আগবেলার থেকে ঝমঝম বৃষ্টি যখন বারবেলা এসে টিপ টিপ করে ঝরতে লাগলো, তখন রাজিয়া বেগমের বিরক্তি আরোও বেড়ে গেলো। আজও যে এই বৃষ্টি একেবারে ধরে আসবে না তা বুঝতে আর বাকি রইলো না।
দুপুরে বিছানায় গা এলিয়ে কিছুক্ষণ মানিক সমগ্রতে চোখ বুলাচ্ছিলো। কিন্তু সিঁড়িঘরের টিনের চালে একটানা বৃষ্টি পড়ার শব্দে কেমন যেন একঘেয়েমি লাগায় বইটা রেখে বারান্দায় এসে বসেছে রাজিয়া বেগম। লাল আর হলুদ রঙের দিয়ে একটা সোয়েটার বোনা শুরু করেছে সেই কবে। অথচ এখনো শেষ করতে পারলো না। লালের মাঝে হলুদ কদম ফুল বানিয়ে ভাল লাগে না,খুলে ফেলে। আবার হলুদের মাঝে লাল ঘোড়া বানিয়ে কেমন যেন অসামঞ্জস্য লাগায় তাও খুলে ফেলে। আর এই করতে গিয়ে সোয়েটার বুনে উঠতে পারছে না। আর উল কাঁটা থেকে ঘর পড়ার বিপত্তি তো আছেই!
একহারা বারান্দার মেঝেতে লাল-কালোয় বরফিকাটা নঁকশা। হাতে উলের কাঁটায় কয়েকঘর তুলে সেই নঁকশাতে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতেই কলিং বেল টা বেজে ওঠে। কাজের মেয়েটা এলো মনে হয়।
রাজিয়া বেগম উঠে গিয়ে গ্রিল ধরে নীচে তাকায়।
” খালাম্মা চাবিটা ফ্যালেন তাড়াতাড়ি, ভিইজ্যা যাইতেছি।”
ইন্দিরা রোডের এ বাড়িটা অন্য বাড়িগুলো থেকে আলাদা। চারপাশের সদ্য গজিয়ে ওঠা আধুনিক এপার্টমেন্টগুলোর ভিড়ে কেমন যেন নিষ্প্রভ। ১৯৬০ সালে তৈরী হওয়া বাড়িটির শেষ সংস্কার হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে। এরপর এ বাড়ির গায়ে রঙের প্রলেপ পর্যন্ত পড়ে নি। নোনা ধরা দেয়ালগুলো থেকে রঙ ঝরে বাড়িটাকে যতটা না বিবর্ণ তার থেকে যেন বেশী হতদরিদ্র মনে হয়।
” আজ রাতের জন্য রুটি বানাও মতির মা। সুগার বেড়েছে, কয়েকদিন মেনে চলতে হবে।”
বারান্দায় কাল থেকে মেলে রাখা কাপড়ে হাত দিয়ে মতির মা সারাদিনের জমানো ক্ষোভ বৃষ্টির উপর উগরাতে থাকে।
” কি বিচ্ছিড়ি বৃষ্টি হইতাছে তিনদিন ধইরা। ঘরবাড়ি সব ড্যাম হইয়া যাইতেছে। ভেজা কাপড় গুলান থ্যাইকা গন্ধ ছুটতাছে তো খালাম্মা। প্যাচপ্যাচা হইয়া গেছে সবকিছু। মরার বৃষ্টি কুনহানকার!”
গজগজ করে ভ্যাপসা গন্ধ ধরা কাপড়গুলো তুলে নিয়ে যায় মতির মা।
রাজিয়া বেগম আধবোনা সোয়েটার ঘরে রেখে দেয়। ওজু করে এসে মাগরিবের নামাজ পড়ে। মোনাজাতে ছেলের জন্য দোয়া পড়ে চোখের পানি ফেলে।
মতির মা একটা কাঁসার জামবাটি তে মুড়ি আর চা এনে টেবিলে রাখে।
” খালাম্মা চা, খাইয়্যা নিয়েন।”
জায়নামাজ টা ভাজ করে চায়ের কাপটা হাতে নিতেই মোবাইল টা বেজে ওঠে।
” মা, কি করছো? সন্ধ্যার চা খেয়েছো?”
” তোমরা ভাল আছো ? দাদুভাই কোথায়? বৌমার শরীর এখন কেমন?”
” সবাই ভাল আছি মা। ইভান স্কুলের জন্য রেডি হচ্ছে। দাঁড়াও কথা বলিয়ে দিচ্ছি।”
ওপাশের শব্দ এখন কিছুটা অস্পষ্ট। তবুও রাজিয়া বেগমের কানে আসে,
” ইভান, গ্র্যান্ডমা ওয়েটিং ফর ইউ, সে হ্যালো টু হার।”
খুটখাট একটু আওয়াজ হয় ফোনে।
” হ্যালো গ্র্যান্ড মা, হাউ আর ইউ? আই এ্যাম গেটিং রেডি ফর স্কুল। টক্ উইথ ড্যাড প্লিজ! টেক কেয়ার, বাই!”
প্রতিদিন এটুকু সময়ই বরাদ্দ রাখে ইভান গ্র্যান্ড মা’র জন্য।
কিন্তু রাজিয়া বেগমের তো একটু একটু করে অনেক গল্প জমেছে ইভানকে বলবে বলে। বৃষ্টিভেজা ছাতিম ফুলের মৌ মৌ গন্ধের গল্প, সবুজ জামরুল গুলোর লালচে হয়ে ওঠার গল্প, উঠোন জুড়ে পড়ে থাকা কড়মচার গল্প আর রান্নাঘরের কার্ণিশে সেই চড়ুই পাখির বাসার গল্প!
” মা, তোমাকে এবার নিয়ে আসবো। আর কতদিন ওখানে একা পড়ে থাকবে। আমি কাগজ পত্র রেডি করছি সব।”
” হু”
” মা, রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। রাত জেগে বই পড়ো না। বয়স হয়েছে তোমার, বিশ্রাম বেশী প্রয়োজন। “
” তুমি এখন বের হবে অফিসের জন্য। সাবধানে যেও।”
ফোনটা রাখতেই ছাতিম ফুলের মিষ্টি গন্ধের একটা ঝাপটা লাগে রাজিয়া বেগমের নাকে। বুকের ভিতর টা ফাঁকা হয়ে যায় হঠাৎ করে ওনার।
সে কতদিন আগের কথা। শান্তিনিকেতনে সেদিন বসন্ত উৎসব। রাজিয়া বেগম তখন শুধুই রেবু। “রাজিয়া বেগম” এর মতো ভারি নামটা তখন যত্ন করে তুলে রাখা ভাল নাম। চব্বিশ পরগণার মেয়ে। খুব ভাল নাচে, গান করে, আবৃত্তি করে, অভিনয় করে। শ্যামলা, কোমড় ছাপানো চুল আর আয়ত চোখের মেয়েটি যখন ” আমার চিত্ত তোমার নিত্য হবে” আবৃত্তি করতো তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে,অপলক দেখে যেতো চয়ন। সেই অপলক চাহনির প্রেম রেবু অব্দি পৌছাতে খুব বেশি সময় লাগে নি।
বসন্ত উৎসবের দিন, চারদিকে আবিরে রেঙেছে সবাই। লাল মাটির শান্তিনিকেতন তখন রঙের খেলায় মেতেছে। রঙের সেই মেলায়, হঠাৎ করেই রেবুকে বিহ্বল করে আবিরে রাঙিয়ে দেয় চয়ন। সেই রঙ রেবুর মনজুড়ে থেকে গেছে এখনো। আবির ছোঁয়ানোর সাথে সাথে মনটাও যে ছুঁয়ে দিয়েছিল চয়ন। এরপরের সময়গুলো গান, কবিতা আর স্বপ্নের। ওদের দু’জনের দেখা অজস্র স্বপ্ন অনাগত দিনের জলছাপ আঁকতে শুরু করে।
একদিন মখমলি ব্লাউজ আর খোদ বেনারস থেকে আনা সিঁদুর লাল বেনারসিতে সেজে রেবু চলে আসে এপার বাংলায়। নিজের দেশ ছেড়ে চয়নের সাথে ঢাকায় এসে সংসার শুরু করে। তবে সংসারে থেকেও চয়নের উৎসাহে গান আর আবৃত্তি চালিয়ে যেতে থাকে রেবু। এ বাড়ির পরিবেশটাও কিন্তু অনুঘটক হয়ে কাজ করেছে। রেবুর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি দু’জনেই গান পাগল। তাই বিকেল হলেই বাড়িতে গ্রামাফোনে বেজে উঠতো কানন দেবীর কন্ঠে নজরুলের গান।
রাজিয়া বেগম চায়ের কাপটা রেখে সেই পুরনো অকেজো গ্রামাফোনে হাত বুলায় আর ভাবতে থাকে রেবু কিভাবে রাজিয়া বেগম হয়ে উঠলো।
চপলা রেবু প্রথম সংসারকে বুঝতে শেখে শ্বাশুড়ি মারা যাবার পর। এক ঝটকায় এ সংসার আর বাড়ির সব দায়িত্ব রেবুর কাঁধে চলে আসে। গান, কবিতাও আস্তে আস্তে সময়ের ফোঁকর গলিয়ে দূরে সরতে থাকে। অসুস্থ শ্বশুর যখন শয্যাশায়ী তখন আড়তের কর্মচারীদের কাছে রেবু হয়ে ওঠে ছোট আম্মা। আর কলেজ শিক্ষক চয়নের ছাত্রদের কাছে রাজিয়া আপা। ক্ষেত্রবিশেষে রাজিয়া বেগম। আর এভাবেই আস্তে আস্তে রাজিয়া বেগম আঁকড়ে ধরে রেবুকে। রেবু হাসফাস করতে করতে পালিয়ে যায়! রেবুর সাথে সাথে হুট করে চয়নও হারিয়ে গেলো। খোকা তখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে ঢুকেছে। হার্ট এ্যাটাকে চিকিৎসার কোন সুযোগ না দিয়ে চয়ন চলে যায়, রাজিয়া বেগমকে রেখে দিয়ে!
” খালাম্মা, কাজ শ্যাষ, যাইগা। কাল কিন্তু বাজার করণ লাগবো, মিজান মিয়া আইবো তো?”
মিজানকে খোকা তিনবছর আগে শেষ যে বার দেশে এসেছিলো তখন ঠিক করে দিয়ে গেছে। সপ্তাহে একদিন এসে আনাজ বাজার করে দেয় আর মাসের শুরুতে এসে মাসকাবারি বাজার করে দেয়।
” দেখি ফোন করে দিবো, মিজানকে।”
” নীচে চলেন, আমি গ্যালে গেটে তালা দিতে হইবো। নীচতলার ভাড়াটিয়া বিকালে দ্যাশের বাড়িত গেছে।”
“ও, তাহলে আজ আর নীচের বাসায় কাজ নেই তোমার। চলো তাহলে, তুমি গেলে আমি তালা লাগিয়ে আসবো।”
মতির মাকে বিদায় দিয়ে ক’খানা সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই রাজিয়া বেগমের হাঁটুর ব্যাথাটা জানান দিতে থাকে।
সেই হাঁটুর ব্যাথা এত বাড়াবাড়ি রূপ নিবে তা কল্পনাতেই ছিল না। অসহ্য ব্যাথা আর তার সাথে জ্বর। সেই জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা বকা। মতির মা দু’দিন রাতে রাজিয়া বেগমের কাছে থাকে। সন্ধ্যায় কাঁপিয়ে জ্বর আসতো, সারারাত ভূল বকতো, ভোরের দিকে একটু ঘুমাতো রাজিয়া বেগম। সাত দিনেও যখন অবস্থার উন্নতি হয় না বরং অচেতন হতে শুরু করেন তখন ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে প্রসূন মানে খোকাকে খবর দেওয়া হয়।
” মা, স্যুপ টা একটু খাবে? নাকি আপেল কেটে দিবো?”
ঘাড় নেড়ে ছেলেকে না করে রাজিয়া বেগম।
” আমি বাড়ি যাব খোকা।”
” যাবে মা, আজ সব টেষ্টের রেজাল্ট চলে আসবে। সব ঠিক থাকলে কাল তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো। “
” ইভান আর বৌমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না ? ওদের তো এভাবে থাকার অভ্যাস নেই।”
” না, ইভান খুব খুশী এখানে এসে।”
খোকা মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে চলে এসেছে পরদিনই।
রাজিয়া বেগমের সব টেষ্ট রিপোর্ট ভাল আসে।
ইভান ওর দাদানের হাত ধরে বাড়ি নিয়ে আসে। ইভানের উচ্ছলতায় এই ধূসর বাড়িটা কেমন ঝলমল করে ওঠে, দৈন্যদশার আবরণ টা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায়। সারাক্ষণ ইভান চড়ুইপাখির মতো এঘর ওঘর করতে থাকে।
” দাদান, হাউ ইউ ফিল নাও?”
” ভাল আছি সোনা।”
” হোয়্যাট!!?”
ইভানের এই বিস্মিত প্রশ্ন একটা ঝাঁকুনি দেয় রাজিয়া বেগমকে!
” দাদুভাই তুমি বাংলা বুঝতে পারো না?”
” মা, ও বাংলা বোঝে না।” মনিষা, ইভানের মা বলে ওঠে।
” তোমরা কখনো চেষ্টা কর নি, মা?”
” আসলে ছোট থেকেই ডে কেয়ারে থাকায় ইভান টা বাংলা শেখার সুযোগই পায় নি।”
একটা আশংকা হঠাৎ করেই রাজিয়া বেগমের বুকে চেপে বসে। নিজের শিকড়, নিজের মাটির দায় মেটানোর জন্য খোকার পর আর কেউ রইলো না! রাজিয়া বেগমের বুকশেলফে সাজানো অসংখ্য বাংলা বই একসময় অনাথ হয়ে যাবে, হয়ত যোগ্য জায়গার অভাবে শুধু উটকো কাগজের স্তুপে পরিণত হবে! এই মাটি, এই ভাষা, এই বইয়ের কোন উত্তরাধিকার থাকবে না!
রাজিয়া বেগম কাঁপা কাঁপা পায়ে নিজের ঘরের একদিকের দেয়ালজুড়ে কাঠের বুকশেলফ্ এর পাশে এসে দাঁড়ায়। খুব ক্ষীণ কন্ঠে ডাকে,
” খোকা, খোকা”
” মা, তুমি আবার উঠেছো? এখন অনিয়ম করা একদম ঠিক হবে না, মা। আর তুমি তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছো না!” টলমলে মা কে দেখে খোকা বলে ওঠে।
” দাদুভাই কে কখনো চেষ্টা করেছো বাংলা শেখাতে?”
খোকা কিছু বলে না।
” এই বইগুলো একসময় কত পড়তে তুমি। এখনো কি সেই পড়ার অভ্যাসটা আছে তোমার।”
” এখন, সময় হয় না মা।”
” হুম, দাদুভাই বই পড়ে?”
“হ্যাঁ, ওখানকার স্কুলে বাচ্চাদের গল্পের বই পড়ার জন্য প্রতিদিন ৩০ মিনিট বেঁধে দেওয়া হয়। আর ও পড়তেও খুব পছন্দ করে।”
” ইশ্! বাংলা জানলে বইগুলো দাদুভাইকে দিয়ে দিতাম সব।”
খোকা কিছু বলে না। শুধু মনিষার দিকে তাকায়। মনিষা ইভানের মা। খোকা সবসময় চেয়েছে ইভান বাংলাটা ধরে রাখুক। কিন্তু মনিষা কখনো এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় নি। আর ইভানের সব ব্যাপারে মনিষাই শেষ কথা। ও ইভানকে নিয়ে পজেসিভও খানিকটা। তাই এক্ষেত্রে খোকার কিছু করার নেই।
মনিষা খুব একটা স্বাভাবিক হতে পারে না মা ছেলের এই আলোচনায়। যেন একটু বিরক্তও হয়। আর প্রসূনের এই সবকিছুর দায়ভার ওর উপর চাপিয়ে দেওয়াটাও খুব অপছন্দ মনিষার।
মনিষা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ইভান পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে আইপ্যাড দেখছে। ছেলের পাশে গিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে। জড়িয়ে ধরে ইভানকে।
” ইভান, ডু ইউ লাইক বাংলাদেশ?”
” ইয়েস, মা”
” হোয়্যাট ডু ইউ লাইক মোস্ট এবাউট দিস কান্ট্রি?”
” দাদান। হোয়াই ইজন’ট সি লিভ উইথ আস?”
” দ্যান ইউ ক্যান আকস্ হার টু গো উইথ আস।”
” হাউ ডু আই রিকুয়েস্ট হার, মম? আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হার লেংগুয়েজ।”
মনিষা উত্তর দেবার ঠিকঠাক ভাষা পায় না।
ইভান দৌড়ে বেড়াচ্ছে বারান্দাজুড়ে। দু’টো চড়ুই উড়ে যায় আবার ঘুরে এসে গ্রিলে বসে। তাই দেখে ইভান খুব মজা পাচ্ছে।
ঘর থেকে রাজিয়া বেগম দেখে আর চোখ জুড়োয়। খুব ইচ্ছে হয় বারান্দায় গিয়ে বসে ইভানের এই উচ্ছ্বাস দেখতে। খুব ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
” দাদুভাই পাখির সাথে খেলছো?”
ইভান তাকিয়ে দাদানকে দেখে কিন্তু কিছু বলে না।
” ইভান কাম হেয়ার, প্লে টাইম ইজ ওভার” মনিষা ডাকে ছেলেকে।
রাজিয়া বেগমকে পাশ কাটিয়ে ইভান চলে যায় মায়ের কাছে।
সময় দ্রুত চলে যায়। তিন সপ্তাহের ছুটি মাত্র। এখন রাজিয়া বেগম অনেকটাই সুস্থ। প্রসূন খুব চাইছিলো মাকে সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে রাজিয়া বেগম কিছুতেই যাবে না।
আজ দুপুরে প্রসূনদের ফ্লাইট। সকাল থেকেই সব গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে। রাজিয়া বেগমের মনটা খুব খারাপ। ইভান আর খোকাকে আবার কবে দেখতে পাবে কে জানে।
” মা, ইভান আপনাকে কিছু দিবে।”
রাজিয়া বেগম নিজের বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিল। উঠে বসলো।
” কি দিবে দাদুভাই?”
ইভান হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ দেয়। তাতে আঁকাবাঁকা করে লেখা বর্ণমালা। রাজিয়া বেগমের চশমার কাঁচটা ঘোলা হয়ে ওঠে। কাঁচটা মুছে আবার চশমাটা পড়ে। কাগজে ইভানের কাঁচা হাতের ” অ, আ,ই,ঈ” দেখতে থাকে।
” এ ক’দিনে এটুকুই শেখাতে পেরেছি মা। আপনি আসুন আমাদের ওখানে। বাকিটা আপনাকে শেখাতে হবে।”
চোখে জল নিয়ে রাজিয়া বেগম হাসতে হাসতে বলে, ” অনেক বড় দায়িত্ব দিতে চাইছো, বৌমা।”
” একমাত্র আপনিই যে ইভানকে বাংলা শেখাতে পারবেন, তা আমি জানি যে।”
প্রসূন দরজায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো।
” খোকা আমি দাদুভাইকে শেখাবো আমার ভাষা। আমার ভাষার উত্তরাধিকার হবে দাদুভাই।”
ইভান যখন দেশ ছাড়ছে তখন ওর হাতে একটা শিশুশিক্ষা। কয়েকদিন পর যখন দাদান এসে ওদের সাথে একেবারে থেকে যাবে তখন বইটা পড়া শিখিয়ে দিবে।
আজ আবার বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে রাজিয়া বেগমের বাড়িটা আজ একদম স্যাঁতস্যাঁতে নয়।