টির মন করে, ছাতা নিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াক কেউ। তুমি বলে ডাকুক। ধারণা হয়— খুঁজে পেলে পৃথিবীও একটা আয়না। ভাঙলে শব্দ হয়।

ধরো, পৃথিবীটা তোমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেলো…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত