| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস নারী

বাঙালির ছাতা ও একজন নারীর লড়াই

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

১৭০৮ থেকে ১৭৮৬ পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্যে বাংলার খুবই নামডাক ছিল। জাহাজ কিনতেন বাঙালি ব্যবসায়ীরা। গন্ধবণিকরা পাট, চিনি, লবণ, তাঁতের কাপড় আর অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে আফিম বিদেশে রফতানি করতেন। সেইসময় ভারতীয় পণ্য কিনতে ইংরেজদের অনেক অর্থ ব্যয় করতে হত। সেসব কথা লেখা আছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দলিলেও। ক্রমে ব্রিটিশ ভারতে অধিপত্য বিস্তার করে। ভেঙে পড়তে থাকে একে একে বাঙালি ব্যবসা। সেই সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সরকারি দপ্তরে কাজের জন্য সৃষ্টি হয় এক নতুন শ্রেণী। অর্ধ-শিক্ষিত যুবকদের দিয়ে খাতা লেখানোটা আয়ত্ত করায় ইংরেজ সাহেবরা। বাবুয়ানা শুরু হয় এভাবেই। কেরানিগিরির তখন তুমুল কদর। রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার লড়াইয়ে একের পর এক বাগানবাড়ি গজিয়ে উঠল গঙ্গার দু’পাড়ে। এমত অবস্থায় ১৮৮২ সালে মহেন্দ্র দত্ত এক নতুন ব্যবসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। তিনি ভারতীয়দের জন্য তৈরি করলেন দেশিয় ছাতা।

ছাতার আবিষ্কার চীনে। চীনের সংজিয়া শহরে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ছাতা তৈরি হয়। সেইজন্যই সংজিয়াকে `পৃথিবীর ছাতা`-ও বলা হয়ে। চীনে যখন ছাতা আবিষ্কার শুরু হয়, তখন ছাতার ব্যবহার ছিল শুধুমাত্র মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পুরুষরা কিন্তু ছাতার ব্যবহার শুরু করেছে, অনেক পরে। শুধুমাত্র সমাজের সম্ভ্রান্ত এবং আর্থিকভাবে শক্তিশালী পরিবারের মহিলারাই ছাতার ব্যবহার করতেন। ছাতা ছিল সামাজিক প্রভাব, প্রতিপত্তির প্রতীক। ইংরেজ মেমরা ছাতা ব্যবহার করতেন। সেই সময় দেশের মানুষকে প্রখর রোদের হাত থেকে রক্ষা পেতে মহেন্দ্র দত্ত তৈরি করলেন দেশিয় ছাতা। নিজের উদ্যোগেই খুলে বসলেন কলকাতার বুকে দেশিয় ছাতা তৈরির কারখানা আর দোকান। গুণগত মানে ঢের ভালো। শুধু একটা দোকান বা কারখানাই নয়। নিজের নামে ব্র্যান্ডিংও করলেন মহেন্দ্র দত্ত। কোম্পানি নাম দিলেন Mohendra Dutt & Sons।  তাঁর স্বপ্ন ছিল একদিন এই সংস্থার তৈরি ছাতা কলকাতা থেকে গোটা দেশে ছড়িয়ে যাবে। ইংরেজ বাবু বিবিরা ব্যবহার করবেন, লন্ডন পাড়ি দেবে তাঁর নাম।  ১৮৮২ সাল থেকে ১৯০৯ – মাত্র সাতাশ বছরেই মহেন্দ্র দত্তের ছাতা দেশবাসীর মনে জায়গা করে নিল। তাঁর অকাল প্রয়াণের পর গোটা ব্যবসায় কালো ছায়া নেমে আসে। দুই ছেলে ভবানীচরণ আর তারিণীচরণ দুজনেই ছোটো ছোটো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্ত্রী রাধারানী দেবী ব্যবসার হাল ধরেন। অপর স্ত্রীর পরিবারের তরফ থেকে এবং মহেন্দ্র দত্তের আত্মীয়রা কোনও মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর কাছে ব্যবসা বিক্রি করে দিলে, সেই সময় রাধারানী দেবী রীতিমত আইন আদালত করে, তা বানচাল করে দেন। মহামান্য আদালতে রাধারানী জানান তাঁর পরলোকগত স্বামীর ব্যবসা এবং ব্র্যান্ডে তিনি ছাড়া আর কারও অধিকার সিদ্ধ নয়। রীতিমত কাগজ পত্র দেখিয়ে মামলা জিতে নেন। ভেবে দেখুন সেই যুগ। যখন সাধারণ বনেদি ঘরের মহিলারা অন্তঃপুরেই ঘুরপাক খেতেন, যাদের খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে গোটা জগত সীমায়িত ছিল। সেই সময়ের এক সদ্য বিধবা মহিলা ঘরের চৌহদ্দির বাইরের দুনিয়ায় রীতিমত কোমর বেঁধে নামলেন, উদ্যোগপতি স্বামীর ব্যবসার হাল ধরলেন। তিনিই চালিয়ে নিয়ে গেলেন ব্যবসা। তিনিই মহেন্দ্র দত্তের ছাতাকে কলকাতার বাইরে ছড়িয়ে দিলেন। এবং টানা ১৪ বছর ছেলে মানুষ করার পাশাপাশি রাধারানী দেবী সামলে দিলেন বাণিজ্য তরী। ১৯২৩ এ ছেলেরা দায়িত্ব নিলেন। বড় ছেলে ভবানী যখন ব্যবসার হাল ধরেন তখন তার বয়স মাত্র ষোলো কি সতের।

বাংলার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই অধিকাংশ তথাকথিত প্রাজ্ঞজনের নজরে কেবল ঘোরা ফেরা করেন শ্রী অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশ, অথবা আশুতোষ মুখার্জি, রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলার সুবর্ণ যুগের ইতিহাসে যাদের উপস্থিতি নিয়ে কেউ কখনও কথা বলেন না তাদের মধ্যে একজন হলেন মহেন্দ্র দত্ত। কিন্তু ১৩৬ বছর ধরে বাঙালির জীবনে সমান জনপ্রিয়, সমান সম্মানিত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত