| 29 মার্চ 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

আমাদের ছোটবেলা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আমাদের ছোটবেলার  দিনগুলো জাঁকজমকে ঠাসা  রূপকথার মত ছিল না। ভীষণই  সাদা- মাটা ছিল সেই দিনগুলো। সকাল হত মায়ের ডাকে। ছুটতে হতো স্কুলে। বিকেলে একটু খেলা-ধুলো। রাতে পড়া-শোনা আর খাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। এইতো ছিল সেই রুটিন বাঁধা জীবন। তবে এটা সত্যি, সব শিশুদের মত আমিও আমার ছোটবেলাকে  বড্ড ভালবাসি। ইচ্ছে হয় একছুটে চলে যাই সেই হারানো সময়ে, ছোটবেলার অপার মুগ্ধতার মাঝে। খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের। প্রকৃতির   নরম ছোঁয়ার মাঝে হারাতে চায়  মন।

ছোটবেলার কথা মনে হলেই সেই ছোট্ট শহরটিকে মনে পড়ে যেখানে আমরা থাকতাম। সেই শহরটি কেমন ছিল আজ বলে বোঝান বড্ড কঠিন, কারণ তেমন শহরের দেখা এখন  আর মেলে না। সেখানে ছিল না এত কোলাহল  কিংবা  মানুষের ভিড়। টুং  টাং শব্দে একটা দু’ টো রিকশা চলত।  হঠাৎ  কোনদিন একটা মোটর সাইকেলের দেখা মিললে হইচই পড়ে যেত। পেট্রলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে পাড়ার সব কচি- কাঁচা মিলে ছুটতাম তার পেছন পেছন। আমাদের সেই শহরে ছিল না কোন বাস, প্রাইভেট কার কিংবা টেম্পু। আশে- পাশের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে চলত  ছোট ছোট লঞ্চ। সপ্তায় একদিন সকালে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এসে থামত স্টিমার। পেটমোটা সেই স্টিমারে চেপে আমরা  বেড়াতে  যেতাম বড় জেলা শহরে। অনেকে যেত আরও দুরে। ঠিক কোথায় আমরা কেউ জানতাম না।

আমাদের না জানার বহরটি ছিল বেশ বড়। আমরা জানতাম না প্লেন কী করে আকাশে ওড়ে, কোথায় নামে। জানতাম না, কম্পিউটার কি জিনিস।  জানতাম না ফাস্ট ফুড খেতে কেমন লাগে। কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, ভাত না খেয়ে মানুষ কী করে বাঁচতে পারে। আমাদের জানা ছিল না গোলাপি মেয়েদের আর নীল ছেলেদের রঙ।
আমাদের হাতে কোন ট্যাব ছিল না । ছিল না মোবাইল। টেলিভিশন তখনো আসেনি সব বাড়িতে। তাই এত কিছু জানা বেশ কঠিনই ছিল। কিন্তু এসব নিয়ে আমরা সবাই মিলে ভাবতাম। গল্পের বইয়ে পড়া ভিনদেশী শহরগুলোর সাদা সাদা মানুষ আর রোবট দেখার জন্য আমাদের মন উতলা হত । বড় হয়ে আমরা কে কোথায় যাব, কী কী দেখব আর খাব-ডায়রিতে এ সবের লিস্ট করে সযত্নে লুকিয়ে রাখতাম। কখনো-সখনো সেসব লেখা পরিবারের বড়দের চোখে পড়লে তুমুল হাসির রোল উঠত। লজ্জা পেয়ে  লুকোতে গিয়ে পাশের বাড়ির  লুডু কিংবা ক্যারাম খেলার আসরে সটান ঢুকে যেতাম আমরা। কেউ বাঁধা দিত না। সব বাড়ির দরজা ছোটদের জন্যে সবসময় খোলা থাকত। ছোটবেলার আমাদের তাই নির্দিষ্ট কোন বাড়ি ছিল না। সবার  বাড়িকে নিজের বলে মনে হত। আমরা দেখতেও যেন একই রকম ছিলাম। একই রকমের দু’টো-তিনটে জামা, এক জোড়া  জুতো, একই রকম ঘরদোর, একই রকম জ্যামিতি বক্স-পেন্সিল,  মোটা সুতো দিয়ে বাঁধা সাদা কাগজের খাতা,  কয়েকটা মাটির খেলনা, একটা ফুটবল – এই ছিল আমাদের সম্বল।

কিন্তু সেই শহরে সবাই মিলে আমরা বেশ ছিলাম।   রাস্তার দু’ ধারে   কিছুটা  দূরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল  কাঠ আর টিনে মোড়া একতলা -দোতলা বাড়িগুলো।  তারই মাঝে  ছিল সবুজ ঘাসে ভরা  ফাঁকা  জায়গা । অথবা ঝোপ-ঝাড়  কিংবা  কলা আর নারকেল গাছের সারি।  ছিল মস্ত  এক খাল। শহর পেরিয়ে নদীর সাথে মিলেছিল সে। তাকে সাথে নিয়ে নদীটি  হারিয়ে গিয়েছিল একেবারে বঙ্গোপসাগরে। কত রকমের নৌকা চলত সেই খালে। বাহারি নাম তাদের। ছোট পানসি নৌকা, ছইয়ে মোড়া বড় নৌকা, বেদেদের নৌকা, ধান কাটতে যাওয়ার নৌকা, ব্যবসায়ীদের মস্ত বড় গয়নার নৌকা। আমরা খাল পাড়ে বসে দেখতাম নৌকার বাহারি পাল তির তির করে বাতাসে উড়ছে। শুনতাম মাঝিদের গান। আর দেখতাম ঝপাৎ ঝপাৎ করে ওপাড়ে কারা  যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে। চলছে দাপাদাপি , ডুব সাঁতারের খেলা। ছোট আমরা বাড়ির ঘাটে বসে জলে পা ডুবিয়ে এসব কাণ্ড দেখতে দেখতে অমন করে সাঁতার শিখব বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম। তারপর বড়দের তত্ত্বাবধানে চলত সাঁতার শেখার পালা। কখনো কলাগাছ জড়িয়ে ধরে, কখনো ফুটবল সাথে নিয়ে, ছোট কলসি কিংবা হাড়ি উলটো করে ধরে চলত জলে ভেসে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা। এভাবেই দাপাতে দাপাতে, চোখ লাল করে জলে ডুবতে ডুবতে,  আমাদের পাড়ার সব ছোটরা সাঁতার কাটা শিখে গিয়েছিল । কেউ কেউ হয়েছিল দুর্দান্ত সাঁতারু। নিমেষেই তারা পৌঁছে যেত খালের এপার থেকে ওপারে।

প্রায় শব্দহীন আমাদের সেই শহরে ঝম-ঝম শব্দে বৃষ্টি ঝরত। একদিন, দু’ দিন, তিন দিন, সাতদিন… বৃষ্টি ঝরেই চলত। সাদা সাদা খইয়ের মত বৃষ্টি। আমরা দল বেঁধে নেমে পড়তাম  বৃষ্টিতে ভিজতে। জলে ভাসা রাস্তায় কাগজের ছোট ছোট নৌকা ভাসাতাম। সে কী আনন্দ! তারপর একসময় ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসতাম বাইরে থেকে। দোতলা বাড়ির বারান্দায় বসে পা  ঝুলিয়ে একমনে বৃষ্টি দেখতাম। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতাম। দেখতাম ঝুম বৃষ্টিতে সামনের রাস্তা জনহীন। ওপারের বিশাল কৃষ্ণচূড়া  গাছের ছোট ছোট ডালগুলো ভেঙে পড়ার  ভয়ে সাঁই সাঁই দুলছে।  রাশি রাশি কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ছে। ভেজা জবু-থবু কাক আর শালিকের দল যেন বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়  আকাশের দিকে ঠায় তাকিয়ে আছে। এমন নাস্তানাবুদ বৃষ্টি শেষে একদিন বিকেলে নরম রোদ উঠত। তেজ কমে এসে থেমে থেমে  ঝরত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সন্ধ্যায় ছোটদের পড়ার সুরে গমগমিয়ে উঠত আমাদের পাড়া। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাঙ ডাকত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। দু’ একটা শেয়ালও  ডাকত দূরে কোথাও। সবকিছু ছাপিয়ে পাশের বাড়ির বাগানের হাস্না-হেনা আর দোলনচাঁপার গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়ত পুরো শহর জুড়ে। পরদিন সকালে দেখা মিলত ঝলমলে রোদের। বড়দের মুখে স্বস্তির হাসি ফুটত, আর ছোটদের মন ভার। আমরা আবার ঝমঝমে বৃষ্টি নামার অপেক্ষা থেকে দল বেঁধে স্কুলে ছুটতাম। যেতে যেতে রাস্তার পাশে ফুটে থাকা কদমের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম।  পাশে উড়ে চলা ফড়িং ধরতে চাইতাম হাত বাড়িয়ে। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে  চলত মহা হট্টগোল। লাঠি লজেন্স কিংবা নারকেল লাগান  আইসক্রিম মুখে পুড়ে  চলত দৌড়ঝাঁপ, কাবাডি আর  বউচি খেলা। পাশাপাশি  জানা -অজানা বিষয় নিয়ে গল্প, গান, আবৃত্তি । আমরা সবাই খুব শিগগির বড় হয়ে যেতে চাইতাম।  ভিনদেশের ডিজনিল্যান্ড দেখে  অজানা গ্রহে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখতাম।

বড় হতে হতে আমাদের  ছোটবেলার অজানা প্রায় সব কিছু জেনে ফেলেছি। স্বপ্নের প্লেনে চেপে যাওয়া হয়েছে অনেক দেশে। কিন্তু কী আশ্চর্য ! কোন কিছুতেই মন ভরে নি। সত্যি বলতে কি, সেই ঝুম বৃষ্টির শব্দ, শিশির ভেজা ঘাস, এক্কা -দোক্কা খেলা, ভেসে আসা রেডিওর গান, ভোররাতের চৌকিদারের হাঁক, ডাকপিয়নের চিঠি, বেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ, মচমচে ভাজা ইলিশ মাছ, পাশে থাকা  মানুষগুলোর মায়াময় স্পর্শ-এসবের  সাথে আমার আর দেখা হয়নি।   এখন আমি  আর কোথাও যেতে চাই না। আমার কেবলি যেতে ইচ্ছে করে আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শহরে। ফিরে পেতে ইচ্ছে করে  ছোটবেলার  সেই দিনগুলোকে। এখন আমি জানি, যেকোন মহার্ঘ জিনিসের চেয়ে  সেই  সাদা-মাটা দিনগুলো  দামি। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত