মাতিলদের সঙ্গে পাবলোর দেখা হয়েছিল ১৯৪৬ সালের গ্রীষ্মে, চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর এক উদ্যানে অনুষ্ঠিত এক কনসার্টে। প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় পরস্পরকে। কিন্তু নেরুদার জীবনে তখন জড়িয়ে আছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী দেলিয়া দেল কাররিল। পাবলো নেরুদা আর মাতিলদে উরুতিয়ার গোপন প্রেম বাড়তে থাকে। চিঠিতে চিঠিতে তারা পরস্পরের কাছে আসেন, দূরে থেকেও। এক সময় দেলিয়ার কাছ থেকে সম্পর্কের গাঁট ছেড়ে মাতিলদের কাছে চলে আসেন পাবলো। বাকি জীবন তাদের সেই অভূতপূর্ব প্রেমের বন্ধন বজায় ছিল। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৩ সালে কবির মৃত্যুও আগ পর্যন্ত তাদের দুজনের মাঝে যে প্রেমের চিঠি চালাচালি হয়েছিল, সেই ঝাঁপি খুলে এস্পানিয়ল ভাষায় একটি বই সংকলিত করেছেন দারিও ওসেস। এটি ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বার্সেলোনা থেকে। এখানে তিনটি চিঠি তর্জমা করা হলো— রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
রোম ২১ ডিসেম্বর ১৯৫০
মাতিলদে,
হয়তো ধারণা করতে পারছ তোমার চিঠি পেয়ে আমার কেমনটা লেগেছে। তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি এতটাই গাঢ় যে এখন পর্যন্ত তোমাকে লেখাই হলো না। কাজটা যে ঠিক হয়নি, তা-ও বলা যায়।
সে যাক, কিন্তু আমরা কী করতে পারি?
প্যারিসে আসতে পারবে না?
এক মাসের মধ্যেই আমরা (আমি ও দেলিয়া) ওখানে ফিরে যাব।
আমি যতটা পারি, তোমাকে সাহায্য করতে পারি। জানো আমি একটি পুরস্কার জিতেছি, যার অর্থমূল্য কয়েক মিলিয়ন। কিন্তু তোমার সফরের খরচের জন্য কিছু পাঠাতে পারব না, কী কারণে পারব না, তা নিশ্চয়ই তুমি বোঝো। ১০ দিনের জন্য ভারতে ছিলাম। ভারত ছেড়ে আসার দিনই তোমার চিঠি পেলাম। ভারতে যা হয়েছে, তাতে করে ওই সফরের কথা ভুলে যেতে সাহায্য করবে। এরপর আমরা গেলাম ভারসোভিয়া, প্রাহা ও ভিয়েনায় …
আজকের পর আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আর কিছু লিখো না। যদি তুমি প্যারিস আসতে চাও আর রাহা খরচ লাগে, তাহলে কারাকাসে এল নাসিওনাল পত্রিকার মিগেল ওতেরো সিলবার সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাকে ওর আন্তরিক প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে এবং বাকিটা ও করবে। বলা বাহুল্য আমার অবর্তমানে ব্যাপারটা ঠিক একই রকম না কিন্তু আমি ওকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেব।
ঠিক করো কী করবে। আমার ওপর আস্থা রাখলে আমার রাগটাগ চলে যাবে। সত্যি বলতে কি তোমাকে আমার চাই।
এরপর আমাকে আর গোপনে কিছু লিখো না। সাধারণভাবে তোমার জীবন ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা লিখে উত্তর দিও এবং তোমার সিদ্ধান্ত জানলে পরে দেলিয়াকে নিয়ে যা যা করণীয়, সেই পথে আগাব।
ইতি
পাবলো
(চিঠির তারিখ: ২৮, সন বা মাসের উল্লেখ নেই কিন্তু আগের চিঠির ধারাবাহিকতায় লেখা)
প্যারিস ২৮
প্রিয়া তোমার চিঠিটা পেয়েছি। পথে পথে তোমার কথা ভাবি। তুমিই ভালো জানো কী করণীয়। কোনো একভাবে তোমার ঠিকানাটা পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে লিখব। প্রতি রাতে, প্রতি সকালে, প্রতিদিন আমাদের মাঝে তোমার কথা মনে হয়। বেনেসুয়েলা যাওয়াটা বাদ দিও না, সব ঠিকঠাক করা আছে। ওখানে যখনই দরকার হবে, তখনই তুমি সহায়তা পাবে। আমার কত কিছু বলার আছে কিন্তু বেহুদা! এখন পোস্ট অফিসে এসেছি। পরে আরো বড় করে লিখব। আমার আশপাশের এক গাদা লোকের ভিড়ের মধ্যে থেকে শুধু তোমাকে চুমু পাঠানোর সময়টুকুই আছে, যা তোমার পাওনা। আমার সাহসী ছোট্ট নারী, সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘ চুমু, সবচেয়ে মধুর, যা তোমার ঠোঁটে রয়ে যাবে চিরদিন।
তোমায় ভালোবেসে
প
(চিঠিটি ভার্সোভিয়া থেকে লেখা)
২৫ নভেম্বর ১৯৫৫
প্রিয়া, এইমাত্র সিয়েস্তার ঘুমটা দিয়ে উঠেছি, যা পত্রপত্রিকা, সাংবাদিক, টেলিভিশন ও বন্ধুদের মধ্যে থেকেও করলাম। বন্ধুদের মধ্যে এখন উপস্থিত আছে নিকোলাস গিইয়েন, রাফায়েল আলবের্তি, চেক কবি ভিতেস্লাভ নেজভাল প্রমুখ।
এইমাত্র স্বপ্নে দেখলাম, যা আগেও দেখেছি। তোমার কাছে টেলিফোন নেই, বাসায় আমি নিজেকে পেঁচিয়ে রেখেছি এক গুচ্ছ তার দিয়ে আর টানাটানি করছি পর্দা নিয়ে। পরে গোটা ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে নিজেকে বলেছি: ‘আমার মনমেজাজ ভালো নেই, কারণ আমি আমার পাতোহাকে* খুঁজিনি, দেখিনি, তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি।’
স্বপ্নটা হতাশাকর ছিল, কারণ কোনো একটা বাধা — কিছু একটা, ভালো করে জানি না তুমি কোথায় — এসে আমার মন বিষিয়ে দিল।
গতকাল পুরনো বন্ধু পোলিশ কবি ভ্লাদিস্লাভ ব্রনিভস্কির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমাদের দোনেগালের মতো হুবহু দেখতে তার একটা কুকুর আছে। কুকুরটার একটা ছবি পাঠালাম।
উৎসব শুরু হয়েছে মাত্র। আজ মিকিউইক্জ জাদুঘরের উদ্বোধন হলো। গত রাতে ছিল ব্যালে: রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। কতবার যে তোমার কথা মনে হয়েছে।
আমার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই চোখে পড়ছে তুষার, ঝরে পড়ছে বড় প্লাসাটায়। বিকেল সাড়ে ৪টা কিন্তু এরই মধ্যে রাতের আঁধার নেমেছে। আমার সাফসুতরা শেষ শার্টটা পরেছি একটা গুরুগম্ভীর সেশনে যাব বলে, যেখানে কোনো কথা বলতে হবে না। বোলোদিয়ার বইটা প্রকাশিত হয়েছে চিলিতে, বেশ ভালো। ওর আর আমার কপিরাইট নিয়ে কথা হয়েছে। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হবে না শুধু তোমাকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরে কেউ প্রশ্ন ছুড়তে না পারে এভাবে প্রগাঢ় ভালোবাসায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে না দেয়ার বেদনাটুকুর কোনো উপশম।
তোমারই
(*পাতোহা – প্রিয়া মাতিলদেকে যে কয়টি নামে ডাকতেন তার একটি)