না। নাম দেখে মোটেও ঘাবড়ে যাবেন না কারণ এই লেখাটা মোটেও উত্তম-সুচিত্রার ওই সিনেমাটা নিয়ে নয়। লেখাটা এমন একজন মানুষকে নিয়ে, যাঁর প্রতিটি দিনই বিচিত্র সব সৃষ্টিশীল কাজকর্মে ভরপুর কিন্তু সেগুলি স্বীকৃতি পাওয়ার সময় তাঁর নামটি রয়ে গিয়েছে প্রদীপের নীচে অর্থাৎ আলোর ওধারের অন্ধকারে। তাঁর কথা ভাবতে গিয়ে তাই ওই পুরনো সিনেমাটির নাম আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, ওই ছোট্টখাট্ট চেহারার, পাতলা গোঁফওয়ালা, সদাহাস্যময় মানুষটার নাম হরিপদ ভৌমিক। আমার মতো স্নেহভাজনদের কাছে যিনি হরিদা নামেই সবিশেষ পরিচিত। তবে আরও একটি বিষয়ে ওই সিনেমাটির সঙ্গে হরিদার সামান্য মিল রয়েছে। ‘ওরা থাকে ওধারে’ রিলিজ করেছিল ১৯৫৪ তে, আর হরিদার আবির্ভাব ১৯৫০-এ। তবে এ তো হল কথার পিঠে কথা– নির্মল রসিকতা। কিন্তু হরিদা এখনও পর্যন্ত যেসমস্ত কাজ করেছেন, তার মধ্যে কিন্তু কোথাও কোনো রসিকতা নেই। বরং সুগভীর গাম্ভীর্য আছে।
আমার মতো যাঁরা হরিদাকে মোটামুটি কাছ থেকে চেনেন, তাঁরা জানেন, এই মানুষটির জ্ঞানতৃষ্ণার কোনো তুলনা হয় না। মনের আনন্দে লেখাপড়া ও ফিল্ড ওয়ার্ক করে তিনি এখনও পর্যন্ত যেসব বিচিত্র গবেষণামূলক কাজগুলি সম্পন্ন করেছেন, তা একজন মানুষের পক্ষে একজীবনে করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেই কাজটির জন্যে নাম হয়েছে হরিদার পরিচিত কোনো ব্যক্তির বা আমলার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের, শহরের বা রাজ্যের। কিন্তু তা বলে তাঁর কাজ করে যাওয়ার উৎসাহ কিন্তু একফোঁটাও কমে যায়নি, বরং দিনদিন তা বেড়ে গিয়েছে।
হরিদার সঙ্গে আমার আলাপ ‘বাঙলীর সার্কাস’বইটিতে তাঁর অসামান্য ভূমিকা লেখার সূত্র ধরে। আগেই শ্রদ্ধেয় ক্ষেত্র গুপ্ত এবং সনৎকুমার মিত্র মশায় সম্পাদিত ‘লোকসংস্কৃতি গবেষণা’ পত্রিকাটির বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হরিদার কয়েকটি প্রবন্ধ এবং অভিধানমালার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ঢেঁকিরও যে অভিধান হয় , রক্তেরও যে একটি অভিধান হতে পারে– ওঁর লেখা পড়ার আগে তা আমার মাথাতেও আসেনি। সেবার বইমেলায় আলাপ হল তাঁর সঙ্গে। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই ফোন হয়। নানা লেখার বিষয়ে কথা হয়। কোনো তথ্য নিয়ে সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে হরিদাকে ফোন করি। তিনি হাসতে হাসতে তার সমাধান করে দেন। একবার প্রায় মিনিট পনেরো কথা বলার পর জানতে পেরেছিলাম তিনি তখন ট্রেনে চেপে হরিদ্বারে চলেছেন।
এই তো, গত ৩১ জুলাই ২০১৯ ‘দেশকাল’ পত্রিকার তরফে দমদমের ওপর লেখা তিনখণ্ড বইয়ের একটি সংকলন আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হল। এই খণ্ড তিনটি হল– ব্রিটিশ দমদম, স্বদেশী দমদম এবং প্রাচীন দমদম। দমদমবাসীদের কাছে এ-এক আনন্দের খবর। অথচ তাঁদের বেশিরভাগই হয়তো এটা জানেন না, দমদম জায়গাটির ইতিহাস লেখার কথা যাঁর মাথায় প্রথম এসেছিল, তিনি এই হরিপদ ভৌমিক। ১৯৭৩ সালে হুগলি থেকে প্রকাশিত ‘ভ্রমণবার্তা’ পত্রিকায় তিনি একটি গদ্য লিখেছিলেন যার বিষয় ছিল দমদম স্টেশনে নেমে হাঁটতে শুরু করলে আপনি কোন-কোন রাস্তাঘাট-মন্দির-মসজিদ দেখতে পাবেন এবং তাদের নামকরণের কারণ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এরপর নিজের স্কুল দমদম আদর্শ বিদ্যামন্দিরের কয়েকজন বন্ধু এবং দু-তিনজন মাস্টারমশাইকে নিয়ে ‘দমদম পুরাবৃত্ত পরিষদ’ নাম দিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন, যার সভ্যদের কাজ ছিল বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজেদের ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করা। এইভাবে ওঁরা সুন্দরবন, বেড়াচাঁপা, জটারদেউল– এমন নানান জায়গায় গিয়েওছিলেন। এরপর হরিদা ‘অর্ক’ নাম দিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন, যাতে ‘দমদম’ নিয়ে একটি সংখ্যা হয়েছিল। ওঁদের স্কুলে রাজেন ঘোষ নামের এক মাস্টারমশাই ছিলেন, যাঁর ইতিহাসের প্রতি খুবই ভালোবাসা ছিল। ফি রোববার তাঁর বাড়িতে একটি সাহিত্যের আসর বসত এবং তিনি একটি কলের গান চালিয়ে সবাইকে গানও শোনাতেন। হরিদা সেই রাজেনবাবুকে গিয়ে ধরলেন তাঁদের পত্রিকায় দমদম নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে দেওয়ার জন্যে। রাজেনবাবু রাজি হলেন কিন্তু আজ দিচ্ছি-কাল দিচ্ছি করে দিন ক্রমশ পিছতে থাকল। শেষে হরিদা একদিন তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে দু’ব্যাগ ভর্তি দমদম বিষয়ক রেফারেন্স বই নিয়ে রাজেনবাবুর বাড়িতে হাজির হলেন। রাজেনবাবু তখন পাড়ার ক্লাবে তাস খেলছিলেন। হরিদা তাঁকে সেখান থেকে পাকড়াও করে বাড়িতে নিয়ে এসে, সারারাত তাঁর বসার ঘরে বসে থেকে, তাঁকে দিয়ে দমদমের ওপর লেখাটি লিখিয়ে, ভোরবেলা লেখা হাতে বাড়ি ফিরেছিলেন । অর্থাৎ এই যে লেগে-থাকা ব্যাপারটা– এটা কিন্তু হরিদার মধ্যে বরাবরই ছিল।
১৯৮৪ সাল নাগাদ কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে সূর্য্যকুমার চট্টোপাধ্যায় বিরচিত ‘কালীক্ষেত্র দীপিকা’ (১৮৯১)-র একটি অরিজিনাল কপি হরিদা খুঁজে পান। এটি ছিল কালীঘাটের ইতিহাস বিষয়ক একটি আকর গ্রন্থ। কলকাতার কোনো লাইব্রেরিতেই তখন সে-বই ছিল না। ন্যাশনাল লাইব্রেরির ক্যাটালগে বইটির নাম ছিল কিন্তু বইটা ছিল না। এ-বই ছাপা না-হলে হারিয়ে যাবে– এই ভেবে হরিদা নিজেই বইটি সম্পাদনা করে ১৯৮৬-তে আবার প্রকাশ করেছিলেন। এবার একশো সাতেরো পাতার মূল বইটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর লেখা চৌষট্টি পাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
দমদম নিয়ে কাজ করার সুবাদে হরিদার হঠাৎ মনে হল এবার কলকাতার মন্দিরগুলো নিয়ে একটু কাজ করলে হয়। যেমন ভাবা তেমনই ঝট করে ছুটে যাওয়া এস এন ব্যানার্জি রোডের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের হেড আপিসে– যদি ওঁদের কাছে কলকাতার পুরনো মন্দিরগুলোর কোনো লিস্ট পাওয়া যায়– এটা খোঁজ করতে। সঙ্গে ছিলেন স্কুলের বন্ধু হৃতেন্দুবিকাশ সরকার। ওঁরা কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে খোঁজ করতে করতে শেষে সমরেশ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানালেন, যিনি সেইসময় ইংরিজি ‘মিউনিসিপ্যাল গেজেট’ পত্রিকাটির সম্পাদক। ১৯২২-এ পত্রিকাটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন এর সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্র স্নেহধন্য অমল হোম ( ১৯২২)। তো সে যাই হোক, সমরেশবাবু দুটি অল্পবয়সী ছেলের কলকাতা নিয়ে উৎসাহ দেখে সেদিন খুশিই হয়েছিলেন। সেইসময় আবার ‘মিউনিসিপ্যাল গেজেট’-এর একটি বাংলা সংস্করণ বেরনোর তোড়জোড় চলছিল। সেটা ছিল ‘কলকাতা কলকাতা’ বিশেষ সংখ্যা। সমরেশবাবু, হরিদাকে তাতে একটি লেখা দেওয়ার কথা বলেন। হরিদার যে লেখাটি দিয়েছিলেন তার বিষয় ছিল কলকাতা শহরের নামকরণ। এই পত্রিকা প্রকাশ পাওয়ার দিন সাতেক বাদে তৎকালীন মেয়র প্রশান্ত শূর একটি পত্রিকা সংক্রান্ত মিটিং ডেকেছিলেন। সমরেশবাবু সেখানে হরিদাকে আসার আমন্ত্রণ জানান। মিটিং-এ প্রশান্ত শূর জানান যে পুরসভার তরফে তাঁরা একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করতে চান।
আলোচনায় ঠিক হয় যে সেটি কিন্তু ‘মিউনিসিপ্যাল গেজেট’ এর বাংলা সংস্করণ নয়, সম্পূর্ণ পৃথক একটি বাংলা পত্রিকা হতে হবে। মিটিং-এ হরিদা বলেন, যেহেতু কলকাতার ইতিহাস মানে সাহেবদের লেখা ইতিহাস, তাই বাঙালিটোলার কোনো ইতিহাস তখনও আমাদের কাছে নেই। আর বাঙালিটোলার ইতিহাস রচনাই এই পত্রিকার মূল লক্ষ্য হোক। সেইসঙ্গে পৌরসভার বিভিন্ন বিভাগে যেসমস্ত কাজকর্ম হচ্ছে সেই খবরগুলিও যদি এখানে ছাপা হয় তবে বর্তমানটা ভবিষ্যতের কাছে রেকর্ডেড হয়ে থাকবে। মেয়র হেসে বলেছিলেন, প্রস্তাব ভালো কিন্তু প্রবন্ধ কতদিন পাওয়া যাবে? মানে, এত লেখা কে দেবে? হরিদা বলেছিলেন, লেখা যদি না-পাওয়া যায় তবে প্রথম দশবছর পত্রিকা চালানোর দায়িত্ব তাঁর একার। তখন ‘পুরশ্রী’ নাম দিয়ে পত্রিকাটি শুরু করা হল। আর ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ — এই প্রথম চারবছর এই পত্রিকাটির ‘অঘোষিত’এডিটর ছিলেন বাবু হরিপদ ভৌমিক। সম্পাদক সমরেশ চট্টোপাধ্যায় জানতেনও না আগামী সংখ্যায় তাতে কী কী লেখা বেরোবে! সেইসময় পত্রিকাটির দাম ছিল পঞ্চাশ পয়সা। একে জনপ্রিয় করার জন্যে এবং এতে কত রিচ লেখা ছাপা হচ্ছে সেটা সিরিয়াস বাঙালি পাঠকদের জানানোর জন্যে হরিদা নিজে এর প্রতিটি সংখ্যা দুশো কপি কিনে, তার একশো কপি কলেজস্ট্রিটের পাতিরাম বুকস্টলে এবং বাকিটা আধাআধি করে শেয়ালদহ এবং গড়িয়াহাটের দুটি বইয়ের দোকানে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিয়ে আসতেন। কারণ সেখানে না পাওয়া গেলে ক’জনই বা জানতে পারবেন যে কর্পোরেশন অফিসে ‘পুরশ্রী’ পাওয়া যায় আর ক’জনই বা সেখানে গিয়ে সংখ্যাগুলি কিনতে পারবেন! এই পত্রিকাটির মাধ্যমেই কিন্তু ‘কলকাতা’ আন্দোলনের একটি নবদিগন্ত খুলে গিয়েছিল আর যা পূর্ণতা পেয়েছিল নয়ের দশকে। ‘পুরশ্রী’র এমন অনেক সংখ্যা আছে যেখানে হরিদা একাই স্বনামে এবং ছদ্মনামে সবক’টি লেখা এবং নিউজ লিখেছেন। শ্রীধর কথক, কলকাতাপ্রেমী, পরিব্রাজক, দিলীপ দাস– এমন সব ছদ্মনামও ছিল তাঁর। অথচ এই ছদ্মনামের আড়ালে থাকা মানুষটি যে কে, তা কিন্তু পাঠকরা কোনোদিন জানতেও পারেননি।
শ্রীহরিপদ ভৌমিক যখন কলকাতার পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুঁজে বের করার তাগিদে আটের দশকের গোড়ায় ঠনঠনিয়ার একটি ঘরে ‘কলকাতা চর্চাকেন্দ্র’-র প্রতিষ্ঠা করলেন তখন যেসব বিদগ্ধজনেরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁদের মধ্যে নিশীথরঞ্জন রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, অতুল শূর, অশোক উপাধ্যায়, জীবনতারা হালদার এবং শ্রীপান্থ-র নাম সবার আগে। এখান থেকে ‘সেকালের সংবাদপত্রে কলকাতা’ নাম দিয়ে দু-খণ্ড বই বেরিয়েছিল, যা ছিল ১৮১৮ থেকে ১৮২১ — এই তিন বছরে ‘সমাচার দর্পণ’ সংবাদপত্রে বেরনো কলকাতা বিষয়ক সমস্ত সংবাদের সংকলন। অত্যন্ত দুঃখের যে এই সংকলন দুটি এখন আর পাওয়া যায় না।
আজ হয়তো পঞ্জিকা নিয়ে অনেকেই লেখাজোখা করেন কিন্তু এর শুরু যে হরিদার হাত-ধরে এটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। ‘পুরশ্রী’তে হরিদাই প্রথম পঞ্জিকা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মেয়র প্রশান্ত শূর একবার হরিদাকে জিগ্যেস করেছিলেন যে, স্বাধীনতার পরে কলকাতা শহরের সমস্ত বস্তির হিসেব কর্পোরেশনের কাছে আছে কিন্তু স্বাধীনতার আগের বস্তিগুলির হিসেব পুরসভার কোনো ডিপার্টমেন্টের কাছেই নেই। সেটা কি কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব? হরিদা হেসে বলেছিলেন, নিশ্চয় সম্ভব কিন্তু সেটা একটু পিছনের দিকের হবে। প্রশান্তবাবু জিগ্যেস করেছিলেন, কত পিছনের ? হরিদা বলেছিলেন, এই ধরুন ১৯১৫ –র। প্রশান্তবাবু বলেছিলেন, ওতেই চলবে। হরিদা তখন সোজা পি. এম. বাগচী-র পঞ্জিকার অফিসে গিয়ে ওঁদের ১৯১৫ সালের ডায়রেক্টরি পঞ্জিকার ফাইলটি নিয়ে বসেছিলেন। আসলে হরিদার কাছে এই গল্পটি শোনার আগে আমি জানতামই না ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা বলে একটা জিনিস হত, যাতে এক-একটি রাস্তার বাড়ির নম্বর ধরে ধরে বাড়ির মালিকের নাম, ভাড়াটের নাম, বাড়িটি পাকাবাড়ি, খোলারঘর না বস্তি, বসতবাড়ি না দোকানঘর– এমন সব তথ্য পরিষ্কার লেখা থাকত। হরিদা অ্যালফাবেটিকালি কলকাতার রাস্তার নাম ধরে-ধরে, তা থেকে শুধুমাত্র খোলার ঘর আর বস্তি বেছে নিয়ে, তার একটি তালিকা তৈরি করে প্রশান্ত শূরের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে বিশ্বব্যাঙ্কের টাকা যে কলকাতাতেও ঢুকেছিল তাতে হরিদার হাতে তৈরি এই তালিকাটির প্রভাব যে কতখানি, এটা খুব গবেট মানুষেরও আশাকরি বুঝতে অসুবিধে হবে না। অথচ এখানেও সেই ‘ওরা থাকে ওধারে’, মানে হরিদার নাম কিন্তু কেউই জানতে পারল না।
এবার আসি সম্পূর্ণ অন্য একটি বিষয়ে। কলকাতায় মেট্রোরেলের কাজ শুরু হতে পারছিল না কারণ ১৯৭৬-৭৭ সাল নাগাদ চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-র বনেদি বাড়ির হোমরাচোমরা মালিকরা, তাঁদের বাড়ির গাড়িবারান্দা মেট্রোরেলের কাজের জন্যে ভাঙা হবে এই নোটিশ পেয়ে, হাইকোর্টে কেস করে মেট্রোর কাজ আটকে রেখেছিলেন প্রায় এক বছরেরও ওপর। তাঁদের বক্তব্য ছিল আমাদের বাড়ির গাড়িবারান্দা আমাদের শহরের পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। একে ভাঙা মানে প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা। সেই সময় ১৯৭৮ সালে হরিদা আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে একটি প্রবন্ধ লেখেন। নাম ছিল ‘কলকাতার গাড়িবারান্দা’। এর আগে অবশ্য হরিদার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ ওখানে বেরিয়েছিল কিন্তু রবিবাসরীয়র রমাপদ চৌধুরী বা রাধানাথ মণ্ডলের কেউই হরিদাকে সাক্ষাতে চিনতেন না। হরিদা বরাবরই তাঁর প্রবন্ধগুলি খামে পুরে আনন্দবাজারের ড্রপবক্সে ফেলে দিয়ে আসতেন এবং আশ্চর্যভাবে সেগুলি ছাপাও হত। একবার রাধানাথবাবু হরিদাকে আনন্দবাজারে নিজেদের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে জিগ্যেস করেছিলেন, আচ্ছা, এই যে আপনি লেখাগুলো পাঠাচ্ছেন এবং সেগুলো ছাপা হয়ে যাচ্ছে, আপনার একবারও সেই লোকগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করেনি যারা আপনার লেখাগুলি মনোনীত করে ছাপতে দিচ্ছে? হরিদা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন যে, তাঁর বাবা বলেছিলেন লেখাগুলি লিখে আনন্দবাজারের ড্রপবক্সে ফেলে আসতে। যদি তা ভালো হয় ছাপা হবে। খারাপ হলে ছাপা হবে না। তাই লেখাটা কে পছন্দ করলেন, কে ছাপতে দিলেন– এটা তাঁর কাছে খুব গৌণ একটি ব্যাপার হিসেবেই থেকে গেছে। আর সেইজন্যেই তিনি কোনোদিন এই দপ্তরে আসার চেষ্টাই করেননি। তখন অল্প কথার মানুষ রমাপদ চৌধুরী হরিদাকে বলেছিলেন, আপনার লেখা ছাপার পিছনে দুটি মাত্র কারণ আছে। এক, লেখাগুলি ভালো। আর দুই, তাদের পিছনে কোনো সুপারিশ নেই। এই অবধি বলে হরিদা হা-হা-হা করে তাঁর সেই বিখ্যাত হাসিটি হেসে বলেছিলেন, আসলে কী জানো, রমাপদবাবুর একটা বদরোগ ছিল। উনি কোনোদিন কোনো সুপারিশ করা লেখা ছাপতে দিতেন না!
যাক গে, কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাচ্ছি। তো সেই ‘কলকাতার গাড়িবারান্দা’ প্রবন্ধে হরিদা লিখেছিলেন, কলকাতার বাবুরা চিরকালই পাল্কিতে চেপে ‘হুন হুনা – হুন হুনা’ করে ঘুরে বেড়াতেন। তখন কলকাতার বেশিরভাগ পাল্কিবাহকরাই ছিলেন উড়িষ্যার মানুষ। পাল্কি বেহারারা তখন যে মজুরি পেতেন, তা ছিল এক জায়গা থেকে আর একটি জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চুক্তি-নির্ভর। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হয় যে তাঁদের রোজ হিসেবে মজুরি দেওয়া হবে। আর সেটা ছিল বারো ঘণ্টায় এক রোজ হিসেবে, এখনকার মতো আট ঘণ্টার রোজ ন। পাল্কিবাহকরা এই রোজ ভিত্তিক মজুরি মেনে নিতে রাজি হননি। তাঁরা সবাই একজোট হয়ে পাল্কি বওয়ার কাজটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং সারা ভারত-জুড়ে পাল্কিবেহারারা প্রায় পনেরো দিন ধরে এই হরতাল পালন করেছিলেন। সেটা ছিল ১৮২৭। বোঝাই যাচ্ছে যে এই চরাচরে কমিউনিস্ট পার্টির তখন কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তাহলে সারা ভারতের সমস্ত পাল্কিবাহকেরা এই হরতাল একজোট হয়ে পালন করলেন কী করে? এর উত্তর হল, তখন ধর্মের নামে ঘট স্থাপন করে তা ছুঁয়ে পাল্কিবাহকদের প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেওয়া হয়েছিল যে যতদিন না তাঁদের দাবি আদায় হবে, ততদিন তাঁরা পাল্কি বওয়ার কাজ করবেন না। আর এই থেকেই নাকি ‘ধর্মঘট’ কথাটির সূত্রপাত হয়েছে। হরিদার মুখে এটা শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, এটাই নাকি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম স্বীকৃত ধর্মঘট। যাই হোক পাল্কিবেহারাদের এই ধর্মঘটে কলকাতার বাবু সমাজ একদম ন্যাজেগোবরে হয়ে গিয়েছিল। তখন কলকাতায় ঘোড়ারগাড়ি ব্যবহার করতেন বড়োলাট বা ছোটোলাটের মতো উচ্চপদে বসে থাকা লালমুখো সাহেবরা এবং নবাববাহাদুর বা রায়বাহাদুরের মতো বাঙালিরা। এই পনেরো দিনের ধর্মঘটের মধ্যেই কলকাতায় ব্রাউন লো নামের এক সাহেব পাল্কির দু’ধারে দু’খানা চাকা জুড়ে পাল্কি-গাড়ি তৈরি করেছিলেন, যা কিনা ঘোড়ায় টেনে নিয়ে যেত। আর তাই দেখে সমাচার দর্পণ নাকি নিউজ করেছিল, ‘এখন ঘোড়ারা পাল্কিবাহক হইয়াছেন!’ সাহেবের নাম অনুযায়ী ওই গাড়িটিকে সবাই ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি বলত। আর এরপর থেকেই ঘোড়ারগাড়ির যুগ শুরু হল। তখন কলকাতার যেসব নববাবুরা ঘোড়ারগাড়ি কিনেছিলেন তাঁদের মোসাহেবরা পাল্কিচড়া বাবুদের সাঙ্গোপাঙ্গদের এই বলে দুয়ো দিত, তোদের বাবু এখনও পাল্কিতে চড়ে, আমাদের বাবু ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বলে তার কত মর্যাদা বেড়েছে! আবার পাল্কিচড়া বাবুদের মোসাহেবরা, ঘোড়ায়চড়া বাবুদের সাঙ্গোপাঙ্গদের এই বলে টিটকিরি দিত যে, তোদের বাবু আবার বাবু নাকি? তাকে তো সাধারণ লোকের মতো রাস্তায় নেমে, তারপর নিজের বাড়িতে ঢুকতে হয়। আমাদের বাবুকে দ্যাখ! সে পাল্কিসুদ্ধু সোজা নিজের বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়! তখন ওই ঘোড়ারগাড়ি-চড়া বাবুদের প্রেস্টিজ বাঁচানোর জন্যে তাঁদের বাড়ির সামনে গাড়িবারান্দা তৈরি করা হয়েছিল। মানে সেটা যেন বাড়িরই একটা অংশ হল। গাড়িবারান্দা তৈরির ইতিহাস বলতে গিয়ে হরিদা এই গল্পটাই বলেছিলেন। সেইসময় উনি সাহিত্য পরিষদ এর লাইব্রেরিতে রাখা নানান পুরনো পত্র-পত্রিকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলকাতা বিষয়ক তথ্য খুঁজে বেড়াতেন।
একদিন এইভাবেই কেশবচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘সুলভ সমাচার’ পত্রিকায়, মানে যে পত্রিকাটি ‘এক পয়সার পত্রিকা’ নামে বিখ্যাত ছিল, ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত একটি খবর আচমকাই চোখে পড়েছিল। খবরটিতে হল, তখনকার ‘জাস্টিস অব পিস’ মানে এখন যেটি কলকাতা কর্পোরেশন, তারা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এখন থেকে কলকাতায় আর কোনো গাড়িবারান্দা নতুন করে তৈরি করা যাবে না এবং কলকাতা উন্নয়নের স্বার্থে যেকোনো গাড়িবারান্দা ভেঙে ফ্যালা যাবে। হরিদা আনন্দবাজারে প্রকাশিত তাঁর ‘কলকাতার গাড়িবারান্দা’ প্রবন্ধটিতে এই খবরটি সুলভ সমাচার থেকে হুবহু কোট করেছিলেন। মজার কথা, এই রেকর্ডটি কিন্তু কর্পোরেশনের কাছেও ছিল না। আর মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ওই কাগজটিই হাইকোর্টে জমা দিয়ে এতদিন ধরে আটকে থাকা গাড়িবারান্দা ভাঙার কেসটি জিতে গেল। ফলে কলকাতায় মেট্রোরেলের কাজও শুরু হল। অথচ মেট্রোরেলের ইতিহাসের কোথাও কিন্তু হরিপদ ভৌমিকের প্রতি সামান্য সৌজন্য জ্ঞাপন করা নেই। উল্লেখ করা নেই তাঁর নাম। মানে এখানেও সেই ‘ওরা থাকে ওধারে’। অথচ হরিদার কাছে ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু করে মেট্রোরেলের সমস্ত বিজ্ঞাপন এবং নিউজ যত্ন করে ধরে রাখা আছে। কারণ হরিদা তো এগুলো কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে করেননি। করেছেন প্রাণের আনন্দে, ইতিহাসকে হারিয়ে না-যেতে দেওয়ার তাগিদে।
এবার একদম শেষকালে আসি ‘রসগোল্লা’ এপিসোড-এ। আজ ভারতের নানা রাজ্যেই রসগোল্লা তৈরি হতে দেখা গেলেও তার কারিগর যে এই বাংলার এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু ভিন রাজ্যে তৈরি হওয়া রসগোল্লারা স্বাদে ও বর্ণে বাংলার রসগোল্লার মতো হয় না। হওয়া হয়তো সম্ভবও নয়। এদিকে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে উল্টোরথের দিনটিকে ‘রসগোল্লা ডে’ ঘোষণা করে ওড়িশা থেকে দাবি তোলা হয় আসল রসগোল্লার জন্ম নাকি পুরীতে। কারণ রথযাত্রার ‘নিলাদ্রীবিজয়’ অনুষ্ঠানে জগন্নাথদেব নাকি তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর মান ভাঙানোর জন্যে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন। আর এও জানা গেল যে, ওড়িশা নাকি ছানার রসগোল্লার জন্যে ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা ‘জি.আই.’ আর তকমা চেয়ে আবেদন করছে। ওড়িশার এই রসগোল্লাটির নাম ‘ছানার ক্ষীরমোহন রসগোল্লা’। আর এর সৃষ্টির সময়কাল নিয়েও মতভেদ রয়েছে। এদিকে বৈদিক শাস্ত্র মতে ছানা হল ছিন্নভিন্ন হওয়া ‘মৃত দুগ্ধ’। তাই ছানা দিয়ে তৈরি কোনো মিষ্টি সেই প্রাচীনকাল থেকেই দেবপূজায় দেওয়া হত না । আর জগন্নাথ মন্দিরের রসগোল্লাটিও যে সেই অপবিত্র মৃত ছানা দিয়ে তৈরি হয়নি, সেটা বোঝানোর জন্যেই ক্ষীর শব্দটি ওখানে ব্যবহার করা হত। আসলে ক্ষীর দিয়ে রসগোল্লা জাতীয় যে মিষ্টিটি পুরীর মন্দিরে তৈরি হত, ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘পাকরাজেশ্বর’ গ্রন্থে তার নাম ‘ক্ষীরগোলক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সেটি আর যা-ই হোক না কেন ছানার রসগোল্লা নয়।
এই গোটা বিষয়টি যিনি হাসিমুখে চা খেতে খেতে আমায় জলের মতো বুঝিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, বাবু শ্রীহরিপদ ভৌমিক।
রসগোল্লার ওপর ওড়িশার জি.আই. চাওয়ার ঘটনাটা হরিদাকে জানিয়েছিলেন ‘রসগোল্লার কলম্বাস’ নবীনচন্দ্র দাস-এর নাতির-নাতি ধীমান দাস। শুনে হরিদা একটু নড়েচড়ে বসেছিলেন। আমার জানা ছিল মোটামুটি বছর পনেরো ধরে উনি একটি ‘মিষ্টির শব্দকোষ’ তৈরির কাজ করে চলেছেন– যা কিনা এখনও শেষ হয়নি। যার একটি ছোট্ট অংশ হল এই রসগোল্লা। হরিদা সেই সংগ্রহ থেকে, ওড়িশার দাবির পাল্টা দাবি হিসেবে রসগোল্লা বিষয়ক কিছু তথ্য একটি বাংলা সংবাদপত্রে ছাপার জন্যে দিয়ে দিলেন, যেখানে প্রায় প্রমাণই হয়ে গিয়েছিল যে ছানার রসগোল্লা বাংলার নিজস্ব আবিষ্কার– অন্য কোনো রাজ্যের নয়। হরিদা একটি ওড়িয়া চ্যানেলে সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন এই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে, কেউ পারলে প্রমাণ করুন– ছানার রসগোল্লা বাংলার নিজস্ব আবিষ্কার নয়! খবরের কাগজে হরিদার ওই স্টেটমেন্ট পড়ে এবং চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেখে পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন নিগমের দপ্তর থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সমস্ত দরকারি তথ্য-প্রমাণ হাতে করে সেই দপ্তরে গিয়ে দেখা করেন। সেই মিটিং-এ তাঁদের জানানো হয়– এ-রাজ্যের সরকার রসগোল্লার জি.আই. পাওয়ার জন্যে কোমর-বেঁধে লড়বে আর হরিদাও কথা দেন তিনি সব রকম তথ্য দিয়ে তাঁদের সাহায্য করবেন। তিনি এও বলেছিলেন, রসগোল্লা নিয়ে খুব শিগগিরি তাঁর একটি বই প্রকাশের ইচ্ছে আছে। তখন সরকারের পক্ষ তাঁকে অনুরোধ করা হয় বইটি যদি এক মাসের মধ্যে প্রকাশ করা যায়, তবে রসগোল্লার জি.আই. এর জন্যে আবেদন করার সময় খুবই সাহায্য করবে। হরিদা এই মিটিং-এর মাত্র উনিশ দিনের মাথায় ‘রসগোল্লা বাংলার জগৎমাতানো আবিষ্কার’– বইটি গাঙচিল প্রকাশন থেকে প্রকাশ করেন। এ বই যাঁরা হাতে নিয়ে দেখেছেন বা ভবিষ্যতে দেখবেন, তাঁরা নিশ্চয় এর পাতা উল্টেই বুঝতে পারবেন যে, এমন একটি বই মাত্র উনিশ দিনে সম্পূর্ণ করা যায় না। এর পিছনে শত-শত বিনিদ্র রাত্রির নীরব পরিশ্রম লুকিয়ে আছে। আর এই আশ্চর্য বইটির সূত্র ধরেই ১৪ নভেম্বর ২০১৭তে আমাদের বাংলা, ছানার রসগোল্লার জন্য জি.আই. পেল। যেমন আগে পেয়েছিল দার্জিলিং চা, গোবিন্দভোগ এবং তুলাইপাঞ্জি চাল এর জন্যে ।
আমার মতো হরিদার কিছু হাতে-গোনা গুণমুগ্ধ এই সাফল্যের জন্যে সেদিনও তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ তাঁর কথা আজও সেভাবে জানতে পারেনি কারণ এও সেই ‘ওরা থাকে ওধারে’। আর নিজে-হাতে নিজের ঢাক পেটানোর কোনোরকম আগ্রহ কোনোদিনই ছিল না এই ভদ্রলোকের।
বইপাগল এই মানুষটির একটি ছোট্ট দুষ্টুমির কথা না জানালে রসগোল্লা নিয়ে এই লেখা হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যেটা হল– হরিদা তাঁর ‘রসগোল্লা’ বইটির প্রকাশের দিন স্থির করেছিলেন ২৪ অগস্ট ২০১৫ অর্থাৎ ২৪ অগস্ট ১৯৬৫-র ঠিক পঞ্চাশ বছর বাদে । পঞ্চাশ বছর আগে ওই দিনটিতেই তৎকালীন রাজ্যসরকার আইন করে কলকাতার বুকে ‘দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা’ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। তাই এই শহরের অন্যান্য মিষ্টির দোকানের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাগবাজারে নবীনচন্দ্র দাস প্রতিষ্টিত রসগোল্লার বিখ্যাত দোকানটিও। মিষ্টি খাবার ইচ্ছে হলে কলকাতার মানুষ তখন গড়িয়ার খাল পেরিয়ে ওপারের কোনো দোকান থেকে মিষ্টি খেয়ে আসত। হরিদা তাই তাঁর বইটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন ওই বিশেষ দিনে, নবীনবাবুর সেই ঐতিহাসিক বাড়িতে এবং ‘কলকাতার কলম্বাস’-এর উত্তর পুরুষদের সপরিবার উপস্থিতিতে সেখানে সেদিন বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল এবং হাসিমুখে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রী আর আমলা এবং যাঁরা প্রত্যেকেই বিশেষ ভাবে আগ্রহী ছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে অন্য এক সরকারের নিয়মে, বানানো বন্ধ করে দেওয়া সে-ই ছানার রসগোল্লাটির জন্মভিটের মাহাত্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে।
কবি, নাট্যকার
সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘রোববারের বাজার’