আজব সাজা
“পণ্ডিতমশাই, ভোলা আমায় ভ্যাংচাচ্ছে।”
“না পণ্ডিতমশাই, আমি কান চুলকাচ্ছিলাম, তাই মুখ বাঁকা দেখাচ্ছিল!”
পণ্ডিতমশাই চোখ না খুলিয়াই অত্যন্ত নিশ্চিন্ত ভাবে বলিলেন, “আঃ! কেবল বাঁদরামি! দাঁড়িয়ে থাক।” আধমিনিট পর্যন্ত সব চুপচাপ। তারপর আবার শোনা গেল, “দাঁড়াচ্ছিস না যে?”
“আমি দাঁড়াব কেন?”
“তোকেই তো দাঁড়াতে হবে।”
“যাঃ আমায় বলেছে না আর কিছু! গণশাকে জিগ্গেস কর? কিরে গণশা, ওকে দাঁড়াতে বলেছে না?” গণেশের বুদ্ধি কিছুটা মোটা, সে আস্তে আস্তে উঠিয়া গিয়া পণ্ডিতমশাইকে ডাকিতে লাগিল, “পণ্ডিতমশাই! ও পণ্ডিতমশাই!”
পণ্ডিতমশাই বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “কি বলছিস বল না।” গণেশচন্দ্র অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কাকে দাঁড়াতে বলেছেন, পণ্ডিতমশাই?” পণ্ডিতমশাই কট্মটে চোখ মেলিয়াই সাংঘাতিক ধমক দিয়া বলিলেন, “তোকে বলেছি, দাঁড়া।” বলিয়াই আবার চোখা বুজিলেন।
গণেশ বেচারা ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি এক পা তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অমনি ভোলা আর বিশুর মধ্যে তুমুল তর্ক বাঁধিয়া গেল। এ বলে ডান পায়ে দাঁড়ানো উচিত, ও বলে, না, আগে বাঁ পা। গণেশ বেচারার মহা মুশকিল! সে আবার পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞাসা করিতে গেল, “পণ্ডিতমশাই, কোন পা ?”
পণ্ডিতমশাই তখন কি যেন একটা স্বপ্ন দেখিয়া অবাক হইয়া নাক ডাকাইতেছিলেন। গণেশের ডাকে হঠাৎ তন্দ্রা ছুটিয়া যাওয়ায় তিনি সাংঘাতিক রকম বিষম খাইয়া ফেলিলেন। গণেশ বেচারা তার প্রশ্নের এ রকম জবাব একেবারেই কল্পনা করে নাই, সে ভয় পাইয়া বলিল, “ঐ যা কি হবে?” ভোলা বলিল, “দৌড়ে জল নিয়ে আয়।” বিশু বলিল, “শিগ্গির মাথায় জল দে।” গণেশ এক দৌড়ে কোথা হইতে একটা কুঁজা আনিয়া ঢক্ঢক্ করিয়া পণ্ডিতমশায়ের টাকের উপর জল ঢালিতে লাগিল। পণ্ডিতমশায়ের বিষম খাওয়া খুব চট্পট্ থামিয়া গেল, কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া গণেশের হাতে জলের কুঁজা ঠক্ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল।
পণ্ডিতমশাই খানিকক্ষণ কটমট করিয়া সকলের দিকে তাকাইয়া তারপর বলিলেন, “যা! তোরা ছেলেমানুষ তাই কিছু বললাম না। খবরদার আর অমন করিসনে।” সকলে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল, কিন্তু পণ্ডিতমশাই কেন যে হঠাৎ নরম হইয়া গেলেন কেহ তাহা বুঝিল না। পণ্ডিতমশায়ের মনে হঠাৎ যে তাঁর নিজের ছেলেবেলার কোন দুষ্টুমির কথা মনে পড়িয়া গেল, তাহা কেবল তিনিই জানেন।
১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তাঁর জন্ম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ময়মনসিংহ জেলার মসুয়ায়। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও যন্ত্রকুশলী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর পিতা এবং অস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর পুত্র।
সুকুমার রায় সিটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে অনার্সসহ বিএসসি (১৯১১) পাস করেন। পরে ফটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে তিনি বিলেত যান। সেখানে তিনি প্রথমে লন্ডন এবং পরে ম্যাঞ্চেস্টারে স্কুল অফ টেকনোলজিতে লেখাপড়া করেন। ম্যাঞ্চেস্টারে স্কুল অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে তিনি পিতার উদ্ভাবিত হাফটোন পদ্ধতি প্রদর্শন করে তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেন।
প্রবাসে থাকা অবস্থায় সুকুমার রায় বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি East and West Society-তে ‘Spirit of Rabindranath’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধটি The Quest পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি বিলেতের বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ পান। তিনি Royal Photographic Society-র ফেলো (FRPS) নির্বাচিত হন। এ ক্ষেত্রে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয়। ১৯১৩ সালে দেশে ফিরে তিনি পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’-এ যোগ দেন।
সুকুমার রায়একাধিক গুণের অধিকারী ছিলেন। অল্প বয়স থেকেই তিনি পিতার অনুপ্রেরণায় মুখে মুখে ছড়া রচনা ও ছবি আঁকার সঙ্গে ফটোগ্রাফিরও চর্চা করতেন। কলেজ জীবনে তিনি ছোটদের হাসির নাটক রচনা এবং তাতে অভিনয় করতেন। তিনি শান্তিনিকেতনে একবার রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে গোড়ায় গলদ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তিনি বেশ কিছু গান রচনা করেন এবং নিজে সেগুলি গেয়েছেনও।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতৃপ্রতিষ্ঠিত সন্দেশ পত্রিকা পরিচালনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। বিলেতে থাকা অবস্থায় তিনি এ পত্রিকার জন্য নিয়মিত গল্প, কবিতা ও নিজের অাঁকা ছবি পাঠাতেন।
সুকুমার রায় প্রেসিডেন্সিতে ছাত্র থাকাকালে ‘ননসেন্স ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন, যার মুখপত্র ছিল সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা। বিলেত থেকে ফিরে তিনি গঠন করেন ‘মানডে ক্লাব’। এখানে আলোচনা ও পাঠের সঙ্গে থাকত ভূরিভোজের ব্যবস্থা। তাই ব্যঙ্গ করে কেউ কেউ একে বলত ‘মন্ডা ক্লাব’।
সুকুমার রায়ের প্রধান অবদান শিশু-কিশোর উপযোগী বিচিত্র সাহিত্যকর্ম। কবিতা, নাটক, গল্প, ছবি সবকিছুতেই তিনি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও কৌতুকরস সঞ্চার করতে পারতেন। তাঁর কাব্যে হাস্যরসের সঙ্গে সমাজচেতনাও প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো: আবোল-তাবোল (১৯২৩), হ-য-ব-র-ল (১৯২৪), পাগলা দাশু (১৯৪০), বহুরূপী (১৯৪৪), খাইখাই (১৯৫০), অবাক জলপান, শব্দকল্পদ্রুম, ঝালাপালা ইত্যাদি। এছাড়া বাংলা ও ইংরেজিতে রচিত তাঁর কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধও রয়েছে। ডাইরির আকারে রচিত হেসোরামের ডাইরী নামে তাঁর একটি অপ্রকাশিত রম্যরচনা আছে।