অন্য চোখে সত্যজিৎ

Reading Time: 7 minutes

আজ ২৩ এপ্রিল। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবস। ইরাবতী পরিবার বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে তাঁকে।

।।জাফর ওয়াজেদ।।

ঘরে ঢুকে দাঁড়ালাম। যেন তার চলচ্চিত্রেরই কোন দৃশ্য দেখছি। পরিচ্ছন্ন, বহুমাত্রিক এবং ব্যঞ্জনাময়। যেন একটি অদৃশ্য ক্যামেরা প্যান করে আমার চোখের সামনে এক একে তুলে ধরছে তার ব্যবহৃত আসবাব, বইপত্র রেকর্ড প্লেয়ার ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস। সব শেষে ক্যামেরা স্থির হলো তার একটি বড় মাপের ছবির ওপর। ছবিটা এতটাই বাঙ্গময় যে, মনে হলো, ওই তো তিনি বসে আছেন, এক্ষুণি কথা বলে উঠবেন তার মেঘমন্ত্র কণ্ঠে।

পর মুহূর্তেই খেয়াল হলো, এই ঘরের সব কিছু আজ বিভিন্ন স্তরবিন্যাসে সযত্নে গোছগাছ করা। আর এই গোছগাছটাই যেন আমাকে সময়ের বাস্তবে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, না তিনি আর কথা বলবেন না। তিনি সত্যজিৎ রায়।

মনে তখনও অবশ্য রোমাঞ্চের একটা অনুরণন চলতেই থাকে। হিসেব করে দেখি ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডের এই বাড়ির এই ঘরে তিনি তার জীবনের শেষ বাইশটা বছর কাটিয়ে গিয়েছেন। এই ঘরে বসেই তিনি চিন্তা করেছেন, কল্পনা করেছেন। লিখেছেন বিশ্বমান্য সব চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, গল্প উপন্যাস, চিঠিপত্র ইত্যাদি। এঁকেছেন ছবি। মগ্ন থেকেছেন তার বহুমুখী অন্যান্য সৃষ্টিকর্মে। দুনিয়ার যত জায়গায় যত মানুষের কাছে তার ঠিকানা রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই কৌতূহল কেন্দ্রে ছিল এই ঘর এবং ঘরে মানুষটি। যে কৌতূহল আজও বর্তমান।

শুরু করা যাক শুরু থেকে। দীর্ঘতপা এই মানুষটির জন্ম ১৯২১ সালে। বাবা সুকুমার রায় তখন মৃত্যু অভিমুখের যাত্রী। অর্থাৎ বাবার অসুস্থতার মধ্যেই ছেলের জন্ম। সত্যজিতের ডাক নাম, প্রায় সকলেই জানেন, মানিক। কিন্তু মানিক কেন? সুকুমার রায়ের মেজভাই সুবিনয় রায়ের ছেলে তথা সত্যজিতের খুড়তুত দাদার ডাক নাম ছিল, ধন। সেটা মিলিয়েই সত্যজিতের ডাক নাম রাখা হয়েছিল মানিক। তখন সকলে বলত, রায়বাড়ির ধন আর মানিক। ধন-এর ভাল না, সরল কুমার।

এবার মানিকেরও একটা ভাল নাম দিতে হবে। আলোচনা চলছে। ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথে মাঝে মধ্যে আসতেন রায়বাড়িতে, বিশেষ করে সুকুমার রায় যখন অসুস্থ তাঁকে দেখতে আসতেন। একদিন মানিকের ভাল নাম কী দেয়া যায় সেটা রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন একটা সহজ নাম। রবীন্দ্রনাথ তাতে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, তা বেশ তো, সরল কুমারের ছোট ভাইয়ের নাম সহজ কুমার দাও না। পরে রবীন্দ্রনাথ মানিকের নাম দিতে চেয়েছিলেন সরিৎ কুমার, সুকুমারের হয়ত সেটা তেমন পছন্দ হয়নি। তাই শেষে তিনি নিজেই বেছে নেন সত্যজিৎ। যে সত্যজিৎ চলচ্চিত্র করে বিশ্বজয় করলেন। তার মনে চলচ্চিত্রকার হবার বাসনাটা জেগে উঠেছিল ঠিক কবে, কোন বয়সে? তিনের দশকে বালিগঞ্জ গবর্নমেন্ট স্কুলে পড়াকালীন সত্যজিতের এক সহপাঠী পরবর্তীকালে তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন, স্কুলে থাকতেই আমরা আমাদের দু-একজন সহপাঠীর ভবিষ্যত সম্বন্ধে আশাবাদী ছিলুম, তখন যেমনি তাদের দেখেছিলুম।… সত্যজিৎ শিল্পী হবে, আমরা তা জানতুম, সারা স্কুলটা তা জানত। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল প্রমুখ স্বনামধন্যদেরই একজন হবে, এটাই ভেবেছিলুম আমরা।

সহপাঠীর এই বয়ানে বোঝা যাচ্ছে, সত্যজিৎ একদিন বড় চিত্রকর বা চিত্র শিল্পী হবে, এটা তারা আন্দাজ করেছিলেন, কিন্তু তিনি যে চলচ্চিত্রকার হবেন তার আভাস পর্যন্ত পাননি।

অন্য দিকে সত্যজিৎ এর কলেজ জীবন যেখানে কাটে, সেই প্রেসিডেন্সির ইংরেজীর অধ্যাপক ড. সুবোধ কুমার সেনগুপ্ত তার স্মৃতিকথার তেহি নো দিবসার এক জায়গায় লিখেছেন, আর একটি ছেলে আমাকে বিস্মিত করিয়াছে অন্যভাবে। এই ছেলেটি ইংরেজীতে খুব ভাল ছিল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৃতীয় পত্রই হবে ইহার বিষয় মৌলিক রচনা প্রধান পরীক্ষক আমার শিক্ষক কুমুদবন্দু রায়। কি কারণে একদিন তাহার কাছে গিয়াছি বড় খাতায় নম্বর তোলা হইতেছে তাহার মধ্যে রোল নম্বরসহ নামও থাকে। সেই খাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের নাম নম্বর লিখিত আছে আমার সুপরিচিত কে ভাল ছেলের সাফল্যে খুব বেশি আনন্দিত হইলাম। মনে করিয়াছিলাম সে ইংরেজীর অনার্স পড়িবে, কিন্তু তাহা পড়িল না। বেশ কিছুদিন পরে একদিন গড়ের মাঠে তাহার সঙ্গে দেখা, জিজ্ঞাসা করিলাম, এখন সে কি করিতেছে। উত্তর পাইলাম, আর্ট শিকিতেছি। মনটা দমিয়া গেল । এমন একজন মেধাবী ছেলের এই দুর্মতি। ইহার নাম সত্যজিৎ রায়।

অর্থাৎ প্রেসিডেন্সির এই অধ্যাপক মনে মনে আহত হরেও সত্যজিতের আর্ট শিক্ষার খোঁজ পেয়েছিলেন। কিন্তু তার সুপরিচিত ভাল ছেলেটির চলচ্চিত্রে প্রতি আকর্ষণের কথা জানেননি। জানলে আরও কত বড় আঘাত পেতেন কে জানে।

এ সবের প্রেক্ষাপটে, স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হতে পারে, অনেকের হয়েছেও, চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে সত্যজিতের মধ্যে অনেক পরে জাগে এবং সেটা কখনই তার কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগে নয়।

কিন্তু সত্যজিতের শৈশবকালীন ছোট্ট অথচ তাৎপর্যময় একটি ঘটনার আলোকপাত করলে এই ধারণা অনায়াসেই ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা যায়। সত্যজিতের বয়স তখন সবে পাঁচ। সে সময় তার পনেরো বছরের পিসতুত দিদি কল্যাণী (কল্যাণী কার্লেকর) কোথায় থেকে একটি ব্রাউন রঙের ফাইবারের বাক্স পেয়েছিলেন, যেটা ছিল অনেকটা ডাক্তারের ব্যাগের মতো দেখতে। সেই বাক্সের গায়ে গোটা গোটা অক্ষরে …

বেশ ডাক্তার, আমাদের অসুখ হলে ওষুধ দেবে। উত্তরে মানিক গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলে, ‘না, আমি ডাক্তার হবো না।’ দিদি যখন জানতে চাইলেন, ‘তাহলে তুমি কী হবে?’ মানিক বলে, ‘আমি জার্মানি থেকে ছবি তোলা শিখে এসে সিনেমা বানাব।’

এ প্রসঙ্গে কল্যাণী কার্লেকর জানিয়েছেন, সিনেমা করার কথাটার পেছনে একটা পটভূমি ছিল। পিসতুত কাকা নীতীন বসু ছবি করতেন। (সত্যজিৎ কে সেটা নিশ্চয়ই ওই বয়সেই আকর্ষণ করেছিল) আর জার্মানির কথাটাও ওর অস্পষ্টভাবে মনে থাকতেও পারে কারণ ওর কাকামণি সুবিনয় রায় এক সময় জার্মানির সঙ্গে আমদানি-রফতানির ব্যবসা করার কথা ভেবেছিলেন এবং কিছু কিছু খেলনা আনিয়েছিলেন।

সত্যজিৎ তার জীবনের প্রস্তুতিপর্বে, বিশেষ করে ছাত্রাবস্থায় কেমন ছিলেন? এ সম্বন্ধে সত্যজিতের দীর্ঘকালের সুহৃদ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তার বন্ধু মানিকবাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, স্কুল বা কলেজে যাকে বলে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল, তা মানিকবাবু কোনদিনই করেননি। অথচ এখন তার চলচ্চিত্র ছাড়া এবং বহুবিধ ব্যাপারে জ্বলজ্বলে প্রতিভার কথা ভাবলে মনে হয় যে তার ছাত্রজীবনের সব পরীক্ষাতেই চোখ বুজে প্রথম হওয়া উচিত ছিল। চোখ বুজে অর্থাৎ অনায়াসে যার সব পরীক্ষাতেই প্রথম হওয়া উচিত ছিল, তা তিনি হননি কেন?

এর উত্তর খোঁজার আগে সত্যজিতের স্কুলজীবনের একটা সরস গঠনার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

একবার স্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী উৎসব উপলক্ষে ঠিক করা হলো। তাতে ছাত্রদের হাতের কাজেরও একটা প্রদর্শনী হবে, প্রস্তাবটা ছিল প্রধান শিক্ষকের, যিনি শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত নীতিপরায়ণ এবং খানিকটা বাতিকগ্রস্ত ছিলেন। ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্যে তিনি এতটাই সজাগ এবং এত ভাল ভাল উপদেশ দিতেন যে, ছাত্রদেরই ধারণা হয়েছিল তিনি তাদের মুনিঋষিদের পর্যায়ে না তুলে ছাড়বেন না।

এ হেন শিক্ষকমশাই নির্দেশ দিলেন, আদর্শ ভাল ছেলের চেহারার আদল কী রকম হবে এবং তার পোশাক চালচলনই বা কেমন হওয়া উচিত? সেটা প্রাঞ্জল ছবি এঁকে প্রদর্শনীতে রাখা হবে।

স্কুলে কার আছে অমন প্রাঞ্জল ছবি আঁকার ক্ষমতা? নিঃসন্দেহে সত্যজিতের। অতএব শিক্ষকমশাই সত্যজিৎকে ডেকে এই গুরুদায়িত্বটা দিলেন।

সত্যজিৎ কয়েকদিনের মধ্যেই সে ছবি এঁকে ফেললেন।

শিক্ষকমশাই ছবি দেখে দারুণ খুশি। তিনি যতটা আশা করেছিলেন এ যেন তার চেয়েও বেশি ভাল হয়েছে, প্রাঞ্জল তো বটেই। অতএব প্রদর্শনীর আগেই তিনি মহাউৎসাহে ছবি নিয়ে ক্লাসে এলেন এবং ছাত্রদের ছবিটা দেখিয়ে সঙ্গে আরও কিছু উপদেশ দিয়ে, ভূয়সী প্রশংসা করলেন সত্যজিতের।

ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া সেই মুহূর্তে বোঝা না গেলেও শিক্ষকমশাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র তারা ক্ষিপ্ত রোষে ঝাঁপিয়ে পড়ল সত্যজিৎের ওপর। এটা কী এঁকেছিস! ইয়ার্কি পেয়েছিস! কোন আক্কেলে এ ছবি আঁকলি? সহপাঠীরা যতই তাদের ঝাল জাড়–ক, রাগ দেখাক, সত্যজিৎ শান্তভাবে তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেন, তিনি আর কী করবেন, মাস্টারমশাই যে অমনই চেয়েছিলেন।

বুদ্ধিমান এবং রসবোধসম্পন্ন সত্যজিতের পক্ষেই এটা সম্ভব হয়েছিল, একই ছবিতে শিক্ষকমশাইকে খুশি করা এবং সহপাঠীদের রাগানো।

এখন কথা হচ্ছে, কী রকম ছবি তিনি এঁকেছিলেন?

ছবিটি তুলে ধরি তাঁর সহপাঠীরই বিবরণেÑ ‘শান্তশিষ্ট নাড়– গোপাল জাতীয় ছেলে, মাথার চুল কদম ছাঁটের। একটু আগের পর্যায়ে এসে থেমেছে, জুলপির প্রশ্ন উঠে না। মাঝখান দিয়ে সিঁথি করে দুপাট করা চুল খানিকটা কপালের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, পুরো হাতা গলাবন্ধ শার্ট, কলারটি অবশ্যই নামানো। আর ধুতি মালকোচা বটে, কিন্তু হাঁটু অবধি তোলা, পায়ে বুট জুতো।’

যাই হোক, এখানে এই ঘটনাটির উল্লেখ করলাম এই কারণে যে স্কুলের তথাকথিত আদর্শ ভাল ছেলে বলতে যাদের বোঝায়, যারা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে জগত সংসার সম্পর্কে উদাসীন থাকে, আদব-কায়দায় যারা যুগোপযোগী হয় না বা হতে পারে না, সত্যজিৎ নিজে তাদের ব্যঙ্গ চোখেই দেখতেন। তার এই ব্যঙ্গটা তার সহপাঠীরাই প্রথমে বুঝতে পারেনি, তাই তারা সত্যজিতের প্রতি রেগে গিয়েছিল।

সত্যজিৎ স্কুলের পরীক্ষায় কোন দিন প্রথম হননি বটে, কিন্তু তার রেজাল্ট প্রথম দশজনের মধ্যেই থেকেছে বারবার। আসলে তিনি ছিলেন আক্ষরিক ও গুণবাচক অর্থে প্রকৃত ভাল ছেলে। এককথায় যাকে বলা হয় চৌকস। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই নানা বিষয়ে চর্চা করতে ভালবাসতেন তিনি এবং সে সবার জন্যে যথেষ্ট সময়ও দিতেন। তাতে স্কুলের পরীক্ষায় নম্বর কমে যাবে বলে উতলা হননি। এটাই ছিল তার স্বভাব। বলা বাহুল্য, পারিবারিক পরিবেশটাও ছিল সেই রকম। লুডু, ক্যারাম ইত্যাদি প্রচলিত ঘরোয়া খেলাসহ নানা রকমের নতুন নতুন বুদ্ধির খেলায় অংশগ্রহণ এবং ছড়া কাট, ছবি আঁকা, ফ্লিম দেখা, ফোটোগ্রাফি ইত্যাদিতে তার সমান উৎসাহ ও ঝোঁকের কথা জানা যায়।

এ ব্যাপারে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত মহাশয় তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন, তার সঙ্গে পরবর্তীকালে স্ক্র্যাবল খেলে, স্টেটসম্যান মারফত লন্ডন টাইমস এর ক্রসওয়ার্ড ইত্যাদি করে তার ক্ষুরধার বুদ্ধি, তড়িৎগতিতে চিন্তার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তির প্রখরতা দেখে অবাক হয়ে গেছি। আর তা ছাড়া গান-বাজনা সম্বন্ধে তাঁর সজাগ কানের কথা তো সবার জানা।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বুদ্ধি খেলা, ধাঁধা, হেয়ালিতে সত্যজিতের ছেলেবেলার ভালবাসা চিরকাল বজায় ছিল। পরিণত বয়সের ব্যস্ত জীবনেও তিনি এ সবের প্রতি আকর্ষণ হারাননি। শুনেছি, তিনি যখনই বিদেশে গিয়েছেন, তখন সুযোগ পেলে ওখানকার নতুন নতুন ঘরে বসে খেলা ইত্যাদি নিয়ে ফিরতেন। বাংলায় তিনি প্রথম যে ক্রসওয়ার্ডটি তৈরি করেছিলেন, তার মধ্যে রাধাপ্রসাদ বাবুর ভাষায় দারুণ প্রোফেশন্যাল ফিনিশি ছিল।

স্কুল পেরিয়ে তিনি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রেসিডেন্সিতে সে সময় বেশির ভাগ বড় লোকের ছেলেরাই পড়ত, যাদের হাতে পয়সার অভাব হতো না। কলেজে এক দারোয়ান ছিল, যে সুযোগ পেলে ছাত্রদের কাছে টাকা ধার চাইত। এবং পেয়েও যেত। ফলে এটা তার বদ অব্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। সত্যজি’ কীভাবে এই দারোয়নের কাছে একদিন টিট ফর ট্যাট হয়ে উঠেছিলেন সেটাই এখানে বলা।

সেদিন সত্যজিৎ তার এক সহপাঠীর সঙ্গে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। দেখেন দারোয়ান তাদের দিকে হন্তদন্তভাবে এগিয়ে আসছে। সত্যজিৎ তার মতলব বুঝতে পারেন। হঠাৎ তিনিও বাক্যবাগীশ হয়ে দারোয়ানের দিকে পা বাড়ায়। এবং একদম মুখোমুখি হয়ে বলেন, দারোয়ানজি আমাদের গোটা দুই টাকা ধার দিতে পার? খুব দরকার! বলা বাহুল্য, দারোয়ান তখন হতভম্ব হয়ে একেবারে উল্টো পথে দৌড় লাগায়।

এবার দ্বিতীয় ঘটনাটির কথা বলি। গরমের ছুটির আগে একদিন সত্যজি’ তার সেই সহপাঠীকে নিয়ে আউট্রাম ঘাটের ওপর এক রেস্তোরাঁয় যান, ওখানকার আইসক্রিম ছিল তার পছন্দ। দুই বন্ধু মিলে আইসক্রিম খান। ফেরার পথে গরমকালের বিকেল। ফুরফুরে হাওয়া। ঢোকেন কার্জ পার্কে। গল্প করতে করতে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসতে চান। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়।

সত্যজিৎ পুলিশটিকে বলেন, বেঞ্চটির গায়ে তো ‘রিজার্ভড’ লেখা নেই। তাহলে আমরা বসব না কেন? উত্তরে পুলিশ বলেন, কেন, তার জবাব তারও জানা নেই। তবে হুকুম নেই, তাই সে বসতে দেবে না।

পুলিশের কথা শুনে সত্যজিৎ বেশ অবাক হন। অগত্যা বিরক্ত মনে বন্ধুর সঙ্গে ফিরে আসেন। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে যায়। সেদিনে ঘটনাটি তাঁর সঙ্গী বন্ধুটি তত দিনে ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ একদিন সত্যজিৎ তার বন্ধুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সরকারী ডাক টিকেট লাগানো একটি চিঠি দেখিয়ে সেটা পড়তে বলেন।

চিঠি পড়ে বন্ধু এবার অবাক হন। তখনকার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সত্যজিৎকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।

সেই চিঠি থেকেই সেদিন পুলিশের কার্জন পার্কের বেঞ্চে বসতে না দেয়ার রহস্যটা জানা যায়Ñ বছর দেড়েক আগে কোন এক ইংরেজ দম্পত্তি ওই বেঞ্চটিতে বসেছিলেন। বেঞ্চটি তখন সদ্য রঙ করা হয়েছিল। ফলে তাদের পোশাক নষ্ট হয়ে যায়। এ ব্যাপালে তারা রিপোর্ট করলে পুলিশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা ওয়েট পেন্ট নোটিশ লাগিয়ে দেয়া হয় এবং অধিকন্ত একজন পুলিশকে সেখানে পাহারায় রাখা হয়। ভিজে রঙ শুকিয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষের খেয়াল করার অভাবে হুকুম পাল্টানো হয়নি। ডেপুটি পুলিশের কমিশনার তাই সত্যজিৎকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তার চিঠিতে।

শৈশব মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সিনেমা বানাবার যে স্বপ্ন দেখিছিলেন সত্যজিৎ, যৌবনে পৌঁছে তা বাস্তবায়িত করলেন। মাঝে সব কিছুর মধ্যে থেকেই নীরবে নিভৃতে প্রস্তুত করে নিয়েছেন নিজেকে। কতটা প্রস্তুত করেছিলেন সেটা বোঝা যায় যখন দেখি শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি, সমীহ ও সম্মান লাভ করেছিলেন। তিনি চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই গড়পড়তা বাঙালীর তুলনায় মাথায় উঁচু ছিলেন সত্যজিৎ। প্রস্তুতি পর্বে সেটা তেমন বোঝা না গেলেও যেদিন বোঝা গেল, সেদিন থেকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি।খ্যাতি পেলেন বিশ্বজোড়া।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>