| 9 অক্টোবর 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

কার দায়

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

নবনীতা সই

সকালে আজও বুবুন আমন্ড গুলো খায়নি৷ তুমি কিছু বলো বুঝলে৷ একদম কথা শোনেনা৷
টিফিন নিয়েছে?
কি যে বলো আজ অবধি কোনদিন টিফিন ছাড়া স্কুলে পাঠিয়েছি? তোমার টাও রেডি৷ নাও নাও কথায় কথায় তুমি আবার আমন্ড খেতে ভুলে যেও না৷
তোমার ব্রেকফাস্ট কোথায়?
ঐ যে গ্রীণ টি, আপেল আর দুপিস টোস্ট।
ডায়েট?
হুম৷ সামনে তোমার অফিসের অ্যানুয়াল পার্টি আসছে না৷ অনলাইন থেকে আনানো ব্ল্যাক ড্রেসটায় আমাকে ফিট হতেই হবে৷
কিপ ইট আপ বেবী৷ আমার কিন্তু দেরী হবে৷
জানি৷ কিন্তু ফোনে এ্যালার্ম আছে টাইম মত লাঞ্চ আর ডিনার করবে৷
সে আর বলতে৷ তবে রুনু ড্রাই ফ্রুটের জন্য অনেক খরচ বেড়ে গেলো গো৷
তুমি কি গো? শরীর তো আগে? কত খাটো বলো তো? না না ওটুকু খাবে অবশ্যই ৷ সিগারেট কম খাও বুঝলে? খরচ বাঁচবে৷
হুম৷
হুম না আমি কিন্তু তাহলে বুবুন কে নিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য ঐ বাড়ি চলে যাবো৷
তোমার মাথা খারাপ? সামনে অ্যানুয়াল ব্যালেন্সশিট জমা করতে হবে, তারপর পার্টি৷ তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না৷ সিরিয়াস বলছি কমিয়ে দেবো৷ ওকে বেবী আমার দেরী হয়ে গেলো৷ বাই ৷
আরে ডিমটা খেলেনা? নাহ্ বাপ ছেলে দুজনে সমান হয়েছে৷

বেলাদি কাজে আসলে সবার আগে রুনু তাকে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে দেয়৷ সবকাজ বেলাদি করলেও রুনু রান্নাটুকু নিজে করে৷ তারপর শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট৷
রুনুর শশুর শাশুড়ি থাকে নৈহাটিতে৷
সেখানে পৈতৃকবাড়ি৷ শশুর মশাই আসতে চাননা যৌথ পরিবার ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে৷
এখনও রুনুর দিদি শাশুড়ি বেঁচে আছেন৷ তবে রুনুর শাশুড়ি একবাক্যে স্বীকার করেন, অমিতের যা কিছু উন্নতি সব রুনুর জন্য৷ আর বুবুন হবার পর তো কথাই নেই৷ বরঞ্চ এখানে আসলে বৌমার যত্নে হাঁপিয়ে যান৷ সময়মত খাওয়া, ঘুম৷
অমিতের ও মাঝে মাঝে অতিরিক্ত মনে হলেও রুনুর কেয়ার ভালোই লাগে৷
বাচ্চা হবার পরও রুনু যেভাবে মেনটেন করেছে নিজেকে, বন্ধুরা তো রীতিমত হিংসা করে৷
চাকরী ছেড়ে দিলো রুনু শুধুমাত্র বুবুন কে মনের মতন মানুষ করবে বলে৷ আর কি চাই, সত্যিই অমিত নিজেকে লাকি মনে করে৷
শাশুড়ি ও জায়েদের, পাড়া প্রতিবেশী, নিজের ঘর, সব ফেলে আসতে পারেন না তো কি, বৌমার উপর অমিতের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত৷ ছেলের চাকরীর উন্নতি, ফ্ল্যাট, গাড়ি সব রুনুর পয়াতে হয়েছে বলেই গর্ব করেন৷

টুং করে এ্যালার্ম বাজতেই, রুনু তৈরী হয়ে নেয়৷ বুবুন কে আনার সময় হয়ে গেছে৷ আজ আবার বুবুনের ব্যায়ামের ক্লাস আছে৷ ফিরতি পথে ডাক্তার অশোক ঘোষের ক্লিনিকে গিয়ে বুবুনের ওজন মাপানো৷ কিছু রুটিন চেকআপ করাতে ও হবে৷ সেই সময়ে টাটকা ফল, সবজি হাতে করে নিয়ে আসে রুনু৷ রোজ টাটকা রান্না করা অভ্যাস৷ গলির মুখে দাঁড়ালেই অটো পাওয়া যায়৷ সোজা বুবুনের স্কুলে৷ যাবার সময় স্কুল গাড়িতে গেলেও ফেরার সময় রুনু নিজে নিয়ে আসে, নইলে অনেক ঘুরে বাচ্ছা নামাতে নামাতে বুবুনের আসতে দেরী হয়ে যায়৷ তাই রুনু নিজে নিয়ে আসে৷

স্কুলের সামনে নামতেই রুনুর মতন অনেক গার্জেনের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতেই ছুটি হয়ে যায়৷ রুনু সবসময় আগে যায়৷ যদি বুবুন রুনু কে না দেখতে পেয়ে কাঁদে৷ ফেরার সময় একটা নতুন অটো আলার অটো তে জায়গা পেয়ে যায়৷ ছেলেটার গোঁফ ওঠেনি৷ বাচ্চাছেলে অটো চালাচ্ছে ৷
কিছুসময় পর ধুম করে আওয়াজ ব্যাস আর কিছু মনে নেই রুনুর ৷

সাতমাস পর হাসপাতাল থেকে যে রুনু ফিরে আসে সে তখন পঙ্গু৷ একটি পা বাদ গেছে রুনুর৷ বুবুনের হাত ভাঙলেও তিনমাস পর সুস্থ হয়ে গেছে৷ কিন্তু রুনুর জীবনের অন্ধকার যেন তার পুরো মনকে গ্রাস করে নিয়েছে৷ অমিতের মা সংসার সামলাচ্ছেন আজ কমাস৷ অমিত হাসপাতাল আর বাড়ি করে করে ক্লান্ত৷ বুবুনের স্কুল বন্ধ ৷ কে পাঠাবে?
অমিতের মা রুনুর দেখাশুনা করবেন না বুবুন কে সামলাবেন? শেষে বুবুন আর রুনু কে নিয়ে অমিতের মা নৈহাটি চলে যান৷ সেখানে একটি নার্শারী স্কুলে ভরতি হয় বুবুন৷ অমিত সপ্তাহ শেষে গিয়ে দেখা করে আসে৷ রুনুর আর বাঁচতে ইচ্ছা করেনা৷ সেদিন অটোটা একটা বাস কে ধাক্কা মেরেছিলো৷ পাশের লোহার রডটা রুনুর মাথায় গিয়ে লাগে৷ বুবুনে একপাশে হয়ে পড়েগিয়ে পায়ে আঘাতটা জোরালো হয়ে লাগে৷ একটি রড ঢুকে গিয়েছিলো পায়ে৷
বুবুন কে জরিয়ে থাকায় বুবুনের চোট কম লেগেছিলো৷ রুনুর বাবা নেই৷ মা দাদার সংসারে থাকেন৷ সবাই মিলে করলেও কতদিন? আস্তে আবার সবার জীবন চলতে থাকে৷ শুধু রুনুর জীবন পুরো অন্ধকার হয়ে যায়৷ সব স্বপ্নগুলো টুকরো টুকরো হয়ে রুনুর চোখের জল হয়ে বয়ে যায়৷ প্রায় বছর দুয়েক এই মানসিক ও শারীরক যন্ত্রণা ভোগ করার পর রুনু কিছুটা স্বাভাবিক হয়৷ আবার রুনু নিজের সংসারে ফিরে আসে৷ বুবুন কে ভালো স্কুলে দিতে হবে৷ অমিতের ও অসুবিধা হচ্ছে ৷ রান্না আর কাজের লোকের উপর সংসার৷ সবাই মিলে সিধান্ত নিয়ে শেষে রুনুকে নকল পা লাগানো হয়৷ বহুদিন লাগে সেই অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে৷ কিন্তু সেই সুর জীবনের কেটে গেছে৷ সেই ছন্দ হয়ত জীবনে আসবে, কিন্তু কবে রুনুর জানা নেই ৷

শুধু রুনুর একটাই প্রশ্ন তার জীবনের এই দূর্ঘনার দায় কার?

(গল্পটা শুধু গল্প নয়, প্রশ্ন৷ যারা রোজ কাজের জন্য পথে বের হচ্ছেন, আপনারা বাড়িতে নিজের জন্য, পরিবারের ভালোর জন্য কতকিছু করেন৷ পুরো জীবনটাই মধ্যবিত্তের পরিবারের আর একটু সুখ শান্তির জন্য ব্যয় হয়ে যায়৷ আপনারা কখনও ভেবেছেন , এই যে রাস্তায় অটো , টোটো চলে সেটা কতটুকু নিরাপদ? আমি মানছি এ্যাকসিডেন্ট সবার হতে পারে৷ কিন্তু বেশীরভাগ দেখা যায় অটো টোটো গুলো চালানোর কোন লাইসেন্স নেই৷ পার্টি ফান্ডে চাঁদা আর একটা ঝান্ডা হাতে করলেই ব্যস সে হয়ে গেলো চালক৷ কি ভাবছেন? তাতে আপনার কি? সে কিন্তু শুধু অটো চালক হলোনা, ব্যস্ততার সময় সে কিন্তু আপনার জীবনের ও চালক হয়ে গেলো৷ ছেলে মেয়ের খাওয়া দাওয়া, পড়াশুনা সব নিয়ে আমরা কত প্ল্যান করি, কিন্তু কখনও ভাবিনা যে অটোটা করে আজ ছেলে কলেজে গেলো তার চালক কি আদেও চালক? না নিতান্ত বালক? জানি বেকার সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা ৷ অটো চলুক টোটো চলুক৷ কিন্তু সরকার থেকে এদের কি কিছু প্রশিক্ষণ বিনা টাকায় বা সামান্য টাকায় দেওয়ানো যায়না? রাতে বাড়ি ফিরছেন৷ দেরী হয়ে গেছে , জানেন কপালে ঝাড় আছে৷ কখনও ভাবেন নি যে অটোতে বসলেন সেই অটো চালক কতটা নিপুন৷ শহরে তাও দেখেছি চারজনের বেশী নেওয়া বারন৷ গ্রামে? অটো গুলোতে বাদুর ঝোলা হয়ে মানুষ যাতায়াত করে৷ ট্রেকার গুলো তো মাথায় লোক নিয়ে যাতায়াত করে৷ ট্রেকার আর বাসের মাথায় উঠলে একটাকা ভাড়া কম নেয়৷ অবাক হচ্ছেন? মাত্র একটাকা কম? গরিবের কাছে রোজের ঐ একটাকা অনেক৷ জীবনের ঝুঁকি নিতেও রাজি৷ কবে কোটিপতি দের জীবনযাত্রা আর কোটিপতি পরিবার নিয়ে ন্যাকা ন্যাকা সিরিয়াল দেখা ছেড়ে আমরা ভাববো এদের নিয়ে? দোষ কার? গরিবের? না আমাদের? না চালক দের? কেউ ভাবেনা৷ আমিও ভাবতাম না কিন্তু ঐ যে মাথায় সবসময় দুষ্টু পোকা কামড়ায়৷ ভাবার কিন্তু সময় এসেছে৷ 

মা তারা ফুডস্

“কি গো মাসি আজও লেজের দিকের মাছ দিলে!” উত্তরাও চেঁচিয়ে ওঠে,” নেজার দিকের মাছ কি আমি কোঁচড়ে করে ঘরকে নিয়ে যাব নাকি গো! আমায় নেজা মুড়ো ছাড়া মাছ বেচি দিয়ে যায়, বলো? যাও দেকিনি অন্য হোটেলে, তিরিশ টাকায় দু সবজি, ডাল ভাজা, টক আর মাছ খাওয়ায়? এ কেবল মা তারা ফুডস্ এ পাবে গো দাদা। আজ সোনামুখ করে খেয়ে নাও ভাইটি আমার, কাল তোমায় গাদা দিতে বলব খন। এই ঘুঙুর নদের চাঁদকে কাল গাদা দিস রে।অয় ভাই, বলে দিলাম গো। “

এ খাঁটি কথা। উত্তরার ‘মা তারা ফুডস’ এর খাওয়ার কোয়ালিটি অন্য সব হোটেলের থেকে ঢের ভালো। এইখানেই কেবল পাতা টকদই পাওয়া যায়। অফিসের আর বাকি সকলের মতন কমলেশ বাবুর দুপুরের খাওয়ার ঠিকানা এই ‘মা তারা ফুডস’। কমলেশ বাবু গ্রামের বাড়ি থেকেই অফিস করেন। ঘন্টা দুয়েক লাগে যাতায়াতে। সকালে দুটো রুটি খেয়ে চলে আসেন।আগে ছিলেন ব্লক অফিসে,সেটা নিজের গ্রাম থেকে বেশী দূর ছিল না।শেষ বয়সে খামখা কেন যে প্রমোশন নিলেন কে জানে! ভাবলেন মাইনেও বাড়বে রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট ও বেশী হবে। অবশ্য তার এসবের দরকার খুব একটা নাই। বিয়ে থাই তো করেননি। ছোটবেলায় বাপ মা মারা গেছিলেন তারপর ভাই বোনদের মানুষ করতে গিয়ে যা হয়।ওই এক গল্প। সময়ে সব দায়িত্ব শেষ করতে গিয়ে নিজের প্রতি দায়িত্বগুলোই অবহেলা করে ফেললেন। গ্রামে জমি জায়গা, চাষবাস, পুকুর সবই আছে তাঁর। ভাইয়ের সংসারে যথেষ্ট সম্মানই করে তাঁকে সকলে।কেবল প্রথমদিকে এই জার্নি আর খাওয়ার কষ্টটা বেশ ভুগিয়েছিল কমলেশ বাবুকে। পেটের সমস্যা হতে লাগল। তখন অফিসেরই হরিদাস তাকে নিয়ে গেল ‘মা তারা ফুডস’ এ। অফিস ক্যান্টিনের অবস্হাও যে চরম বাজে।’মা তারা ফুডস’ তার থেকে ঢের ভালো। সেই হোটেলই চালায় উত্তরা। আগে স্বামীর সাথেই থাকত দোকানে।

দুদিনের জ্বরে মানুষটা চলে গেল, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে উত্তরা তখন পড়ল অথই জলে। হোটেলের কর্মচারীরাই বলল “বৌদি তুমিই চালাও হোটেল’। উপায়ও নাই। শুরু হল অসম লড়াই। আশপাশের হোটেল মালিকরা বড় পেছনে লাগতে লাগল।দোকানে দামড়ার দেওয়াল, সবই সরকারি জায়গায়। কোনদিন টালি চুরি হয় যায় তো কোনদিন উনুন ভাঙা থাকে। কাস্টমার ভাঙানো তো আছেই। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তরা লড়ে গেছিল। পনেরো বছরে সে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। বত্রিশে উত্তরা নেমেছিল জীবনযুদ্ধে,আর আজ বয়স হল প্রায় আটচল্লিশ। উত্তরা এখন কেউ একটু বেয়াদপি করলেই সমানে তেড়ে যায়।

এই যেমন পাশেই রতনের দোকান, একদম গায়ে গায়ে। একদিন রতন পেছনের জল যাওয়ার নালাটা কাটতে দিচ্ছিল না ধনা কে। ধনা ‘মা তারা ফুডসের’ বহুতদিনের কাজের লোক। ধনা বলেছিল “দেখ রতন, ফালতু ঝামেলা করিসনি, আমাদের নালা তো তোর অসুবিন্ধা করছে না, তাইলে কাটতে দিচ্ছিস না কেন?” রতনের হোটেল এমনিতেই মাছি তাড়ায়, তারপর উত্তরার হোটেলে লোকে দাঁড়িয়ে থাকে তবু তার দোকানে আসে না, এই জ্বালা তো রতনের ছিলই। রতন বাপের বয়সী ধনাকে মা বোন তুলে গাল দিলে সেও বলেছিল “মুখ খারাপ করিস না রতন , ভালো হবে না।” ঘুঙুর এঁটো বাসন রাখতে গিয়ে দেখে রতন ধনাকে শাসাচ্ছে।ঘুঙুরও কম যায় না। সে রতনকে বলে “নিজের দমে ব্যবসা করো না রতন দা, অন্যের ভালো দেখে চোখ টাটায় কেন তুমার।” রতনের মাথায় আগুন জ্বলে গেল, ঘুঙুরের কব্জি ধরে বলল “মেয়েমানুষ হয়ে এত তেজ,শালী দম দেখার শখ না, আয় দেখাচ্ছি দম।” ঘুঙুর চিৎকার করে উঠলে আশপাশের সবাই জড়ো হয়ে গেছিল।উত্তরা তখন ভেতরে, চিৎকার শুনে এসে রতনকে সাবধান করে বলেছিল, ” রতন ঘুঙুরের হাত ছাড়, আর আমার সাথে লাগতে আসিস না।”রতন বলল “আমার মেলা কাজ, তোমার মত মেয়েমানুষের পেছনে লাগতে আমার বয়ে গেছে। জানি না তুমি কেমন করে খরিদ্দার ধরো। ” কথাগুলোর মধ্যে একটা প্রছন্ন অসভ্যতা ছিল।উত্তরা রাগের মাথায় রতনকে সেদিন চেলাকাঠ দিয়ে এমন পিটিয়েছিল যে রতনের ডানহাত ভেঙে গেছিল। সেই থেকে উত্তরা কে সবাই সমঝে চলে।

কমলেশবাবু কে ঘুঙুর একটু যত্ন করেই খেতে দেয়।রোজই এখানে দুপুরের খাবারটা খান তিনি, তবে বৃহস্পতিবার বাদ দিয়ে। কমলেশ বাবু উত্তরার আধার কার্ড করিয়ে দিয়েছিলেন, শুধু তার নয়, ছেলে, মেয়ে, জামাই সকলের। ধনা, ঘুঙুর,পকা, মোরগ কাউকেই লম্বা লাইন দিতে হয়নি কমলেশবাবুর সৌজন্যে। কমলেশবাবুই বলে দিয়েছিলেন, “ওরা আমার লোক”। সেই থেকে কমলেশবাবুকে এরা সবাই বড় সমীহ করে।কমলেশ বাবু রোজ দেখেন তার পাতে মাছের পেটিই থাকে। কারো পাতে করলা ভাজা নাই কিন্তু তার পাতে আছে। সেদিন আবার ঘুঙুর পাতে একটা পোস্তর বড়া দিয়ে গেল। কমলেশ বাবু বললেন এটা নিয়ে যা, পোস্তর বড়া আমায় দিলি কেন, চেয়েছি? ঘুঙুর মুচকি হেসে বলে “খাও কাকু খাও, মাসি বলেছে তোমারে দিতে, আজ মঙ্গলবার কি না, মাছ তো খাবে না”। কমলেশ তাকায় উত্তরার দিকে। সে ব্যস্ত হিসেব মিলাতে। কমলেশ বাবুর দিকে চোখ যেতেই উত্তরা আঁচলটা টেনে নিয়ে মাথা নামিয়ে নিল। কমলেশ বাবু লক্ষ্য করেছেন যে তাঁকে দেখলেই উত্তরা একটু সচেতন হয়ে যায়, গায়ে মাথায় কাপড় দেয়। তবে তার এই পক্ষপাতও কমলেশের নজর এড়ায় না। টক দই এর পরিমানও অন্যদের থেকে তার পাতে বেশীই থাকে রোজদিন। কমলেশ বাবুরও ভালোই লাগে, এরকম আলাদা যত্ন পেতে। টাকা মেটানোর সময় মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেন “এত খাটাখাটনি, নিজের শরীরের যত্ন নিচ্ছ তো!” ডাকাবুকো উত্তরা একদম কুঁকড়ে যায় এরকম কথা শুনে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। তার কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে না তাই এরকম করে কেউ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। কমলেশবাবুর কাছে উত্তরার কথা সরে না।মাঝে মাঝে কমলেশ বাবু উত্তরার কাশি হয়েছে দেখলে কাশির টনিক এনে দেন। হাঁটু ব্যাথার জন্য পেইন কিলারও এনে দেন। প্রভাতীর বড় লজ্জা লাগে নিতে, কিন্তু পয়সা মেটানোর সময় তিনি আস্তে করে টেবিলে রেখে চলে যান। দুজনার কথা তেমন হয়না।

সময়, সব কাজ সময়েই শেষ করে। অন্যথা হয়না। কমলেশ বাবুর অবসরের সময় আসন্ন। ঘর, অফিস, কাজ, দুপুরের ‘মা তারা ফুডস’ আর বাড়ি ফেরা।তবু জীবনকে কোনদিনই একঘেয়ে লাগেনি। ছুটির দিনগুলোয় চাষের জমির তদারকি করেন, ভাইয়ের নাতনির সাথে খেলা তো আছেই। পূজা-আর্চা আছে।ত্রি আহ্নিক করা কমলেশ বাবুর পূজোর সময় মন্ত্রোচ্চারণ অভূতপূর্ব। সুন্দর চন্ডীপাঠ করেন। দানধর্ম ও করেন যতটা পারেন।কেবল জাত নিয়ে একটু ছুবিছুবি আছে। ভাইয়ের ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় কুলীন নয় বলে কত সম্বন্ধের কথা যে এগোয়ই নি তা ঈশ্বরই জানেন।

এ মাসের শেষে কমলেশ বাবুর রিটায়ারমেন্ট। সাত বছর কেমন করে না জানি পেরিয়ে গেল।রিটায়ারমেন্টের পর চাষ বাস নিয়ই থাকবেন। রিটায়ারমেন্টের পর চাকরি করা পোষাবে না তাঁর,দরকারও তো নেই।। তবে ডিপার্টমেন্টের গুপ্তবাবু কিন্তু বলেছেন যে “ব্যানার্জী দা আপনাকে আমি ছাড়ব না, আমি ওপর মহলে আপনার নাম রেফার করেছি। জানেনই তো কি অবস্হা ডিপার্টমেন্টের, একটা লোক দেয় না, শুধু কাজ বাড়ছে। সামনেই আবার ভোট।”কমলেশ বাবু মুচকি হাসেন। নাহ্ সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েই ফেলেছেন যে আর চাকরী নয়। কিন্তু কেন জানি কমলেশ বাবুর হঠাৎ কেমন একা লাগতে লেগেছে, যত রিটায়ারমেন্টের দিন এগিয়ে আসছে একটা ভয়ও হচ্ছে। কিসের ভয় সেটা জানেন না। নাহ্ এই ভয়টা ঝেড়ে ফেলতে হবে,নইলে দুর্বল হয়ে পড়বেন

রিটায়ারমেন্টের দিন অফিসের সবাই কে খাওয়ানোর একটা চল আছে। কমলেশবাবু ভাবলেন সেদিন ” মা তারা ফুডসের” সকলকে ডাকবেন কিনা, এতদিন ওখানেই তো তিনি অন্নসেবা করেছেন। হরিদাসকে বললে সে বলল “না স্যার ওদের বলার দরকার নাই, কে কি মনে করবে, হাজার লোক বাইরের লোক।”হরিদাস ঠিকই বলেছে, ওরা আসতেও সঙ্কোচ করবে আবার বাইরের লোক বলে যদি কেউ ফিসফাস করে তো সেটাও অসম্মানের। রিটায়ারমেন্টের দিন সাধারণত বাইরের লোক বলতে যার রিটায়ারমেন্ট তার বাড়ির লোকেরা আসে কিন্তু তার আর বাড়ি থেকে কে আসবে! বললে ভাইয়ের পরিবারের লোকেরা সানন্দে আসত কিন্তু কি দরকার। একা এসেছি একাই না হয় যাব।

আজ উত্তরাদের গিয়ে বলে দিতে হবে যে কাল তার রিটায়ারমেন্ট। যদিও হোটেলের মালকিনকে তার রিটায়ারমেন্টের খবর দেওয়ার ব্যাপারটা বাতুলতা, তবু কমলেশ বাবুর মনে হল একবার বলা উচিত। এতদিন যে তাকে যত্ন করে খাওয়াল, তাকে একবার বলবেন না!দুজনেরই আলাদা সংসার। বয়স দুজনের শরীরেই বাত, প্রেসার,সুগার উপহার দিয়েছে। কমলেশবাবুর জীবনে এরকম যত্ন করে খাওয়ানোর লোক তো তেমন নেই। আসলে উত্তরার প্রতি কমলেশ বাবুর কেমন একটা টান জন্মেছে, বলতে পারো মমতা জন্মেছে। এত প্রতিকুলতার মধ্যেও সৎপথে সে রোজগার করছে, পড়াশোনা জানা নাই তবু হোটেলে চালাচ্ছে।মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, ছেলেকে স্কুলে চালানোর মারুতি ভ্যান কিনে দিয়েছে। কমলেশ একদিন বলেছিলেন “ছেলেকে দোকানে বসাও না কেন?” উত্তরা বলেছিল “লক্ষ্মী বেচে লক্ষ্মী লাভ তো, এ বড় কঠিনকাজ, সংযম চাই, কম লোভ চাই,যদি না পারে, তবে একূল ওকূল দু কূলই যে যাবে।”

কমলেশ উত্তরার জন্য একটা শাড়ি কিনেছেন। কিন্তু দেবেন কি করে, এটাই ভেবে পাচ্ছেন না! যদি কিছু মনে করে উত্তরা, যদি লোকজন দেখে ফেলে? কেন যে সহজ হতে পারছেন না কে জানে, একটা তো শাড়ী বই কিছু নয়। উত্তরা নিতে অস্বীকার করবে না নিশ্চয়।সারাজীবন তাকে এসব কিনতে হয়নি,পছন্দও হবে কিনা তাও জানেন না। আসলে আর তো দেখা হবে না ওদের সাথে। মনে রাখবে তাকে ঘুঙুর?পাকাবুড়ি একটা। মায়ের মত খেতে দিত, শাসন করত।ঘোষ,গোয়ালা জাতে। অবস্হার বিপাকে হোটেলে কাজ নিয়েছে।ধনা, পকাই আর ওই ছোটছেলেটা মোরগ?ওকে তো তিনি কতদিন চাঁদ বিস্কুট কিনে দিয়েছেন। বাস স্ট্যান্ডে চার বছর বয়সে মোরগকে পেয়েছিল উত্তরা। কথা বলতে পারে না।কমলেশ বাবু বলেছিলেন যে চোদ্দ বছরের কমে দোকানে জোগাড়ের ছেলে রাখা ঠিক না। উত্তরা বলেছিল, “কি করব দাদা, কথা বলতে পারে না, লেখাপড়া তো হবে না, এখানে দুটো খেতে তো পাবে নইলে নেশা ভিক্ষা করে নেশা করবে যে।” এও সত্যি কথা। কমলেশ বাবু দেখেছেন জীবন উত্তরাকে বড় বাস্তববাদী করেছে।

আগামীকাল তো অফিসেই খাওয়া, আজই শেষ ‘মা তারা ফুডস’ এ খাবেন তিনি। অবশ্য অফিসে যাওয়া আসা লেগেই থাকবে আরও কিছুদিন, এখন পেনশন চালু হতে, সব পাওনাগন্ডা পেতে বেশকয়েকবার ওনাকে আসতেই হবে এখানে। তখন খাবেন । এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন কমলেশবাবু। হোটেল থেকে কিছুটা দূর থেকেই দেখলেন হোটেলের সামনে একটা জটলা। জটলা না, ভীড় বলাই ভাল। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল, কোন বিপদ হল নাকি কারোও। ভিড়টা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেও পারছেন না। একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল “ও দাদু বিরাট বাওয়াল হয়েছে গো। উত্তরা মাসি পুরো ক্ষেপে গেছে গো।” কেন,কি হয়েছে?
“আর বলো না ওই বেদো রতনটা আছে না, সে এসে মাসির জাত নিয়ে খিস্তি করছিল।”
জাত?
“হ্যাঁ গো জাত। শালা রতন এসে বলেছে যে মাসি জাতে ডোম, থান্দার টাইটেল আর ভদ্দরলোকেরা মা তারা র নাম দেখে এখানে খায়। রতন তো নিজে মিশ্র বামুন, তাও ওর হোটেলে লোকে যায় না তাই কুত্তাটা এমনি করে ভাংচি দিচ্ছে।”

কমলেশ বাবুর অন্ধকার দেখছেন চোখে। কোন কথাই তার কানে ঢুকছে না। উত্তরা জাতে ডোম? সত্যি বলতে জাত তিনি মানেন কিন্তু এতদিন উত্তরার জাত নিয়ে তিনি ভাবেনইনি। তিনি তো কত্তো বার,উপোশের দিন এখানে খেয়েছেন। ঘুঙুর বলেছে “তুমি ভাল করে খাও কাকু, আমি আলাদা বাসনে তোমার জন্যে করে এনেছি।”কমলেশবাবুও নিশ্চিন্তে খেয়েছেন কারণ উত্তরার ওপর তার ভরসা জন্মেছে।আর খাওয়ার পর উত্তরার মুখে দেখেছেন পরম আনন্দ। যেন তাকে খাইয়ে উত্তরার জনার্দন সেবা হল।

কিন্তু ডোমজাতের হাতে তিনি এ ইস্তক খেয়ে এসেছেন? না জেনে হলেও এ তো পাপই। নীচু জাত, রুগ্ন ব্যক্তি, ময়লা পাত্রে খেলে যে সেসবের বদগুন নিজ শরীরে প্রবেশ করে। আর এই অপিবত্রতা নিয়ে তিনি ঘরের দুর্গা কে এতদিন ভোগ নিবেদন করেছেন, সন্ধ্যারতি করেছেন। হা ঈশ্বর এ কি পাপ তিনি করলেন। মাথাটা ঘুরে গেল কমলেশবাবুর। বুঝতে পারলেন পড়ে যাচ্ছেন কিন্তু টাল সামলাতে পারলেন না।

“ও কাকু, কাকু, কি হয়েছিল তোমার। পড়ে গেলে কি করে। মাথা ঘুরে গেইছিল নাকি।” ঘুঙুর জিজ্ঞাসা করল। জ্ঞান ফিরলে দেখলেন হোটেলের বেঞ্চে তিনি শুয়ে। কমলেশ বাবুর শরীরে কোন শক্তিই যেন অবশিষ্ট নেই, কোনরকমে বসলেন। হোটেলের সামনে ভিড়টা পাতলা হয়ে গেছে। ঘুঙুর ডাকল “ও মাসি দেখো কাকুর জ্ঞান ফিরেছে”। জামাটা খুলে দিয়েছে পকাই। মুখেবুকে জলে দিয়েছে,স্যান্ডো গেঞ্জীটা ভিজে গেছে। ওই দেখো কি করে না জানি পৈতেটা ছিঁড়ে গেছে কমলেশবাবুর।তিনি দেখলেন উত্তরা এক গ্লাস জল নিয়ে এল।মুখে ভয়, চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা সব মিলেমিশে কেমন যেন একটা ছাপ ফেলেছে।তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন, এই জন্যই কি!উত্তরার হাতের জলের গ্লাসটা ঘুঙুরকে দিয়ে জলটা খাইয়ে দিতে বললেন। তখন কমলেশবাবুর এমন শক্তি নাই যে আর কাউকে বাধা দেবেন। মাথায় ব্যান্ডেজ। পায়েও লেগেছে।

উঠতে যাচ্ছিলেন কমলেশ বাবু। উত্তরা বলল “কোথায় যাচ্ছেন এ অবস্হায়! আপনি বসুন। ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছি। আপনারে পৌঁছিয়ে দেবে, এখন এদুধটুকু খেয়ে নিন, বল পাবেন, ডাক্তারের কাছে যাবেন?” কমলেশবাবু শুধু চেয়ে থাকলেন তার দিকে। উত্তরার মুখ এতো সামনে থেকে কখনো দেখেননি তিনি। চোখে এত মায়া, এত ভালবাসা। শ্যামলা মুখ, কাঁচাপাকা চুলে তো, কই কি জাত তা দেখা যায় না।

গাড়িতে উঠতে গিয়ে কমলেশ বাবু বললেন আমার ব্যাগটা? উত্তরার হাতেই ছিল সেটা। এগিয়ে দিলেন। কমলেশবাবু ব্যাগ থেকে গোলাপি তাঁতের শাড়িটা বের করে উত্তরার হাতে দিয়ে বললেন, আজ আমার চাকরীর শেষ দিন। উত্তরা হেসে মাটি ছুঁয়ে প্রনাম করে বলল “ভালো থাকবেন”। কিন্তু কমলেশ স্পষ্ট দেখলেন কি পটুতার সাথে চোখের জল আঁটকে নিল উত্তরা।গাড়ি চলছে, পেছনে থেকে যাচ্ছে ‘মা তারা ফুডস’।থেকে যাচ্ছে মোরগ, পকাই, ধনা, ঘুঙুর আর উত্তরা। উত্তরা থান্দার, জাতে ডোম এ ভাবনা আর কমলেশের মনে খচখচ করছে না, দুচোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলেন। দুচোখ বেয়ে তখন নোনাজল বান ডেকেছে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত