সাড়ে চুয়াত্তর মানে অভিশাপ

Reading Time: 3 minutes

সাড়ে চুয়াত্তর” নামে একটি শব্দ আছে। রাজস্থান এবং উত্তর ভারতে একটি প্রথা ছিলো একসময়; সেটি হচ্ছে, গোপনীয় চিঠির সামনে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সংখ্যাটি লিখে রাখা। যাতে চিঠির প্রাপক বাদে অন্য কেউ সেই চিঠি খুলে না পড়ে। অন্য কেউ সেই চিঠিটি খুলে পড়লে তার ভাগ্যে “সাড়ে চুয়াত্তর মণের অভিশাপ” নেমে আসবে। শুরুতে সম্ভবত যে কোনো গোপনীয় চিঠির জন্যই এই প্রথা চালু ছিল, পরে মূলত প্রেম পত্রের সামনে লেখা থাকত সাড়ে চুয়াত্তর। রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশ থেকে ক্রমশ এই প্রথাটি ছড়িয়ে পড়ে ভারতে এবং স্বাভাবিকভাবে অবিভক্ত বাংলাতেও। এবার দেখে নেওয়া যাক, কী সেই “সাড়ে চুয়াত্তর মণের অভিশাপ!”

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী। Photo Source: factsninfo.com


এই সাড়ে চুয়াত্তর মণের অভিশাপের অনেকগুলো করুণ কাহিনী আছে। তবে সবগুলো কাহিনীর মূল কথা— করুণ মৃত্যু। প্রথম কাহিনীর সময় আনুমানিক ১৩০৩ সাল, দিল্লীর সিংহাসনে তখন বসে আছে আলাউদ্দিন খিলজী। খিলজী চিতোর নগরি আক্রমণ করেছিলো। কেউ কেউ বলেন, চিতরের রাণী পদ্মিনীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে খিলজী এই কাজ করে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, পদ্মিনীর স্বামী চিতোরের রাজা রতন সিং তার গুণী সভাসদ বংশীবাদক রাঘব চেতনকে চুনকালি মাখিয়ে গাধার পিঠে তুলে রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছিলো। কারণ, রাঘব চেতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো গোপন তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে সে লোকজনের অনিষ্ঠ করছে। রাঘব সেই অপমানের মির্মম প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞা করলো। সে তখন খিলজীর সাথে হাত মেলালো। রাঘবের কাছে পদ্মিনীর রূপের কথা শুনে খিলজী মুগ্ধ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হল মেওয়ার রাজ্য অভিযানের। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু হলো মেওয়ারের রাজধানী চিতোর অভিমুখে। কিন্তু চিতোরের কাছে এসে বোঝা গেল, কাজটা যতটা সহজ হবে ভাবা হয়েছিলো আসলে ততটা সহজ নয়। ছোটখাট পাহাড়ের ওপর অবস্থিত ৭ম শতকে বানানো চিতোরগড়ের কেল্লা এক দূর্ভেদ্য দূর্গ, সেটা বাইরে থেকে আক্রমন করে ধ্বংস করা মোটামুটি অসম্ভব। তখন সুলতান আশ্রয় নিল এক কৌশলের। রাজা রতন সিং এর কাছে দূত পাঠানো হল। বলা হলে, সুলতানের দূর্গ দখল কিংবা রাজ্যদখলের কোন মতলব নেই; তিনি কেবল রানী পদ্মিনীকে বোনের মত দেখেন, তাকে এক পলক দেখেই চলে যাবেন। রতং সিং পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। একদিকে মান ইজ্জতের প্রশ্ন, অন্যদিকে সুলতানের বিশাল বাহিনীর হুমকি। চিতোরগড় দূর্ভেদ্য হলেও দূর্গ অবরোধ করে বসে থাকলে কোন না কোন সময় সরাসরি লড়াইয়ে যেতেই হবে, বিশাল সুলতানি বাহিনীর সাথে পারা সম্ভব নয়। তাই রাজাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হতে হল, এতে করে যদি প্রজাদের প্রাণরক্ষা করা যায়। এদিকে রাণী পদ্মিনী শর্ত দিলেন যে তিনি সরাসরি সুলতানকে দেখা দেবেন না, সুলতান আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখবেন।

পদ্মিনী প্যালেস। (১৮৪৬ সনে পূনঃনির্মিত)। শোনা যায়,  এ স্থানেই ঘটেছিল সেই জওহরের ঘটনা। Photo Source: sangbadpratidin.in


সুলতান আলাউদ্দিন এই শর্ত মেনে কিছু সংগীসাথী নিয়ে অতিথির বেশে কেল্লায় প্রবেশ করলেন। কথামত রাণী পদ্মিনীও তার মহলে আয়নায় দেখা দিলেন। সুলতান রাণীর রূপের বর্ণনা যা শুনে এসেছেন, বাস্তবের রাণী পদ্মিনী তার চাইতেও অনেক রূপবতী। একে ছাড়া কি চলে!

কেল্লা থেকে অতিথিদের বিদায় দিতে রাজা রতন সিং সৌজন্য বশতঃ সুলতানকে কিছু পথ এগিয়ে দিতে এলেন। সুলতান এটাকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে আচমকা রতন সিংকে বন্দী করে তার শিবিরে নিয়ে গেলেন। এরপর চিতোরগড় কেল্লায় খবর পাঠালেন, কাল সকালের মধ্যে রাণী পদ্মিনীকে তার শিবিরে পাঠিয়ে দিলে তিনি রাজা রতন সিংকে মুক্তি দেবেন এবং আর কারো কোন ক্ষতি না করে দিল্লী ফেরত যাবেন।

এরপর ঘটনাপ্রবাহ জটিল আকার ধারণ করলো এবং শুরু হলো যুদ্ধ। বিশাল সুলতানী বাহিনীর সাথে চিতোরের বাহিনী পেরে উঠলো না। সে সময়, রাজপুতানায় “জহর ব্রত” নামে নারীদের মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত ছিলো— যাতে কোন শহর বা দুর্গ দখল হবার আগেই শহরের নারীরা তাদের আত্মসম্মান রক্ষার জন্য আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করত। রাজ্যের পতনে নিজসহ প্রাসাদের নারীদের আত্মসম্মান রক্ষার্থেরাণী পদ্মিনী জহরব্রত করে মৃত্যুবরণ করল। সাথে কিছু সৈন্যও মৃত্যুবরণ করলো। এই আত্মহত্যা করা সৈন্য ও রাণীদের ছাইভষ্মের ওজন নাকি ছিল সাড়ে চুয়াত্তুর মন!

রাজপূত নারীদের জহর ব্রত পালন। Photo Source: en.wikipedia.org


দ্বিতীয় গল্পটি সম্রাট আকবরের সাথে যুক্ত। ১৫৬৮ সালে আকবর চিতোর দখল করার পর প্রমাণ হিসাবে তার সৈন্যরা অসংখ্য রাজপুত সৈন্যের মৃতদেহ থেকে সম্মানগ্রন্থি (যাকে আরবীতে জুনর বলে) খুলে নিয়ে এসে দেখায়। সেই সম্মানগ্রন্থির সম্মিলিত ওজন হয় সাড়ে চুয়াত্তর মণ। তৃতীয় গল্পটিও এই যুদ্ধের সাথে জড়িত। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দুর্গের ভিতরের নারীরা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই সূত্রেই রাজস্থান এবং উত্তর ভারতে গোপনীয় চিঠির সামনে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সংখ্যাটি লিখে রাখার প্রথা চালু হয়। মানে প্রাপক ছাড়া অন্য যে ব্যক্তি এই গোপনীয় চিঠিটি খুলে পড়বে তার ভাগ্যে ওই সাড়ে চুয়াত্তর মণের নির্মম অভিশাপ নেমে আসবে।

ধারণা করা যায়, এই তিনটি গল্পের মধ্য থেকে রাণী পদ্মিনী আর আলাউদ্দিন খিলজীর গল্পটি থেকেই সাড়ে চুয়াত্তর প্রথাটির উৎপত্তি হয়। পদ্মিনীর প্রতি আলাউদ্দিন খিলজীর গভীর আকর্ষণের স্মৃতি থেকেই হয়তো পরে শুধুমাত্র প্রেমের চিঠির উপরে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ লেখার নতুন প্রথা শুরু হয়।

.

তথ্যসূত্র:

  1. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল এবং প্রবীরেন্দ্র চ্যাটার্জির ফেসবুকের লেখা।
  2. উইকিপিডিয়া এবং কিছু বাংলা ব্লগ।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>