| 29 নভেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ: দি হোয়াইট হাউজ ইন দ্য কোল্ড ফরেস্ট । অৎসুইশি

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

 

 

অনুবাদকের কথা:

বই পড়ার ক্ষেত্রে হরর/থ্রিলার/মিস্ট্রি আমার পছন্দের জনরা। আর আমার লেটেস্ট অবশেসন হলেন জাপানিজ লেখক ‘Otsuichi’ (অৎসুইশি)। উনার লেখার ইংরেজি অনুবাদেই আমি বুঁদ হয়ে আছি। সব গল্প শুরু হয় এতো সহজ ভাবে যে হয়তো এক প্যারার পরেই ঘাপটি মেরে থাকা টুইস্ট আর ঘটনার ভয়াবহতা আগে ভাগে আঁচ করার কোন উপায় নেই। বর্ণনায় নেই অহেতুক নাটুকেপনা আর মনোলোগ বা যেকোন ঘটনা তরতর করে ছোট ছোট বাক্যে এগিয়ে যায় দারুণ স্টোন-কোল্ড নির্বিকার এক স্টাইলে। পাঠক চরিত্রগুলোর (যাদের বেশীরভাগই নামহীন, আছে ভয়ঙ্কর সাইকোপ্যাথ খুনীও) অনুভূতির সাথে একাত্ম হয়ে যাবে! কখনো বিবমিষা, ভয় আবার তীব্র দুঃখবোধ ঢেউয়ের মতো এসে আচ্ছন্ন করে ফেলবেই। আপাতত ‘Goth’, ‘Zoo’ এবং ‘Summer, fireworks and my corpse’  টাইটেলের গল্প সমগ্র বার বার পড়া চলছে।

ষোল বছর বয়সে লেখা শুরু করে সতেরো বছর বয়সেই সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়া বিচিত্র ছদ্মনামধারী এই লেখকের লেখা পড়ে ঘোরগ্রস্থ হয়ে অনুবাদ করে ফেললাম।

সানজিদা হক


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

 

লেখক পরিচিতিঃ ‘অৎসুইশি’ এর আসল নাম ‘হিরোতাকা আদাশি’। হরর/ফ্যান্টাসী লেখক এবং চলচিত্র নির্মাতা অৎসুইশি ১৯৭৮ সালে জাপানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬ বছর বয়সে ‘সামার, ফায়ারওয়ার্কস অ্যান্ড মাই করপ্স’ দিয়ে অৎসুইশির লেখালেখির ক্যারিয়ার শুরু। এই বইটির জন্য তিনি ‘সিক্সথ অ্যানুয়াল জাম্প নভেল অ্যান্ড নন-ফিকশন প্রাইজ’ জিতে নেন। তিনি মূলত ‘গথ’ এবং ‘জু’ দিয়েই পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই বইগুলোর ছোট গল্পগুলি নিয়ে ‘মাংগা কমিকস’ এবং ফিচার ফিল্মও তৈরী করা হয়েছে। ২০০৩ সালে ‘গথ’ জাপানের সম্মানজনক ‘হনকাকু মিস্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ জিতে নেয়। লেখকের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘কলিং ইউ’, ‘সিসোউ হলিডে’ ইত্যাদি।


আমি থাকতাম ঘোড়ার আস্তাবলে। না বাড়ীতে নয়। আস্তাবলে ঘোড়া ছিলো তিনটা যেগুলো পুরা জায়গা জুড়েই হাগতো।

‘তুই না থাকলে আরেকটা ঘোড়া এখানে রাখা যেতো!’ আন্টি বলতেন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে। আস্তাবলের নীচের অংশটুকু একটার উপর আরেকটা এলোপাতাড়ি অসমান পাথর বসিয়ে তৈরী আর উপরের অংশে কাঠের তক্তা। ঘোড়ার লাথির ভয়ে একটা কোনায় কুঁকড়ে শুতাম আর পাথর গুনতাম। অসমান পাথরগুলো ছিলো মানুষের মুখের মতো দেখতে। হয়তো বাহু । অথবা গোড়ালি। নয়তো বুক, গলা, ঘাড়। আস্তাবলে ছিলো গোবরের প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। কিন্তু এটাই ছিলো আমার একমাত্র বাড়ি। শীতের রাতগুলো ছিলো খুব ঠান্ডা, খড়ের নীচে শুয়েও কাঁপুনি থামতো না।

                                

আমার কাজ ছিলো আস্তাবলের গোবর সাফ করে পিছনে রাখা, মাঠে নিয়ে যাওয়া। আংকেল দূরে দাঁড়িয়ে নাক চেপে রেখে ঘাউ ঘাউ করে নির্দেশ দিতেন। এই কাজটা ছিলো অন্তহীন ধরণের। আস্তাবলের পিছনে গোবরের টিলা হয়ে গিয়েছিলো রীতিমতো!

আন্টির বাসায় তিনটা বাচ্চা ছিলো, দুটো ছেলে একটি মেয়ে। তারা এখানে মাঝে মাঝে খেলতে আসতো। বড়টা একটা লাঠি দিয়ে আমাকে বাড়ি দিতো আর ছোটটা তখন হাসি আটকানোর চেষ্টা করতো।

বেশীদিন লাগেনি যখন রক্ত ঝরেছিলো।

একদিন তারা আমাকে ঘোড়ার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো। আমি দলামোচা হয়ে গেলাম যখন ঘোড়া ঝেড়ে দৌড় লাগালো। এরপর থেকে আমার চেহারা আর আগের মতো ছিলোনা। দুই ভাই পালিয়ে গেলো আর ভাব দেখাতে লাগলো যে তারা এই বিষয়ে কিছুই জানে না।

আমার মুখমন্ডল হতে বেশ বড় একটা অংশ গায়েব হয়ে গেলো। আমি লাল মাংসের দলা চেছে তুলে আস্তাবল থেকে বের হয়ে এলাম। বাড়ীর মূল অংশে যেয়ে আন্টিকে খুঁজলাম সাহায্যের জন্য। বাইরে ছিলো প্রচুর আলো আর তাজা বাতাস গোবরের গন্ধের রেশটুকুও উড়িয়ে নিয়ে গেলো। ঘাসের লন ছিলো সবুজ সমুদ্রের মতো। যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম আমার মুখ থেকে তরল ঝরে পড়ছিল।

আমার আন্টি তাঁর ঘরে মুরগী আর কুকুর রাখতেন, সেগুলো তখন উঠানে আরাম করছিলো। আমি দরজায় টোকা দিলাম কিন্তু কোন আওয়াজ করিনি, আর আমার মুখ থেকে যা খসে পড়েছিলো তা শক্ত করে হাতে ধরে রাখলাম।

আন্টি বের হলেন। চীৎকার দিলেন। উনি চাননি উনার বাড়ীর আশেপাশে আমি থাকি।

‘এখন বাড়ীতে মেহমান আছে’ উনি বললেন।‘তুই আস্তাবলে যাতো! তোকে দেখলে অবশ্যই উনাদের ঘেন্না লাগবে’।

উনি দূর দূর করে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। রাত নেমে এলো। ঘোড়ার খাওয়ার পানি দিয়ে ক্ষত ধুয়ে নিলাম। কুয়ার পরিস্কার পানি ব্যবহারের অনুমতি ছিলোনা। বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারালাম, ঘুমালাম। ক্ষুধা তাড়ালাম ঘোড়ার গামলার খাবার খেয়ে।

আমার আন্টি খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ এনে দিতেন তো উনি ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে বললেন ‘এ কী! এখনো বেঁচে আছিস দেখছি! তুই নিশ্চিত ভাবেই শক্ত কিছু দিয়ে তৈরি’।

আমি পুরো মাস কাটালাম সতর্ক ভাবে যেন মুখে কোন কিছুর ছোঁয়া না লাগে। ব্যথা স্থায়ী ছিলো প্রায় অর্ধেক বছর । আমার মুখের টুকরাটা অনেকদিন সাথে রেখেছিলাম। সেটা সময়ের সাথে পঁচে, কালো হয়ে গন্ধ ছড়ালো। আস্তাবলের দেয়াল ছিলো পাথরের। পাথরগুলো মুখের মতো দেখতে। আর মাংসের টুকরাটা পাথরে চেপে ধরে কল্পনার ফানুস উড়াতাম। আমার গর্ত হওয়া, বিকৃত মুখ থেকে পুঁজ চোয়ানো একসময় বন্ধ হলো।

                                 

আন্টির বাড়ীতে থাকা লাল চুলের ছোট্ট মেয়েটি প্রায়ই আস্তাবলে এসে আমার সাথে গল্প করতো। আন্টি বা কাজিনদের মতো ও কখনো আমাকে মার দেয়নি। ও আমার জন্য লুকিয়ে বই নিয়ে আসতো আর ওর দয়াশীল সহায়তায় আমি পড়তে শিখে গেলাম। আমি খুব দ্রুত মুখস্থ করতে পারতাম। আমার শেখার দ্রুততায় মেয়েটি খুব অবাক হতো। আস্তাবলে রাতে কোন আলোর ব্যবস্থা ছিলোনা। তাই দিনের বেলা দেয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় পড়তে হতো। লাল চুলের মেয়েটি আমাকে সংখ্যা চিনিয়েছে, আরো শিখেছি অংক, এমনকি জটিল হিসাব নিকাশের সমাধান ওর থেকেও ভালো পারতাম। ‘সত্যিই তুমি খুব স্মার্ট!’ সে বলতো।

একদিন হঠাৎ আন্টি আস্তাবলে চলে এলেন আর আমি বইটা খড়ের নীচে লুকানোর সময়ই পেলাম না। উনি বই হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন বই খুব দামী জিনিস এবং এটা আমার ছোঁয়া একদম অনুচিৎ। তারপর উনি একটা লাঠি নিয়ে আমাকে আচ্ছামতো পেটাতে থাকলেন। উনি ভেবে পেলেন না বই কোথা থেকে এলো!

‘আম্মু থামো’! চেঁচিয়ে উঠলো লাল চুলের মেয়েটি। ঐ মুহুর্তে সে ভিতরে ঢুকছিলো। ‘তুমি জানো এই ছেলেটা কতো স্মার্ট? এমনকি আমার ভাইদের থেকেও বেশী’? আন্টি মোটেও সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না। সেটা প্রমাণ করার জন্য মেয়েটির নির্দেশে বাইবেলের একটি স্তবক মুখস্থ বললাম। ‘তো হইছেটা কি’? বলে আন্টি রাগের চোটে লাফাতে লাফাতে পিছলে পড়লেন গোবরের গাদায়।

                                  *

আমরা সবাই বেড়ে উঠলাম। দুই ভাই শিকারে ঘোড়া নিয়ে যাওয়ার সময় ছাড়া আস্তাবলে আসতো না। লাল-চুলো মেয়েটি চলে গেলো বোর্ডিং স্কুলে। তাই তাকেও আর পাওয়া গেলো না আশেপাশে। এমনকি আন্টি উচ্ছিষ্ট খাবারও দেয়া বন্ধ করে দিলেন। আংকেল উনার জমিজমা আস্তে আস্তে বিক্রী করে দিচ্ছিলেন।

আমি আস্তাবলের কোনায় থাকি, মানুষ ভুলে গিয়েছে আমাকে। বছর বছর খড়ের নীচে লুকিয়ে থেকেছি। আমার ধারণা লোকজন ভেবেছে আমি দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়েছি। তবুও রাতে আস্তাবলের গোবর সাফ করতাম, কারো আওয়াজ পেলে লুকিয়ে যেতাম। দেয়ালের পাথরগুলো মানুষের চেহারার কথা মনে করিয়ে দিতো। আমি তখনো দেখতে পেতাম হাত আর পা। সেগুলো দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম। মাঝরাতে উঠে যে গর্তে উদ্বৃত্ত খাবার ফেলা হতো সে খানে হামাগুড়ি দিয়ে খেতে যেতাম। এক রাতে আন্টি আমাকে দেখে ফেললেন। ‘তুই এখনো আছিস এখানে?’ বলে অল্প কিছু টাকা আবর্জনায় ছুড়ে দিলেন। ‘এটা নিয়ে এখান থেকে দূর হ’।

শহরে চলে গেলাম। উঁচু উঁচু দালান, অনেক মানুষজন। যাদের সাথেই চোখাচোখি হলো চমকে উঠলো আমার বিকৃত চেহারা দেখে। কেউ অপলক তাকিয়ে রইলো, কেউ চোখ সরিয়ে নিলো। আন্টির টাকাগুলো সামনের পকেটে রাখলাম। একদিন অলিগলিতে হাঁটছিলাম কিছু লোক আমার দিকে এগিয়ে এলো। তারপর আমার সাথে ভয়ঙ্কর কিছু জিনিস করা হলো আর আমি বুঝে গেলাম শহর এড়িয়ে থাকতে হবে। চিহ্নবিহীন রাস্তাগুলোয় হাঁটা শুরু করলাম আর পথ হারিয়ে ফেললাম। অনেক বছর ধরে শুধু হেঁটেছি।

বহু সময় পার করে শেষমেষ জঙ্গলে ঢুকলাম নতুন করে জীবন শুরুর আশায়। মানুষজন থেকে নিজেকে আলাদা রাখি কারণ দেখেছি মানুষের সাথে সাক্ষাত হলেই ভয়াবহ সব ব্যাপার ঘটে যায়। আমি জানতাম যে আমার একটা ঘর তৈরী করা দরকার। ঘোড়ার আস্তাবলের সেই পাথরের দেয়ালের কথা মনে ছিলো। মনে হলো ঐরকমের একটা কিছু বানাতে হবে। আমি মুখ, অথবা হাত-পায়ের সাথে মেলে এরকম পাথরের খোঁজে পুরো জঙ্গল চষে ফেললাম। পাথর তেমন নেই। যতোই ঘুরি খালি গাছ আর গাছ। মাটিতে পঁচে যাওয়া পাতার পুরু স্তর হয়ে আছে।

একদিন পাথরের সন্ধানে থাকার সময় দেখলাম একটি কমবয়ষ্ক লোক পাহাড়ী পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। আমি ভাবতাম সব মানুষই ভয়ঙ্কর কিসিমের তাই ঠিক করলাম আমার উচিৎ লোকটাকে মেরে ফেলা। তো সেটাই করলাম। ওকে খুন করলাম। তার চেহারা কেমন চেনা মনে হলো। হ্যাঁ, আস্তাবলের দেয়ালের একটা পাথরের সাথে মিল ছিলো। আমি তার লাশ বহন করে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে গেলাম। আমি আমার ঘর বানানোর জিনিস পেয়ে গিয়েছি।

                                

আমি আমার মৃতদেহের ঘর তৈরী করলাম। লাশগুলো সুন্দর গুছিয়ে স্তুপ করে দেয়াল বানালাম। লাশ সংগ্রহের জন্য আমাকে জঙ্গল ছেড়ে বের হতে হতো।

এক মহিলা, বুকের কাছে কাপড়ের ব্যাগ ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। আমি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম। আমার সামনে চলে গেলে ঝোপ থেকে বের হয়ে পিছু নিলাম। পায়ের আওয়াজ পেয়ে সে ফিরে তাকালো। তার চিৎকারে অনেক জোর ছিলো। আমি আমার হাত দিয়ে তার গলা প্যাঁচিয়ে ধরলাম। সে হাত থেকে ব্যাগটা ফেলে দিলো। ভেতরের জিনিস সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। ছিলো শাক-সবজী। একটা আলু গড়িয়ে এসে আমার পায়ের আঙ্গুলে গুঁতা মারলো।

তার ঘাড় ভাঙ্গাটা ছিলো সহজ বিষয়। ভাঙ্গার সাথে সাথে তার গলার আওয়াজ মিলিয়ে গেলো। সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিলো। এমনকি মৃত্যুর পরেও তার দৃষ্টি আমার মুখের গর্তের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিলো। পরে তার ঠান্ডা দেহটি ঘরের ভিত্তিপ্রস্তরের অংশ হলো। সেটাকে  জঙ্গলের পঁচা পাতার স্তরের উপর শুইয়ে দিলাম এবং পরবর্তীতে এটা দেয়ালের লাশের স্তুপের সহযোগী হলো।

এক লোক ফল বোঝাই লেবেল দেওয়া কাঠের বাক্স ঠেলাগাড়ী করে নিয়ে ছোট্ট কাঠের ব্রীজ পার হচ্ছিলো। ব্রীজের নীচে লুকিয়ে ছিলাম। লাফ দিয়ে কোন শব্দ না করে ঠেলাগাড়ীতে উঠে পড়লাম। প্রথমে সে বুঝতে পারেনি, পরে গাড়ী কেনো হঠাৎ ভারী হয়ে গেলো দেখতে গেলো আর আমি হাতে থাকা পাথর দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দুই ভাগ করে ফেললাম, সে চেঁচানোর সময়টাও পায়নি। তাকে ঠেলায় তুলে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে গেলাম। অগণিত অন্য লাশগুলোর সাথে জড়ো করলাম। মৃত লোকটি আমার ঘরের দেয়ালের অংশ হয়ে গেলো। তার প্রাণহীন দেহটি ছিলো আমার ঘর তৈরীর কাঁচামাল।

আমার ঘর তৈরীর জিনিস বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করতাম। ঝামেলা কমাতে জঙ্গল থেকে বেশ দূরের গ্রাম গুলোতে জিনিসগুলো রাখতাম। মানুষ মেরে তাদের একটা জায়গায় জড়ো করতাম। এরপর পর্যাপ্ত পরিমাণে হলে ঠেলাগাড়ীতে ভরে খড় দিয়ে ঢেকে রাতের গভীরে জঙ্গলে নিয়ে আসতাম।

এক রাতে ঠেলাগাড়ী ভর্তি উপকরণ নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিলাম। এসময় পিছন থেকে আওয়াজ এলো ‘এই থামো!’ এতো রাতে এখানে ঘুরাঘুরি করছো যে? লোকজন বলছে এক কিডন্যাপারের উদয় হয়েছে!’ বয়ষ্ক লোকটার হাতে ইলেকট্রিক ল্যাম্প। সে এগিয়ে এসে গাড়ীর কোনায় হাত দিয়ে দিয়ে খড়ের দিকে তাকিয়ে বললো ‘কিডন্যাপারটা পাশের গ্রামটাতে গিয়েছিলো, হারানো মানুষগুলোর কি হয়েছে জানে না কেউ! আমার নাতিরা বলে ওদের খেয়ে ফেলা হয়েছে!’ এক মহিলার সাদা গোড়ালির অংশ খড়ের নীচ থেকে বের হয়ে ছিলো। লোকটার নজর ওখানে গেলো। সে নীচু হয়ে ওটা ছুঁতে গেলো। ঠান্ডা মৃতদেহের শীতলতা অনূভব করে সে চমকে উঠলো। আমি গলা টিপে মেরে তাকে ঠেলায় ভরে নিলাম।

                                  *

নীরব জঙ্গল। বছরের ঠান্ডা সময় তখন। পাতাগুলো রং হারিয়েছে আর বেশীরভাগই গাছ থেকে পড়ে গিয়েছে। আমি চারকোনা বাক্স আকৃতিরর সাধারণ একটি ঘর বানালাম। দেয়াল তৈরী করলাম লাশের স্তুপ সাজিয়ে যাদের মধ্যে কোন ফাঁকফোকর নেই। কিছু ছিলো পুরুষ কিছু মহিলা। কেউ গ্রামবাসী, কেউ পরিব্রাজক। ওদের জঙ্গলে নিয়ে পোষাক খুলে ফেলতাম। সকলেই ছিলো নগ্ন এবং একদম সাদা।

দেহগুলোকে দেয়ালে আঁটানোর জন্য কেউ শুয়ে ছিলো, কেউ বসে। কেউ হাটু জড়িয়ে বসা আবার কারো হাত আরেকজনের গলায় প্যাঁচানো। দেয়ালগুলো পাতলা ছিলো না। এক মানুষ সমান পুরু হলে সেটা দূর্বল দেয়াল হতো তাই কয়েক মানুষ সমান পুরুত্বের বানালাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মজবুত করতে গাছের ডাল ব্যবহার করতে হলো। ঘর প্রায় শেষ হওয়ার পথে। জিনিসের ঘাটতি হলে আরো যোগার করতাম। দেয়ালগুলো যথেষ্ট উঁচু ছিলো। উপকরণ সাদা তাই ঘরটাও হলো সাদা।

তখনো শীত বজায় ছিলো। অর্ধসমাপ্ত দেয়ালে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাতাম। মানুষগুলোর বহন করা ব্যাগের খাবার খেতাম। যখন স্তুপ করা মানুষ দিয়ে গড়া দেয়াল শেষ হলো তখন সময় হলো ছাদ বানানোর। বড় বড় গাছের ডাল বিছিয়ে তার উপর আরো লাশ শুইয়ে দিলাম। বরফ ঢোকা বন্ধ হলো। ঘর বানানো শেষ হয়ে গেলো। নীরব জঙ্গলে একটি ছোট সাদা ঘর। লাশগুলোর চামড়া ছিলো শীতল, ভয় ধরানো সাদা। যখন জোৎস্নায় ভেসে যেতো ঘরটি, চকমক করতো চুমকি বসানো ওড়নার মতো।

দেয়ালের গোড়ার শরীরগুলি উপরের লাশগুলির ওজনের ভারে ধীরে ধীরে পঁচা পাতার স্তুপে ডেবে যাচ্ছিলো। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জন্য ঘরটি বেশ বড়ই ছিলো। সহজ সাধারণ কাঠামো। শুধু একটা ছাদ, চার দেয়াল আর একটি প্রবেশদ্বার। বাতাস ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট।

আমি ভিতরে ঢুকলাম, হাঁটু জড়িয়ে বসলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। আমার চারপাশে শুধু মুখ। দেয়াল তৈরী করা মানব দেহগুলো সব ঠেসে চাপা এক ধরণের জটিল বাঁকাচোরা অবস্থায় আছে। মানুষগুলোর হাত-পা এমন ভাবে প্যাঁচানো দেখে মনে হতো অনেকগুলো সাপ এক জায়গায় পাক খাচ্ছে। সবার চোখ খোলা আর আমাকে দেখছে। ঠিক সেই ঘোড়ার আস্তাবলের মতো। এক মহিলার লম্বা চুল ঝুলে নীচের কিছু মুখ ঢেকে ফেলেছে। এই ঘরে আমি থাকতাম। চুপচাপ শান্ত জীবন। এই জঙ্গলে এমনকি একটা পাখিও ছিলো না। শুধু ছিলো এই সাদা ঘরটি। তাদের সবার চোখ খোলা, আমাকে দেখছে।

হাঁটু জড়িয়ে কুঁজো হয়ে ঘুমাতাম। মাঝে মাঝে আন্টির বাড়ীর কথা মনে হতো। চোখ বন্ধ করলেই যেন ঘোড়ার আস্তাবলে চলে যেতাম। লাল-চুলো ছোট মেয়েটাকে মনে পড়তো। চিন্তা করতাম যে বাড়ীটায় আমার বাবা-মায়ের সাথে থাকতাম সেটার কথা।

আমরা খুব একটা ধনী পরিবার ছিলাম না। শীতকালে বাবা ঠান্ডায় জমে শক্ত হয়ে যাওয়া মাঠে নিড়ানি দিতেন, মাও হাত লাল না হওয়া পর্যন্ত সাহায্য করতেন। এক বৃষ্টির দিনে উনারা এক প্রাণঘাতী দূর্ঘটনার শিকার হলেন। ছুটে যাওয়া ঘোড়ার গাড়ীর নীচে চাপা পড়েছিলেন। আমাকে সেটাই বলা হয়েছিলো।

তো এরপর আন্টি আমাকে নিলেন আর উনার আস্তাবলে জায়গা দিলেন। মূল বাড়ীতে যাওয়ার অনুমোদন ছিলোনা। এর ফলে আমার গায়ে সবসময় গোবরের গন্ধ থাকতো। আস্তাবলের নীচের অংশ ছিলো জড়ো করা পাথর দিয়ে বানানো যেগুলো ছিলো মানুষের মুখের মতো দেখতে। ঘরটিতে বসবাসের কিছুদিন পর একটি মেয়ে আমার সাথে সাক্ষাত করতে এলো।

                                

তখন আমি ঘরেই। চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। ঝরা পাতার উপর পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝলাম কেউ একজন জঙ্গলের গভীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই ঘরটার সন্ধানে। ধূসর আকাশ থেকে সূর্যের ক্ষীণ রশ্মি আমার ছোট ঘরের প্রবেশ পথে পড়ছিলো। একটি ছোট ছায়া পথটি ঢেকে ফেললো। মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করলাম কে হতে পারে! মেয়েটি দরজার কোনা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়েছিলো। বাচ্চা একটি মেয়ে। তার চেহারা জুরে ভয়, এবং তার পরনে ঘন নীল, প্রায় কালচে রঙ্গের জামা, তার গায়ের চামড়া ছিলো অসুস্থ সাদাটে মতো, ঠোঁট দুটো নীল। ঠান্ডা অথবা ক্ষুধার কারণে না, ভয়ে নীল।

‘তুমি এখানে থাকো?’ সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো। তার হাত দুটো বুকের কাছে শক্ত করে ভাঁজ করা। মাথা নোয়ানো। ‘তোমার ঘর মানুষ দিয়ে বানানো!’ সে আমার ছোট ঘরের ভিতরে হেঁটে হেঁটে দেখলো। আমি তার পাশে পাশে ঘুরছিলাম। সে ঘুরে আমার দিকে তাকালো। চোখে অবাক দৃষ্টি ফুটে উঠলো। ‘তোমার মুখে একটা গর্ত!’ তাকে চিন্তিত দেখালো যখন সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। ‘কতো বড় গর্ত! এতো বড় যে পাখি বাসা বানাতে পারবে। এতো গভীর আর অন্ধকার যে আমি ঠিকমতো দেখতেই পারছিনা!’

আমার মুখের গর্ত নিয়ে তাকে সত্যিই খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিলো। ‘তুমিই কি সবাইকে নিয়ে এসেছো?’ তার উত্তেজনা দেখে মনে হলো যেকোন সময় জ্ঞান হারাবে। ‘আমি সবসময় ভেবেছি, যে লোক আমার আমার ভাইকে নিয়েছে সে এই জঙ্গলের গভীরেই আছে। আমার ভাইকে ফেরত দাও! আমি এখানে এসেছি আমার ভাইয়ের খোঁজে’। মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে যখন সে দেয়ালের শরীরগুলির দিকে তাকিয়ে ছিলো। ঠান্ডা জঙ্গলে, সূর্যের হালকা আলোয় সাদা মৃতদেহগুলো প্রায় জ্বলজ্বল করছিলো। ‘আমি জানি আমার ভাই এখানেই আছে। সে খুব স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম’।

সেই হ্যান্ডসাম, স্মার্ট দেখতে ছেলেটা ভিতরের দেয়ালের অংশ ছিলো। সে তার মাথা দিয়ে উপরের দেহগুলি ধরে রেখেছিলো। মেয়েটাকে ডেকে দেখালাম। সে যখন তার দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়ের চেহারা দেখলো নাম ধরে ডেকে উঠলো। ভাইয়ের কাঁধ ধরে দেয়াল থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করলো। তাকে থামাতে হলো। ছেলেটি ছাড়া আমার লাশের ঘরটি হেলে পড়ে যাবে।

‘কিন্তু আমার ভাইকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে’। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো। ‘আমার আব্বু ভাইকে আমার চেয়ে বেশী পছন্দ করেন। উনি সবসময় আমাকে মারেন। এবং চেহারা সবসময় ভয়ানক করে রাখেন। ভাইয়া নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আব্বুর খুব মন খারাপ। উনি আম্মু আর ভাইয়ার সাথে বসে খাবার খেতে ভালোবাসেন। এখন আমার আম্মু বিদেশে কাজ করছেন। আম্মু ফিরে আসার আগেই আমি আমার ভাইকে বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাই। প্লিজ, প্লিজ, আমার ভাইকে আমার কাছে ফেরত দাও!’ সে শুকনা পাতাগুলার উপর হাঁটু গেড়ে বসে মিনতি করছিলো। তাকে আমার প্রত্যাখান করতে হলো কারণ ওর ভাই ছাড়া আমার ঘর পড়ে যাবে। তার চোখ ভর্তি পানি। সে আমাকে বললো ‘আমাকে ওর জায়গা নিতে দাও’।

তো ছেলেটির দেহ সরালাম। সে দ্রুত ওর ভাইয়ের জায়গাটিতে চেপে দাঁড়িয়ে গেলো। তখনও শক্ত হয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকা ছেলেটির শরীর উল্টে পড়ে গেলো। মেয়েটি তার কালচে নীল জামা নিয়ে ভাইয়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো এবং সেটা ছিলো পুরো সাদা দেয়ালের একমাত্র রঙ্গীন অংশ।

‘প্লিজ আমার ভাইকে বাড়ীতে দিয়ে আসো’। ব্যাথাতুর কন্ঠে সে তার বাড়ী যাওয়ার রাস্তা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো। খুব সহজেই মনে রাখতে পারলাম। ‘তুমি তো খুব দ্রুত শেখো!’ মৃতদেহের দেয়ালে চেপে থাকা মেয়েটির চেহারায় বিষ্ময়।

ছেলেটির শরীর নিয়ে বের হয়ে এমন ভাব দেখালাম যেন তার বাড়ির দিকে যাচ্ছি। আসলে কয়েক পা যেয়ে লাশটি ফেলে দিয়েছিলাম। ওটার পাশে হাঁটু আঁকড়ে বসে দরজার দিকে নজর রাখলাম। ছেলেটির লাশ বাড়ীতে নেওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলোনা। নিশ্চিত ছিলাম আমি চলে যাওয়া মাত্রই মেয়েটি দেয়াল থেকে পালাবার ধান্ধা করবে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু সে বের হলোনা। সারাদিন চলে গেলো। সেই সময়টুকুতে ওর বাড়ী যেয়ে ফিরে আসা যাবে। তাই আমার ঘরে ঢুকে ভান করলাম ওর ভাইকে বাড়ীতে দিয়ে এসেছি। সে তখনও দেয়ালেই দাঁড়িয়ে। এক ইঞ্চিও নড়েনি। ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আব্বু খুব খুশী হবেন। আম্মুও বিদেশ থেকে ফিরে এসে আর কষ্ট পাবেন না’। চোখে খুশীর অশ্রু নিয়ে বললো সে। সাদা মৃতদেহ ভর্তি দেয়ালের চিপায় সে লম্বা দাঁড়িয়ে রইলো সাহায্যকারী হয়ে।

                                  

তো এইভাবে মেয়েটির সাথে আমার জীবন শুরু হলো। সে কথা বলতে পছন্দ করতো। তার গলার আওয়াজে ছোট ঘরটি ভরে যেতো। দিন যেতে লাগলো আর দেয়ালের গোড়ার শরীরগুলি আকৃতি হারাতে লাগলো। শুরুর দিকে সে খুব নম্র ভাবে কথা বলতো। সময়ের পার হওয়ার সাথে সে হাসতে শুরু করলো। ঠান্ডা, সাদা ছোট ঘরে, নীরব জঙ্গলে তার হাসি সূর্যের আলোর মতো ছিলো।

‘আচ্ছা বলোতো তোমার মুখে গর্ত হলো কিভাবে?’ বললাম। ‘ইশ কি দুঃখজনক’ ফুঁপিয়ে বললো সে। তার বাবা তাকে পিটাতো, সে ঘোড়ার আস্তাবলে পালিয়ে থাকতো। গোবরের গন্ধের কথা মনে করে সে মুখ বাঁকালো। ‘এই ঘরের গন্ধও খুব তীব্র তবে আস্তাবলের মতো না’।

তো আমার পড়া গল্প শুনিয়ে আমরা সময় কাটাতাম। সেই সময়গুলো অদ্ভুত ছিলো। তার আগ পর্য্ন্ত আমি একা ছিলাম, সারি সারি খোলা চোখের মুখের মাঝে হাঁটু জড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিলো না। আগে যে ভয় লাগতো সেটা মিলিয়ে গেলো। নিঃশব্দে, শান্তির সাথে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।

                                

সে সোজা দাঁড়িয়ে ঘুমাতো। কিছুদিন পর তার কথা বলা আস্তে আস্তে কমে গেলো। তার মুখ সাদা হতে লাগলো এবং শেষমেষ আশেপাশের মৃতদেহের মতোই হয়ে গেলো। আমার মনে হলো সে ঠান্ডায় অথবা ক্ষুধায় মারা যাবে। ‘একটা গল্প বলো’ বলতো সে। যতটুকু মনে ছিলো বলতাম। অবশেষে ওর চোখের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো, বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। চেহারায় লেগে রইলো নম্র হাসির ছোঁয়া।

তার আকৃতি ছোট হয়ে গেলো। আমি জানতাম মাথার উপরের লাশের ভারের চোটে সে চ্যাপটা হয়ে যাবে। তার চেহারা ঠান্ডা, সাদা হয়ে গেলো। তার ঘন নীল জামাটি ছিলো ঘরের একমাত্র রং। হাঁটু জড়িয়ে ঘরের মাঝখানে স্থির বসে রইলাম। কথা বলার মতো কেউ না থাকায়, কিছু বলার আর দরকার হলো না। ঘরটি আবার আগের মতো নীরব হয়ে গেলো। অনুশোচনা জাগলো। উঠে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ওর বাড়িতে যাবো। তার প্রতি করা প্রতিজ্ঞা আমি রাখিনি। ছেলেটি তখনও ঘরের কাছেই পড়ে ছিলো। সূর্যের আলোয় পঁচে গলে গিয়েছিলো। যখন তাকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম সে খসে যেতে লাগলো। আমি মেয়েটিকেও বাড়ী নিতে চাইলাম কারণ সে তার বাবা-মাকে গভীর ভাবে ভালোবাসতো।

মেয়েটিকে দেয়াল থেকে টেনে বের করার সময় কোন দ্বিধা বোধ করিনি। তার কাঁধ ধরে টান দিলাম। ঘরটা হেলে যেতে লাগলো। তার প্রাণহীন দেহ নিয়ে বের হওয়া মাত্রই আমার সাদা লাশ ভর্তি ঘর গাদাগাদি হয়ে পড়ে রইলো। বাঁকাচোরা শরীর গুলো আর মানুষ হিসেবে চেনার উপযোগী ছিলোনা। তারা এখন বিশাল আবজর্নার স্তুপ মাত্র। নীরব, ঠান্ডা, জঙ্গলের গভীরে যেখানে অন্তহীন সারি সারি গাছের গোড়া, সেখানে ছিলো একটি মাংসের পাহাড়। ফলের লেবেল লাগানো বাক্সে মেয়েটিকে ঢুকালাম। তার কোঁচকানো শরীরের ফাঁকে তার ভাইয়ের গলে যাওয়া শরীরও ভালোমতো এঁটে গেলো। ঢাকনা লাগিয়ে বাক্স তুলে ওদের বাড়ীর দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

গন্তব্যে পৌঁছাতে দিনের অর্ধেকটা লেগে গেলো। বাড়ীটা একটা ছোট গ্রামের পাহাড়ের মাথায় ছিলো। দরজায় টোকা দিলাম কিন্তু কেউ ছিলোনা সেখানে। দোরগোড়ায় দুই শিশুর দেহভর্তি বাক্স নামিয়ে রেখে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরলাম। দেখলাম এক মহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, হাতে বড় ব্যাগ। আমি নিশ্চিত ছিলাম মেয়েটির মা বিদেশ থেকে বাড়ী ফিরেছে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করলাম।

সে কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। সারা চেহারা জুরে হাসি। ‘ওহ! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ’। সে হাত দিয়ে আমার কাঁধ ধরলো। ‘তুমি বেঁচে আছো! তোমার মুখ ঘোড়ার লাথি খাওয়ার পর যেমন ছিলো ঠিক তেমনই আছে। এতগুলা বছর তোমাকে নিয়ে আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম’। যদিও তার বয়স বেড়েছে, চুলগুলো তখনও লাল ছিলো।

‘ঠিক আছে, তুমি এখানে আবার কাজ শুরু করবে। আমি অনেকদিন বাইরে থেকে মাত্রই ফিরলাম। বাচ্চাগুলোকে দেখার তর সইছে না আর’। সে দরজার কাছে রাখা বাক্সের দিকে তাকালো। নীচু হয়ে ঢাকনা খুলতে গেলে আমি তাকে বিরত করলাম। ‘কিসের গন্ধ ওটা? এই ফলগুলি মনে হয় পঁচে গিয়েছে। তুমি কি এটা পিছনের গোবরের গাদায় নিয়ে যেতে পারবে?’

আমি ওটা তুলে আস্তাবলের পিছনে রাখা গোবরের গাদার দিকে হাঁটা দিলাম। আমি গোবরের টিলাটি দেখতে পেলাম। ঠিক সেই ছোটবেলার মতোই। ছেলে আর মেয়েটাকে ঘোড়ার গোবরের নীচে পুঁতে দিলাম। আস্তাবলে ঢুকলাম। এটা সবসয় যেমন ছিলো ঠিক তেমনটাই আছে। আমি দেয়ালের কাছে গেলাম এবং শরীর কুঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

                                  

 

                                           

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত